দ্বিচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ
বেহারা বলিয়াছিল, বাবু ফিরিবেন পরশু কিংবা তরশু কিংবা তাহার পরের দিন নিশ্চয়।
কিন্তু এই তাহার পরের দিনের নিশ্চয়তাকে সমস্তদিন ধরিয়া পরীক্ষা করিবার মত শক্তি আর অচলার ছিল না। এই তিনদিনের মধ্যে রামবাবু একদিনও আসেন নাই। তাঁহার আসাটাকে সে সর্বান্তঃকরণে ভয় করিয়াছে, অথচ এই না আসার নিহিত অর্থকে কল্পনা করিয়াও তাহার দেহ কাঠ হইয়া গিয়াছে। তিনি অসুস্থ ছিলেন, এবং ইতিমধ্যে পীড়া যে বাড়িতেও পারে, এ কথা তাহার মনেও উদয় হয় নাই। কেবল আজ সকালে ও-বাড়ির দরোয়ান আসিয়াছিল, কিন্তু ভিতরে প্রবেশ না করিয়া বাহিরে পাঁড়েজির নিকট হইতেই বিদায় লইয়া ফিরিয়া গিয়াছে। সে কেন আসিয়াছিল, কি খবর লইয়া গেল, কোন কথা অচলা ভয়ে কাহাকেও জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করিতে পারিল না, কিন্তু তাহার পর হইতেই এই বাড়ি, ঘরদ্বার, এই-সব লোকজন সমস্ত হইতে ছুটিয়া পলাইতে পারিলে বাঁচে, তাহার এমনি মনে হইতে লাগিল।
বেহারাকে ডাকিয়া কহিল, রঘুবীর, তোমার বাড়ি ত এই দিকে, তুমি মাঝুলি গ্রামটা জানো?
সে কহিল, অনেককাল পূর্বে একবার বরিয়াত গিয়েছিলাম মাইজী।
কতদূর হবে বলতে পারো?
রঘুবীর এদেশের লোক হইলেও বহুদিন বাঙালীর সংস্রবে তাহার অনেকটা হিসাববোধ জন্মিয়াছিল, সে মনে মনে আন্দাজ করিয়া কহিল, ক্রোশ ছয়-সাতের কম নয় মাইজী।
আজ তুমি আমার সঙ্গে যেতে পারো?
রঘুবীর ভয়ানক আশ্চর্য হইয়া বলিল, তুমি যাবে? সেখানে যে ভারী পিলেগের বেমারী।
অচলা কহিল, তুমি না যেতে পারো, আর কোন চাকরকে রাজি করিয়ে দিতে পারো? সে যা বকশিশ চায়, আমি দেবো।
রঘুবীর ক্ষুণ্ণ হইয়া কহিল, মাইজী, তুমি যেন পারবে, আর আমি পারব না? কিন্তু রাস্তা নেই, আমাদের ভারী গাড়ি ত যাবে না। এক্কা কিংবা খাটুলি—তার কোনটাতেই ত তুমি যেতে পারবে না মাইজী!
অচলা কহিল, যা জোটে, আমি তাতেই যেতে পারবো। কিন্তু আর ত দেরি করলে চলবে না রঘুবীর। তুমি যা পাও একটা নিয়ে এসো।
রঘুবীর আর তর্ক না করিয়া অল্পকালের মধ্যেই একটা খাটুলি সংগ্রহ করিয়া আনিল এবং নিজের লোটা-কম্বল লাঠিতে ঝুলাইয়া সেটা কাঁধে ফেলিয়া বীরের মতই পদব্রজে সঙ্গে যাইতে প্রস্তুত হইল। বাড়ির খবরদারীর ভার দরোয়ান ও অন্যান্য ভৃত্যদের উপরে দিয়া কোন এক অজানা মাঝুলির পথে অচলা যখন একমাত্র সুরেশকেই লক্ষ্য করিয়া আজ গৃহের বাহির হইল, তখন সমস্ত ব্যাপারটাই তাহার নিজের কাছে অত্যন্ত অদ্ভুত স্বপ্নের মত ঠেকিতে লাগিল। তাহার বার বার মনে হইল, এই বিচিত্র জগতে এমন ঘটনাও একদিন ঘটিবে, এ কথা কে ভাবিতে পারিত।
ধূলা-বালির কাঁচা পথ একটা আছে। কিন্তু কখনও তাহা সুবিস্তীর্ণ মাঠের মধ্যে অস্পষ্ট, কখনও বা ক্ষুদ্র গ্রামের মধ্যে লুপ্ত, অবরুদ্ধ। গৃহস্থের সুবিধা ও মর্জিমত তাহার আয়তন ও উদ্দেশ্য পরিবর্তিত হইয়া কখনো বা নদীর ধার দিয়া, কখনো বা গৃহপ্রাঙ্গণের উপর দিয়াই সে গ্রামান্তরে চলিয়া গিয়াছে। প্রথম কিছুদূর পর্যন্ত তাহার কৌতূহল মাঝে মাঝে সজাগ হইয়া উঠিতেছিল। একটা মৃতদেহ একখণ্ড বাঁশে বাঁধিয়া কয়েকজন লোককে নিকট দিয়া বহন করিয়া যাইতে দেখিয়া সংক্রমণের ভয়ে তাহার দেহ সঙ্কুচিত হইয়াছিল, ইচ্ছা করিয়াছিল, জিজ্ঞাসা করিয়া লয়, কিসে মরিয়াছে, ইহার বয়স কত এবং কে কে আছে। কিন্তু পথের দূরত্ব যত বাড়িয়া চলিতে লাগিল, বেলা তত পড়িয়া আসিতে লাগিল এবং কাছে ও দূর গ্রামের মধ্য হইতে কান্নার রোল যত তাহার কানে আসিয়া পৌঁছিতে লাগিল, ততই সমস্ত মন যেন কি একপ্রকার জড়তায় ঝিমাইয়া পড়িতে লাগিল।
বহুক্ষণ হইতে তাহার তৃষ্ণাবোধ হইয়াছিল, এখানেই কতকটা পথ নদীর উচ্চ পাড়ের উপর দিয়া যাইতে যাইতে একটা ঘাটের কাছে আসিয়া সে ডুলি থামাইয়া অবতরণ করিল এবং হাত-মুখ ধুইয়া জল খাইবার জন্য নীচে নামিতেই তাহার চোখে পড়িল, গোটা-দুই অর্ধগলিত শব অনতিদূরে আটকাইয়া রহিয়াছে। ইহাদের বীভৎস বিকৃতি তাহার মনের উপর এখন কোন আঘাতই করিল না। অত্যন্ত সহজেই সে হাত-মুখ ধুইয়া জল খাইয়া ধীরে ধীরে গিয়া তাহার খাটুলিতে বসিল। কোন অবস্থাতেই ইহা সে তাহার পক্ষে সম্ভবপর, কিছুকাল পূর্বে এ কথা বোধ করি সে চিন্তাও করিতে পারিত না।
ইহার পর হইতেই প্রায় গ্রামগুলাই পরিত্যক্ত, শূন্য, কদাচিৎ কোন অত্যন্ত দুঃসাহসী ব্যক্তি ভিন্ন যে যেথায় পারিয়াছে পলায়ন করিয়াছে। কোথাও শব্দ নাই, সাড়া নাই, ঘরদ্বার রুদ্ধ, অপরিচ্ছন্ন—মনে হয় যেন কুটীরগুলা পর্যন্ত মরণকে অনিবার্য জানিয়া চোখ বুজিয়া অপেক্ষা করিয়া আছে। এই মৃত্যুশাসিত নির্জন পল্লীগুলির ভিতর দিয়া চলিতে রঘুবীর ও বাহকদিগের চাপা-গলা এবং ত্রস্ত-ভীত পদক্ষেপে প্রতিমুহূর্তেই অচলাকে বিপদের বার্তা জানাইতে লাগিল, কিন্তু মনের মধ্যে তাহার ভয়ই হইল না, ইহার সহিত তাহার যেন কোন আজন্ম পরিচয় আছে, সমস্ত অন্তঃকরণ এমনি নির্বিকার হইয়া রহিল।
এইভাবে বাকি পথটা অতিবাহিত করিয়া ইহারা যখন মাঝুলিতে উপস্থিত হইল, তখন বেলা শেষ হইয়া আসিয়াছে। অচলার দৃঢ়-বিশ্বাস ছিল, তাহাদের পথের দুঃখ পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই অবসান হইবে। গ্রামের কৃতজ্ঞ নরনারী ছুটিয়া আসিয়া তাহাদের সংবর্ধনা করিয়া ডাক্তার সাহেবের দরবারে লইয়া যাইবে, তথায় রোগী ও তাহাদের আত্মীয় বন্ধু-বান্ধবের আনাগোনায়, ঔষধ-পথ্যের বিতরণের ঘটায় সমস্ত স্থানটা ব্যাপিয়া যে সমারোহ চলিতেছে, তাহার মধ্যে অচলার নিজের স্থানটা যে কোথায় হইবে, ইহার চিত্রটা সে একপ্রকার কল্পনা করিয়া রাখিয়াছিল। কিন্তু আসিয়া দেখিল, তাহার কল্পনা কেবল নিছক কল্পনাই। তাহার সহিত ইহার কোথাও কোন অংশে মিল নাই, বরঞ্চ যে চিত্র পথের দুই ধারে দেখিতে দেখিতে সে আসিয়াছে, এখানেও সেই ছবি। এখানেও পথে লোক নাই, বাড়িঘর-দ্বার রুদ্ধ, ইহার কোথায় কোন্ পল্লীতে সুরেশ বাসা করিয়াছে, খুঁজিয়া পাওয়াই যেন কঠিন।
এই গ্রামে প্রত্যহই একটা হাট আজও বসে বটে এবং অন্য সময়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরাদমে চলিতেও থাকে সত্য, কিন্তু এখন দুর্দিনের বেচা-কেনা সারিয়া লোকজন অপরাহ্ণের বহু পূর্বেই পলাইয়াছে—ভাঙ্গা হাটের স্থানে স্থানে তাহার চিহ্ন পড়িয়া আছে মাত্র।
রঘুবীর খোঁজাখুঁজি করিয়া একটা দোকান বাহির করিল। বৃদ্ধ দোকানী ঝাঁপ বন্ধ করিতেছিল; সে কহিল, তাহার ছেলেমেয়েরা সবাই স্থানান্তরে গিয়াছে, কেবল তাহারা দুইজন বুড়া-বুড়ী দোকানের মায়া কাটাইয়া আজিও যাইতে পারে নাই। সুরেশের সম্বন্ধে এইটুকু মাত্র সন্ধান দিতে পারিল যে, ডাক্তার নন্দ পাঁড়ের নিমতলার ঘরে এতদিন ছিলেন বটে, কিন্তু এখনও আছেন কিংবা মামুদপুরে চলিয়া গিয়াছেন সে অবগত নয়।
মামুদপুর কোথায়?
সিধা ক্রোশ-দুই দক্ষিণে।
নন্দ পাঁড়ের বাড়িটা কোন্ দিকে?
বৃদ্ধ বাহির হইয়া দূরে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া একটা বিপুল নিমগাছ দেখাইয়া দিয়া কহিল, এই পথে গেলেই দেখা যাইবে।
অনতিকাল পরে ভীত পরিশ্রান্ত বাহকেরা যখন নিমতলায় আসিয়া খাটুলি নামাইল, তখন সূর্য অস্ত গিয়াছে। বাড়িটা বড়, পিছনের দিকে দুই-একটা পুরাতন ইঁটের ঘর দেখা যায়; কিন্তু অধিকাংশই খোলার। সম্মুখে প্রাচীর নাই—চমৎকার ফাঁকা। গৃহস্বামীকে দরিদ্র বলিয়াও মনে হয় না, কিন্তু একটা লোকও বাহির হইয়া আসিল না। কেবল প্রাঙ্গণের একধারে বাঁধা একটা টাটু-ঘোড়া ক্ষুৎপিপাসার নিবেদন জানাইয়া অত্যন্ত করুণকণ্ঠে অতিথিদের অভ্যর্থনা করিল।
সদর দরজা খোলা ছিল, রঘুবীর সাহস করিয়া ভিতরে গলা বাড়াইতেই দেখিতে পাইল, পাশের বারান্দায় চারপাইয়ের উপর সুরেশ শুইয়া আছে এবং কাছেই খুঁটিতে ঠেস দিয়া একজন অতিবৃদ্ধ স্ত্রীলোক বসিয়া ঝিমাইতেছে।
বাবুজী।
সুরেশ চোখ মেলিয়া চাহিল এবং কনুইয়ে ভর দিয়া মাথা তুলিয়া ক্ষণকাল তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া প্রশ্ন করিল, কে, বেয়ারা? রঘুবীর?
রঘুবীর সেলাম করিয়া কাছে গিয়া দাঁড়াইল, কিন্তু প্রভুর রক্ত-চক্ষুর প্রতি চাহিয়া তাহার মুখের কথা সরিল না।
তুই এখানে?
রঘুবীর পুনরায় সেলাম করিল এবং বাহিরের দিকে ইঙ্গিত করিয়া শুধু কেবল বলিল, মাইজী—
এবার সুরেশ বিস্ময়ে সোজা উঠিয়া বসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, তোকে পাঠিয়েছেন?
রঘুবীর ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, না, তিনি নিজেই আসিয়াছেন।
জবাব শুনিয়া সুরেশ এমন করিয়া তাহার মুখের প্রতি একদৃষ্টে তাকাইয়া রহিল, যেন কথাটাকে ঠিকমত হৃদয়ঙ্গম করিতে তাহার বিলম্ব হইতেছে। তার পরে চোখ বুজিয়া ধীরে ধীরে শুইয়া পড়িল, কিছুই বলিল না।
অচলা আসিয়া যখন নীরবে খাটিয়ার একধারে তাহার গায়ের কাছেই উপবেশন করিল, তখন কিছুক্ষণের নিমিত্ত সে তেমনি নিমীলিত-নেত্রে মৌন হইয়া রহিল, ভদ্রতা রক্ষা করিতে সামান্য একটা ‘এসো’ বলিয়াও ডাকিতে পারিল না। শিশুকাল হইতে চিরদিন অত্যধিক যত্ন-আদরে লালিত-পালিত হইয়া আবেগে ও প্রবৃত্তির বশেই সে চলিয়াছে, ইহাদের সংযত করার শিক্ষা তাহার কোনকালে হয় নাই। এই শিক্ষা জীবনে সে প্রথম পাইয়াছিল, কেবল সেইদিন, যেদিন তাহার মুখের হাসিকে পদাঘাত করিয়া মুখ ফিরাইয়া মহিম ঘরে চলিয়া গেল। সেদিন একনিমেষে তাহার বুকের মধ্যে নীরবে যে কি বিপ্লব বহিয়া গেল, সে শুধু অন্তর্যামীই জানিলেন এবং আজও কেবল তিনিই দেখিলেন, ঐ শান্ত অচঞ্চল দেহটার সর্বাঙ্গ ব্যাপিয়া কতবড় ঝড় প্রবাহিত হইতেছে। সেদিনও মহিমের আঘাতকে সে যেমন করিয়া সহ্য করিয়াছিল, আজও তেমনি করিয়াই সে তাহার উন্মত্ত আবেগের সহিত নিঃশব্দে লড়াই করিতে লাগিল—তাহার লেশমাত্র আক্ষেপ প্রকাশ পাইতে দিল না।
এমন করিয়া যে কতক্ষণ কাটিত বলা যায় না, কিন্তু বাহকদের আহ্বানে রঘুবীর বাহিরে চলিয়া গেলে, সেই শব্দে সুরেশ ধীরে ধীরে চোখ মেলিয়া চাহিল। কহিল, তুমি আমার চিঠি পেয়েছ? অচলা মুখ তুলিয়াই আস্তে আস্তে বলিল, না।
সুরেশ একটু বিস্ময় প্রকাশ করিয়া কহিল, চিঠি না পেয়েই এসেছ, আশ্চর্য! যাই হোক, এ ভালই হল যে একবার দেখা হল। বলিয়া একটা কথার জন্য তাহার আনত মুখের প্রতি একমুহূর্ত চাহিয়া থাকিয়া নিজেই কহিল, আমার জন্য তোমাকে অনেক দুঃখ পেতে হল—খুব সম্ভব যতদিন বাঁচবে, এর জের মিটবে না, কিন্তু সমস্ত ভুল হয়েছিল এই যে, মহিমকে তুমি যে এতটা বেশি ভালবাসতে তা আমিও বুঝিনি, বোধ হয় তুমিও কোনদিন বুঝতে পারোনি! না?
কিন্তু অচলা তেমনি অধোমুখে নিরুত্তরে বসিয়া রহিল দেখিয়া সে আবার বলিল, তা ছাড়া আমার বিশ্বাস, মানুষের মন বলে স্বতন্ত্র কোন একটা বস্তু নেই। যা আছে, সে এই দেহটার ধর্ম। ভালবাসাও তাই। ভেবেছিলাম, তোমার দেহটাকে কোনমতে পেলে মনটাও পাবো, তোমার ভালবাসাও দুষ্প্রাপ্য হবে না—কে জানে হয়ত সত্যিই কোনদিন ভাগ্য সুপ্রসন্ন হতো—হয়ত যা সর্বস্ব দিয়ে এমন করে চেয়েছিলাম, তাই তুমি একদিন নিজের ইচ্ছেয় আমাকে ভিক্ষে দিতে। কিন্তু আর তার সময় নেই; আমি অপেক্ষা করবার অবসর পেলাম না। বলিয়া সে পুনরায় কনুইয়ে ভর দিয়া মাথা তুলিল এবং সন্ধ্যার ক্ষীণ আলোকের মধ্যে নিজের দুই চক্ষের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করিয়া অচলার আনত মুখের প্রতি নিবদ্ধ করিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিল।
একজনের এই একাগ্র দৃষ্টি আর একজনের সন্নত দৃষ্টিকে যেন আকর্ষণ করিয়া তুলিল—কিন্তু পলকমাত্র। অচলা তৎক্ষণাৎ চোখ নামাইয়া লইয়া অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে অত্যন্ত লজ্জার সহিত কহিল, এদেশ থেকে ত সবাই পালিয়েছে—এখানকার কাজ যদি তোমার শেষ হয়ে থাকে ত বাড়ি, কিংবা আরও কত দেশ আছে—তুমি চল, ডিহরীতে আর একদণ্ড টিকতে পাচ্চিনে।
সে আমার বেশি আর কে জানে? বলিয়া একটা নিশ্বাস ফেলিয়া সুরেশ বালিশে মাথা দিয়া শুইয়া পড়িল এবং কিছুক্ষণ নিঃশব্দে স্থিরভাবে থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিতে লাগিল, অনেক কষ্টে আজ সকালে দু’খানা চিঠি পাঠাতে পেরেছি। একখানা তোমাকে, আর একখানা মহিমকে। সে যদি না এর মধ্যে চলে গিয়ে থাকে ত নিশ্চয় আসবে, আমি জানি।
শুনিয়া অচলা ভয়ে, বিস্ময়ে চমকিয়া উঠল, কহিল, তাঁকে কেন?
সুরেশ তেমনি ধীরে ধীরে বলিল, এখন তাকেই আমার একমাত্র প্রয়োজন। ছেলেবেলা থেকে সংসারের মধ্যে অনেকদিন অনেক গ্রন্থিই পাকিয়েছি, আর তাদের খোলবার জন্যে এই মানুষটিকে চিরদিন আবশ্যক হয়েছে! তাই আজও তাকেই আমার ডাক দিতে হয়েছে। এত ধৈর্য পৃথিবীতে আর ত কারও নেই!
অচলার বুকের মধ্যে তোলপাড় করিতে লাগিল, কিন্তু সে অধোমুখে স্থির হইয়া শুনিতে লাগিল। সুরেশ বলিল, আমার চিঠির মধ্যে প্রায় সব কথাই লেখা আছে—পড়লেই টের পাবে। সেদিন তোমার হাতে আমার সমস্ত সম্পত্তির পাকা উইলখানাই দিয়েছি। ইচ্ছে করলে তার অনেক জিনিসই তুমি নিতে পারো, কিন্তু আমি বলি, নিয়ে কাজ নেই। বরঞ্চ আমি বেঁচে থাকলেও যেমন গরীব-দুঃখীরাই সমস্ত পেতো, আমার মরণের পরেও যেন তারাই পায়। আমার কিছুর সঙ্গেই আর তুমি নিজেকে জড়িয়ে রেখ না অচলা—তুমি নিশ্চিন্ত হও, নির্বিঘ্ন হও—আমার সমস্ত সংস্রব থেকে তুমি নিজেকে যেন সর্বতোভাবে বিচ্ছিন্ন করতে পারো। চেষ্টা করলে পৃথিবীতে অনেক দুঃখই সহা যায়—আমার দেওয়া দুঃখেও যেন একদিন তুমি অনায়াসে সইতে পারো।
তাহার আচরণে ও কথা বলার ভঙ্গিতে অচলার মনের মধ্যে আসিয়া পর্যন্তই কেমন যেন ভয় ভয় করিতেছিল, এই শেষের কথাটায় সে যথার্থই ভীত হইয়া বলিয়া উঠিল, তুমি এ-সব কথা তুলচ কেন? উঠে বস না! যাতে আমরা এখনি বার হয়ে পড়তে পারি, তার উদ্যোগ করে দাও না!
তাহার আশঙ্কা ও উত্তেজনা লক্ষ্য করিয়াও সুরেশ কোন উত্তর দিল না। যে বৃদ্ধা খুঁটি ঠেস দিয়া ঝিমাইতেছিল, সে সজাগ হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, বাবু এখন ঘরের মধ্যে যাবেন, না আলোটা বাইরে এনে দেবে—তাহারও কোন জবাব দিল না; মনে হইতে লাগিল, সহসা যেন সে তন্দ্রাচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছে। উদ্বিগ্ন অচলা তাহার পূর্ব প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করিতে যাইতেছিল, সুরেশ চোখ মেলিয়া অত্যন্ত সহজভাবে কহিল, এখনও তোমাকে আমার আসল কথাটাই বলা হয়নি অচলা, আমি মরতে বসেছি—আমার বাঁচবার বোধ করি আর কোন সম্ভাবনাই নেই।
প্রত্যুত্তরে শুধু একটা অস্ফুট, অব্যক্ত কণ্ঠস্বর অচলার গলা হইতে বাহির হইয়া আসিল, তার পরেই সে মূর্তির মত নিস্পন্দ হইয়া বসিয়া রহিল।
সুরেশ বলিতে লাগিল, আগে থেকেই আমি উইল করে রেখেছি বটে, কিন্তু কেউ যদি মনে করে, আমি ইচ্ছে করে মরচি, সে অন্যায়, সে মিথ্যা—সে আমার মরার বেশি ব্যথা হবে। আমি সতর্কতার এতটুকু ত্রুটি করিনি, কিন্তু কাজে লাগল না। যদি কখনো তোমাকে কেউ জিজ্ঞাসা করে, তাদের তুমি এই কথাটা বলো যে, সংসারে আরও পাঁচজনের যেমন মৃত্যু হয়, তাঁরও মৃত্যু তেমনি হয়েছে,—মরণকে কেবল এড়াতে পারেন নি বলেই মরেছেন, নইলে মরবার ইচ্ছে তাঁর ছিল না। মরণের মধ্যে আমার কোন হাত, কোন বিশেষত্ব ছিল, এই অপরাধটা আমাকে যেন কেউ না দেয়।
অচলা কিছুই বলিল না। কথা কহিবার শক্তি যে তাহার শুকাইয়া গিয়াছিল, এ কথা সেই প্রায়ান্ধকারের মধ্যে তাহার ভয়ার্ত মুখের প্রতি চাহিয়া সুরেশ ধরিতে পারিল না। ক্ষণকাল আপনাকে সে সংবরণ করিয়া লইয়া পুনরায় বলিতে লাগিল, আমি না এসে থাকতে পারিনে বলেই তোমাকে লুকিয়ে সেদিন ভোরবেলায় পালিয়ে এসেছিলুম। এসে দেখি, গ্রাম প্রায় শূন্য। এ বাড়িতে একটা চাকর মরেছে এবং তার কোন গতি না করেই বাড়িসুদ্ধ সবাই পালাতে উদ্যত হয়েছে। তাদের নিরস্ত করতে পারলুম না বটে; কিন্তু মড়াটার একটা উপায় হল। ফিরে এসে ভাবলুম, আমিও বাড়ি চলে যাই; কিন্তু দুপুরবেলা মামুদপুর থেকে একটা ছেলে কাঁদতে কাঁদতে এসে জানালে, তার মায়ের খুব অসুখ। তাকে অস্ত্র করতে গিয়েই নিজের এই বিপদ ঘটালুম। এমন অনেক ত করেছি, আমি সাবধানও কম নই, কিন্তু এবার দুর্ভাগ্য এমনি যে, এক্কার চাকায় বুড়ো আঙুলের পিছনটা যে ঘষে গিয়েছিল, সেটা কেবল চোখে পড়ল হাতের রক্ত ধুতে গিয়ে। তাড়াতাড়ি ফিরে এসে যা করবার সমস্তই করলুম, বাড়ি যাবার উপায় থাকলে আমি চলেই যেতুম, কিছুতেই থাকতুম না, কিন্তু কোন উপায় করতে পারলুম না। কাল রাত্রে জ্বরবোধ হ’ল—এ যে কিসের জ্বর সে যখন বুঝতে আর বাকি রইল না, তখন অনেক কষ্টে, অনেক চেষ্টায় একটা লোক দিয়ে তোমাদের দু’জনকে দু’খানা চিঠি লিখে পাঠিয়েছি।
অচলা অশ্রু-ব্যাকুলকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, কিন্তু এখন ত উপায় আছে, আমার ডুলিতে তোমাকে নিয়ে এখনি আমি বেরিয়ে পড়ব—আর একমিনিট থাকতে দেব না।
কিন্তু তুমি?
আমি হেঁটে যাবো—আমার কথা তুমি কিছুতে ভাবতে পাবে না।
হেঁটে যাবে? এতটা পথ?
তোমার পায়ে পড়ি, তুমি আর বাধা দিয়ো না, বলিতে বলিতেই অচলা কাঁদিয়া ফেলিল।
সুরেশ পলকমাত্র মৌন হইয়া রহিল, তার পরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া ধীরে ধীরে বলিল, আচ্ছা, তাই চল। কিন্তু বোধ হয়, এর আর প্রয়োজন ছিল না।
অচলা বাহিরে আসিয়া দেখিল, গাছতলায় বসিয়া রঘুবীর নীরবে চানাভাজা চর্বণ করিতেছে। কহিল, রঘুবীর, বাবুর বড় অসুখ, তাঁকে এক্ষুণি নিয়ে যেতে হবে। ডুলিওয়ালাদের বল, তারা যত টাকা চায়, আমি তার চেয়ে বেশি দেব—কিন্তু আর একমিনিটও দেরি নয়।
প্রভুপত্নীর ব্যাকুল কণ্ঠস্বরে রঘুবীর চমকাইয়া উঠিয়া দাঁডাইল, কহিল, কিন্তু তারা ত দু’জনকে বইতে পারবে না মাইজী!
না না, দু’জনকে নয়। আমি হেঁটে যাবো, কিন্তু আর একমিনিটও দেরি চলবে না রঘুবীর, তুমি শিগ্গির যাও—কোথায় তারা?
রঘুবীর কহিল, ভাড়ার টাকা নিয়ে তারা দোকানে গেছে খাবার কিনতে। এখুনি ডেকে আনচি মাইজী, বলিয়া সে অভুক্ত চানাভাজা গাত্রবস্ত্রের খুঁটে বাঁধিতে বাঁধিতে একপ্রকার ছুটিয়া চলিয়া গেল।
ফিরিয়া আসিয়া অচলা সুরেশের শিয়রে বসিল, এবং হাত দিয়া তাহার কপালের উত্তাপ অনুভব করিয়া আশঙ্কায় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। মুনিয়ার মা কেরোসিনের ডিবা জ্বালিয়া অনতিদূরে মেঝের উপর রাখিয়া গিয়াছিল, তাহার অপর্যাপ্ত ধূমে সমস্ত স্থানটা কলুষিত হইয়া উঠিতেছিল, সেইটা সরাইতে গিয়া একটা ঔষধের শিশি অচলার চোখে পড়িল; জিজ্ঞাসা করিল, একি তোমার ওষুধ?
সুরেশ বলিল, হাঁ, আমারই। কাল নিজেই তৈরি করেছিলুম, কিন্তু খাওয়া হয়নি। দাও—
কথাটা অচলাকে তীব্র আঘাত করিল, কিন্তু না খাওয়ার হেতু লইয়াও আর সে কথা বাড়াইতে ইচ্ছা করিল না। ঔষধ দিয়া শিয়রে আসিয়া সে আবার তেমনি নীরবে উপবেশন করিল। অনেকক্ষণ হইতেই সুরেশ মৌন হইয়াই ছিল, কিন্তু সে নিঃশব্দে কত বড় যাতনা সহিতেছে, ইহাই উপলব্ধি করিয়া অচলার বুক ফাটিতে লাগিল।
বিলম্ব হইতেছে—রঘুবীরের দেখা নাই। মাঝে মাঝে সে পা টিপিয়া উঠিয়া গিয়া দরজায় মুখ বাড়াইয়া অন্ধকারে যতদূর দেখা যায়, দেখিবার চেষ্টা করিতে লাগিল, কিন্তু কোথাও কাহারও সাড়া নাই। অথচ পাছে এই উৎকণ্ঠা তাহার কোনমতে সুরেশের কাছে ধরা পড়িয়া যায়, এই ভয়েও সে ব্যাকুল হইয়া পড়িল।
রাত্রি বাড়িয়া যাইতে লাগিল, খুঁটির কাছে মুনিয়ার মায়ের নাসিকা ডাকিয়া উঠিল—এমন সময় ক্ষুধিত পথশ্রান্ত রঘুবীর ভগ্নদূতের ন্যায় উপস্থিত হইয়া ম্লান মুখে জানাইল বেহারারা ডুলি লইয়া বহুক্ষণ চলিয়া গিয়াছে, কোথাও তাহাদের সন্ধান মিলিল না।
অচলা সমস্ত ভুলিয়া বিকৃত-কণ্ঠে বারংবার প্রশ্ন করিতে লাগিল, তাহারা কখন গেল? কোন্ পথে গেল? এবং কিজন্য গেল? আমাদের যা-কিছু, সমস্ত দিলেও কি আর একখানা সংগ্রহ করা যায় না?
রঘুবীর অধোমুখে স্তব্ধ হইয়া রহিল। এই নিদারুণ বিপত্তি তাহারই অবিবেচনায় ঘটিয়াছে, ইহা সে জানিত; তাই সে তাহার প্রাণপণ চেষ্টা নিষ্ফল করিয়া তবেই ফিরিতে পারিয়াছিল।
কিন্তু আরও একজন তাহারি মত নিঃশব্দে স্থির হইয়া শয্যার ’পরে পড়িয়া রহিল। এই চঞ্চলতার লেশমাত্রও যেন তাহাকে স্পর্শ করিতে পারিল না। রঘুবীর চলিয়া গেলে সে আস্তে আস্তে বলিল, ব্যস্ত হয়ে কি হবে অচলা, তাদের পেলেও কোনও লাভ হতো না। এই ভাল—আমার এই ভাল।
আর অচলা কথা কহিল না, কেবল সেই অনন্ত পথযাত্রীর তপ্ত ললাটে ডান হাতখানি রাখিয়া পাষাণ-প্রতিমার ন্যায় স্থির হইয়া রহিল।
তাহার চারিদিকে জনহীন পুরী মৃত্যুর মত নির্বাক্ হইয়া আছে। বাহিরে গভীর রাত্রি গভীরতর হইয়া চলিয়াছে, চোখের উপর কালো আকাশ গাঢ় হইয়া উঠিয়াছে—সেইদিকে চাহিয়া তাহার কেবলই মনে হইতে লাগিল ইহার কি প্রয়োজন ছিল! ইহার কি প্রয়োজন ছিল!
এই যে তাহার জীবন-কুরুক্ষেত্র ঘেরিয়া এতবড় একটা কদর্য সংগ্রাম চলিয়াছে, সংসারে ইহার কি আবশ্যক ছিল? দুনিয়ার সমস্ত জ্বালা, সমস্ত হীনতা, সকল স্বার্থ মিটাইয়া সে কি ওই রাত্রির মত আজই শেষ হইয়া যাইবে? তার পরে সমস্ত জীবনটা কি তাহার কুরুক্ষেত্রের মত কেবল শ্মশান হইয়া যুগ যুগ পড়িয়া রহিবে? এখানে কি চিতার দাহচিহ্ন কোনদিন মিলাইবে না? পৃথিবীতে ইহাও কি প্রয়োজনের মধ্যে?
কিন্তু এ কুরুক্ষেত্র কেন বাধিল? কে বাধাইল? এই যে মানুষটি তাহার সকল ঐশ্বর্য, সকল সম্পদ, সকল আত্মীয়-পরিজন হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া এমন একান্ত নিরুপায়ের মরণ মরিতে বসিয়াছে, এই কি কেবল এতবড় বিপ্লব একা ঘটাইয়াছে? আর কি কাহারও মনের মধ্যে লুকাইয়া কোন লোভ কোন মোহ ছিল না? কোথাও কোন পাপ কি আর কেহ করে নাই?
কিন্তু সহসা চিন্তাটাকে সে যেন সজোরে ঠেলিয়া ফেলিয়া একটুখানি নড়িয়া-চড়িয়া উঠিল। কে যেন দুই হাত দিয়া চাপিয়া তাহার কণ্ঠরোধ করিতে বসিয়াছিল। সেই সময় সুরেশও জল চাহিল। হেঁট হইয়া মুখে তাহার জল দিয়া আবার অচলা স্থির হইয়া বসিল। তাহার শ্রান্তি নাই, ক্লান্তি নাই, চোখ হইতে নিদ্রার আভাসটুকু পর্যন্ত যেন তিরোহিত হইয়া গিয়াছে। সেই দুটি শুষ্ক চোখ মেলিয়া আবার সে নীরব আকাশের প্রতি একদৃষ্টে তাকাইয়া রহিল। বহুদিন পূর্বে অনেক যত্ন করিয়া যে মহাভারতখানি শেষ করিয়াছিল—আজ তাহারই শেষ সর্বনাশ যেন তাহারই মনের মধ্যে ছায়াবাজির ন্যায় প্রবাহিত হইয়া যাইতে লাগিল। সেখানে যেন কত রক্ত ছুটিতেছে, কত অজানা লোক মিলিয়া কাটাকাটি মারামারি করিয়া মরিতেছে—কত শত-সহস্র চিতা জ্বলিতেছে, নিবিতেছে—তাহার ধূমে ধূমে সমস্ত স্বর্গ-মর্ত্য একেবারে যেন আচ্ছন্ন একাকার হইয়া গিয়াছে!
কিছুক্ষণের জন্য সুরেশ বোধ হয় তন্দ্রামগ্ন হইয়া পড়িয়াছিল—তাহার সাড়া ছিল না। কিন্তু এমন করিয়া যে কতক্ষণ গেল, কি করিয়া বাহিরে যে সময় কাটিতে লাগিল, কি করিয়া যে রাত্রি প্রভাতের পথে অগ্রসর হইতেছিল, সেদিকেও অচলার চৈতন্য ছিল না। তাহার নিমীলিত চক্ষের কোণ বাহিয়া জল পড়িতেছিল, স্রস্ত হাতদুটি সুরেশের বালিশের উপর পড়িয়া, সে একান্ত-মনে বলিতেছিল, হে ঈশ্বর! আমি অনেক দুঃখ, অনেক ব্যথা পাইয়াছি, আজ আমার সকল দুঃখ, সকল ব্যথার পরিবর্তে একে তুমি ক্ষমা করিয়া কোলে তুলিয়া লও; আমার মা নাই, বাপ নাই, স্বামী নাই—এত বড় লজ্জা লইয়া কোথাও আমার দাঁড়াইবার স্থান নাই। আমি কত যে সহিয়াছি, সে ত তুমি জান—আর আমাকে বাঁচিতে দিয়ো না প্রভো! আমাকেও তোমার কাছে টানিয়া লও!
কথাগুলি সে যে কতভাবে কতরকমে মনে মনে আবৃত্তি করিল, তাহার অবধি নাই—অশ্রুজলও যে কত ঝরিয়া পড়িল তাহারও সীমা নাই।
মাইজী।
তখন সবেমাত্র প্রভাত হইয়াছে, অচলা চমকিয়া দেখিল, রঘুবীর কাহার যেন প্রবেশের অপেক্ষায় সদর-দরজা উন্মুক্ত করিয়া দাঁড়াইয়াছে।
কি রঘুবীর? বলিয়াই যাহার সহিত তাহার চোখে চোখে দেখা হইয়া গেল, সে মহিম। একবার সে কাঁপিয়া উঠিয়াই দৃষ্টি অবনত করিল।
দ্বারের কাছে মুহূর্তের জন্য মহিমের পা উঠিল না, এখানে এমন করিয়া যে আবার তাহার সহিত দেখা হইবে, ইহা সে প্রত্যাশা করে নাই। কিন্তু পরক্ষণেই ধীরে ধীরে সে কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, এখন সুরেশ কেমন আছে?
অচলা মুখ তুলিল না, কথা কহিল না, শুধু মাথা নাড়িয়া বোধ হয় ইহাই জানাইতে চাহিল, সে ইহার কিছুই জানে না।
মিনিট-খানেক স্থির থাকিয়া মহিম সুরেশের ললাট স্পর্শ করিতেই সে চোখ মেলিয়া চাহিল। সেই জ্যোতিহীন রক্তনেত্রের প্রতি চাহিয়া মহিমের গলা দিয়া সহসা স্বর ফুটিল না। তার পরে কহিল, কেমন আছ সুরেশ?
ভালো না—চললুম। তুমি আসবে আমি জানি—আমার সুমুখে এসে বস।
মহিম উঠিয়া গিয়া শয্যার একাংশে তাহার পায়ের কাছে বসিল। বলিল, ডিহরীতে ডাক্তার আছে, আমার এক্কায় কোনমতে—
সুরেশ মাথা নাড়িয়া বলিল, না টানাটানি করো না, মজুরী পোষাবে না। আমাকে quietly যেতে দাও।
কিন্তু এখনো ত—
হ্যাঁ, এখনো হুঁশ আছে, কিন্তু মাঝে মাঝে ভুল হচ্ছে। আমার জীবনটা গরীব-দুঃখীর কাজে লাগাতে পারলুম না, কিন্তু সম্পত্তিটা যেন তাদের কাজে লাগে মহিম। তাই কষ্ট দিয়ে এতদূর তোমাকে টানে এনেছি, নইলে মৃত্যুকালে ক্ষমা চেয়ে কাব্য করবার প্রবৃত্তি আমার নেই।
মহিম নীরব হইয়া রহিল।
সুরেশ বলিতে লাগিল, ও-সব আমি বিশ্বাসও করিনে, ভালও বাসিনে। একটা দিনের ক্ষমার প্রতি আমার লোভও নেই। ভাল কথা, একটা উইল আছে। অচলাকে আমি কিছুই দিইনি—আর তাকে অপমান করতে আমার হাত উঠল না। তবে দরকার বোঝ ত সামান্য কিছু দিয়ো।
মহিম ব্যাকুল হইয়া উঠিল, আর আমাকে কেন এর মধ্যে জড়াচ্ছো সুরেশ?
সুরেশ বলিল, ঠিক এই জন্যই যে, তোমাকে জড়ানো যায় না। যার লোভ নাই, যার ন্যায়ান্যায়ের বিচার—হঠাৎ উপরের দিকে দৃষ্টি তুলিয়া কহিল, কিন্তু সারারাত তুমি বসে আছ অচলা—যাও, হাতমুখ ধোও গে। মুনিয়ার মা সমস্ত দেখিয়ে দেবে—যাও—
সে উঠিয়া গেলে কহিল, কেবল একটা জিনিসের জন্য আমার ভারী দুঃখ হয়। অচলা যে তোমাকে কত ভালবাসত, সে আমিও বুঝিনি, তুমিও বোঝোনি—ও নিজেও বুঝতে পারেনি। সেটা তোমার দারিদ্র্যের সঙ্গে এমনি ঘুলিয়ে উঠল যে—যাক! এমন সুন্দর জিনিসটি মাটি করে ফেললুম—না পেলুম নিজে, না পেতে দিলুম অপরকে। কিন্তু কি আর করা যাবে! পিসীমাকে একটু দেখো—শোকটা তাঁর ভারী লাগবে।
বৃদ্ধ মুনিয়ার মা ঔষধের শিশি লইয়া কাছে দাঁড়াইতেই সে উত্ত্যক্তস্বরে বলিয়া উঠিল, না না, আর ঔষধ নয়। একটু জল দে। একটা নাটক লিখতে আরম্ভ করেছিলুম মহিম, আমার ড্রয়ারে আছে—পারো ত পড়ো।
মহিম তাহার মুখের পানে চাহিতে পারিতেছিল না, অধোমুখে শুনিতেছিল—এইবার চোখ তুলিয়া কি একটা বলিবার চেষ্টা করিতেই সুরেশ থামাইয়া দিয়া বলিল, আর না মহিম, একটু ঘুমুই। খাবার-দাবার সমস্ত যোগাড় আছে, কিন্তু সে ত তোমাদের ভাল লাগবে না। বলিয়া সে চোখ বুজিল।
মহিম ক্ষণকাল চুপ করিয়া আস্তে আস্তে বলিল, আমার শেষ অনুরোধ একটা রাখবে সুরেশ ?
কি?
তুমি ভগবানকে কোনদিন ভাবোনি, তাঁর কথা—ও আমার ভাল লাগে না। বলিয়া সুরেশ মুখখানা বিকৃত করিয়া পাশ ফিরিয়া শুইল। মহিম প্রাণপণে একটা অদম্য দীর্ঘশ্বাস চাপিয়া লইয়া নির্বাক হইয়া রহিল।