একবিংশ পরিচ্ছেদ
তখনও কেদারবাবু আগেকার স্বাস্থ্য ফিরিয়া পান নাই। খাওয়া-দাওয়ার পরে আসিয়া বারান্দায় একখানা ইজি-চেয়ারে পড়িয়া খবরের কাগজ পড়িতে পড়িতে হয়ত একটু তন্দ্রাভিভূত হইয়াছিলেন, দরজায় ঠিকা গাড়ির কঠোর শব্দে চোখ মেলিয়া দেখিলেন, সুরেশ এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাঁহার কন্যা ও ঝি অবতরণ করিল। ঘুমের ঝোঁক তাঁহার নিমিষে উড়িয়া গেল; কি একটা অজ্ঞাত শঙ্কায় শশব্যস্তে উঠিয়া পড়িয়া গলা বাড়াইয়া চিৎকার করিলেন, অচলা যে? সুরেশ, তুমি কোথা থেকে? কি, ব্যাপার কি? এ-সব কি কাণ্ড-কারখানা, আমি ত কিছু বুঝতে পারিনে!
অচলা উঠিয়া আসিয়া পিতার পদধূলি গ্রহণ করিল। সুরেশ প্রণাম করিয়া কহিল, মহিমের টেলিগ্রাফ পাননি?
কেদারবাবু উদ্বিগ্নমুখে কহিলেন, কৈ, না!
সুরেশ একখানা চৌকি টানিয়া লইয়া উপবেশন করিয়া বলিল, তা হলে হয় সে টেলিগ্রাফ করতে ভুলেছে, না হয় এখনো এসে পৌঁছায় নি।
কেদারবাবু কহিলেন, টেলিগ্রাফ যাক, ব্যাপার কি, তাই আগে বল না! তুমি এদের কোথা থেকে নিয়ে এলে?
সুরেশ বলিল, কাল রাত্রিতে আগুন লেগে মহিমের বাড়ি পুড়ে গেছে।
বাড়ি পুড়ে গেছে? সর্বনাশ! বল কি—বাড়ি পুড়ে গেল? কেমন করে পুড়ল? মহিম কৈ? তুমি এদের পেলে কোথায়? এক নিশ্বাসে এতগুলা প্রশ্ন করিয়া কেদারবাবু ধপ্ করিয়া তাঁহার ইজি-চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন।
সুরেশ বলিল, এদের সেখান থেকেই নিয়ে আসচি। আমি সেখানেই ছিলাম কিনা।
কেদারবাবুর মুখ অত্যন্ত অপ্রসন্ন এবং গম্ভীর হইয়া উঠিল, কহিলেন, তুমি ছিলে সেখানে? কবে গেলে, আমি ত কিছু জানিনে। কিন্তু সে কৈ?
সুরেশ বলিল, মহিম ত আসতে পারছে না, তাই—
তাঁহার গম্ভীর মুখ অন্ধকার হইয়া উঠিল। মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না না, এ-সব ভাল কথা নয়। অতিশয় মন্দ কথা। যৎপরোনাস্তি অন্যায়। এ-সব ত আমি কোনমতেই—, বলিতে বলিতে তিনি চোখ তুলিয়া কন্যার মুখের প্রতি চাহিলেন।
অচলা এতক্ষণ একটা চেয়ারের পিঠে হাত রাখিয়া নীরবে দাঁড়াইয়া ছিল। পিতার এই সংশয় তাহার মর্মে গিয়া বিঁধিল। তাহার এই অকস্মাৎ আগমনের হেতু যে তিনি লেশমাত্র বিশ্বাস করেন নাই, তাহা সুস্পষ্ট উপলব্ধি করিয়া লজ্জায় ঘৃণায় তাহার মুখে আর রক্তের চিহ্ন রহিল না।
কেদারবাবু এখানে ভুল করিলেন। মেয়ের মুখের চেহারায় তাঁহার সন্দেহ দৃঢ়ীভূত হইল। আরাম-চেয়ারটায় হেলিয়া পড়িয়া হাতের কাগজখানা মুখের উপরে টানিয়া নিয়া ফোঁস করিয়া একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, যা ভাল বোঝ তোমরা কর। আমি কালই বাড়ি ছেড়ে আর কোথাও চলে যাবো।
সুরেশ ক্রুদ্ধ-বিস্ময়ের সহিত কহিল, এ-সব আপনি কি বলচেন কেদারবাবু? আপনি বা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবেন কেন, আর হয়েছেই বা কি? বলিয়া সে একবার অচলার প্রতি একবার তাহার পিতার প্রতি চাহিতে লাগিল; কিন্তু কাহারও মুখ তাহার দৃষ্টিগোচর হইল না।
কেদারবাবুর কাছে কোন জবাব না পাইয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, যাক, আমার ওপর মহিম যা ভার দিয়েছিল তা হয়ে গিয়েছে। এখন আপনারা যা ভাল বোঝেন করুন। আমার নাওয়া-খাওয়া এখনো হয়নি, আমি বাড়ি চললুম। বলিয়া সে কয়েক পদ দ্বারের অভিমুখে অগ্রসর হইতেই কেদারবাবু উঠিয়া বসিয়া ক্লান্তকণ্ঠে কহিলেন, আহা, যাও কেন ছাই।ব্যাপারটা কি, তবু শুনিই না। আগুন লাগল কি করে?
সুরেশ অভিমান-ভরে বলিল, তা জানিনে।
তুমি গেলে কবে সেখানে?
দিন পাঁচ-ছয় পূর্বে। আমি খাইনি এখনো, আর দেরি করতে পারিনে, বলিয়া পুনরায় চলিবার উপক্রম করিতেই কেদারবাবু বলিয়া উঠিলেন, আহা-হা, নাওয়া-খাওয়া ত তোমাদের কারও হয়নি দেখচি, কিন্তু জলে পড়নি এটাও ত বাড়ি, এখানেও ত চাকরবাকর আছে। অচলা, ডাকো না একবার বেয়ারাটাকে—দাঁড়িয়ে রইলে কেন? বোস, বোস, সুরেশ, ব্যাপারটা কি হলো, খুলেই সব বল শুনি।
সুরেশ ফিরিয়া আসিয়া বসিল। একটু চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, রাত্রে ঘুমুচ্চি, মহিমের চিৎকারে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে দেখি, সমস্ত ধুধু করে জ্বলছে; খড়ের ঘর, নিবোবার উপায়ও ছিল না, সে বৃথা চেষ্টাও কেউ করলে না—সর্বস্ব পুড়ে গেল আর কি!
কেদারবাবু লাফাইয়া উঠিয়া বলিলেন, বল কি হে, সর্বস্ব পুড়ে গেল? কিছুই বাঁচাতে পারা গেল না? অচলার গয়নাপত্রগুলো?
সেগুলো বেঁচেচে।
তবু রক্ষে হোক! বলিয়া বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া আবার চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন। খানিকক্ষণ স্তব্ধভাবে বসিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তবু, কি করে আগুনটা লাগল?
সুরেশ কহিল, বললুম ত আপনাকে, সে খবর এখনো জানা যায়নি। তবে গ্রামের মধ্যে বড় কেউ আর তার শুভাকাঙ্ক্ষী নেই, তা জেনে এসেছি।
নেই বুঝি?
না।
কেদারবাবু আর কোন কথা কহিলেন না। অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া বসিয়া থাকিয়া পরিশেষে আর একটা গভীর নিঃশ্বাস মোচন করিয়া, উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, যাও, স্নান করে এসো গে সুরেশ, আর বেলা করো না। দেখি, রান্না-বান্নার কি যোগাড় হচ্ছে। বলিয়া তাহাকে সঙ্গে করিয়া বাহির হইয়া গেলেন।
আহারাদির পরেও তিনি সুরেশকে মুক্তি দেন নাই। সে একটা আরাম-চৌকির উপরে অর্ধনিদ্রিতাবস্থায় পড়িয়া ছিল। অচলাও সেই যে স্নানান্তে তাহার ঘরে গিয়া খিল দিয়াছিল, আর তাহার কোন সাড়াশব্দ ছিল না। বিশ্রাম ছিল না শুধু কেদারবাবুর। এখন যে টেলিগ্রাম আসা না আসার বিশেষ কোন সার্থকতা ছিল না, তাহারই জন্য সমস্ত বেলাটা ছটফট করিয়া, সন্ধ্যার সময় অসময়ে ঘুমানো উচিত নয়, এই অজুহাতে মেয়েকে ডাকাইয়া পাঠাইয়া, প্রথমেই বলিয়া উঠিলেন, তোমরা যে বললে, সে টেলিগ্রাম করেচে—কৈ তার ত কিছুই দেখিনে। তোমরা ট্রেনেতে এসে পড়লে, আর তারের খবর এতক্ষণেও পৌঁছল না। আচ্ছা, দাঁড়াও ত দেখি, বলিয়া মেয়ের মুখের জবাব না শুনিয়াই চটিজুতা ফটফট করিতে করিতে দ্রুতবেগে বাহির হইয়া গেলেন এবং ক্ষণকাল পরেই নীচে হইতে তাঁহার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর স্পষ্ট শুনা যাইতে লাগিল। অচলার দাসীকে ধরিয়া তিনি নানাপ্রকারে জেরা করিতেছেন, এবং প্রত্যুত্তরে সে আশ্চর্য হইয়া বারংবার প্রতিবাদ করিয়া বলিতেছে, সে কি বাবু, আগুন লেগে ঘরদোর সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল, চক্ষে দেখে এলুম, আর আপনি বলছেন, পোড়েনি! আর আগুন যদি না-ই লাগবে, তবে ঘরদোর পুড়ে ভস্ম হয়ে গেল কি করে, একবার বিবেচনা করে দেখুন দেখি!
সুরেশ সমস্তই শুনিতেছিল; সে মাথা তুলিয়া দেখিল, অচলা চৌকাঠ ধরিয়া দাঁড়াইয়া পাংশু-মুখে কান পাতিয়া প্রত্যেক কথাটি গিলিতেছে। শুষ্ক উপহাসের ভঙ্গিতে কহিল, তোমার বাবার হল কি, বলতে পারো?
অচলা চমকিয়া মুখ ফিরাইয়া বলিল, না।
সুরেশ কহিল, আমি নিশ্চয়ই বলতে পারি উনি বিশ্বাস করেন নি। ওঁর ধারণা, আগুন লাগার গল্পটা আমাদের আগাগোড়া বানানো। একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, সত্যি-মিথ্যে একদিন টের পাবেনই, কিন্তু ওঁর সন্দেহটা এমন যে, এখানে আসা আমার পক্ষে একেবারে অসম্ভব হয়ে উঠেচে।
অচলা শুষ্কমুখে জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি আর আসবেন না?
সুরেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, বোধ করি সম্ভব নয়। আমারও ত কিছু আত্মসম্মান বোধ আছে। কোন লোককে দিয়ে আমার ব্যাগটা বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ো।
অচলা ঘাড় নাড়িয়া বলিল, আচ্ছা। কিন্তু তাহার এখানে আসা না-আসার সম্বন্ধে কোন কথা কহিল না।
তা হলে কাল সকালেই দিয়ো। অনেক দরকারী জিনিস আমার ওর মধ্যে আছে, বলিয়া সে কেদারবাবুর জন্যে অপেক্ষা না করিয়াই বাহির হইয়া গেল।
কেদারবাবু ফিরিয়া আসিয়া কিছু আশ্চর্য হইলেন বটে, কিন্তু মনে মনে যে অপ্রসন্ন হইয়াছেন, তাহা বোধ হইল না।
রাত্রে বহুক্ষণ পর্যন্ত শয্যার উপর ছটফট করিয়া অচলা উঠিয়া পড়িল। তাহার ইচ্ছা, বাহিরে বারান্দায় দাঁড়াইয়া সম্মুখের রাজপথের উপর লোকচলাচলের প্রতি চাহিয়া কিছুক্ষণের জন্যেও অন্যমনস্ক হয়।
তাহার ঘরের ও-দিকের কবাট খুলিয়া সে বারান্দায় আসিয়া দেখিল, তখনও বসিবার ঘরে আলো জ্বলিতেছে। প্রথমে মনে করিল, চাকরেরা গ্যাস বন্ধ করিতে ভুলিয়া গিয়াছে। কিন্তু কয়েক পদ অগ্রসর হইতেই ভিতর হইতে তাহার পিতার কণ্ঠস্বর কানে আসিতে তাহার বিস্ময়ের পরিসীমা রহিল না। চিরদিন তিনি দশটা বাজিতে না বাজিতেই শয্যা গ্রহণ করেন; কিন্তু আজ সাড়ে দশটা বাজিয়া গিয়াছে। পরক্ষণেই দাসীর গলা শুনা গেল। সে বলিতেছে, এখন সোয়ামী মারা গেছে—আর যে মৃণাল-দিদিমণি শ্বশুরঘর করে, এমন ত আমার মনে হয় না বাবু। জামাইবাবুর সঙ্গে কি যে দাদা-নাতনী সুবাদ, তা তেনারাই জানে।
প্রত্যুত্তরে কেদারবাবু শুধু হুঁ বলিয়াই চুপ করিয়া রহিলেন।
অচলা বুঝিল, ইতিপূর্বে অনেক কথাই হইয়া গিয়াছে। মৃণালের সম্বন্ধে, মহিমের সম্বন্ধে, তাহার সম্বন্ধে—কিছুই বাদ যায় নাই। কিন্তু পাছে নিজের সম্বন্ধে নিরতিশয় অপ্রিয় কথা নিজের কানেই শুনিতে হয়, এই ভয়ে সে যেমন নিঃশব্দে আসিয়াছিল, তেমনই নীরবে ফিরিয়া যাইতে চাহিল; কিন্তু কিসে যেন তাহার পা লোহার শিকলে বাঁধিয়া দিয়া গেল।
কেদারবাবু অল্পক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া প্রশ্ন করিলেন, দু’জনের তা হলে বনিবনাও হয়নি বল?
ঝি কহিল, মোটে না বাবু, মোটে না। একটি দিনের তরে না।
এই দাসীটিকে অচলা নির্বোধ বলিয়াই এতদিন জানিত; আজ দেখিল, বুদ্ধি তাহার কাহারো অপেক্ষা কম নয়।
কেদারবাবু আবার মিনিট-খানেক মৌন থাকিয়া বলিলেন, কাল রাতে তা হলে কারও খাওয়া হয়নি বল? সুরেশ যাওয়া পর্যন্তই একরকম ঝগড়াঝাঁটিতেই দিন কাটছিল?
দাসীর উত্তর শুনা গেল না বটে, কিন্তু পিতার মুখের মন্তব্য শুনিয়াই বুঝা গেল, সে গ্রীবা আন্দোলনের দ্বারা কিরূপ অভিমত ব্যক্ত করিল। কারণ, পরক্ষণেই কেদারবাবু একটা গভীর নিশ্বাস মোচন করিয়া বলিলেন, এমনটি যে একদিন ঘটবে, আমি আগেই জানতুম। আজকালকার ছেলেমেয়েরা ত বাপ-মায়ের কথা গ্রাহ্য করে না; নইলে আমি ত সমস্তই একরকম ঠিক করে এনেছিলুম। আজ তা হলে ওর ভাবনা কি! বলিয়া আর একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিলেন, তাহাও স্পষ্ট শুনিতে পাওয়া গেল।
ঝি পূর্ণ সহানুভূতির সহিত প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কহিল, তাই বলুন ত বাবু, নইলে আজ ভাবনা কি! কোন্ অজ পাড়াগাঁয়ে কিনা একটা খোড়ো মেটে বাড়ি! তাও রইল কৈ? আজ জামাইবাবুও ত—, বলিয়া সেও কথাটাকে শেষ না করিয়াও একটা দীর্ঘশ্বাসের দ্বারা অনেকদূর পর্যন্ত ঠেলিয়া দিল।
কপাল! বলিয়া কেদারবাবু মিনিট-দুই নিঃশব্দে থাকিয়া, উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, আচ্ছা, তুই যা; বলিয়া তাহাকে বিদায় দিয়া আলো নিবাইবার জন্য বেয়ারাকে ডাকাডাকি করিতে লাগিলেন।
অচলা পা টিপিয়া আস্তে আস্তে তাহার ঘরে আসিয়া বিছানায় শুইয়া পড়িল। পিতার উদারতা, তাঁহার ভদ্রতাবোধের ধারণা কোনদিনই তাহার মনের মধ্যে খুব উচ্চ অঙ্গের ছিল না, কিন্তু সে যে বাটীর দাসীর সহিত নিভৃতে আলোচনা করিবার মত এত ক্ষুদ্র, ইহাও সে কখনও ভাবিতে পারিত না। আজ তাহার নিজের মন ছোট হইয়া মাটিতে লুটাইতেছে—কিন্তু তাহার স্বামী, তাহার পিতা, তাহার দাসী, তাহার বন্ধু—সবাই যখন তাহারই মত ভূমিতলে পড়িয়া, তখন কাহাকেও অবলম্বন করিয়া কোনদিন যে সে এই ধূলিশয্যা হইতে উঠিয়া দাঁড়াইতে পারিবে, এ ভরসা সে কল্পনা করিতেও পারিল না।