তিতাস একটি নদীর নাম- Titash ekti nodir naam by অদ্বৈত মল্লবর্মণ - Adwaita Mallabarman, chapter name জন্ম মৃত্যু বিবাহ

জন্ম মৃত্যু বিবাহ

জন্ম মৃত্যু বিবাহ তিন ব্যাপারেই মালোরা পয়সা খরচ করে। পাড়াতে ধুমধাম হয়।

অবশ্য সকলেই খরচ করিতে পারে না। যাদের পয়সা কড়ি নাই তারা পারে না।

তবু প্রতি ঘরেই জন্ম হয়, বিবাহ হয়, মৃত্যু হয়। এ তিনটি নিয়াই সংসার। এ তিনের সাহায্যেই প্রকৃতি তার ভারসাম্য রক্ষা করিয়া চলিয়াছে। জন্মের পরে দীর্ঘ ব্যবধান অস্তে বিবাহ এবং তারপরে দীর্ঘ ব্যবধান অন্তে মৃত্যু হইয়া থাকে। ইহাই প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু যে সমস্ত ঘরে জন্মের পরেই মৃত্যু হইয়া যায় তারা দুর্ভাগ। কারণ তিনটি ব্যাপারেই খরচপাতি করা হইলেও বিবাহ ব্যাপারের খরচই সবচেয়ে আনন্দ ও অর্থপূর্ণ। বিবাহে যৌবনের স্মৃষ্টির যে নিশ্চিত সম্ভাবনা রহিয়াছে, সে-লোকে পৌঁছানোর পথ যেমন খাটো, তেমনি পথের দুই পাশে থাকে ফুলের বন, প্রজাপতি আর রামধনু। সে পথের শুরু হয় বসন্তের হরিৎ উত্তরীয়-বিছানো রঙিন সিড়ির প্রথম ধাপে। শেষ যখন হয় তখন দেখা যায় সবুজ তরুর ফুলের সমারোহ শেষ হইয়া সে-তরুতে ফল ধরিয়াছে।

কিন্তু সে ফল পাকিয়া শুকাইয়াও তো যায় না। তখন তার ঝরিয়া না পড়িয়া উপায় কি। কালক্রমে সে তরু বন্ধ্যা হইয়া পত্রগুচ্ছ খসিয়া শিথিল হইয়াও তো যায়। তখন তার মূল উপড়াইয়া পড়িয়া না যাইয়া উপায় কি? সেরূপ ফলের জন্যও মানুষের ক্ষোভ নাই। সেরকম তরুর জন্যও মানুষের রোদন নাই।

কেন না, জন্ম, বিবাহ, মৃত্যু এ তিন নিয়াই সংসার।

এ তিন বস্তু প্রতিঘরেই স্বাভাবিক ঘটনা হইলেও এমনও ঘর দেখা যায় যে-ঘরে কোনকালে হয়ত বস্তু তিনটিকে দেখা গিয়াছিল, কিন্তু বর্তমান হইতে দৃষ্টি করিয়া সুদূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত চোখ মেলিয়া যতক্ষণই চাহিয়া থাকি না কেন—তিনটিই পর পর আসিবে এমন সম্ভাবনা দেখিতে পাই না। অতীতকে নিয়া হাসিতে পারি র্কাদিতে পারি, স্বপ্ন সাজাইতে পারি, কিন্তু ফিরিয়া তাকে পাইতে পারি না। হাতের মুঠায় পাইতে চাই তো বৰ্ত্তমান, আশায় আশায় বুক বাধিতে চাই তো ভবিষ্যৎ। কোনকালে কি হইয়াছিল সে-কথা তুলিয়া লাভ দেখি না।

একবার যে জম্মিয়াছে সে একদিন মরিবেই। কাজেই যে ঘরে মানুষ আছে মৃত্যু সে ঘরে ঘটিবেই। কিন্তু ঘরে মানুষ আছে বলিয়াই এবং সে ঘরে মৃত্যু একদিন ঘটিবে বলিয়াই জন্ম এবং বিবাহও সে ঘরে ঘটিবেই এ কথার অর্থ হয় না। তবে এমন ঘর চোখে পড়ে খুব কম এই যা।

মালোপাড়ায় এই দুর্ভাগ্যের অধিকারী একমাত্র রামকেশবের ঘর। বুড়াবুড়ির এখন ঝরিয়া পড়ার পালা। এ শুষ্ক তরুতে কখনো ফল ধরিবে, পাগলেও এ আশা পোষণ করিতে দ্বিধাবোধ করিবে। আর বিবাহ? জন্মিয়া পরে বিবাহ না করিয়া যে ব্যক্তি পাগল হইয়া গিয়াছে তার বিবাহের কথা ভাবিতে দ্বিধাবোধ করিবে স্বয়ং পাগলেও।

কোনোকালে এঘরে না পড়িবে জন্মিবার উলুধ্বনি, না শোনা যাইবে গায়ে-হলুদের গান। কিছুদিন পরে হোক অধিকদিন পরে হোক সে-ঘরে শোনা যাইবে শুধু একটি মাত্রই ধ্বনি। সে ধ্বনি শুনিয়া কেবল বুক কাঁপিবে, মনে এক ফোঁটা আনন্দ জাগিবে না।

কিন্তু রামকেশবের ঘর লইয়াই মালোপাড়ার সব নয়। এখানে কালোবরণের ঘরও আছে। এ-ঘর অল্পদিনের ব্যবধানে তিনতিনটা বিবাহের চেলিপর মুখ দেখিয়াছি। তিন বৌ-ই ফলন্ত লতা। তিনজনেরই পাল্লা দিয়া ছেলেমেয়ে হইতেছে। এক একটি শিশুর জন্মের উৎসবও করে জাঁকজমকের সঙ্গে। অন্নপ্রাশন করে আরও জাঁকাইয়া।

কিছুদিন আগে মেজবে সন্তানসম্ভবা হইয়াছিল। কোনোদিন স্বামীর ও নিজের খাওয়ার পর এঁটোকাঁটা ফেলিবার জন্য যদি আস্তাকুড়ের নিকটে আসিত, সেখান হইতে অনন্তর মার ঘরের সবটা চোখে পড়িত। অনন্ত তখন কতকগুলি বাঁশ বেত, একটা দা, আরো কিছু নগণ্য খেলার সামগ্ৰী লইয়া নিবিষ্ট মনে তুচ্ছ বস্তুকে প্রার্থনাতীত মর্যাদা দিবার কাজে আত্মনিয়োগ করিয়া আছে।

মেজবৌর ক্লান্তিবিকৃত মুখ আর অস্বাভাবিক রকমের দৈহিক স্ফীতির কোনো কিনারা সে করিতে পারিত না।

একদিন কালোর মাকে খুব ব্যস্ত দেখা গেল। এক দৌড়ে অনন্তদের উঠানে আসিয়া হাক দিল, ‘অনন্তর মা, জোকার দিয়া যা?’

অনন্তর মা গেল। আরো পাঁচ বাড়ির পাঁচ নারী আসিয়া মিলিত হইল। একখানা ছোট ঘরের দরজার মুখে তারা সকলে মিলিয়া দাঁড়াইয়া আছে। সকলের মুখেই উৎকণ্ঠা। তাদের মাঝে অনন্তর মাও গিয়া দাঁড়াইল। মার কাছ ঘেঁষিয়া দাঁড়াইল গিয়া অনন্ত। কোথা দিয়া কি হইয়া গেল, অনন্ত জানিল না। একজনে মনে করাইয়া দিবার ভঙ্গিতে বলিল, ‘ছাইলা হইলে পাঁচ ঝাড় জোকার, মাইয়া হইলে তিন ঝাড়।‘ অনন্তর নিকট একথাও অর্থহীন।

কালোর মা ঘরখানার ভিতরে থাকিয়া কি সব হুলুস্কুলু করিতেছিল, গলা বাড়াইয়া বলিল, ‘বিপদ সাইরা গেছে সোনাসকল। মন খুশি কইরা জোকার দেও।‘

নারীরা উঠান ফাটাইয়া পাচবার উলুধ্বনি করিল।

নবাগতকে মাঙ্গলিক অভ্যর্থনা জানানো শেষ করিয়া নারীরা উকি দিয়া ঘরের ভিতরটা দেখিতে চেষ্টা করিতেছে। অনন্তও সকৌতুহলে দেখিল। মেজবৌর সে স্ফীতি আর নাই। শীর্ণ। উপুড় হইয়া মাটিতে পড়িয়া আছে। চুল আলুথালু। চূড়ান্ত সময়ের প্রাক্কালে তার মুখের ভিতর নিজের চুল পুরিয়া দেওয়া হইয়াছিল। সে চুল এখনো কতক কতক মুখে করিয়া বে। বেহু স হইয়া পড়িয়া আছে। রক্তে একাকার। তারই মধ্যে রক্তের চেলির মত একফালি মানুষ। ননীর মত নরম, পুতুলের মত দুর্বল। বৌর পেট ফাঁড়িয়া এত দুর্বল ছোট মানুষটি বাহির হইল কি করিয়া!

একটা নেকড়ার সাহায্যে তুলিয়া কালোর মা দরজার কাছে আনিল সমাগতা নারীদিগকে দেখাইবার জন্ত। সকলেই দেখিবার জন্য ঝুঁকিয়া পড়িল। অনন্ত একবার দেখিয়া পিছাইয়া গেল।

ছয় দিনের দিন ঘরে দোয়াত কলম দেওয়া হইল। এই রাতে চিত্রগুপ্ত আসিয়া সেই দোয়াত হইতে কালি তুলিয়া সেই কলমের সাহায্যে শিশুর কপালে লিখিয়া যায় তার ভাগ্যলিপি।

অষ্টমদিনে আট-কলাই। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে অনন্তরও ডাক পড়িল। খই, ভাজ-কলাই, বাতাসা সেও কোচড় ভরিয়া পাইল।

তের দিন পরে অশৌচ-অন্ত। সব কিছু ধোঁয়া-পাখ্‌লার পর নাপিত আসিয়া কালোবরণাদি তিন ভাইয়ের তের দিনের খাপছাড়া দাড়ি কামাইয়া গেল। মন্ত্র পড়িয়া পুরোহিত উঠিয়া গেলে, উঠানে একটি চাটাই পাতিয়া তাতে ধান ছড়াইয়া দেওয়া হইল। নূতন একটা শাড়ি পরিয়া, নূতন একটা রঙিন বড় রুমালে জড়াইয়া ছেলেকোলে মেজবে বাহির হইল! চাটাইর উপর উঠিয়া ধানগুলি পা দিয়া সারা চাটাইয়ে ছড়াইয়া দিল। এদিকে পুরনারীরা এক সঙ্গে গলা মিলাইয়া গাহিয়া চলিল, ‘দেখ রাণী ভাগ্যমান, রাণীর কোলেতে নাচে দয়াল ভগবান। নাচ রে নাচ রে গোপাল খাইয়া ক্ষীর ননী, নাচিলে বানাইয়া দিব হস্তের পাচনি। একবার নাচ দুইবার নাচ তিনবার নাচ দেখি, নাচিলে গড়াইয়া দিব হস্তের মোহন বাশি।‘

দক্ষিণা দিয়া বিদায় করিতে করিতে কালোবরণ পুরোহিতকে বলিল, দেখেন ত কর্ত, মুখে-পস্‌সাদের ভাল দিন নি আছে। দুই কাম এক আয়োজনেই সারা করতে চাই, কি কন।‘

পঞ্জিকা দেখিয়া পুরোহিত বলিয়া দিল, পরশুই একটা ভাল দিন অন্নপ্রাশনের।

ছোটবউর ছেলে বাড়িয়া উঠিতেছে। বসিয়া নিজের চেষ্টাতে মাথা ঠিক রাখিতে পারে। কিন্তু ইদানীং অত্যন্ত পেটুক হইয়া উঠিয়াছে। যাহা পায় খাদ্যাখাদ্য বিচার না করিয়া মুখে পুরিয়া দেয়। কালোর মা বলে, মুখে-প্রসাদ দেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।

কাজেই দুইদিন পরেই বাড়িতে আরো একটা উৎসবের আয়োজন হইল।

সেদিনও অনস্তর মার ডাক পড়িল। আরো অনেক নারীর ডাক পড়িল। গীত গাহিবার জন্য।

প্রথমে স্নানযাত্রা। ছেলেকোলে ছোটবোঁকে মাঝখানে করিয়া গান গাহিতে গাহিতে নারীরা তিতাসের ঘাটে গেল। ছোট বোঁ তিতাসকে নিজে তিনবার প্রণাম করিল, ছেলেকেও তিনবার প্রণাম করাইল। এক অঞ্জলি জল লইয়া তার মাথ৷ ধোঁয়াইল। শাড়ির আঁচল দিয়া মুছিয়া নদীকে আবার নমস্কার করিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিল।

এক মুহূর্ত বিশ্রাম করিয়া তার চলিল রাধামাধবের মন্দিরে। সঙ্গে একথালা পরমান্ন। সেখানে পরমান্নকে নিবেদন করিয়া প্রসাদ করা হইল। ছোট বউ একটুখানি তুলিয়া ছেলের মুখে পুরিয়া দিল, বাকি সবটাই উপস্থিত ছেলেদের মধ্যে বিতরণ করা হইল।

মালোর বিবাহে সবচেয়ে বেশি উল্লাস পায়। বিবাহ করিয়া সুখ, দেখিয়া আনন্দ। বিবাহ যে করিতেছে তার তো সুখের পার নাই। পাড়ার আর সব লোকেরাও মনে করে, আজকের দিনটা অতি উত্তম।

যারা সবচেয়ে প্রিয়, যারা সবচেয়ে নিকটের, তাদের বিবাহ করিয়া বউ লইয়া আমোদ-আহ্লাদ করিতে দেখিলে মালোর খুব খুশি হয়। যে বিবাহও করিতে পারে না, সে রাত কাটায় নৌকাতে। এ পাড়ার গুরুদয়াল সেই দলের। বয়স চল্লিশের উপর।

তার সঙ্গে একদিন নৌকাতে কালোবরণের ছোট ভাইয়ের ঝগড়া হইয়া গেল।

গুরুদয়াল বলিয়াছিল সেদিন বাজারের ঘাটে, তিন বিবাহের তিন ছেলের বাপ হইয়া শ্যামসুন্দর বেপারি আবার যদি বিবাহ করে তো পুবের চাঁদ পশ্চিমে উদয় হইবে।

কালোর ভাই প্রতিবাদ করিয়াছিল, রাখিয়া দেও। কাঠের কারবার করিয়া অত টাকা জমাইয়াছে কোন দিনের জন্তে। শেষকালে স্ত্রী কাছে না থাকিলে বেপারি কি রাত কাটাইবে তুলার বালিশ বুকে লইয়া? একবার যখন মুখ দিয়া কথা বাহির করিয়াছে, তখন বিবাহ একটা না করিয়া ছাড়াছাড়ি নাই।

‘হ। কইছ কথা মিছা না। শেষ-কাটালে ইস্তিরি কাছে না থাকলে মরণ-কালে মুখে একটু জল দিবে কেডায়? পুত ত কুত্তার মুত।‘

কালোর ভাই সম্প্রতি একটি পুত্র লাভ করিয়াছে। সে এখন পুত্রগর্বে গর্বিত। পুত্র জাতটার উপর এই একচেটিয়া অপবাদ দিতে দেখিয়া সে চটিয়া উঠিল, “তুমি যেমুন আঁটকুড়ার রাজা, কথাখানও কইছ সেই রকম।

পিতৃত্বহীনতার অপবাদ। অসহ। গুরুদয়ালের মুখ দিয়া অভিশাপ বাহির হইল, ‘অখন থাইক্যা তোরেও যেন ঈশ্বরে আঁটকুড়া বানাইয়া রাখে।‘

‘দূর হ, শ্যাওড়াগাছের কাওয়া, এর লাগি-ঐ তোর চুল পাকছে, দাড়ি পাকছে, তবু শোলার মুটুক মাথায় উঠ্‌ল না।’

‘নইদার পুতে কি কয়! আমার মাথায় শোলার মুটুক উঠ্‌ল না, তার লাগি কি তোর মাথা মুয়ান লাগছে দশজনের বৈঠকে? আমি কি রাইতকালে গিয়া তোর ঘরের বেড়া ভাঙছি কোনোদিন, কইতে পারবে?’

‘খাড় হেই শালা গুরু-দাওয়াল, অখনই বাপের বিয়া মার সাঙ দেখাইয়া দেই।‘

এ নৌকা হইতে কালোর ভাই লগির গোড়া গুরুদয়ালের মাথা লক্ষ্য করিয়া ঘুরাইল। ও নৌকা হইতে গুরুদয়ালও একটি লগি তুলিয়া আঘাত করিতে উদ্যত হইল।

নৌকার অন্যান্য লোক ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিল। কেউ বলিল, ‘আরে রামনাথ ক্ষেমা দে।‘ কেউ বলিল, ‘ও গুরুদওয়াল, ভাটি দেও। রামনাথ অবুজ হইতে পারে, তুমি ত অবুজ না।‘

শেষে কালোর ভাইয়ের কথাই ঠিক হইল। শ্যামসুন্দর বেপারি উত্তর মুলুক হইতে কাঠ আনাইয়া এখানে কারবার করে। সেই মুলুক হইতে একটা লোক রেলগাড়িতে করিয়া বৌ-নিয়া তার বাড়িতে আসিল। শামসুন্দরের নিজে যাইতে হইল না। চিঠিপত্রেই সব হইয়া গেল।

যেদিন বিবাহ হইবে সেদিন বৈকালে কয়েকজন বর্ষীয়সী অনন্তর মার বাবান্দায় পাড়া-বেড়াইতে আসিল। তারা প্রথমেই তুলিল আজকের বিবাহের কথা।

একজন বলিল, ‘নন্দর-মা আছিল বেপারির পয়ল বিয়ার বৌ আমার বাপের দেশে আছিল তারও বাপের বাড়ি। এক বছরই দুইজনার জন্ম, বিয়াও হইছে একই গাওয়ে। সে পড়ল বড় ঘরে আমি পড়লাম গরীবের ঘরে। তার হাতে উঠল সোনার কাঠি আমার হাতে ভাতের কাঠি। থাউক সেই কথা কই না, কই ভইন এই কথা, আজ যার সাথে বিয়া হইতাছে—এযে নন্দর-মার নাতিনের সমান। এরে লইয়া বুড়া করব কি গো? এর যখন কলি ছিট্‌ব বুড়া তখন ঝইরা পড়ব।‘

অন্যমনস্ক অনন্তর মার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া অন্ত একজন বলিল, ‘কাকের মুখে সিন্দুইরা-আম লো মা।‘

তৃতীয়ার মনের বনে রঙের ছোঁয়া লাগিয়াছে। প্রবীনা হইলেও মন বুঝি তার মস্‌গুল। পরের বিবাহের বাজনা শুনিলেই নিজের বিবাহের দিনটির কথা মনে পড়ে। মনের খুশি চাপিতে না পারিয়া অনন্তকে লইয়া পড়িল, ‘কিরে গোলাম! বিয়া করবি?’

বিবাহের কথা অনন্ত তিন চার দিন ধরিয়া শুনিতেছে। কথাবার্তার ধরণ হইতে আসলবস্তু কিছু বুঝিতে না পারিলেও এটুকু বুঝিয়াছে বিবাহ করা একটা খারাপ কিছু নয়। অতি সহজভাবে সে উত্তর দিল, ‘করমু।’

‘ক দেখি, বিয়া কইরা কি করে।’

প্রশ্নটা একটু জটিল ঠেকিল। কিন্তু খানিক বুদ্ধি চালনা করিয়া বেশ সপ্রতিভ ভাবেই জবাব দিল, ‘ভাত রান্ধায়।’

‘হি হি হি, কইতে পারলি না গোলাম, কইতে পারলি না। বিয়া কইরা লোকে বৌয়ের ঠ্যাং কান্ধে লয়, বুঝলি, হি হি হি।’

উত্তরটা অনন্তর মনঃপুত হইল না মোটেই। ভাবিল উহু, এ হইতেই পারে না। কিন্তু সত্য হইলে ত বিপদ।

‘আমারে বিয়া করবি?’

মোটা মোটা ঠ্যাং দুটির দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাইয়া অনন্ত বলিল, ‘না।’

সন্ধ্যার পর মার সঙ্গে বিবাহ দেখিতে গিয়া অনন্ত বিস্ময়ে বিমূঢ় হইয়া গেল। সে যেন বিবাহ দেখিতেছে না, একটা চমৎকার গল্প শুনিতেছে। প্রভেদ শুধু এই, গল্প যে বলিতেছে তাকে দেখা যাইতেছে না, আর তার কথাগুলি শোনা যাইতেছে না। সে যা যা বলিতেছে অনন্ত সে-সব চোখের সামনে দেখিতেছে।

সামনে যে টোপর মাথায় চুপ করিয়া বসিয়া আছে, সে বিরাট এক দৈত্য। ছোট মেয়েটাকে তার দলের লোকেরা ধরিয়া আনিয়া তার গুহার মধ্যে বন্দী করিয়া রাখিয়াছে। মেয়েটা চাহিয়া দেখে চারিদিকে লোকজন, পালাইবার চেষ্টা করিয়া কোন ফল হইবে না। তার চেয়ে এই ভাল। আপাততঃ দৈত্যকে ঘুরিয়া প্রদক্ষিণ করিতে করিতে তার মাথায় ফুল ছড়াইয়া তাকে তুই রাখা চলুক। তার লোকজন অন্যমনস্ক হইলে যেই একটু ফাক পাওয়া যাইবে অমনি মেয়েটি এখান হইতে পলাইয়া যাইবে। কোথায় যাইবে? যেখানে তার জন্য খেলার সার্থীরা প্রতীক্ষা করিয়া আছে। পালাইয়া অনন্তদের বাড়ীতে গিয়া উঠিলে মন্দ হয় না। মা তাকে কিছুদিন লুকাইয়া রাখিবে। দৈত্যটা তাকে পাড়াময় বৃথাই খুঁজিয়া মরিবে। পাইবে না। অবশেষে একদিন মনের দুঃখে তিতাসের জলে ডুবিয়া মরিবে।

অনন্তর ধ্যান ভাঙ্গিল তখন, যখন বড় বাতাসার হাঁড়ি হাতে একজন একমুঠা বাতাসা তুলিয়া তার হাতের কাছে নিয়া বলিল, ‘এই নে, বাতাসা নে। কোন দিকে চাইয়া রইলি?’

অনন্ত হাত পাতিয়া বাতাসা লইল। ততক্ষণে বিবাহ শেষ হইয়া গিয়াছে এবং বিবাহ সমাপ্তির মধু-চিহ্ন রূপে নাপিত ভাই ‘গুরুবচন’ বলিতেছে—

 

শুন শুন সভাজন শুন দিয়া মন,

শিবের বিবাহ কথা অপূর্ব কথন।

কৈলাস-শিখরে শিব ধ্যানেতে আছিল,

উমার সহিতে বিয়া নারদে ঘটাইল।

শিবেরে দেখিয়া কাঁদে উমাদেবীর মা,

এমন বুড়ারে আমি উমা দিব না।…

শিবেরে পাইয়া উমা হরষিত হইল,

সাঙ্গ হইল শিবের বিয়া হরি হরি বল।

 

গুরুবচনের মাঝখানটায় শ্যামসুন্দর চমকাইয়া উঠিয়াছিল : এ সব কথা ঠিক তাহাকে উদ্দেশ করিয়া বলিতেছে না ত! যা হোক, বচনের শেষের দিকটা আশাপ্রদ। উমার মা যাহাই মনে করুক না কেন, উমা নিজে খুশি হইয়াছে।

বিবাহবাড়ি খালি হইবার আগেই অনন্তর মা অনন্তকে হাত ধরিয়া বাড়ির পথে পা দিয়াছিল। পথে চলিতে চলিতে হাতের বাতাসাগুলিকে অনন্তর অকিঞ্চিৎকর মনে হইতে লাগিল। মনের দিক দিয়া সে এই একটি দিনের অভিজ্ঞতাতেই অনেকখানি আগাইয়া গিয়াছে। কয়েকটা অজানার আগল ধীরে ধীরে খুলিয়া গিয়াছে।

এই বিবাহেও শ্যামসুন্দর অনেক টাকা খরচ করিয়াছে। মালোপাড়ার সবাইকে পরিতৃপ্তির সহিত ভোজন করাইয়াছে।

কিন্তু কালীপূজাতে হয় সব চাইতে বেশী সমারোহ। বিদেশ হইতে কারিগর আসে। পূজার একমাস আগে মূর্তি বানানো শুরু হয়।

প্রকাণ্ড বাঁশের কাঠামটা ছিল অনন্তর চোখে পরম বিস্ময়। তৈরী করিতে পাঁচদিন লাগিল। এক বোঝাই খড় আসিলে, পাটের সরু দড়ি দিয়া খড় পেঁচাইয়া তৈরী হইল নির্মস্তক সব মূর্তি। সেগুলি কেবল বাঁশের উপর খাড় করা; খাড়া কাঠামে পিঠ-লাগানো। মানুষের আকার নিয়াছে হাত পা শরীরে, নাই কেবল মাথা।

একদিন এক বোঝাই মাটি তিতাসের ঘাটে লাগিল। ছোট করিয়া কাটা পাটের কুচি সে মাটির সঙ্গে মিশাইয়া জল ঢালিয়া মালোর ছেলেদের জিন্মায় দেওয়া হইল। তারা নাচিয়া কুদিয়া পাড়াইয়া মাড়াইয়া সে মাটি নরম করিল। এই মাটিতে আকাশ-ছোঁয়া মূৰ্তি তৈয়ার হইবে। সে মাটির কাজ করা বড় গৌরবের, বিশেষ ছেলেদের পক্ষে।

কারিগরেরা সে মাটি লাগাইয়া দেহ সংগঠন করিল। মূতির গলার উপর যেদিন মাথা পরান হইল সেদিন মনে হইল এত বড় মূর্তি যেন কথা কহিতে চায়।

মূর্তির গায়ে খড়িগোল লাগাইয়া পালিশ করাতেই অনন্ত ভাবিল কারিগরের কাজ ফুরাইয়াছে, এই মূর্তিরই পূজা হইবে।

‘মূর্তি ত বানান হইল, পূজা কোন দিন?’

‘দূর বলদ, মূর্তির অখনো মেলাই বাকি। সাদা খড়ির উপরে রঙ লাগাইব, নানান রঙের রঙ। যেদিন চক্ষুরদান হইব, সেইদিন কাম সারা। পূজা হইব সেইদিন রাইতে।‘

সুবিজ্ঞ সাথীর আশ্বাস অন্তরে নিয়া অনন্ত পরের দিন গেল। কিন্তু নিরাশ হইল। পাল খাটাইয়া মণ্ডপের সামনাটা ঢাকিয়া দিয়াছে। কারিগরদের যাওয়া-আসার জন্য একটুখানি ফাক আছে এক কোণে। সেখানে চোখ ডুবাইয়া দেখা গেল ছোট ছোট অনেক বাটিতে অনেক জাতের রঙ গোল রহিয়াছে। সেই রঙে তুলি ডুবাইয়া কারিগরের দ্রুত বেগে চালাইতেছে, আর প্রতিমা প্রতিক্ষণে নব নবরূপে বিচিত্র হইয়া উঠিতেছে।

কালোর-মা-ই নির্দিষ্ট করিয়া দিল, কাল যে কালীপূজা হইবে, তাতে কালোর-মা, অনন্তর-মা আর বৃন্দার-মা সংযমী থাকিবে। সংযমী যারা থাকে তারা আগের দিন নিরামিষ খায়, পূজার দিন প্রাতঃস্নান করে। পূজার জল তোলে, ফুল বাছাই করে, ভোগ নৈবেদ্য সাজায় আর ফুলের মালা গলায় নামাবলী গায়ে যে পুরোহিত পূজায় বসে তার নির্দেশ মতো নানা দ্রব্য আগাইয়া দেয় এবং প্রতিমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধযুক্ত নানা কাজ করে। কম গৌরবের কথা নয়। তারা পুরোহিতের সাহায্যকারিণী। অর্ধেক পূজা তারাই সমাধা করে। পুরোহিত তো কেবল মন্ত্রের জোরে। অনন্তর মার গৌরব বাড়িল। কিন্তু সুবলার বৌয়ের জন্য দুঃখ পাইল। সে এসব কাজে কত পাক অথচ কালোর মা তাকেই কিছু বলিল না।

সারাদিন এক ফোঁটা জল মুখে না দিয়া কারিগরেরা তুলির শেষ পোঁচ লাগাইয়া যখন পরদা সরাইল, আকাশের আলো ফুরাইয়াছে বলিয়া তখন পালের নিচে গ্যাসের আলোর আয়োজন চলিতেছে।

মা বলিয়া দিয়াছে, অত বড় প্রতিমা, প্রথমে পায়ের দিকে চাহিও, তারপর ধীরে ধীরে চূড়ার দিকে। একেবারেই মুখের দিকে চাহিলে ভয় পাইবে। সে-কথা ভুলিয়া গিয়া অনন্ত একেবারেই মুখের দিকে চাহিল কিন্তু ভয় পাইল না।

একটু পরেই দেখা গেল নৈবেদ্য হাতে করিয়া মা পূজারিণীর বেশে মণ্ডপে ঢুকিতেছে। শুদ্ধ শান্ত ধবলী বেশ। নূতন একখানা ধবধবে কাপড় পরিয়াছে মা। কোথায় পাইয়াছে কে জানে! কিন্তু এই বেশে মাকে যা সুন্দর দেখাইতেছে। মণ্ডপের বাহিরে একটা বাঁশবাঁধা। তার ওপাশে কাহাকেও যাইতে দেয় না। কেউ গেলে ধমক খাইয়া ফিরিয়া আসে। এ অভিজ্ঞতা তার নিজেরও হইয়াছে। আর তারই মা কিনা অত সব পূজাসামগ্ৰী লইয়া মণ্ডপের ভিতরে একেবারে প্রতিমার গাঁ ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়াছে! এত কাছে যারা যাইতে পারিয়াছে তারা সামান্ত নয়। অনন্তর মত এত সামান্ত ত নয়ই, তাদের সঙ্গে নিশ্চয়ই দেবতার কথাবার্তা চলে। মার প্রতি অনন্তর অনির্বচনীয় শ্রদ্ধা জন্মিল। অথচ এই মা’ই তাহাকে কোলে তুলিয়াছে, খাওয়াইয়াছে পরাইয়াছে। একান্ত ইচ্ছা করিতেছে মা একবার তার দিকে দৃষ্টিপাত করুক। তার দৃষ্টির প্রসাদ ঝরিয়া পড়ুক অনন্তর চোখেমুখে। কিন্তু না, বড় দুর্ভাগা সে। মা কোনোদিকে না চাহিয়া চলিয়া গেল। একবার চাহিয়াও দেখিল না, তারই ছেলে অনন্ত দীনহীনের মত দূরে দাঁড়াইয়া। মার জন্য অনন্ত খুব গর্ববোধ করিল।

তারপর অনেকক্ষণ মাকে আর দেখা গেল না। বোধ হয় বাড়ি চলিয়া গিয়াছে।

বাহিরে অমাবস্যার অন্ধকার। পালের বেড়া দেওয়া তীব্র আলোর রাজ্য হইতে বাহির হইয়া একেবারে অন্ধকারের সমুদ্রে গিয়া পড়িল। কোনমতে পথ চিনিয়া বাড়িতে আসিয়া দেখে দ্বার বন্ধ। মা আসে নাই। এত রাত। এত অন্ধকার। সে এখন যায় কোথায়। আবার সেখানে একা একা ফিরিয়া যাওয়া। একথা যে ভাবাও যায় না। তবু যাইতে হইবে। দুঃসাহসের জয়যাত্রা তাকে এখনই শুরু করিতে হইবে। তুর্জয় সাহসে বুক বাঁধিয়া অনন্ত কোনো দিকে না চাহিয়া পথ বাহিয়া চলিল। গল্পের মধ্যে যাদের কথা সে শুনিয়াছে এখন তাদের সঙ্গে যদি দেখা হইয়া যায়। না তাদের কারো সঙ্গেই পথে দেখা হইল না। তার বোধ হয় জানে না অনন্ত আঁধারে একা এপথ দিয়া যাইতেছে। জানিলে আসিত। অনেক লোক লইয়া তাদের কারবার। অনন্তর মত এত ছোট মানুষ কাউকে ভুলিয়া যাওয়া তাদের অসম্ভব নয়। তার আত্মসন্মানে আঘাত পড়িল। সে তাদের কথা আত জানে, অথচ অনন্তর কথা তারা জানে না।

এই বাড়িতেই পূজার সবকিছু দ্রব্য রাখা হইয়াছে। তার মা এই বাড়িতেই কোনো একটা ঘরে আছে হয়ত। অনেকগুলি পুজার উপকরণ সামনে লইয়া প্রদীপের পাশে বসিয়া আছে প্রতিমার মত। কাছে দেখিতে পাইয়া অনন্তকে তাড়াইয়া দিবে না ত? পূজার জন্য মা তার কাপড়খানা পরিষ্কার করিয়া দিলেও, মার মত অত পরিষ্কার নয়। আর তাকে অত সুন্দর কোনোকালেই দেখাইবে না। তবে ত এখন মার কাছে যাওয়া ঠিক হইবে না। কিন্তু আজ অন্ধকারে যে দুরন্ত সাহসের কাজ সে করিয়া ফেলিয়াছে, মা যদি তাহ। জানে তবে নিশ্চয় তাকে কাছে ডাকিয়া নিয়া কোলে ঠিক না বসাইলেও পাশে বসাইয়া বলিবে, তুমি অমন ভাবে আঁধারে এক পথ চলিও না। সে বলিবে, তাতে কি মা, আমার তেমন ভয় করে নাই ত। মা বলিবে, তোমার ভয় না করিতে পারে কিন্তু আমার ভয় করে। তুমি আঁধারে হারাইয়া গেলে তোমার মত এমন আর একটি অনন্তকে আমি কোনকালে পাইব না। মা তাহা হইলে সত্য কথাই তো বলিবে। কোথায় পাইবে আমার মত আরেকটিকে। তেমন কাউকেও দেখি না ত। না, মাকে কথাটা বলিতেই হইবে।

একটা ঘরের দিকে আগাইয়া গেল। দরজা খোলা। ভিতরে প্রদীপ জ্বলিতেছে। তার আলোয় উঠানটাও কিঞ্চিৎ আলোকিত। এই আলোতে একটি ছেলেকে সন্দিগ্ধভাবে ঘুরিতে দেখিয়া কারো মনে সন্দেহ ঢুকিয়া থাকিবে, ছেলেট পূজার কোনো দ্রব্য চুরি করিবার তালে আছে। সে খুব জোরে এক ধমক দিল। অনন্ত মাকে খুঁজিতেছে একথা বলিবার অবসর পাইল না। লোকটা আগাইয়া আসিয়া সরিবার পথ দেখাইলে অনন্ত নীরবে পূজামণ্ডপে চলিয়া আসিল।

তাকে অসহায়ের মত দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া কে একজন দয়াপরবশ হইয়া তার দিকে চাহিল।

‘এই, তুই কার ঘরের?’

অনন্ত এ প্রশ্নের অর্থ বুঝিল না।

‘ও পুলা, তোর বাপ কেডা?’

বাপ নামক পদার্থটা যে কি, অনন্ত তাহা কিছু কিছু বুঝিতে পারে। এই পাড়ার সমবয়সী অনেক ছেলেরই বাপ নামক এক একটি লোক আছে। বাজারের ঘাট হইতে ছোলাভাজা মটরভাজা বিস্কুট কমলা কিনিয়া দেয়। সকালে রাতের জাল বাহিয়া আসিয়া কারে বা কোলে নেয়, কারে বা চুমু খায়, কারে বা মিছিমিছি কাদায়। দুপুরে নিজহাতে তেল মাখাইয়া তিতাসের ঘাটে নিয়া স্নান করায়। পাতে বসাইয়া খাওয়ায়। মাছের ডিমগুলি বাছিয়া বাছিয়া মুখে তুলিয়া দেয়। এসব অনন্তর একদিনের দেখা অভিজ্ঞতা নয়। অনেকদিন দেখিয়া, মনে মনে পর্যালোচনা করিয়া তবে সিদ্ধান্তে আসিয়াছে যে, বাপের এইসব করে। আরো দেখিয়াছে মালো-পাড়ার ছেলেদের গায়ে যে লাল-নীল জামা, এসবও ঐ বাপেরাই কিনিয়া দেয়। যাদের বাপ আছে তারা শীতে কষ্ট পায় না। অনন্ত শীতে কষ্ট পায় তার বাপ নাই বলিয়া। এ ঠিক মার কাজ নয়। কিন্তু তারও বাপ থাকিতে পারে বা কেউ একজন ছিল এ প্রশ্ন কোনোদিন তার মনে জাগে নাই। মাও কোনোদিন বলিয়া দেয় নাই। অথচ মা কত কথা বলিয়া দেয়। বড় অদ্ভূত প্রশ্ন। আগে কেউ এ প্রশ্ন করে নাই। অনন্ত এর কোনো জবাব খুঁজিয়া পাইল না।

‘তুই কার লগে আইছস্?’

এইবারের প্রশ্নটি সোজা। একটু আগেই সে আঁধার জয় করিয়া আসিয়াছে। সঙ্গে তার কেউ ছিল না। জানাইল, একলা আসিয়াছে।

‘এ বলদটা কার ঘরের রে বিপিন?’

বিপিন নামক যুবকটি প্রশ্নকর্তার কৌতুহল এই বলিয়া নিবৃত্ত করিল, তুমি থাক পরের গ্রামে, নিজের গ্রামে কে গেল কে আসিল তুমি কি করিয়া জানিবে। এর মা বিধবা। গায়ে নূতন আসিয়াছে। কালোবরণ বেপারির বাড়ির কাছে বসতি নিয়াছে। রাত পোহাইলে দেখিয়া যাইও ছোট ঘর খানাতে থাকে খায়।

বিপিন একটা পাতলা কাঁথা গায়ে জড়াইয়া উত্তর দিতেছিল। লোকটার কানের কাছে মুখ নিয়া বলিল, ‘ছোট ঘরে বসত করে বড় গুণবতী। হি হি হি।’

অনন্তর পূজা দেখা হইল না। ভিতরে যারা ঘুমাইয়া ছিল, ঘুম পাইলে তাদের দলে ভিড়িয়া অনন্তও এক সময়ে তাদের গাঁ ঘেঁষিয়া শুইয়া পড়িল। একসময়ে কাঁসি-ঘণ্টা বাজাইয়া পূজা হইয়া গিয়াছে। তারা উঠিয়া পূজা দেখিল, প্রণাম করিল, প্রসাদ পাইল। যে-সব ছেলে বাপ ভাই জেঠা খুড়ার সঙ্গে আসিয়াছিল, তারা তাদের সঙ্গে চলিয়া গিয়াছে। অনন্ত কারে সঙ্গে আসে নাই। তার ঘুমও কেউ ভাঙাইল না।

ঘুম যখন ভাঙিল তখন অনেক বেল। এঘরে একজনও শুইয়া নাই। কিন্তু যত ভিন-পাড়ার ভিন-গায়ের লোক বিহানের বাজার করিতে আসিয়াছিল, তারা এখন প্রতিমার নিকট ভিড় জমাইয়াছে।

ঐ-বাড়িতে মা ছিল। যদি সেখানে গিয়া মাকে পাওয়া যায়। এই ভাবিয়া চোখ মুছিতে মুছিতে সে-পথেই রওয়ান হইল।

মা সেখানেই আছে। আর সেখানে জমিয়াছে একপাল তারই মত বয়সের ছেলেমেয়ে। বড় একটা পিতলের গামলাতে সবগুলি নৈবেদ্যের প্রসাদ ঢালিয়া তার মা নিজ হাতে মাখিতেছে। চিনি বাতাসা সন্দেশ কলা আর আলোচাল। আরো নানা জিনিস। সব একসঙ্গে মাখিয়া মা প্রসাদ বানাইতেছে; যত ছেলের দল চুপ করিয়া চাহিয়া আছে সে প্রসাদের দিকে আর অনন্তর মার মুখের দিকে, প্রসাদ প্রস্তুতরত হাতখানার দিকে।

মার একেবারে সামনে গিয়া পড়া যুক্তিযুক্ত মনে হইল না। সেও ছেলের দলে মিশিয়া তাদেরই একজন হইয়া মাকে দেখিতে লাগিল।

প্রসাদ মাখা শেষ হইলে অনন্তর মা মাধুকরির মত বড় এক এক দলা করিয়া এক এক জনের হাতে প্রসাদ দিতে লাগিল। অন্য ছেলেদের মত অনন্তও একবার ভিড়ের ভিতরে হাত বাড়াইল। সেও তেমনি বড় একদলা প্রসাদ পাইল।

অনন্ত স্পষ্ট দেখিয়াছে, দিবার সময় মা তার দিকে চাহিয়াছে আর একটুখানি হাসিয়াছে। রাতজাগা চাঁদের স্বচ্ছ পাণ্ডুর মমতামাখা হাসি শুধু একটুখানি হাসিয়াছে।

তারপর থেকে চারদিন এখানে অপরূপ কাণ্ড হইল। এক নাগারে আট পালা যাত্রা গান আর কবি গান হইল।

চার দিন পর্যন্ত মালোর দিনে যাত্রা রাত্রে কবি শুনিল। চার দিনের জন্য নৌকাণ্ডলি ঘাটে বাঁধা পড়িল। জালগুলি গাবে ভিজিয়া রোদে শুকাইল। চারদিন তাদের না হইল আহার না হইল নিদ্রা।

কয়দিনের ধুমধামের পর মালোপাড়া ঝিমাইয়া পড়িয়াছে। অত্যধিক আনন্দের অবসানে অনিবার্যরূপে যে অবসাদ আসিয়া পড়ে, তারই কোলে ঝিমাইতে থাকিল মালোপাড়ার ঘেঁষাঘেঁষি ছোটবড় ঘরগুলি।

এর ব্যতিক্রম কেবল রামকেশবের ঘর। যার ঘরে নিত্য নিরানন্দ, আনন্দাবসানের দুঃখের আঁধার সে-ঘরে তুলিয়া উঠে না। ঘনাইয়া আসে না শ্রান্তির অবসন্ন কালে মেঘ। গরীব বলিয়া মাতব্বরের বলিয়াছিল, ‘রামকেশব, তোমার পাগলার চাঁদা বাদ দিলাম। তোমার চাঁদ দিয়া দেও।‘

তারা লণ্ঠন লইয়া  উঠানে বসিয়াছে। দিবে-না বলা চলিবে না। তাদের হাতে হুকা  দিয়া রামকেশব ডাক দিল, ‘মঙ্গলারে, অ মঙ্গলা, তুই না জাল কিনতে চাইছিলি, টাকা থাকে ত লইয়া আয়?’

ঝড়ের ঢেউ বুকে করিয়া জালটা বাহির করিলে যার হাতে চাঁদার কাগজ ছিল সে বলিল, ‘জালটা অখন বেইচ্চ না কিশোরের বাপ। তোমার চান্দা ছাড়াও পূজা হইব, কিন্তু জাল বেচলে আবার জাল করতে দেরি লাগব। আমি মাত্‌বররারে সামঝামু।’

এ জন্য রামকেশবের মনে একটা সঙ্কোচ ছিল। চাঁদ দিবে না অথচ পূজার প্রসাদ খাইবে। পরের চাঁদায় গান হইতেছে। সে গান যে বসিয়া বসিয়া শুনিবে, লোকে তার দিকে চাহিয়া কি মনে করিবে।

পূজার একরাত ও গানের চারদিন চাররাত সে পাগলকে ঘরে বাঁধিয়া রাখিল। এবং নিজে না দেখিল পূজা, না পাইল প্রসাদ, না শুনিল গান। চাররাত ধরিয়া খালের মুখে একটানা জাল পাতিয়া রাখিল। তাহাতে সে প্রচুর মাছ পাইল এবং চড়া দামে বেচিয়া কিছু টাকা পাইল। কিন্তু গরীবের হাতে টাকা পড়িলে উড়িবার জন্য ছটফট করে। পরিবারকে জানাইল, পাগলের মঙ্গলের জন্য ‘আলন্তির’ দিনে সে কয়েকজন লোককে খাওয়াইবে।

বুড়ি বলিল, ‘ঐ দিন ত ঘরে ঘরে খাওয়ার আরব্ব, তোমার ঘরে কেডায় খাইতে আইব কও।’

‘কথাটা ঠিক?’

কালীপূজার সময় গান বাজনায় আমোদ আহ্লাদে মালোর অনেক টাকা খরচ করে সত্য, কিন্তু খাওয়া-দাওয়ার জন্য খরচ করে এই উত্তরায়ণ সংক্রান্তির দিনে। এই দিন পৌষ মাসের শেষ। পাঁচ ছদিন আগে থেকেই ঘরে ঘরে গুঁড়ি-কোটার ধুম পড়ে। মুড়ি ভাজিয়া ছাতু কুটিবার তোড়জোড় লাগে। চাউলের গুঁড়ি রোদে শুখাইয়া খোলাতে টালিয়া পিঠার জন্য তৈরী করিয়া রাখে। পরবের আগের দিন সারারাত জাগিয়া মেয়েরা পিঠা বানায়। পিঠা রকমে যেমন পিচিত্র, সংখ্যায়ও তেমনি প্রচুর। পরের দিন সকাল হইতে লাগে খাওয়ার ধুম। নারী পুরুষ ছেলে বুড়া অতি প্রত্যুষে জাগিয়া তিতাসের ঘাটে গিয়া স্নান করে। যারা জালে যায় তারাও নৌকায় উঠিবার আগে গামছা পরিয়া ডুব দেয়। ঠকঠক করিয়া কাঁপিতে থাকায় মাছ ধরার কাজে সুবিধা হয় না। তুত্তোর, পরবের দিনে কিসের মাছ ধরা, এই বলিয়া তুই চার খেউ দিয়াই জাল খুলিয়া ফেলে। ঘরে থাকিয়া নারীরা আর ঘাটে যাইয়া ছেলেপিলেরা নদীর উপর চোখ মেলিয়া রাখে, কার নৌকা কত সকালে আসিয়া ভিড়ে। যারা যত সকালে ভাসিবে তারা তত সকালে খাইবে। এবং সকলে যত সকালে আসিয়া খাওয়া শেষ করিবে, গ্রামের নগর-কীর্তনও তত সকালে আরম্ভ হইবে। সারাটা গ্রাম ঘুরিয়া কীর্তন করার জন্য সকলের আগে বাহির হয় মালোপাড়ার দল। সাহাপাড়া আর যোগীপাড়া হইতেও দেখাদেখি দল বাহির হয়। কিন্তু মালোদের মত কীর্তনে অত জৌলুস হয় না। তারা কীর্তন করে ঝিমাইয়া আর মালোর করে নাচিয়া কুঁদিয়া লাফাইয়া ঝাঁপাইয়া। তাই কদমা বাতাসাও ধরিতে পারে তারাই বেশি। সে যে কি আনন্দের! সে সময় পুরুষেরা কীর্তন করিয়া বাড়ি বাড়ি লুট ধরিতে যায় আর মেয়ের ঘরে বসিয়া নানা উপকরণের পঞ্চান্ন-ব্যঞ্জন রান্না করে।

ঘরে ঘরে এত প্রাচুর্যের দিনে রামকেশবের বাড়িতে খাইতে আসিবে কে।

তবু তার সাধ দুর্বার হইয়া উঠিল। সে স্থির করিল রাধামাধবের বাড়িতে একটা ‘সিধা’ দিবে আর খাইতে নিমন্ত্রণ করিবে যাত্রাবাড়ির রামপ্রসাদ জামাইকে, বাড়ির পাশের মঙ্গলা আর তার ছেলে মোহনকে আর সুবলার শ্বশুরবাড়ির সব কয়জনকে। আরো একজনের কথা তার মনে জাগে, সে গ্রামের নূতন বাসিন্দা, অনন্তর মা। তার ছেলেটাকে বড় আদর করিতে ইচ্ছা করে। সে কি আসিবে। কালোর-মা হয়ত এতক্ষণে তাকে নিমন্ত্রণ করিয়া বসিয়াছে। সে বাড়িতে খাইবেও অনেক ভাল।

নিমন্ত্রণ পাইয়া সুবলার শাশুড়ী মায়ে-ঝিয়ে অনেক চাউলের গুঁড়ি কুটিয়া রামকেশবের বাড়ি দিয়া আসিল। নিজেদের জন্য আগে যত গুঁড়ি কুটিয়া রাখিয়াছিল তাহাও পাঠাইয়া দিল। এবারের পরব তাদের বাড়িতে না হইয়া ঐ বাড়িতেই হোক।

রামকেশব যে সাধ মুখ ফুটিয়া প্রকাশ করারও সাহস পায় নাই, সে সাধ পূর্ণ করিল সুবলার বৌ। গুঁড়ি গোলার প্রাথমিক কাজ মায়ে-ঝিয়ে শেষ করিয়া সন্ধ্যা সময়ে সে গিয়া অনন্তর মাকে ধরিয়া বসিল, ‘পিঠা বানাইতে হইব দিদি, চল।‘

‘কই?’

‘ঐ বাড়তি্‌ যে বাড়তি্‌ একটা পাগলা থাকে।‘

অনন্তর মার বুকটা ছাঁৎ করিয়া উঠিল, ‘ন না ভইন, অচিনা মানুষ তারা। কোনদিন তারাও কিছু কয় নাই, আমিও যাই নাই। আমি দিদি যাইতে পারি না।’

‘দিদি, তুমি মনে কইরা দেখ, আমিও অচিন আছ্‌লাম, চিনা হইলাম। মানুষের কুটুম আসা-যাওয়ায় আর গরুর কুটুম লেহনে-পুছনে। তুমি দিদি, না কইর না। বুড়া মানুষ। কোন দিন মইরা যায়। তার মনে সাধ হইছে, লোকসেবা করাইব। এই পরবের দিনে লোক পাইব কই? এক লোক পাওয়া গেছে মন্দিরের রাধামাধবেরে, আর লোক পাওয়া গেছে আমার বাপেরে আর বড় মাত্‌বরেরে। আরেক লোক তোমার অনন্ত। তুমি-আমি কেবল পিঠা বানানোর লাগি, বুঝ্‌ছ নি।‘

অনন্তর মাকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়া সে অনন্তকে লইয়া রামকেশবের রান্নাঘরে ঢুকিল এবং প্রথম খোলার প্রথম পিঠাখানা রাধামাধবের জন্য তুলিয়া রাখিয়া পরের পিঠাখানা অনন্তর হাতে দিল, তাকে চৌকিতে বসাইয়া, খোলা হইতে পিঠা তুলিবার ফাঁকে ফাঁকে তার খাওয়া দেখিতে লাগিল।

অনন্তর মা ঘরে সন্ধ্যাদীপ জ্বালাইয়া একটু পরেই সে দীপ নিভাক্টল, এবং দরজা বন্ধ করিয়া নিমন্ত্রণ-বাড়িতে গিয়া চুকিল। অনন্ত তখন মুবলার বৌর ঠিক পাশটিতে বসিয়া মনোরম ভঙ্গিতে পিঠা খাইতেছে।

স্বামীপুত্রকে নদীতে পাঠাইয়া একটু পরে মঙ্গলার বৌও আসিয়া তাহদের সঙ্গে মিলিত হইল। অতঃপর তিনজনে মিলিয়া খুব তোড়ের সহিত পিঠা বানাইতে লাগিল। এক বুড়ি কিশোরের মা আরেক বুড়ি সুবলার শাশুড়ী তাদের সঙ্গে কিছুতেই আঁটিয়া উঠিতে না পারিয়া কাজে ভুল করিতে লাগিল। রাত আরেকটু অধিক হইতে দুই বুড়িষ্ট ঢুলিতেছে দেখিয়া তিনজনেই তাহাদিগকে ছুটি দিলে, তার মাঝঘরে গিয়া ঘুমাইয়া পড়িল। অনন্তও হইল তাদের শয্যার সঙ্গী। তখন তিনজনেই রহিল সমান সমান। তারা এমনভাবে কাজ করিয়া চলিল যে, যেন এ রাতের জন্য তারাই এ বাড়ির মালিক।

পাগলটার রাতে ঘুম নাই। আজ রাতে আবার পাগলামি বাড়িয়াছে। একটু আগে এ ঘরের মহিলাদিগকে অকারণে দেখিয়া গিয়াছে। তারপর বারান্দায় বসিয়া গান করিয়াছে, প্রলাপ বকিয়াছে এবং দা দিয়া মাটি কোপাইয়াছে। এত করিয়াও তৃপ্ত না হইয়া আবার মহিলাদের ঘরের দিকে আসিতেছে দেখিয়া মঙ্গলার বৌ দরজা বন্ধ করিয়া দিল। বন্ধ দুয়ার দেখিয়া সে আর দাঁড়াইল না, বারান্দায় গিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।

মঙ্গলার বৌয়ের সহসা নিশি রাতে গল্প শুনিবার সাধ হইল। অনন্তর মাকে ধরিয়া বসিল, ‘একখান পরস্তাব কও ভইন। নতুন দেশের নতুন মানুষ তুমি। অনেক নতুন পরস্তাব তুমি শুনাইতে পারবা।’

অনন্তর মা একটু ভাবিয়া দেখিল; তার নিজের জীবনে এত বেশি ‘পরস্তাব’ জমিয়া আছে, আর সে ‘পরস্তাব’ এত বিচিত্র যে, ইহা ফেলিয়া কানে-শোনা ‘পরস্তাব’ না বাধিবে দানা, না লাগিবে ভাল, না পরিবে দরদ দিয়া বলিতে। তার নিজের জীবনের বিরাট কাহিনীর নিকট আর যত সব কাহিনী তো নিতান্ত তুচ্ছ। কিন্তু এ কাহিনী তো এখানে বলিবার নয়। শুধু এখানে কেন, কোনোখানেই বলিবার নয়। এ কাহিনী নিজে যেমন কুলকিনারাহীন, এর ভবিষ্যৎও তেমনি কুলকিনারাহীন। এ কাহিনী সহজে কাউকে খুলিয়া বলা যায় না, কিন্তু গোপন করিয়া সহিয়া থাকিতে অসীম ধৈর্য, কঠোর আত্মসংযম লাগে। তাকে না বলিয়া মনের গোপনে লুকাইয়া রাখার জন্য মনের উপর অনেক বল প্রয়োগ করিতে হয়। তবু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়া রাখিয়াছে, যদি কোন দিন চূড়ান্ত সময় আসে সেদিন বলিবে, তার আগে বুক যতই মুচড়াইয়া দুমড়াইয়া ভাঙ্গিয়া চুরিয়া থাক সেখানেই উহাকে সযত্নে সংগোপনে লুকাইয়া রাখিবে।

তার অন্যমনস্কতাকে নির্মমভাবে আঘাত দিল মঙ্গলার বৌ ‘কি গ বিন্দাবনের নারী, কোন কালোচোরা লড়দা গেছে মাইরা বাঁশির বাড়ি। পরস্তাব শুনাইবা ত শুনাও ভইন। ভাল লাগে না। না জানলে না কর, জানলে কও।‘

কড়ার টগবগে তেলে হাত দিয়া গোলা ছাড়িতে ছাড়িতে অনন্তর মা বলিল, ‘আমি একখান পরস্তাব জানি, এক মাইয়ারে দেইখ্যা এক পুরুষ কেমুন কইরা পাগল হইল, কয় এরে বিয়া করুম?’

‘বিয়া করল?’

একটু ভাবিয়া অনন্তর মা বলিল, ‘করল?’

‘তার পর কি হইল?’

‘তারপর আর মনে নাই।’

‘কপাল আমার। এই বুঝি তোমার পরস্তাব। কেবল একজন পুরুষ কি কইল, সংসারের সব পুরুষইত মাইয়া দেইখ্যা পাগল হয়, বিয়া না কইরা ছাড়ে না। কিন্তু বিয়া করার পরে কি হয় সেই খানইত আসল কথা। তুমি ভইন আসল কথাই শুনাইলা না, চাইপ্যা গেল।

‘জানি না দিদি, জানলে কইতাম।‘

এইবার কথা কহিল সুবলার বৌ। অনন্তর মার কথায় সে চমকাইয়া উঠিয়াছিল। এ মেয়ে একথা জানে কি করিয়া। কথার পিঠে সে কথা দিল, ‘আমি জানি ঐ মাইয়া-পাগল কি কইরা সত্যের পাগল হইয়া গেল, আর তার বন্ধু কি কইরা মারা গেল। কিন্তুক কমুনা।‘

সুবলার বউ একটু থামিয়া আবার বলিতে লাগিল—

পাগল আর বন্ধু যখন ছোট ছিল একজনের মা তখন তাদের দুজনকেই খুব ভালবাসিত। একজন তখন ন’দশ বছরের মেয়ে। মাঘমণ্ডলের দিনে দুষ্ট বন্ধু তার চৌয়ারি বানাইয়া দিয়াছিল। সেইদিন মা ঠিক করিয়া রাখিল দুইজনের যে-কোন জনকে মেয়ে সঁপিয়া দিবে। শেষে স্থির করিল বড়জনই বেশি ভাল, তাকেই মেয়ে দিবে। সে যেদিন পাগল হইয়া ফিরিয়া আসিল সেদিন মত গেল বদলাইয়া। মেয়ের বাপ তখন পাগলের বাপকে খালি এড়াইয়া চলিতে চায়। পাগলের বাপ ডাকিয়া বলে, তুমি আমাকে এড়াইয়া চল কেন। বাজারে যাইতে আমার উঠান দিয়া না গিয়া রামগতির উঠান দিয়া ঘুরিয়া যাও কেন। আমি কি জানি না, আমার কপাল ভাঙ্গিয়াছে। পাগলের নিকট বিয়া দিতে আমি কেন তোমাকে বলিব। তারপর একদিন ঢোলঢাক বাজাইয়া মেয়ের বিয়া হইয়া গেল। কার সঙ্গে হইল জানি, কিন্তু বলিব না।

—আরও জানি। বিয়ার পর বন্ধু গেল জিয়লের ক্ষেপ দিতে। বড় নদীতে একদিন রাত্রিকালে তুফান উঠিল। নৌকা সাঁ সাঁ করিয়া ছুটিয়াছে, মানাইতে পারে না। মালিকেরা চতুর মানুষ। তারা নিজে কিছু না করিয়া, যাকে জন খাটাইতে নিয়াছে বিপদ আপদের কাজগুলি সব তাকে দিয়াই করায়। নৌকা তীরে ধাক্কা খাইয়া চৌচির হইবে। তার আগেই ত নৌকার পাঁচজনে তীরে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া হাত দিয়া, কাঁধ লাগাইয়া পিঠ ঠেকাইয়া নৌকার গতিরোধ করিবে। এই ঠিক করিয়া সকলে নামিবার জন্য প্রস্তুত হইল। কিন্তু কার্যকালে শুধু এক ঐ বন্ধু নামিল, আর কেউ নামিল না। তারা বিশ্বাসঘাতকতা করিল। শেষে ঐ বন্ধু নৌকার ধাক্কায় চিত হইয়া পড়িয়া গেল। এক সে। না পড়িয়া উপায় আছে। নৌকা তার বুকখানা মথিয়া পিণ্ড করিয়া দিল। আর সে-নৌকা কার-নৌকা সবই জানি। কিন্তু বলিব না।

‘জান যদি, তবে কইবা না কেনে? ‘

‘চোখে জল আইয়া পড়ে দিদি। কইতে পারি না।’

‘একজনের কথা যে কইল, সে মাইয়া কে?’

‘তার নাম বাসন্তী। সে অখন নাই। মারা গেছে?’

আবহাওয়া বড় করুণ ও ভারাক্রান্ত হইয়া উঠিল। মঙ্গলার বে এই রকম আবহাওয়া সহিতে পারে না। হালকা করিবার জন্য কথা খুঁজিতে খুঁজিতে সহসা বলিয়া উঠিল—

‘আমিও জানি?’

মঙ্গলার বৌ বিজ্ঞের ভঙ্গিতে কথাটা বলিয়া খোলার একখানা পিঠার প্রতি এমন মনোযোগ দিল যেন তুই জনে পায়ে ধরিয়া সাধিলেও যা জানে তা খুলিয়া বলিবে না।

মঙ্গলার বৌর রসাল গল্পটা স্থরু না হইতেই আবহাওয়া আবার থমথমে হইয়া পড়িল। আজ দুইটি নারীর মনের কোথায় যে কাঁটা বিঁধিতেছে কে বলিবে। পাগল চুপ করিয়া আছে দেখিয়া তাদের মন আরো বেশি দোলা খাইতে লাগিল। হয়ত সে ভাবিতেছে। কি ভাবিতেছে। সে যে ভাবিতে পারিতেছে ইহা কল্পনা করিয়া তাদের বুকে কোন্‌ সুদূরের ঢেউ আসিয়া আছড়াইয়া পড়িতেছে।

অনন্তর মার মন উদাম হইয়া উঠিল, ‘কও না গো ভইন, তোমার কথাখান বিস্তারিৎ কইরা, শুনি, পরাণ সার্থক করি।’ কিন্তু মুখের শ্লেষে বুকের বেদন ঢাকা পড়ে না। যে-কাহিনীর বিয়োগান্তিকা নায়িকা সে নিজে, সখীর সে কাহিনী আগাগোড়া জানা আছে কিন্তু যাকে নিয়া এত হইল সেই যে শ্রোতা, একথা সে জানে না, এর চাইতে আর বিচিত্র কি হইতে পারে।

অনন্তর মার নির্বন্ধাতিশয্যে সুবলার বৌ প্রবাস-খণ্ডে কিশোরের পত্নীলাভ এবং পত্বি-অভাবে পাগল হওয়ার বিবরণ বর্ণনা করিয়া কহিল, ‘কন্যা, এই বর্তের নি এই কথা।‘

অনন্তর মা অশ্রু গোপন করিয়া বলিল, ‘হ।‘

‘তবে ঘটে দেও বেলপাতা।‘

তার পরের যেটুকু অনন্তর মার জানা ছিল না, সে কাহিনী আরও করুণ। কিশোরকে বঞ্চিত করিয়া বাসন্তীর কি ভাবে বিবাহ হইল এবং সুবল কি করিয়া মারা গেল।

সুবলার বউ ঘটনা কয়টি আর একবার বলিল—

তারপর পাগল তো বাড়ি আসিল। বাপ মনে করিয়াছিল আনিবে টাকা, সেই টাকায় বাসন্তীরে আনিব ঘরে। কিন্তু তার বাড়াভাতে পড়িল ছাই। সে আসিল পাগল হইয়া।

বাসন্তীর বাপ দীননাথ। সে এখন রামকেশবকে এড়াইয়া চলে। আগে তুই জনে ভাব ছিল। পরে বাসন্তীকে কিশোরের সঙ্গে বিবাহ দিবার কানাযুষ যখন চলিতে লাগিল, ভাবট তখন খুবই বাড়িয়াছিল। এখন দীননাথ এ বাড়ির উঠানও মাড়ায় না। ঘাটে দেখা হইলে পাছে কিছু জিজ্ঞাসা করে এই ভয়ে সে পাশ কাটাইয়া যায়।

একদিন কিন্তু কিছুতেই পাশ কাটাইতে পারিল না। রামকেশব তাহাকে হাত ধরিয়া শুনাইয়া দিল, ‘আসমানে চান্দ উঠলে পর লোকে জানে। আমার কিশোর পাগল হইছে বেবাক লোকেই জানে। আমি কি আর ঘুর-চাপ দিয়া রাখছি?’

দীননাথ চুপ করিয়া থাকে।

‘আমি কি মাথার কিরা দিয়া কই যে, বাসন্তীরে আমার পাগলের সাথে বিয়া দেও।’

‘কি যে তুমি কও দাদা। সেই কথা তুমি কি কইতে পার। তোমারে আমরা চিনি না?’

‘তবে এমন এড়াইয়া বেড়াইয়া চল কেনে ভাই।’

‘এড়াইয়া চলি, তোমার কষ্ট দেইখ্যা বুক কান্দে, তাই।’

‘আমার কষ্ট নিয়া আমি আছি। তার জন্যে তোমরা কেনে কান্দ?’

দীননাথের বুক বেদনায় টনটন করিয়া উঠে! একমাত্র ছেলে। পাগল হইয়া গিয়াছে। ঘর তুয়ার ভাঙ্গে। জিনিসপত্ৰ লণ্ডভণ্ড করে। গলা ফাটাইয়া কাঁদে। বুড়া তাকে নিয়া কি বিপদেই পড়িয়াছে। একে শেষ বয়স। তার উপর এই দাগ। এই কয়মাসে তাকে দ্বিগুণ বুড়া বানাইয়াছে। আর বুড়ি। তার দিকে আর চাওয়াই যায় না। অনেক কান্না জমাট বাঁধিয়া তাকে বোবা বানাইয়াছে। ইহাদিগকে সান্তনা দিবার চেষ্টা করা অপেক্ষ ইহাদিগকে এড়াইয়া চলা অনেক সহজ।

‘বাসন্তীর বিয়া কোনখানে ঠিক কর্‌লা?’

দীননাথ অপরাধীর মত বলে, ‘আমি ত চুপ কইরা আছিলাম। গোলমাল লাগাইয়াছে আমার পরিবার। কয়, সুবল খুব ভাল পাত্র। তারেই ডাক দিয়া বাসন্তীরে পার কর।‘

একদিন সুবলের সঙ্গে বাসন্তীর বিবাহ হইয়া গেল। সেই এক রাত। আকাশে চাঁদ আছে তারা আছে। দীননাথের উঠানে কলাগাছের তলায় বাসন্তীকে সুবল হাতে হাত দিয়া বউ করিতেছে। মেয়ের গীত গাহিতেছে হুলুধ্বনি দিতেছে। জোরে জোরে বাজনা বাজিতেছে। এত জোরে বাজিতেছে যেন রামকেশবের কানের পর্দা ছিঁড়িয়া যাইবে। একটা টিমটিমে আলোর সামনে রামকেশব তামাক টানিতেছে। হুকার শব্দে বাজনার শব্দ ঢাকিবার বৃথা চেষ্টা করিতেছে। তার পাশে বুড়ি বসিয়া বসিয়া ঝিমাইতেছে। গভীরভাবে কিছু বুঝিবার মত বোধশক্তি তার আর অবশিষ্ট নাই। আর বোধশক্তি নাই পাগলটার। সে অর্থহীন ভাবে একটা পুরোনো জাল টানিয়া ছিঁড়িতেছে।

অনেক রাত অবধি সে বাজনা চলিল। তারপর এক সময় উহাও নিস্তব্ধ হইয়া গেল। তখন বুঝি বিবাহবাড়ির সকলেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু বুড়াবুড়ির চোখে সে রাতে আর ঘুম আসিল না।

তারপর একটি দুইটি করিয়া পাঁচটি বছর গত হইল। এই পাঁচ বছরে অনেক কিছুই ঘটিয়াছে। যেমন তিলক মারা গিয়াছে। কিন্তু কে মনে রাখিয়াছে!

তবে একটি ঘটনা মালোপাড়ার অনেকেই মনে রাখিয়াছে। সে হইতেছে সুবলের মৃত্যু। বড় মর্মান্তিকভাবে মরিয়াছে সুবল। কালোবরণের বড় নৌকায় করিয়া জিয়লের ক্ষেপ দিতে গিয়াছিল। সুবল বলিয়াছিল আমাকে ভাগীদার হিসাবে নেও। তারা বলিয়াছিল নৌকা আমাদের পুজি আমাদের। ভাগীদার হিসাবে নিব কেন? মাসিক বেতনে নিব। শুনিয়া সুবলের বৌ বলিয়াছিল, তবে গিয়া কাম নাই। কিন্তু বিবাহ করিয়াছে, লোকজন খাওয়াইয়াছে। হাতের টাকাকড়ি খরচ হইয়া গিয়াছে। সামনে তুরন্ত আষাঢ় মাস। এই দুঃসময়ে সে নিজে কি খাইবে বৌকে কি খাওয়াইবে! কাজেই বেতনধারী হইয়া না গিয়াই বা সে কি করে!

এখন, লোক যদি হয় বেতনধারী, পুঁজিদার হয় তার মালিক, তাকে সেই মালিক তখন চাকরের মত জ্ঞান করে!

মেঘনা নদীর মাঝখান দিয়া কালোবরণ বেপারির নৌকা চলিতেছিল। এমন সময় আসিল তুফান। ঈশান কোণের বাতাস নৌকাটাকে ঝাটাইয়া তীরের দিকে নিয়া চলিল। সকলে প্রস্তুত হইল তীরে ধাক্কা লাগিবার আগেই তারা লাফাইয়া নামিয়া পড়িবে এবং একযোগে ঠেলিয়া নৌকার গতিবেগ কমাইয়া আসন্ন তুর্ঘটনা নিবারণ করিবে। আগে সুবলের উপর আদেশ হইল, শীঘ্র লগি হাতে লাফাইয়া তীরে গিয়া পড়, পড়িয়া, লগি ঠেকাইয়া নৌকাটাকে বাঁচা। তোর সঙ্গে আমরাও লাফ দিতেছি। বেতনধারী লোকের মনে মুনিবের প্রতি প্রবল একটা বাধ্যবাধকতাবোধ থাকে। তাই সুবল ফলাফল না ভাবিয়া মালিকের আদেশমত লাফাইয়া তীরে নামিল কিন্তু আর কেউ ভয়ে নামিল না। সুবল লগিটার গোড়াটা নৌকার তলার দিকে ছুড়িয়া, মাঝখানটাতে কাঁধ লাগাইতে গেল, তাহাতে নৌকার বেগ যদি একটু কমে। বেগ কমিল না। ঢালু তীর। সবেগে নৌকা তীরে উঠিয়া আসিল। সুবল নৌকার তলায় চাপ৷ পড়িল, আর উঠিল না।

বাসন্তীর হাতের শাখা ভাঙ্গিল, কপালের সিঁদুর মুছিল। কিন্তু জাগিয়া রহিল একটা অব্যক্ত ক্রোধ।

চারি পাঁচ বছরে সে অনেক কিছু ভুলিয়াছে। স্বামীর জন্য আর তার কষ্ট হয় না। স্বামী বড় নিদারুণ মৃত্যু মরিয়াছে। একথা মাঝে মাঝে মনে হয়। কল্পনা করিতে চেষ্টা করে একটা মনিবের অসঙ্গত আদেশ আর একটা নিরুপায় ভূত্যের তাহা পালনের জন্য মৃত্যুর মুখে বাপাইয় পড়ার দৃশ্যটা।

একটা পড়ার পুঁথির মত পাগলের মনের উপর দিয়া তার পাগলামির ইতিহাসখানা পাতার পর পাতা উল্টাইয়া গেল। পূর্বস্মৃতি হয়ত তাকে খানিকক্ষণের জন্য আত্মস্থ করিয়া দিল, সে নিজের দিকে, জগতের দিকে তাকাইবার সহজাত ক্ষমতা ফিরিয়া পাইল। না, হয়ত পাইল না। দুইটি নারী তার রান্নাঘরে পিঠা বানাইতেছে। দুইটির সহিতই তার জীবনের সম্পর্ক সুগভীর। ইহাদিগকে কাছে পাইয়া হয়ত ক্ষণকালের জন্য তার বুক ভরিয়া উঠিয়াছে। হয়ত ভরিয়া উঠে নাই। পাগলের মনের হদিস পাওয়া স্বাভাবিক মানুষের কাজ নয়। তবু মনে হয়, দুটি নারীর এতখানি কাছে অবস্থান তার মনে আলোড়ন জাগাইয়া থাকিবে, তাহা না হইলে, হাঁড়িখুড়ি না ভাঙ্গিয়া, জাল দড়ি না ছিঁড়িয়া ভাল মানুষের মত সে স্থির হইয়া বসিয়া কাঁদিবে কেন?

এ ঘরে সুবলার বউ কাহিনী শেষ করিয়া আনিয়াছে। আর এ ঘর হইতেই শোনা যাইতেছে বারান্দাতে পাগল ফোঁপাইতেছে তার শব্দ। অনন্তর মা অনেক করিয়াও মনের বেদন চাপিতে পারিতেছে না। বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়া উঠিতেছে। বুঝি এখনই কান্নায় ফাটিয়া পড়িবে। কিন্তু সব কিছু চাপিতে চাপিতে এমনই অভ্যাস হইয়া গিয়াছে যে, মনের জোরে সে পাথরের মতই শক্ত হইয়া যাইতে পারে।

কেরোসিনের আলোতে তার পাণ্ডুর মুখের দিকে চাহিয়া সুবলার বৌ শিহরিয়া উঠিল। নিশীথ রাত্রির স্তব্ধতার মাঝে মুখখান একেবারে অপার্থিব আকার ধারণ করিয়াছে। ক্ষণেকের জন্য তার মনে একটা সন্দেহ উঁকি দিয়া গেল, এ কি সেই, নয়া গাঙ্গের বুকে যাহাকে ডাকাতে লইয়া গিয়াছিল!

দিনের আলোতে যাকে সত্য ও বাস্তব মনে করা যাইত, রাতের গহনে তাকেই অবাস্তব রহস্তে রূপায়িত করিয়া দেয়। সুবলার বৌর বাস্তববুদ্ধি লোপ পাইল। নিশার গহনত তার কল্পনার দূরত্বকে অস্পষ্ট করিয়া দিল। তার মনে হইল, হাঁ সে-ই। তবে রক্তমাংসের মানুষ সে নয়। তার প্রেতাত্মা।

মঙ্গলার-বৌ কাছে না থাকিলে সুবলার বৌ চিৎকার করিয়া উঠিত।

মঙ্গলার বৌ তার ভাবান্তর লক্ষ্য করিয়া মনে করিল, ছেমড়ির ঘুম পাইয়াছে। বলিল, ‘যা লা সুবলার বৌ, অনন্তর পাশে গিয়া শুইয়া থাক?’

শুইয়া, ঘুমন্ত অনন্তকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া সুবলার বৌ বুঝিতে পারিল এতক্ষণে সে বাস্তবের মৃত্তিক-স্পর্শ পাইয়াছে।

সকালে পাগল আবার যা ছিল তাই হইয়া গেল।

অনন্তর মা রাতে চোখ বুজে নাই। সুবলার বউ, মঙ্গলার বউ, অনন্ত অকাতরে ঘুমাইতেছে। আর ঘুমাইতেছে বুড়ি। বুড়া রাতের জালে গিয়াছে, আসিতে অনেক দেরি হইবে। বেলা হইয়াছে। কিন্তু অনন্তর মার দিকে কেহই চাহিয়া থাকে নাই। তার বুক ধড়াস ধড়াস করিতে লাগিল। একখানি ধুচনিতে কয়েক খানি পিঠা তুলিয়া পরিপাটি করিয়া সাজাইল। মনে চিন্তার ঢেউ। পাগলের চোখে সারারাত ঘুম ছিল না। বারান্দায় বেড়া-দেওয়া খুপড়িতে সে ছিল। দা দিয়া মেঝের মাটি চষিয়া ফেলিয়াছে। অনন্তর মা তার সামনে গিয়া দাঁড়াইল। সে ঘাড় তুলিয়া চাহিল, দা উচাইয়া কোপ মারিতে আসিল। অনন্তর মা নড়িল না। এক হাতে ধুচনি আগাইয়া দিল আরেক হাতে তার পিঠে মাথায় স্পর্শ করিতে লাগিল। কোনো সুন্দরী যেন বনের এক জানোয়ারকে বশ করিতে যাইতেছে। পাগল তার দায়ের উদ্যত কোপ থামাইল, কিন্তু শান্ত হইল না। দায়ের ঘাড়ের দিকটা দিয়া অনন্তর মার পিঠে আঘাত করিল। অনন্তর মা ভ্ৰক্ষেপ করিল না। একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া একখানা পিঠা তার মুখে তুলিয়া দিল। পাগল মুখ ফিরাইয়া উঠানে নামিল, নামিয়া একদিকে দৌড় দিল।

অনন্তর মার বুক আশায় ভরিয়া উঠিল। তার পাগল হয়ত একদিন ভাল হইয়া যাইবে।

সেদিন সুবলার বৌর গলা জড়াইয়া অনন্তর মা অনেকক্ষণ কাঁদিল। কিন্তু সুবলার বৌ এ কান্নার কোনো অর্থ খুঁজিয়া পাইল না।

মাঘের শীত গিয়া ফাল্গুনের বসন্ত আসিল। পাগলের বাড়ির মন্দার গাছে প্রায়ই একটা কোকিল ডাকে। অনন্তর মা সুযোগ পাইলেই গিয়া দাঁড়ায়। তাকে এক নজর দেখিয়া আসে। কিন্তু দেখা দেয় না, চোরের মত যায়, পাছে পাগলের নিকট নিজে ধরা পড়ে। চৈত্রের শেষে বসন্ত যাই যাই করিতেছে। এমন সময় আসিল দোল পূর্ণিমা। উত্তরের শুকদেবপুরের মত এ গায়ের মালোরাও দোল করিল, হোলি-গান গাহিল। সুবলার বৌ নিজে স্নান করিল, অনন্তকে, তার মাকে স্নান করাইল। পরে অনন্তকে দিয়া বাজার হইতে আবির আনাইয়া বলিল, ‘চল দিদি উত্তরের আখড়ায় রাধামাধবেরে আবির দিতে যাই।’

রাধামাধব জ্যান্ত কেউ নয়। বিগ্রহ। তাকে আবির দিলে কি হইবে। সে তো আর পাল্টা আবির দিতে পারিবে না। চুপ করিয়া থাকিবে আর যত দেও তত আবির গ্রহণ করিবে। তবু এতে নূতনত্ব আছে। দশজন স্ত্রীলোকের মাঝে মিশিয়া একটু আনন্দ করা যাইবে। অনন্তর মা বলিল, ‘চল যাই।’

পাগলের উঠান দিয়া পথ। কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া পথ আগলাইয়া দাঁড়াইল। আব্দার ধরিল, ‘আ গোপিনী, আমারে আবির দে।’

সুবলার বৌ বিরক্ত হইয়া বলিল, ‘ভারি আহ্লাদের পাগল। তারার পাগল তারা বাইন্ধা রাখতে পারে না। কয়, পরের পাগল হাততালি, আপনা পাগল বাইন্ধ রাখি। ছাইড়া দেয় কেনে? পাড়াপড়শীরে জাদ করার লাগি ’ সে কোনমতে পাশ কাটাইয়া বিপদ হইতে মুক্তি পাইল। অনন্তর মা তার পিছনে ছিল। আবেগে চঞ্চল হইয়া এক ঝাকা চুলদাড়ির উপর মুটামুঠ আবির মাখাইয়া দিল। চোখের কোণে রহস্য করিতে করিতে পাগল বলিল, ‘আমার আণবির কই হি হি হি? বলিয়া সে এক ধাক্কায় আবিরের থালা অনন্তর মার হাত হইতে মাটিতে ফেলিয়া দিয়া ঘরে গিয়া দরজা বন্ধ করিল।

সুবলার বৌ হতবুদ্ধি হইয়া বলিল, ‘একি করলা তুমি দিদি।‘

অনন্তর মা হাসিয়া বলিল, ‘আইজকার দিনে সকলে সকলেরে রাঙাইছে। পাগলেরে ত কেউ রাঙাইল না ভইন। আমি একটু রাঙাষ্টয়া দিলাম।‘

‘কেউ যদি দেখত?‘

‘ত হইলে কইতাম তারে, পাগলে আমারে পাগলিনী করছে।’

‘মস্করা রাখ দিদি। কোন দিন তোমারে ধইরা পাগলে না জানি কি কইরা বসে, আমি সেই চিন্তাই করি দিদি। কি কারণে পাগল হইছে সেই কথাখান ত তুমি জান না।’

‘জানি গো জানি, মনের মানুষ হারাইয়া পাগল হইছে।’

‘তুমি ত তার মনের মানুষ মিলাইয়া দিতে পার না।’

‘তা পারি না। তবে চেষ্টা কইরা দেখতে পারি, আমি নিজে তার মনের মানুষ হইতে পারি কিনা?’

‘বসন্তে তোমার মন উতালা করছে দিদি। তোমার অখন একজন পুরুষ মানুষ দরকার।’

অনন্তর-মা কথাটা মানিয়া নিয়া চুপ করিয়া রহিল। প্রতিবাদ করিয়া কথা বাড়াইল না। মার আঁচল ধরিয়া অনন্ত চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। তার দিকে ইশারা করিয়া চাপাগলায় বলিল, ‘যা-তা কইও না ভইন। পুলা রইছে, দেখ না?’

অনন্ত আমোদ পাইতেছে। রূপকথার রাজ্যের লোকের ‘মত পাগলটার চেহারা। আর তার মা ওটাকে আবির মাখাইতেছে। পাগলটা আবিরের থালা ফেলিয়া দিয়াছে। মার আতগুলি আবির নষ্ট হইয়াছে। অনন্ত নত হইয়া মাটি হইতে আবির তুলিতেছিল। সুবলার বউ তার একখানা হাতে ধরিয়া জোরে সোজা করিয়া বলিল, ছত্তোরি, যামুন রাধামাধবেরে আবির দিতে। তারে আবির দিয়া লাভ কি। আয়রে অনন্ত।’

ঘরে গিয়া সে অনন্তকে আবির মাখাইল, চুমা খাইল, বুকে চাপিয়া ধরিল, ছাড়িয়া দিয়া আবার বুকে চাপিয়া ধরিল। অনন্তর মুখখান সুন্দর, চোখ দুটি সুন্দর, শরীরখানা সুন্দর। যখন কথা বলে কথাগুলি সুন্দর। যখন কোনদিকে চাহিয়া থাকে তখন তাকে অনেক অনেক বড় মনে হয়।

‘না দিদি, মন ঠাণ্ডা কর। পুরুষ মানুষ দিয়া কি হইব। তারা বৃষ্টির পানি-ফোটা, ঝরলেই শেষ। তারা জোয়ারের জল। তিলেক মাত্র মুখ দিয়া নদীর বুক শুইন্যা নেয়। এই অনন্তই আমরার আশা ভরসা। দুইজনে এরেই মানুষ কইরা তুলি চল। এ-ই একদিন আমরার দুঃখ ঘুচাইব।‘

অনন্তর মা যখন সূতা কাটিতে বসে, বৈশাখের উদাস হাওয়া তখন সামনের গাছগাছালি হইতে শুকনা পাতা ঝরাইয়া লইয়া তার ঘরে আসিয়া ঢোকে। এই সময়ের দমকা হাওয়া অনেককেই চমকাইয়া দেয়। অনন্তর মার বুকের শূন্যতাটুকু তখন বেশি করিয়া তার নিজের কাছে প্রকাশ হইয়া পড়ে। কিন্তু হাওয়া উদাস হইলে কি হইবে। বড় দুরন্ত। খামক কতকগুলি ঝরাপাতা রাখিয়া দিয়া তার ঘরখানাকে নোংরা করিয়া যায়। ঝাঁটাইয়া দূর করিয়া দিয়াও উপায় নাই, সে সে করিয়া সেগুলি আবার ঘরেই ঢুকিয় পড়ে। ‘তুত্তোর মরার পাতার জালায় গেলাম।’—নিরুপায় হইয়া সে দরজা বন্ধ করিয়া দেয়। এমন সময় এক ঝাপট দমকা হাওয়ার মতই অনন্ত আসিয়া উপস্থিত হয়। আম কুড়াইতে গিয়াছিল। এ হাওয়াতে গাছের পাতা যেমন ঝরে, তেমনি আমও ঝরে। তুই হাতে যাহা পারিয়াছে, বুকের সঙ্গে চাপিয়া ধরিয়া তাহাই নিয়া আসিয়াছে। দরজা বন্ধ দেখিয়া ডাক দেয়, মা, ছুয়ার ঘুচা, দেখ, কত আম। এই ডাকে সাড়া না দিয়া পারে না। দরজা খুলিয়া তাকে ঘরে নেয়। দেখি! কত আম। তোর মাসিরে ডাক দিয়া আন। অনন্ত একদৌড়ে ছুটিয়া যায়। সে ডাকে সুবলার বৌও সাড়া না দিয়া পারে না।

বর্ষায় খুব কষ্টে পড়িল। অনন্তর মা খায় কি। এই সময়ে মাছ খুব পড়ে। কিন্তু তার আগেই সকলের জাল বোনা শেষ হইয়া যায়। তারপর আর কেউ সূতা কিনিতে আসে না।

সূতাকাটাতে আর হাত চলে না। বিক্রি হয় না, কাটিয়া কি লাভ! তার সংসার অচল হইয়া পড়িতেছে। পেট ভরিয়া খাইতে না পারিয়া অনন্ত দিনদিন শুখাইয়া যাইতেছে।

সুবলার বৌ মা-বাপের চোখ এড়াইয়া এক আধ ‘টুরি’ চাউল আনিয়া দেয়, দুই একটা তরিতরকারি, এক-আধটা মাছ, একটু মুন, তেল, কয়েকটা হলুদ। তাতেই বা কত চলিবে। তাও বেশি দিন দিতে পারিল না। একদিন হাতেনাতে ধরা পড়িয়া গেল। মা-বাপের সংসারে পড়িয়া আছে সে। জলের উপরে ভাসিতেছে। পা বাড়াইয়া মাটির কঠিনতা সে কোনোকালে পাইল না। সে আর কি করিবে। মা বকিল, বাপে বকিল। সকল গালমন্দ সে মুখ বুজিয়া সহিয়া লইল। তারা তাকে অনন্তর মার বাড়ি আসিতে নিষেধ করিল। সে নিষেধ মানিয়া নেওয়া ছাড়া তারও কোনো উপায় রহিল না।

অনন্তর মা কোনোদিকে চাহিয়া ভরসা দেখে না। খড়ের চাল ফুটা হইয়া গিয়াছে। রাতদিন জল ঝরে। বেড়া এখানে ওখানে ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। হু হু করিয়া ঠাণ্ডা বাতাস ঢোকে। পরণের কাপড়খানাতে ভাল করিয়া কোমর ঢাকিতে গেলে বুক ঢাকা পড়ে না, বুক ঢাকিতে গেলে উরুদুইটির খানে খানে ফরসা চামড়া বাহির হইয়া পড়ে। যেখানটাতে জল পড়ে না, তেমন একটু জায়গা দেখিয়া অনন্তকে লইয়া  চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। কাঁথা বালিস ভিজিতেছে লক্ষ্য করিয়া সেগুলিকে কাছে নিয়া আগলাইয়া বসে। এভাবে অনন্তর মার দিন আর কাটিতে চায় না।

সুবলার বৌর মতিগতি খারাপ হইয়া যাইতেছে। একদিন তার মা ইহা আবিষ্কার করিল। পশ্চিম পাড়াতে থাকে, বাঁশের ধনু মাটির গুলি লইয়া পাখি মারিয়া বেড়ায়, মাথায় বাবরি চুল, নাম তার ময়না। আঁস্তাকুড়ের পাশের ছিটুকি গাছের জঙ্গল। ময়না সেখানে একটা পাখিকে তাক করিয়াছিল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়াতে গুন গুন করিয়া গান ধরিয়াছিল, ‘টিয়া পাললাম, শালিখ পাললাম, আরও পাললাম ময়না রে। সোনামুখী দোয়েল পাললাম, আমার কথা কয় না রে।‘ সুবলার বউ আঁস্তাকুড়ে জঞ্জাল ফেলিতে গিয়া তার সঙ্গে হাসিয়া কথা কহিয়াছে। আর তার মা নিজের চোখে দেখিতে পাইয়াছে। দেখিয়া, রাগে গরগর করিতে করিতে, বুড়া বাড়ি আসিলে তাহাকে বলিয়া দিয়াছে।

দুইজনের ঝগড়া বকুনির পর সুবলার-বেয়েরও মুখ খুলিয়া গেল, ‘আমি ময়নার সাথে কথা কমু, তার সাথে পুরীর বাইর হইয়া যামু। তোমরা কি করতে পার আমার। খাইতে দিব না, খামু না, পরতে দিব না, পরুম না। কিন্তুক আমি বাইর হইয়া যামুই। তোমরার মুখে চুনকালি পড়ব, আমার কি। আমার তিন কুলে কারুর লাগি ভাবনা নাই। একলা গতর আমি লুটাইয়া দেমু, বিলাইয়া দেমু, নষ্ট কইরা দেমু, যা মনে লয় তাই করুম, তোমরা কথা কইতে পারব না। মনে কইরা দেখ কোন শিশুকালে বিয়া দিছল। মইরা গেছে। জানলাম না কিছু, বুঝলাম না কিছু। সেই অবুঝকালে ধর্মে কাঁচারাড়ি বানাইয়া থুইছে। সেই অবধি পোড়া কপাল লইয়া বনেবনে কাইন্দা ফিরি। তোমরা ত সুখে আছে। তোমরা কি বুঝ বা আমার দুঃখের গাঙ, কত গহীন। আমার বুঝি সাধ আহ্নাদ নাই। আমার বুঝি কিছুর দরকার লাগে না।‘

‘হারামজাদী পোড়ামুখী কয় কি রে, বলিয়া দীননাথ আগুন হইয়া খড়ম আনিতে গেল। পরিবার তাহাকে মানাইয়া বলিল, ‘তুমি অখন বাইর হইয়া যাও। আমার মাইয়ারে আমি সমঝামু।‘

মা সান্ত্বনার স্বরে মেয়েকে বলিল, ‘পোড়াকপালি, তুই কি দশজনের বৈঠকে তোর বাপেরে ভক্তি দেওয়াইতে চাস। তার মান ইজ্জত আছে না?’

‘আছে ত আছে। তাতে আমার কি এমন সাতবংশ উদ্ধাব পাইছে? ভাবছিলাম আমারই দুঃখের দুঃখী অনন্তর মার মত সার্থী পাইয়া, অনন্তর মত ছাইলা কোলে পাইয় সব জ্বালাযন্ত্রণা জুড়ামু। তোমরা আমারে তার কাছে যাইতে দিবা না। দিবা না যখন, আমি মানুষ ধরুম। দেখি তোমরা কদিন আমারে ঘরে বাইন্ধা রাখতে পার।’

‘অ-লো পোড়াকপালি, অখনই যা। অনন্তর মার কাছে তুই অখনই যা। তবু পুরুষ মানুষ থাইক্য মনটারে ফিরাইয়া রাখ।‘

‘মা, তুমি ত জান, আজ দুই দিন অনন্তর মার পেটে দানাপানি নাই।’

‘লইয়া যা। দুই টুরি চাউল লইয়া যা। একটা ঝাগুর মাছ আছে, লইয়া যা। আর যা যা তোর মনে লয়, লইয়া যা। অ-লো, অখনই যা।’

‘মা! অনন্তর মার কাপড়খানা ছিড়া রোঁয়া রোঁয়া হইয়া গেছে। আমার ত তিনখান কাপড়। একখান দেই?’

‘তোর ঠাকুরের কাছে জিগাইয়া পরে কমু, তুই অখন যা। না না, শুন, তোর ঠাকুরেরে জানাইবার কাম নাই। অনন্তর মারে একটা কাপড় তুই দিয়া দে।‘

সুবলার বৌয়ের পুরুষমানুষের অভাব সেই মুহুর্তেই মিটিয়া গেল।

ভাদ্রমাসে মাছের পুরা জো। এ সময় কাটা সূতার দর বাড়িয়া গেল। মাছের গুঁতায় অনেক নূতন জাল ছিন্নভিন্ন হইয়া যায়। জেলেরা দামের দিকে চায় না। মোটা চিকন মাঝারি সবরকম সূতা। তার যে-কোন দামে কিনিয়া নেয়। অনন্তর মার সকল সূতা একদিনে বিক্রি হইয়া গেল। তার একদণ্ড কথা বলার অবসর নাই। টেকো তার ঘুরিয়াই চলিয়াছে। একদিন লক্ষ্য করিয়া দেখিল, টেকোতে পাক দিতে দিতে তার গৌরবর্ণ উরুতে কালো দাগ বসিয়া গিয়াছে। এত সূতা সে কাটিয়াছে। এত সব সূতায় তারই ঘরে জাল তৈয়ার হইতে পারিত। সে জালে সারারাত মাছ ধরার পর বিহানে তার ঘরে ঝাঁকাভরা মাছ আসিত! কোঁচড়ভরা টাকা পয়সা আসিত! আর-সব লোকের বাড়িতে কত সমারোহ। তাদের পুরুষেরা কিসিম বলিয়া দেয়, নারীরা সেই অনুযায়ী সূতা। কাটে। ভাল হইলে পুরুষেরা কত সুখ্যাতি করে। পাকাইতে গিয়া, ছিঁড়িয়া গেলে, মিষ্ট কথায় কত গালি দেয়। নারীরা মুখ ভার করিয়া বলে, যে-জন ভাল সূতা কাটে তারে নিয়া আসুক। কোন্দলের পরে ভাব হইয়া ঘরখানা মধুময় হইয় উঠে। সে-সকল ঘরে পাঁচ রকমের কাজ হয়। আর তার ঘরে হয় কেবল এক রকম কাজ। সূতা কাটা।

সুবলার বৌকে পাইয়া অনন্তর মা মনের আবেগ ঢালিয়া দেয়, ‘তুমি না কইছিল ভইন আমার একজন পুরুষ চাই। হ, চাই-ইত। পুরুষ ছাড়া নারীর জীবনের কানাকড়ি দাম নাই।’

‘পুরুষ একটা ধর না।’

‘কই পাই।’

‘পাগলারে ধর।’

‘ধরতে গেছলাম। ধরা দিল না।’

‘ঠিসারা কইর না দিদি।‘

‘আমি ভইন ঠিসারা করি না। সত্য কথাই কই। পাগল। যদি আমারে হাতে ধইরা টান দেয়, আমি গিয়া তার ঘরের ঘরনী হই। আর ভাল লাগে না।’

সুবলার বউ হতবুদ্ধি হইয়া যায়, ‘অত মানুষ থাকতে এই পাগলার দিকে নজর গেল তোমার? অত যদি মন উচাটন হইয়া থাকে, জল আনতে গিয়া যারে মনে ধরে চোখের ঠার দিয়ো! ‘

‘পুরুষ কি ভইন কেবল এর-ই লাগি? পরের ঘরে চাইয়া দেখ, সংসার চালায় পুরুষে। নারী হয় তার সঙ্গের সাখী। আমার যত বিড়ম্বনা ’

‘না দিদি, তুমি পাগলের লাগি পাগলিনী হইয়া গেছ। এই পাগলেই একদিন তোমারে খাইব। আচ্ছা, সত্য কইরা কও তো দিদি, পাগলে যারে হারাইছে, সে জনা কি তুমি?’

‘পাগলে কারে কই হারাইছে, তার আমি কি জানি। আমি কেবল জানি, এক্‌লাজীবন চলে না। পাগলেরে পাইলে তারে লখ্‌ কইরা জীবন কাটাই।’

সুবলার বউ দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়িয়া বলে, ‘আমারও দিদি সময় সময় মন অচল হইয়া পড়ে। কিন্তু আমি পতিজ্ঞা কইর রাখ্‌ছি, এই ভাবেই চালামু।‘

তার সঙ্গে অনন্তর মার তফাৎ আছে। ভবানীপুরে যতদিন ছিল তখন তার বুক ভরিয়া ছিল একদিকে অনন্ত, আর একদিকে শিশুর মত সরল দুই বুড়া। তিলেকের জন্যও কোনোদিন অনন্তর মার মন বিচলিত হয় নাই। মন তার বিচলিত আজকেও হয় নাই। নিজেকে শুধু সে শ্রান্ত ক্লান্ত বোধ করিতেছে। যে আলোক-স্তম্ভ লক্ষ্য করিয়া এতদিন সে পথ চলিয়াছিল আজ তার পাদদেশের অন্ধকারে দাঁড়াইয়া দেখে, তার আর এখন চলার শক্তি নাই। পাগল নিজে আসিয়া তার ভার নিক, নয় তো তাকে ঘরে ডাকিয়া নিয়া মারিয়া ফেলুক। সুবলার-বউর মধ্যে বিপ্লবী নারী বাস করে। কিন্তু অনন্তর মার মনে বাসা বাঁধিয়াছে এক সর্বনাশ৷ সাংসারিক কামনা। সে সংসারী হইতে চায়। সে আসিয়া তাহাকে লইয়া ঘর বাঁধুক। কিন্তু পাগল কি কোনোদিন কারো মনের কথা বোঝে।

সুবলার বউ একদিন বলিয়াছিল, তিন বছর আগে দুইজন বিদেশী নারীপুরুষ আসিয়াছিল। খালের পারে তার বাপকে পাইয়া তারা জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, রামকেশবের ছেলে কিশোর কোন বাড়িতে থাকে। আমাদিগকে সেই বাড়িতে নিয়া চল। সেই বাড়িতে আসিয়া দেখে ঘরে এক যম-কালে বুড়া আর এক শুকনা বুড়ি, আর, এক পাগল বারান্দাতে বসিয়া প্রেতকীর্তন করিতেছে। যাকে দেখিতে আসিয়াছে, তাকে দেখে না। পাগলকে চিনিতে পারিয়া তার হাত দুটি ধরিয়া বলে, ‘অ কিশোর, আমার মাইয়ারে কষ্ট লুকাইয়া রাখছ বাবা, কও।’ পাগল তখন ঠিক ভাল মানুষের মত বলে, ‘নয়া গাঙ্গের মুখে তারে ডাকাইতে লইয়া গেছে।’ তারা আর তিলেক বিলম্ব করে নাই। তখনই স্টেশনে গিয়া গাড়ি ধরিয়াছিল।

তার বাপ মা যাহা জানিয়া গিয়াছে, তারপর আর কোনোদিন তারা এদিকে আসিবে না।

এক বুড়া আছে। তাকে বাপ বলিয়া ডাক দিলে মেয়ের মত তুলিয়া নিবে। বলিবে আমার ঘরের লক্ষ্মী ঘরে আসিয়াছে। কিন্তু সব কথা শুনিয়া বলিবে ডাকাতে তোমাকে নষ্ট করিয়াছে। আমার ঘরে তোমার স্থান হইবে না। পাগল যদি কোনদিন ভাল হয়, সেও বলিবে, ডাকাতে তোমারে অসতী করিয়া ছাড়িয়া দিয়াছে। তুমি যে সতী, তার কোন প্রমাণ নাই। তখন আমার অনন্তর যে কোনো উপায়ই থাকবে না। অথচ ভগবান সাক্ষী, নৌকার ভিতর হইতে তুলিয়া নিবার সময় তারা একবার মাত্র ছু ইয়াছিল। তারপর তাকে বসাইয়া নৌকা চালাইবার সময় সে ঝুপ করিয়া জলে পড়িয়া গেল। জেলের মেয়ে। নদীর পারে বাপের বাড়ি। শিশুকাল হইতে সাতারের অভ্যাস। দম বন্ধ করিয়া এক ডুবে অনেক দূর যাইতে পারে। ডাকাতেরা তাকে আর পায় নাই। নদীর কিনারাতে গিয়া সে অচৈতন্য হইয়া পড়িয়াছিল। ভাগ্যে সে আর কারে হাতে না পড়িয়া গৌরাঙ্গ আর নিত্যানন্দ দুষ্ট বুড়ার হাতে পড়িয়াছিল। তারা দুই ভাই, ছোট নৌকায় বড় নদীতে মাছ কিনিতে যাইতেছিল। সকালবেলা তীরের দিকে চাহিয়া দেখে এই অবস্থা। জ্ঞান ফিরিয়া আসিলে তারা তাকে বলিয়াছিল, তুমি কি মা কোনো বামুন কায়েতের মেয়ে। সে বলিয়াছিল না বাবা আমি জেলের মেয়ে। তারা বলিয়াছিল তোমার বাপের বাড়ী কোথায়, কি করিয়া পাঠাইব। সে বলিয়াছিল সেখানে আর পাঠাইবার কাজ নাই। তোমাদের সঙ্গে লইয়া চল। এই তার ইতিহাস।

সে কি সব থাকিতেও এই অপরিচয়ের মধ্যেই নিঃশেষ হইয়া যাইবে। কিন্তু অনন্ত! সে তার বাপকে চিনিল না, তার বাপও তাকে চিনিল না, এ যে বড় নিদারুণ। সুবলার বউ কেবল একটা দিক বুঝিয়াই নাড়াচাড়া করে। সেও বুঝিবে না অনন্তর মার কতদিক ভাবিয়া দেখিতে হয়।

একটা ধারণা কি জানি কেন তার মনে বদ্ধমূল হইয়াছে যে পাগল একদিন ভাল হইয়া যাইবে। রোজ রোজ অনন্তর মাকে দেখিতে দেখিতেই তার মাথা ঠিক হইয়া যাইবে। তাকে দেখিয়া মুগ্ধ হইবে, পরোক্ষে তার সেবা পাইয়া তার প্রতি দরদী হইয়া উঠিবে। অনন্তর মাকে ভাল করিয়া কোনোদিন সে দেখে নাই। সে নিজে বলিয়া না দিলে ও কিছুতেই চিনিতে পারিবে না। যারা চিনিতে পারিত সেই তিলক, সুবল,— তারা এখন স্বর্গে। কি ভাল মানুষ তারা ছিল। কতভাবে তার সাহায্য করিয়াছে। ওর সঙ্গে তারা কত আত্মজনার মত কাজ করিয়াছে। তারা স্বর্গ হইতে আশীৰ্বাদ করুক, পাগল যেন তাকে না চিনিয়া ভালবাসিয়া ফেলে। সেই ভালবাসারই সূত্র ধরিয়া সে যেন পাগলের ঘরনী হইতে পারে একটা নতুন কাজ হইবে। লোকে নিন্দা করিবে। কিন্তু এ নিন্দ সহ করা অসাধ্য হইবে না। তা ছাড়া, দেশে দেশে একটা কথা উঠিয়াছে বিধবাদের বিবাহ দেও। পুরুষ যদি বউ মরিলে আবার বিবাহ করিতে পারে, নারী কেন স্বামী মরিলে আবার বিবাহ করিতে পারিবে না। তার স্বামী কি মরিয়াছে? হা, তার স্বামী স্মৃতির দিক দিয়া মনের দিক দিয়া এখন মরিয়া আছে। সেই দিন তার পুর্নজন্ম হইবে। সে নিজেও সব জানিয়া শুনিয়া জড়ভরত হইয়া আছে। তাও প্রায় মরিয়া থাকারই মত। সেদিন তার ও নবজন্ম হইবে। আর অনন্ত। তার কি হইবে। অনন্ত কার পরিচয়ে সংসারে মুখ দেখাইবে। সে সমস্যার ও সমাধান হইবে। তাকে একটা রূপকথা শুনাইব।—অর্থাৎ আসল কথাটাই, যা ঘটিয়াছে সেই সত্য কথাটাই তাকে শুনাইয়া রাখিব। সে তাতে আমোদই শুধু পাইবে না, মার সাহসের কথা, কষ্ট সহ করার ক্ষমতার কথা শুনিতে শুনিতে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া যাইবে। গৌরব বোধ করিবে মার জন্য। পাগলকেও তুনিয়ার অজানা এমন সব স্মৃতিকথা শুনাইব যে, সে তার মনের গভীরে বিশ্বাসকে ঠাঁই না দিয়া পরিবে না, এই তার সেই মালাবদলের বউ। সেবায় যত্নে মুগ্ধ করিয়া, হাসিতে খুশিতে তার মন পূর্ণ করিয়া, ওর জীবনে তার অপরিহার্যতাকে কায়েম করিয়া নিয়া, একদিন সে সত্যের মূর্ত ব্যঞ্জনার মধ্যে দিয়া জানাইবে ডাকাতেরা তার কেশাগ্রও স্পর্শ করে নাই। সেই রাত্রিতেই সে নদীতে পড়িয়া সব কিছু বাঁচাইয়াছে। তার পাগল নিশ্চয়ই ভাল হইয়া উঠিবে।

শীতের সময়ে পাগলের অবস্থা নিদারুণ খারাপ হইয়া গেল। বাঁধিয়া রাখা যায় না। ঘরের জিনিসপত্র তো আগেই ভাঙ্গিয়াছে। এখন পরের জিনিসপত্রও ভাঙ্গিতে শুরু করিয়াছে। পথের মানুষকে ডাকিয়া আনিয়া মারে। পাগলামির এ অবস্থা বড় ভয়ানক।

তার বাপ গলা ছাড়িয়া কাঁদে। সহিতে না পারিলে মারে। মারের দরুণ দেহে জখমের অন্ত নাই।

একদিন কোথা হইতে আর এক পাগল আসিয়া জুটিল। দুই পাগলে মিলিয়া তামাক খাইল এবং অনেক হাসির কাণ্ড করিল। সে-পাগল যাইবার সময় কিশোরের জখমগুলির উপর আরও জখম করিয়া গেল। সেই হইতে কিশোরের মাথায় এক দুবুদ্ধি চাপিয়াছে। সে নিজের গায়ে নিজে জখম করিয়া চলিল। তার গায়ে এত জখম হইল যে, তার দিকে আর তাকানোই যায় না। অনন্তর মা কুলের বাধা লাজের বাধা ঠেকাইয়া কাজে নামিল। সে নিজে ঘোরাঘুরি করিয়া এক কবিরাজের কাছ হইতে গাছগাছড়ার ওষুধ আনিল। সাবানে গরমজলে ঘা ধুইয়া সে ওষুধের প্রলেপ দিল। প্রথম প্রথম তাকেও খুব মারধর করিত। শেষে শ্রান্ত হইয়া আত্মসমর্পণ করিল। লোকে দেখিল এক সুন্দরী একটা পোষা জানোয়ারকে সেবা যত্নে আবেগে দরদে ভাল করিয়া তুলিতেছে। মুখে কেউ কিছু বলিল না। অনন্তর মার বড় দয়ার শরীর, এই সুমন্তব্য করিয়াই নীরব রহিল। একটা লোক মরিতে যাইতেছে, মানবতার খাতিরে এক নারী পর হইয়াও আপন জনের মত ভাল সেবা যত্নে বাঁচাইয়া তুলিতেছে, এতে দোষ নাই, ঈশ্বর সন্তুষ্ট হয়। এতে ধর্ম হয় পুণ্য হয়, আর, একজনার পুণ্যের জোরে সারা গায়ের কল্যাণ হয়—সুবলার বউ পরিচিত অপরিচিত সকল মহলে এই কথা জোর গলায় প্রচার করাতে কারও মুখ দিয়া কোন বিপরীত কথা বাহির হইল না।

শীতের শেষে পাগলের রূপ বদলাইয়া গেল। আশায় অনন্তর মার বুক ভরিয়া উঠিল। সুবলার বউ মুখে বিরক্তি প্রকাশ করিল, কয়েকটা ধারালো মন্তব্যে অনন্তর মাকে বিদ্ধ করিল। কিন্তু মন পড়িয়া রহিল কি এক দুজ্ঞেয় রহস্যকে হৃদয়ঙ্গম করার দিকে।

আবার বসন্ত আসিল।

অনন্তর মা একদিন তার মাকে বলিয়া দুই নারীতে ধরাধরি করিয়া তাকে ঘাটে লইয়া গেল। সাবান মাখাইয়া ঝাপাইয়া বুপাইয়া স্নান করাইল। প্রকাশু দিবালোকে। সারা গায়ের নারী-পুরুষে চাহিয়া চাহিয়া দেখিল। অনন্তর মা ক্ৰক্ষেপ করিল না। কেবল ভাবিল, সে তারই ছেলের বউ, বুড়ি যদি একথাটা একটিবার মাত্র বুঝিত।

একটা ভিন্‌-রমণীর সেবাযত্ন পাইয়া কিশোর যেন ক্রমেই আমোদিত হইয়া উঠিতেছে। অনন্তর মার বুক তুরু দুরু করিতে থাকে।

কিশোর তার সকল অত্যাচার সহানুভূতি দিয়াই সহ করিয়া ছিল, বাকিয়া বসিল নাপিত ডাকিয়া চুলদাড়ি সাফ করিবে শুনিয়া। পীড়াপীড়ি করিলে পাগলামি বাড়িয়া যায়। অনন্তর মা আর বেশি আগাইল না।

তারপর আসিল দোলের দিন। অনন্তর মার কাছে এটি একটি শুভযোগের দিন। এই দিনটি তার জীবনের পাতায় গভীর দাগ কাটিয়া লেখা হইয়া আছে।

মালোরা সেদিন সকাল সকাল জাল তুলিয়া বাড়ি আসিল, আসিয়া তারা হোলির আসরে বসিয়া গেল। ঢোলক বাজাইয়া গান ধরিল, বসন্ত তুই এলিরে, ওরে আমার লাল ত এলো না? এগানের পর আর একজন ঘাড় কাত করিয়া গালে হাত দিয়া ওস্তাদি ভঙ্গিতে যে গান গাহিল, তার ধুয়া হইতেছে, ‘তালে লালে লালে লালে লালে লালে ল’লে লাল? যেন তার আকাশ ভুবন একেবারে লাল হইয়া গিয়াছে। কিন্তু এটা বোল। আগে শুধু বোলটাই গাহিয়া, শেষে উহাকে কথা দিয়া পূরণ করিল, ব-স-ন-তে-রি জ্বালায় আমার প্রাণে ধৈ-র্য মানে না। মূল গায়েন আবার বোল চালাইল, তালে লালে লালে লালে ইত্যাদি।

অনন্তর মার কুটির খানাও লালে লাল। তার ঘরে অনেক আবির আসিয়াছে। সুবলার বউ বহু যত্ন করিয়া আবিরের থালা সাজাইয়া আনিয়াছে। অনন্তকে আজ একেবারে লালে লাল করিয়া দিবে। বেচারা না বলিবার অবসর পাইবে না। আবির দিতে গিয়া তার বুক কাঁপিয়া উঠিল। ছেলেটা যেন অনেক খানি বড় হইয়াছে। গালেমুখে আবির মাখাইতে চোখ দুটির দিকে দৃষ্টি পড়িল। সে চোখ যেন আরেক রকম হইয়া গিয়াছে। সহজ ভাবে যেন চাওয়া যায় না। সুবলার বউ দুরন্ত। সে দমিতে জানে না। সব কিছু অগ্রাহ করিয়া চলিতে ভালবাসে। এবারও সে তাকে বুকে চাপিয়া চুমু খাইল। কিন্তু এবার সে আর তাকে ছোট গোপালটির মত সহজ ভাবে নিতে পারিল না। এবার যেন আব এক রকমের অনুভূতি আসিয়া তার মনের যত সরলতা কাড়িয়া নিতেছে। তার চোখ বুজিয়া হাত দুটি আলগা হইয়া আসিল। কিন্তু অনন্তর হাত দুটি একখানি ফুলের মালার মত তখনও মাসির গলা জড়াইয়া রাখিয়াছে।

অনন্তর মা ভাবিতেছে আরেক কথা। তাদের প্রথম প্রেমাভিষেকের দিনটিকে সে কি ভাবে সার্থক করিয়া তুলিবে। সে পাগলকে এমন রাঙানো রাঙাইবে যে, তাতে করিয়া তার সে দিনের সেই স্মৃতি মনে জাগিয়া উঠিবে, তার পাগলামি সে নিঃশেষে ভুলিয়া গিয়া পরিপূর্ণ প্রেমের দৃষ্টিতে তার প্রেয়সীর দিকে নয়নপাত করিবে। সে বড় সুখের বিষয় হইবে। তখনকার অত আনন্দ অনন্তর মা সহিতে পারিবে ত? সেদিনের মত আজও তার পা কাঁপিয়া বুক তুরু হুরু করিয়া উঠিবেন ত?

সুবলার বউ আর অনন্তর দৃষ্টি এড়াইয়া এক সময়ে অনন্তর মা পথে নামিল। ওদিকে দোলের উৎসব বাড়িতে হোলির গান তখন তালে-বেতালে বেসামাল হইয়া চলিয়াছে।

কিশোর রঙ পাইয়া প্রথম প্রথম খুব পুলকিত হইয়া উঠিল। অনন্তর মার চোখে তাকে আজ কত সুন্দর দেখাইতেছে। আজ যদি সেই দিনটি তার মাধুর্য লইয়া, ঠিক ঠিক প্রতিরূপ লইয়া, ফিরিয়া আসে। অনন্তর মা অনেক কিসসা-কাহিনী শুনিয়াছে প্রিয়জনের শোকে মানুষ পাগল হইয়া যায়, প্রিয়জনকে পাইলে আবার তার পাগলামি দূৰ হয়। এও শুনিয়াছে, প্রিয়দিনগুলির স্মৃতি জাগাইতে পারিলেও পাগলামি দূর হইয়া যায়। পাগলামি ত আর দেহের অসুখ নয় যে ডাক্তার কবিরাজের ওষুধ লাগিবে। ওটা আসলে অসুখই নয়, মনের একটা অবস্থা মাত্র। এই অবস্থার গতিবেগ ফিরাইয়া দিতে পারিলে পাগল আর পাগল থাকে না। অনন্তর মা আরও ভাবিয়া বাহির করিয়াছিল। পাগল যদি ভাল হইবার হয় তো এভাবেই ভাল হইবে। শুধু তার নিজেব পাগল নয়। দুনিয়ার সব পাগল যেন এভাবেই ভাল হইয়া যায়। এ ছাড়া পাগল ভাল করার আর কোন পথ নাই। যদি থাকিত, সকল পাগলই ভাল হইত। কিন্তু ভাল হয় না!

সেও কেন আমাকে দুই মুঠ আবির মাখাইয়া দিতেছে না। সে কি পাষাণ। সে কি বোঝে না তার মন কি চায়। হঁ বুঝিতে পারিতেছে ত। সেও ত একমুঠা আবির অনন্তর মার কপালে আর গালে মাখাইয়া দিল। কেউ ধারে কাছে নাই। বুড়ি ঝাঁপের ওপাশে ঝিমাইতেছে। বুড়া তার শ্বশুর গিয়াছে হোলি গাহিতে। এখানে কেউ নাই। এই বেড়া দেওয়া বারান্দা। তারা দুজনে এখানে একা। অনন্তর মা শক্তি সঞ্চয় করিয়া আপনাকে অটল করিয়া তুলিল।

কিন্তু শেষ দিকে কিশোর একেবারে পরিবর্তিত হইয়া গেল। তার পাগলামি আবার মাথা চাড়া দিয়া উঠিল। সে এক সাংঘাতিক কাণ্ড করিয়া বসিল।

সে ক্ষিপ্রগতিতে হাত বাড়াইয়া তার প্রেয়সীকে পাজাকোলা করিয়া তুলিল। তুলিয়া ঝড়ের বেগে উঠানে নামিয়া চীৎকার জুড়িল, লাঠি বাইর কর, ওরে লাঠি বাইর কর। সতীর গায়ে হাত দিছে, আইজ আর নিস্তার নাই। মার, কাট, খুন কর। একজন ও পলাইতে না পারে। কই, আমার লাঠি কই। দম নিয়া আবার গলা ফাটাইয়া বলিল, ‘তেল আনি, জল আন, তোমার মাইয়া মূর্ছা গেছে।‘

হোলির আসর ভাঙ্গিয়া লোকজন তখন ছুটিয়া আসিয়া পড়িয়াছে। কিশোর একবার লোকজনের দিকে আর একবার মেয়েটার দিকে চাহিতে লাগিল। তার চোখ দুটি আরও বড়, তার ও লাল হইয়াছে। মেয়েটার খোপ খুলিয়া গিয়া, সাপের মত লম্বা চুল মাটিতে লুটাইয়া পড়িয়াছে। বুকটা চিতাইয়া উঁচু হইয়া উঠিয়াছে। এত উঁচু যে, কিশোরের নাকের নিশ্বাসে তার আবরণটুকুও সরিয়া যাইতেছে। সে মূর্ছা গিয়াছে। তার বুকের কাপড় শীঘ্রই সরিয়া গেল। কিশোর পুরাপুরি পাগল হইয়া সে বুকে মুখ ঘষিতে লাগিল। দাড়ি গোফের জবর জঙ্গিমায় বুঝিবা সেই নরম তুলতুলে বুকখানা উপড়াইয়া যায়।

‘কি দেখতাছ রামকান্ত, কি দেখতাছ গঙ্গাচরণ, ধর ধর। পাগলের পাগলামি ছাড়াও?’

হোলির উদ্দীপনায় লোকগুলি আগে থেকেই উত্তেজিত ছিল। এবার সকলে মিলিয়া কিশোরকে আক্রমণ করিল। লাথি, চড়, কিল, ঘুষি, ধাক্কা এসব তো চলিলোই, আরো অনেক কিছু চলিল। যেমন, কয়েকজনে লাঠি আনিয়া তার দেহের জোড়ায় জোড়ায় ঠকিয়া ঠুকিয়া মারিল। তারপর কয়েকজনে বাহুতে ধরিয়া উপরে তুলিয়া উঠানের শক্ত মাটি দেখিয়া আছাড় মাড়িল। কয়েকজনে আবার চুলদাড়ি ধরিয়া উপরে তুলিল, তুলিয়া গোটা শরীরটা চারি পাশে ঘুরাইল। শেষে একবার দাড়ির গোড়া ছিঁড়িয়া, কিশোরের স্পন্দবিহীন দেহ উঠানের এক কোণে ছিটকাইয়া পড়িলে, মেয়ে লোকের গায়ে হাত দেওয়ার উচিত শাস্তি হইয়াছে, বলিতে বলিতে লোকগুলি নিরস্ত হইল। তারা এবার মূৰ্ছিত মেয়েটাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইয়াছে।

আক্রান্ত হওয়ার পূর্বক্ষণে কিশোরের চমক ভাঙ্গিয়াছিল। কি করিতেছে বুঝিতে পারিয়া মেয়েটাকে আস্তে মাটিতে নামাইয়া দিয়াছিল। মেয়ের তখন মূর্ছার চরম অবস্থা। কতকগুলি স্ত্রীলোক তেলজল পাখা লইয়া তার সংজ্ঞা ফিরাই বার চেষ্টা করিতেছে। এমন সময় সে চোখ মেলিয়া দেখে বাড়িঘর লোকে লোকারণ্য। কয়েকজনে তাকে সোজা করিয়া তুলিবার চেষ্টা করিলে সে আবার পড়িয়া যাইতেছিল। মুবলার বউ এতক্ষণ কোথায় ছিল কে জানে; উধ্বশ্বাসে ছুটিয়া আসিল, আসিয়া, নরনারীর মহারণ্য ভেদ করিয়া অনন্তর মাকে কোনো রকমে কাঁধের উপর এলাইয়া তার ঘরে আনিয়া তুলিল।

লোকগুলি তখন দলে দলে চলিয়া গেল। কিশোর উঠানের এক কোণে পড়িয়া ছিল। তার সংজ্ঞা ফিরাইবার জন্য কেউ চেষ্টা করিল না। এক সময় আপনার থেকেই সংজ্ঞা ফিরিয়া আসিল। উঠিতে চেষ্টা করিল, পারিল না। এত দিন পরে এই প্রথম সে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলিল, ‘বাবা, আমারে একটু জল দে। জল খাইয়া বলিল, ‘বাবা, আমারে ঘরে নে; আমি উঠতে পারি না।’

কিশোর রাত্রিটা কোন রকমে বাঁচিয়া ছিল। পরের দিন ভোর হওয়ার আগেই মরিয়া গেল। তার মা-বুড়ি এতদিন বোবা হইয়া ছিল। চোখের জল বুকের কান্না জমাট বাঁধিয়া গিয়াছিল। এবার তাহা গলিয়া প্রবাহের বেগে ছুটিল। সে অনেক কথা বলিয়া বলিয়া বিলাপ করিল, যেমন, মরিবার আগে জল খাইতে চাহিয়াছিল, সে জল সে ত খাইয়া গেল না। মরিবার আগে কি কথা যেন কহিতে চাহিয়াছিল, সে কথা সে ত কহিয়া গেল না।

অনন্তর মা মরিল চারদিন পরে। সেইদিনই তার জর হইয়াছিল। আর হইয়াছিল কি রকম একটা জ্বালা, কেউ জানে না কি রকম।

সারারাত ছটফট করিয়া সে মরিল ভোর হওয়ার পরে। সুবলার বেয়ের কোলে মাথা রাখিয়া চুপ করিয়া ছিল। আলো ফুটিতেছে, তারই দিকে চোখ মেলিয়া ছিল। . যে আলো ফুটিতেছে অনন্তর ভোরের আকাশ রাঙাইয়া।

জন্ম মৃত্যু বিবাহ এ তিনেতেই মালোরা পয়সা খরচ করে। সে পয়সাতে কাঠ আসিল, বাঁশ আসিল, তেল ঘি আসিল, আর আসিল মাটির একটি কলসী। সমারোহ করিয়া নৌকায় তুলিয়া তারা অনন্তর মাকে পোড়াইতে লইয়া গেল।

চিতাতে আগুন দিতে দিতে একজন বলিল, ‘পাগলে মানুষ চিন্তাই ধরছিল। চাইর দিন আগে মরলে এক চিতাতেই দুজনারে তুইল্যা দিতাম। পরলোকে গিয়া মিল্য। যাইত।‘

এক সময়ে তিনজনে মিলিয়া প্রবাসে গিয়াছিল। সেখান থেকে আরেকজনকে লইয়া তারা ফিরিয়া আসিতেছিল। এই চারিজন এইভাবে আগে পিছে মরিয়া গেল। তারা যে প্রবাসে গিয়া অত কিছু দেখিয়াছিল শুনিয়াছিল, অত আমোদ আহ্লাদ করিয়াছিল, অত বিপদে আপদে পড়িয়াছিল, সে ছিল একটা কাহিনীর মত বিচিত্র। এইকাহিনী যারা সৃষ্টি করিয়াছিল তারা এখন চলিয়া গিয়াছে। এ সংসারে আর তাদের দেখা যাইবে না।