(১)
অয়ন
শুনলো ফোনটা বাজছে। টেবিলের উপর থেকে মোবাইলটা নিতে যাবে, কলটা কেটে গেল। আননোন
নম্বর। ইদানিং তার প্রচুর রং কল আসছে। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যে কখনও বাদ নেই। ফোন
তুললে সেই দুটো কথা ভেসে আসে -স্যালাম, ইকবাল মিয়াঁ...... । কখনও পুরুষ কন্ঠে
কখনও নারী কন্ঠে। ভিন্ন ভিন্ন গলা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। প্রতিবার
অয়ন ‘রং নম্বর’ বলে । তবু ফোন আসে। সেই
একই কথা গুলো আবার ভেষে আসে। রাস্তার
ধারে পর্দাটা দুপুর থেকেই সরানো ছিল। অয়ন
নতুন নোবেলটা নিয়ে জানালার ধারে বসেছিল। অয়নের জানালার সোজাসুজি অনেকক্ষণ ধরেই কারা যেন
কি নিয়ে আলোচনা করছে ? সন্ধ্যে সাতটা
বাজে। স্ট্রীট ল্যাম্প গুলো অনেক আগেই জ্বলে গেছে। অয়নের বাড়ির সামনের ল্যাম্পটা
কিছুক্ষণ আগেই দপদপ করতে করতে নিভে গেছে। সাবধানের মার নেই। অয়ন জানলা দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। বৃথা
চেষ্টা, অন্ধকার তাদের মুখ গুলোকে ঢেকে দিয়েছে। অল্প আলো আর তাদের গলার ভাষাভাষা
স্বর তাদের অস্তিত্যকে জানান দিচ্ছে। অয়ন
টেবলের উপর থেকে কফির কাপটা তুলে নিয়ে একটা চুমুক দিয়েই মুখটা বিস্বাদে কুঁচকে
ফেলল। শিবুদা, কফিতে চিনি দ্যায়নি। কিছুক্ষণ আগে শিবুদা অয়নের জন্যে টেবিলের
উপর কফি রেখে গেছে বেড়িয়ে গেছে। নেহাত ভুলেই হয়তো চিনি দেয়নি। সদর দরজার কলিংবেলের শব্দে অয়ন ফিরে তাকালো
ড্রয়িংরুমের দিকে। এখন আবার কে এলো? তার চেনা জানা কেউ? দ্বিধাগ্রস্ত মনে নিশব্দে দরজার দিকে এগিয়ে গেল
অয়ন। দরজার ল্যাচ কী টা ধরে চাপ দিয়ে দরজা খুলতেই, কালো ছায়ার মতো এক নারী মূর্তি
নিমেশে ঘরের ভিতরে চলে এলো। -অবন্তিকা,
তুমি এভাবে? অয়ন বিষ্ময়ে বলে ওঠে। অবন্তিকা হাঁপাতে থাকে। তারপর নিজে কিছুটা
ধাতস্ত্য হয়ে বলে –এই এমনি, রাস্তার অন্ধকার, জোর পায়ে হেঁটে এলাম তাই...। গভীর উদ্বেগের মধ্যে একটা গভীর
শ্বাস ফেলল অবন্তিকা।
এক বছর আগে এক বাসস্টপে অয়ন অবন্তিকাকে প্রথম দেখেছিল। সাদা এপলিক করা কামিজ আর নীল জিন্স পরা ফর্সা একটি
সুন্দরী মেয়ে সেদিন বাসস্টপে এসে দাঁড়িয়েছিল। স্বভাবতই অভিকের
চোখ তার নতুন ফোন থেকে সরে সেই সুন্দরী মেয়েটার দিকে পরেছিল। মেয়েটি বিস্ময় চোখে
তার দিকে তাকিয়ে ছিল। যেন তাকে কোথাও দেখেছে মনে করতে পারছে না।
মেয়েটির সাথে তার পরিচয় নেই, এমনকি
আগেও কখনো দেখেনি তাহলে মেয়েটি তার দিকে এই রকমভাবে তাকিয়ে আছে কেন? অয়নের মেয়েটির উপর বেশ
কৌতূহল অনুভব করছিল। এর আগে অয়নের কখনো কোনো মেয়েকে নিয়ে এমন কৌতূহল হয়নি। বরং অনেক সময়ে তাকে ঘিরে সব মেয়েদের অকারণ
কৌতূহল অগ্রাহ্য করে বেড়িয়ে এসেছে। তাকে ঘিরে অন্যকারুর অকারণ কৌতূহল তারপর নিজের মতামত অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে
দিক এটা অয়নের পছন্দ নয়। সে কম কথা বলতে পছন্দ করে এবং দরকার ছাড়া কথা বলে না। একদিন এই নিয়ে তার
বান্ধবী রনিতার সঙ্গে রাগারাগিও হয়। রনিতা বলে বসে এন্টিক জিনিস পত্র সংগ্রহ মানেই
আবর্জনা সংগ্রহ, এর পরিবর্তে অন্য কিছু হবি করতে। সেদিন অয়ন রনিতার
সাথে রাগারাগি করে চলে আসে। পরে অবশ্য রনিতা অয়নের সাথে যোগাযোগ করার
চেষ্টা করেছিল অয়ন তাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি।
সেইদিন বাসস্টপের অচেনা মেয়েটি অবশ্য তার বান্ধবীর ডাকে তাদের গাড়িতে
করে চলে গিয়েছিল। সেদিন অয়নের মনে মেয়েটির প্রতি কৌতূহল রয়েই গেছিল। সম্পূর্ণ অপরিচিত
মেয়ের প্রতি কৌতূহল সেদিন নিজের কাছেই নিজেকে বড় অদ্ভুত লেগেছিল অয়নের। সে রোজই তো কত চেনা-অচেনা মানুষজন দেখছে, কৈ তখন তো কোন কৌতূহল হয়নি। তবে এখন কেন তার
এই রকম কৌতূহল হচ্ছে? তাও আবার সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি মেয়ের ক্ষেত্রে। হয়তো মেয়েটা নতুন
এসেছে এখানে বা এখানে কোন আত্মীয় বা চেনা
পরিচিত কেউ থাকে, দেখা করতে এসেছিল, অয়নকে কারুর সাথে গুলিয়ে ফেলে ভুল করছে। হতেই পারে, এই ধরনের ঘটনা ঘটেই থাকে এক্ষেত্রেও হয়তো তাই হয়েছে।
তারপর দুইদিন পরে হঠাৎ অয়নের সাথে আবার বাসস্টপে দেখা ওই মেয়েটার। একই পোশাক একই সময়। শুধু ওই দিন মেয়েটা
অয়নের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছিল। অচেনা মেয়েটির তাকে দেখে হাসার কারণ বড় অদ্ভুত
লেগেছিল অয়নের। তাকে কি হাস্যকর দেখতে? তাহলে সবাই হাসতো। মেয়েটা আবারও একই
ভুল করছে। মেয়েটির ভুল ভাঙ্গাতে গিয়েও কয়েক পা ফেলেও অয়ন থমকে
দাঁড়িয়ে পরলো। মেয়েটি কি ভেবেছে, তাকে দেখে হাসির কারণ কি, সেটা অয়নের বোঝা দূরহ। অয়নের যেটা মনে হয়েছে, সেটা হয়তো মেয়েটা ভাবেনি, অন্য কোনো কারণে হেসেছে। কথাতেই তো আছে 'দেবা না জানন্তি কুত্রাপি মনুষ্যা'? মানুষ কি ভাবে,
কি করবে, ভগবানই বলতে পারে না। তাই আগ বাড়িয়ে কিছু
বলতে গেলে তাকে পাগল না ভেবে বসে।
ওই দিন কলেজ শেষে অয়ন ফিরে আসছে বাড়িতে। সেই দিনের ক্লাস
গুলো বেশ ভালোই হয়েছে। নতুন একটা প্রোজেক্ট
পেয়েছে তার ই কাজ শুরু করবে বাড়ি গিয়ে। 'অয়ন দা!', একটি মেয়ের কণ্ঠস্বর শুনে অয়ন পিছন ফিরে
তাকালো। এইতো সেই মেয়েটা। এখানে ও কি করছে? অয়নের নামই বা জানলো কিভাবে? কেউ কি বলেছে?
এই মেয়েটাই বা তাকে ডাকছে কেন? বিস্ময়ে অয়ন মেয়েটার দিকে এগিয়ে
গেল।
-তুমি অয়ন দা না?
-হ্যাঁ।
-তুমি এখানে কি নিয়ে পড়ছো?
-কম্পিউটার সায়েন্স,
থার্ড ইয়ার।
-আমি এখানে ম্যাথ অনার্সে
ভর্তি হলাম।
-ও, আচ্ছা, কিন্তু আমি তো তোমাকে ঠিক.... অয়ন এখনো মেয়েটির দিকে বিস্ময়
নিয়ে তাকিয়ে।
-চিনতে পারোনি?
-না...
-আমি অবন্তিকা, তোমার পাড়ায়তেই তো থাকি। আমায় আগে দেখনি?
-না,মানে ঠিক খেয়াল করিনি।
অবন্তিকা হেসে ফেলেছিল। অয়নের অবন্তিকাকে চিনতে না পারাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সে একটু লাজুক স্বভাবের। সে মেয়েদের থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করে। খুব দরকার না হলে
কোন মেয়ের সাথেই বিশেষ কথা বলে না। এই তো কদিন আগে বন্ধুদের থেকে ফার্স্ট ইয়ারের
নতুন মেয়েদের সাথে আলাপ জমাতে যাওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিল। এ প্রস্তাব প্রথম
নয়। সে আগেও
এই ধরনের প্রস্তাব পেয়েছে। মেয়েদের দেখতে যাওয়ার কি আছে? এই কথাটা তার বোধগম্য হয় না। তার কি
কোন প্রাগৈতিহাসিক জীব না মঙ্গল বা প্লুটো থেকে আসা কোন এলিয়ান,নাকি তাদের দর্শনে পাপ ক্ষয় হয়ে পূণ্য লাভ হয়। তাদের সাথে শুধু
কথা বলার জন্য কেন যে ছেলে গুলো এদের পিছনে ছুটে বেড়ায় কে জানে? সে দিন ও সে যায়নি।
-বাড়ি যাবে না? অয়ন জিজ্ঞাসা করলো।
-হ্যাঁ, যাবো। আমার ফ্রেন্ড আসুক। আমি ওর গাড়িতেই ওর সাথে যাওয়া আসা করি।
কি হল আজ
এলে না তো? কৌতূহলী হয়ে অবন্তিকা জিজ্ঞাস
করলো।
-না, আজ ঠিক
ভালো লাগলো না। কলেজে ও যাইনি।
আশ্চর্য্য চোখে অয়নের দিকে ফিরে তাকালো অবন্তিকা। সারাদিন বাড়িতে বসে আছে
অয়ন? কিন্তু কেন? – কি ব্যাপার বলো তো? আজকাল একা একা থাকছো। অবন্তিকার প্রশ্নে অয়ন গভীর শ্বাস ফেলল।
-নাথিং, জাস্ট স্পেন্ডিং টাইম। অয়নের এই
উত্তর অবন্তিকার আশানুরূপ। অয়ন চাপা স্বভাবের ছেলে। এতো সহজে যে সে সম্পূর্ণ কথাটা
বলবে না, তা অবন্তিকা ভালো মতোই জানে। -ইউ
হ্যাজ চেঞ্জড। হেসে ফেলল অয়ন। -আই হ্যাভ
নেভার চেঞ্জড। দ্যা টাইম হ্যাভ চেঞ্জড। অবন্তিকা গম্ভীরভাবে অয়নের দিকে তাকালো।
তার ভুরু দুটি কুচকিয়ে প্রায় জোড়া লেগে গেছে। -থাক অনেক হয়েছে। আর নাটক করতে হবে
না। অবন্তিকার কথায় অয়ন আবারও শুধু
হাসলো।
অয়ন নিঃশব্দে টেবিলের থেকে বিস্কুটের প্লেটটা
অবন্তিকার দিকে এগিয়ে দিল। অবন্তিকা চিন্তিত গম্ভীর মুখে দুটো বিস্কুট তুলে নিল
প্লেটের থেকে। আজকের অয়ন আগের অয়নের থেকে অনেকটাই আলাদা তার কাছে। শেষ একমাস ধরে
এই পরিবর্তনটা লক্ষ্য করছে অয়নের মধ্যে।
সামান্য কয়েকদিনের পরিচয়ে অবন্তিকার অয়নকে খুব চেনা মনে হয়েছিল। তার সেই চেনা অয়ন
বদলে গেছে। যে অয়ন এখন নিঃসঙ্গতাকে বেছে নিয়েছে, সেই অয়নের কয়েকদিন আগে পর্যন্ত্য
একা থাকতে দমবন্ধ লাগতো। অবন্তিকা বুঝতে
পারছে, অয়ন হতাশার মধ্যে রয়েছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর অবন্তিকা কথা বলা শুরু
করলো। -আজ সারাদিন কি করলে?
-নতুন
নোবেলটা পরলাম। অয়ন অবন্তিকার প্রশ্নের
গভীরতা না মেপেই জবাব হাল্কা ভাবেই দিল। অবন্তিকা আড় চোখে টেবিলে রাখা বইটার দিকে
লক্ষ্য করলো। সম্ভবত কোনো বিদেশী নোবেলের ইংরেজী অনুবাদ। ক্ষণিকে চুপ থেকে
অবন্তিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর অয়নের
প্রশ্নেই দুইজনের নীরবতা শেষ হল। - আমি যখন ফোন
করলাম তখন তুমি কোথায় ছিলে? অবন্তিকার
অন্যমনস্কতা কাটিয়ে অয়নের প্রশ্নের উত্তর দিতে সময় লাগলো। -রাস্তায় ছিলাম। তুমি আসবে না শুনে নীতুর বাড়ি
চলে গেলাম। নীতু মানে নিবেদিতা অবন্তিকার
প্রিয় বান্ধবীদের একজন। অয়ন, অবন্তিকার কাছে অন্য বান্ধবীদের নামের সাথেও এই নামটা
শুনেছে। নিবেদিতাকে অয়ন সামনে থেকে কখন দেখেনি। অবন্তিকা ও তার বান্ধবীরা দেখা
সাক্ষাৎ করে নিজেদের মধ্যে সময় কাটায়। তাই নেহাত লজ্জায় আমন্ত্রণ পেয়েও তাদের
মধ্যে অয়ন আর উপস্থিত হতে চাইনি। বিভিন্ন ওজুহাতে এড়িয়ে গেছে। -এতো তাড়াতাড়ি
বন্ধুরা প্ল্যান করে হানা দিলে?
অবন্তিকা
ঘাড় নাড়লো। -বন্ধুরা নয় তো। আমি একা গেলাম। আসলে ও একটা প্রবলেমের মধ্যে আছে। তাই
ভাবলাম...
-কি রকম
প্রবলেম? অয়ন জিজ্ঞাস করলো।
-লজ্জা করে
না মেয়েদের পার্সোনাল বিষয়ে এতো ইন্টারেস্ ?
অবন্তিকা একটু মজা করেই বিরক্ত হওয়ার ভান করলো। অয়ন উত্তর দিল না। অবন্তিকার মুখে হাল্কা হাল্কা একটা হাসির রেখা।
অয়নকে তর্কে হারিয়ে দেওয়ার আনন্দ বিরক্তির অভিনয় ছাপিয়ে বেড়িয়ে আসছে। অবন্তিকা
থামলো না। আবারও বলল – তোমরা, ছেলেদের নিয়ে এতো প্রবলেম না। সামান্য রূপ দেখেছো
কি গলে গিয়ে, মেয়েদের পিছনে পড়ে যাও।
-যদি না
পড়তো তাহলে খুশি হতে? অয়ন পালটা প্রশ্ন
করলো। অবন্তিকার উত্তর দেওয়ার আগেই অবন্তিকার ঘড়ির দিকে চোখ পড়লো। -এই রে অনেক
দেড়ি হয়ে গেল। সপিং এ যেতে হবে। মা ওয়েট করছে। আজ আসি। পরের দিন না বেড়লে দেখ কি করি?