কিছু সুখ কিছু ব্যথা Kichu Sukh Kichu Byatha by রত্না চক্রবর্তী - Ratna Chakraborty , chapter name সন্তান

সন্তান

(১)


রিম্পাকে এত হাসিখুশি বহুদিন কেউ দেখে নি। টুম্পার বিয়ের সময়ও তার বিষন্ন মুখে হাসির ছোঁয়া ছিল না। কিন্তু যবে থেকে তুলতুল এসেছে তার  জীবনে তবে থেকে তার মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে, উদাসীনতাটা কেটেছে। রাতদিন তাকে ঝিনুকে করে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, তাকে আগলে রাখার মধ্যে দিয়ে তার মধ্যে একটা প্রাণ সঞ্চার হয়েছে। রিম্পা মন্দির পাড়ার পাগলী পিসির কাছে প্রায়ই যায় তুলতুলের কোন সমস্যা হলে। পাগলী পিসি এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ বলা যায়। তুলতুলকে দিদিমার স্নেহে বুকে তুলে নেয় পাগলী পিসি, তার নিজের ঘরে যে অনেকগুলি।অনেক টোটকা, ওষুধ-বিষুধ পাগলী পিসি জানে। 


 (২)

এই তিনমাসে তুলতুল খেলতে শিখেছে, রিম্পার ভাষায় হাসতেও শিখেছে। টুম্পা অবশ্য দেখেনি তুলতুলকে, ওর শ্বশুরবাড়ি বিশাল বনেদি ধনী পরিবার, ঠাকুর আছে ওদের বাড়ি। বৌ বিয়ের আটবছর বাদে সন্তানসম্ভবা হয়েছে, তাকে একেবারে তুতুপুতু করে রেখেছে, তিন মাসের পর থেকে আর বাপের বাড়িতেই আসে নি। এই বাচ্চা হলে ওরা পাঠাবে আঁতুড় তোলার জন্য, একেবারে আঁতুড় তুলিয়ে পূজো দিয়ে বৌ নিয়ে যাবে। খুব সাবধানের বাচ্চা, দিদির থাইরয়েড ধরা পড়েছে আর তার বরের আর শ্বশুরবাড়ির সবারই তো মারাত্মক শ্বাস কষ্টের ধাত। এলার্জী থেকে নাকি এই রোগ। মা তো শশব্যস্তভাবে সব গোছগাছ জোগাড় টোগাড় করছে, মেয়েদের নিয়ে তার বড় ভয়, বড় মেয়েটার বিয়ে দিলেন, কি সুন্দর দেখতে জামাই সুন্দরী মেয়ের সাথে যেন রাজযোটক,  ভালো চাকরি করে, শুধু মা বাবা আর ছেলে, ছোট ফ্যামিলি। ভালোই ছিল রিম্পা, সিমলা হনিমুনে গেল, কি সুন্দর সে সব ছবি কিন্তু সেই ছবির সংসার ভেঙে গেল। বেশ কিছুদিন স্বাভাবিকতার ব্যাতিক্রম চলছিল, সবাই খুশি একজন নতুন মানুষ আসছে। কিন্তু দিন কুড়ি বাদেই রিম্পার প্রচন্ড পেটের যন্ত্রণা, অসম্ভব ব্লিডিং হতে লাগল, ডাক্তার অনেক দেখালো, কিন্তু সব ডাক্তারের একই রায় দিলেন, অপারেশন করে ইউটেরাস ওভারী বাদ দিতে হবে। দুঃখে কষ্টে পাগলের মতো কান্নাকাটি করছিল রিম্পা। অপারেশন  করাতেই হল, নয়তো  জীবন সংশয়। কিন্তু আসল ঘটনা বাকি ছিল, যে বৌ কখন ও মা হতে পারবে না, একমাত্র ছেলের বংশধর দিতে পারবে না তাকে আর সহ্য করতে পারল না রিম্পার শ্বশুর শ্বাশুড়ি। আর বরের চরম ঔদাসিন্য। বাড়িই ফিরত না সে , অসুস্থ বিধ্বস্ত রিম্পা শেষে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। রিম্পার মা-বাবা নিয়ে এলেন রিম্পাকে। কেমন হয়ে গেল রিম্পা। অনেক পরীক্ষা করিয়ে ঠিকুজী কুষ্টি মিলিয়ে বিয়ে দিলেন  ছোট মেয়ে টুম্পার। কিন্তু টুম্পার ও বাচ্চা হচ্ছিল না। কিন্তু ওর শ্বশুরবাড়ির থেকে হাঙ্গামা করে নি, ওর বড় জা'র ও বাচ্চা হয় নি,মেজ'জার অবশ্য ওর অনেক পরে বছর দেড়েক হল বিয়ে  হয়েছে তারও এখনো হয় নি।  মনে হয় ছেলের কোন দুর্বলতা ছিল তাই দুঃখ করা ছাড়া আর কিছু করে নি তারা। সেই টুম্পা এবার মা হতে চলেছে, কাজেই তাদের বিশাল সাবধানতা, বিশাল যত্ন। রিম্পাও অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে কবে সেই রক্তমাংসের পুতুলটা নিয়ে তার বোন আসবে। সে রোজ চুপিচুপি  তুলতুলিকে বলে "জানিস আর একটা তোর মতো ছোট্ট পুতুল আসবে আমরা খুব আদর করব, ভালোবাসব, খুব মজা হবে। " তুলতুলি আদুরে হাই তুলে রিম্পার পেটে মাথা গোঁজে। তার চোখেও খুশির ঝিলিক। 

(৩)  

সন্ধ্যার আঁধার নেমেছে, রিম্পা একা স্খলিত পায়ে বাড়ি ফিরছে, ওর চোখে দৃষ্টি আবছা। বাড়িতে রিম্পার মা অপেক্ষা করছে অধীর হয়ে, আকাশে মেঘ করেছে, তার দুঃখী মেয়ে কোথায় এখন। তার বুকের মাঝে তোলপাড়, কাল তার ছোট মেয়ে নবজাতক নিয়ে ঘরে আসছে। কাল নার্সিংহোমে মেয়েটা তার হাত জড়িয়ে ধরে রুগ্ন হাসি হেসে বলেছিল "আমার খুব মজা হচ্ছে মা, কতদিন বাদে তোমার কাছে গিয়ে থাকব। " জামাই আর টুম্পার ননদ কাল এসেছিল নার্সিংহোম ফেরত তাদের বাড়ি, বড় বড় মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে, সারা পাড়া প্রতিবেশীদের মিষ্টি খাওয়াতে হবে, অনেক কষ্টের এই সন্তান তাদের বংশে, খুব খুশি তারা। আঁতকে উঠেছিল জামাই তুলতুলিকে দেখে ," একি ঘরে বেড়াল ঢুকলো কি করে? ইস!  তাড়ান তাড়ান, এর লোমের ভিষণ এলার্জি বাড়ে, আমার তো শ্বাস কষ্ট শুরু হয়ে যায়। খুব সাবধান মা দেখবেন ছোট শিশু, ওদের প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব কম, আর ডাক্তার তো বারবার বলেছেন সময়ের একটু আগে হয়েছে কোন ইনফেকশন না হয়। হাত তুলে তাড়া দিয়ে, পা দিয়ে থপথপ শব্দ করে, মুখে হ্যাট হ্যাট শব্দ করে সে বেড়াল তাড়ালো, বিস্মিত তুলতুলি ধীরে ধীরে ঘর থেকে  চলে গেল তার মার কাছে, এরা কারা!! তার ঘর থেকে তাকে তাড়াচ্ছে কেন?  সাদা মুখে বারান্দার রেলিং ধরে থরথর করে কাঁপছিল রিম্পা, তুলতুলি তার পায়ের কাছে বসে মুখ তুলে তার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। রিম্পা প্রায় তাকে ছোঁ মেরে কোলে তুলে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে চলে গেল। সে অঝোর ঝরে কাঁদছে, এরপর কি হবে সে জানে, তার এই বেড়াল নিয়ে "আদিখ্যেতা " কেউ সইবে না, বাবাও না। একটা বেড়ালের জন্য মেয়ের শ্বশুরবাড়ির সাথে বিবাদ করা যায় না। এই মেয়ে অন্তত এতদিন সুখে শ্বশুর ঘর করছে সেটাতো আর ভেঙে দেওয়া যায় না। ওরা চলে যাবার পর মা ছাদে এসেছিল, আকুল কান্নায় ভেঙে পড়েছিল দুজনে,  যে যার সন্তানের জন্যে দুঃখে চিন্তায়। 
 শেষে মাই মেয়েকে  বুদ্ধি দিল, তুই কোথায় যাবি ওকে নিয়ে, কোন আত্মীয়ের বাড়ি যাবি?  লোক হাসবে, কারো ব্যথা কেউ বোঝে না,  সংসারে কূটনীতি হবে। তার চেয়ে তুই পাগলী ঠাকুর ঝির ডেরায় যা, তোর সন্তান সেখানেই ভালো থাকবে। ওরা চলে গেলে তুই নিয়ে আসবি আবার, একটা তো মাস মা, তুই চুপিচুপি দেখতে যেতে পারবি। এটাতো মানিস তোর থেকে পাগলী ঠাকুরঝি অনেক যত্ন করবে তুলতুলিকে। দেখবি যখন নিয়ে আসবি কত্ত খেলা শিখে যাবে, মোটাসোটা হয়ে যাবে।  ওখানে সতের আঠেরটা বেড়াল, তুলতুলিও মিশতে শিখবে ওদের জাতের সাথে। দেখ ঠাকুরঝি গোঁড়া বামুন পুরোহিতের মেয়ে ছিল, সতের বছরে বিধবা হয়ে ফিরে এসেছিল। মাথাটাই তো প্রথম দিকে খারাপ হয়ে গিয়েছিল, ঠাকুরজামাই সাপের কামড়ে গেল,  গ্রামে ওঝা ডাকল, ডাক্তার দেখালো না। শ্বশুরবাড়ির থেকে অপয়া বলে তাড়িয়ে দিল। সেই থেকে ওই বেড়াল নিয়েই আছে, শুচিবাই মানুষ। "একটু হেসে মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে আঁচলে চোখ মুছিয়ে বললেন " মনে কর না তোর সন্তান হোস্টেলে গেছে মানুষ হবে বলে, আবার ফিরে আসবে। 

বৃষ্টিটা নেমেই গেল। নার্সিংহোমে বসে টুম্পা অধীর হয়ে ভাবছে কমজোরি বাচ্চা, কাল মার কাছে নিয়ে যাব,গ্রাম ওখানে ঠান্ডা বেশি, বাচ্চাটার ঠান্ডা লেগে যাবে না তো। মা র কাছে ভালোয় ভালোয় পৌঁছাতে পারলে বাঁচি। মার হাতে তুলে দিলে শান্তি। বড় কষ্টের সন্তান তার। মা খোলা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ঝাঁটে ভিজতে লাগলেন, তার দুই সন্তান বড় কষ্টে আছে, কখন কে কি ভাবে ঘরে ফিরবে। রিম্পার কষ্ট আর একজনও বুঝেছিল, সে অসময়ের বৃষ্টি। নইলে পাড়া প্রতিবেশী দেখলে বলত না " আদিখ্যেতা নেকামির কান্না, বোনের বাচ্চা হয়েছে তাই হিংসা ", বৃষ্টি সে কান্না ঢেকে দিল আদরে।।