ফাউণ্ডেশন অ্যাণ্ড এম্পায়ার by আইজাক আসিমভ, chapter name দ্বিতীয় পর্ব : দ্য মিউল - ২৬. অনুসন্ধানের সমাপ্তি

দ্বিতীয় পর্ব : দ্য মিউল - ২৬. অনুসন্ধানের সমাপ্তি

কারো মুখে কথা নেই। বিস্ফোরণের শব্দের প্রতিধ্বনি গড়িয়ে চলে গেল নিচের কুঠুরীগুলোর দিকে, পরিণত হল গমগমে ভগ্ন শব্দে। মিলিয়ে গেল ফিসফিসানিতে। তার আগে খসে পড়া ব্লাস্টারের তীক্ষ্ণ ধাতব শব্দে চাপা পড়ল একবার। ম্যাগনিফিসোর তীব্র আর্তনাদ মসৃণ হল, ডুবে গেল টোরানের অব্যক্ত গর্জনের মাঝে।

যন্ত্রণাকাতর এক নীরবতা নেমে এল।

বেইটার মাথা নোয়ানো। এক ফোঁটা অশ্রুবিন্দুতে আলো লেগে চিকচিক করে উঠল। শিশু বয়সের পর আর কখনো কাঁদেনি বেইটা।

টোরানের মাংসপেশি শক্ত হয়ে আছে, কিন্তু সে শিথিল করার চেষ্টা করল না।–মনে হল পরস্পরের সাথে সেঁটে থাকা দাঁতগুলো আর কোনোদিন আলগা করতে পারবে না। ম্যাগনিফিসোর মুখ ফ্যাকাশে, নিষ্প্রাণ।

শেষ পর্যন্ত চেপে থাকা দাঁতের ফাঁক দিয়ে অচেনা কণ্ঠে বলল টোরান, “তুমি তা হলে মিউলস ওমেন। ও তোমাকে দলে টেনেছে!”

মাথা তুলল বেইটা। মুখে যন্ত্রণাকাতর কৌতুকের ছাপ, “আমি মিউলস ওম্যান? কী চমৎকার!”

জোর করে হাসল একটু। চুলগুলো পিছনে সরিয়ে দিল, কণ্ঠস্বরে ফিরে এল প্রায় স্বাভাবিকতা। “সব শেষ, টোরান; এখন বলা যায়। কতদূর রক্ষা করেছি, আমি জানি না। তবে এখন সব খুলে বলা যায়।”

সম্ভবত প্রচণ্ড চাপের কারণেই টোরানের উত্তেজনা শিথিল হল। “কী বলবে, বে? আর কী বলার আছে?”

“বলব, যে দুর্ভাগ্য আমাদের পিছু নিয়ে এসেছে। এর আগেও আমরা ধারণা করেছিলাম। মনে নেই? সব সময় বিপদ আমাদের পিছু লেগেছিল, কিন্তু কীভাবে যেন অল্পের জন্য বেঁচে যাই। আমরা ফাউণ্ডেশন-এ গেলাম-এবং সেটা পরাজিত হল, অথচ স্বাধীন বণিকেরা তখনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে-কিন্তু হেভেনে যাওয়ার জন্য সময়মতো বেরিয়ে আসতে পারলাম। পৌঁছলাম হেভেনে এবং সেটা পরাজিত হল, কিন্তু আবারো সময়মতো বেরিয়ে আসতে পারলাম। গেলাম নিওট্রানটর এবং কোনো সন্দেহ নেই যে এই মুহূর্তে ওটা মিউলের পক্ষে যোগ দিয়েছে।”

মাথা নাড়ল টোরান, “বুঝতে পারছি না।”

“টোরি, এমন ঘটনা বাস্তব জীবনে ঘটে না। তুমি আর আমি অতি সাধারণ মানুষ; এক বছরের মধ্যে আমাদের একটার পর একটা রাজনৈতিক ঝড়ের শিকার হওয়ার কথা না, যদি না সেই ঝড় আমাদের সাথেই থাকে, যদি না জীবাণুর উৎসটাকে আমরা সব সময় কাছে রাখি। এখন বুঝতে পারছো?”

ঠোঁট দুটো চেপে বসল টোরানের। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকাল ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত দেহের দিকে, যা এক সময় ছিল মানুষ। অসুস্থ বোধ করল সে।

“চলো এখান থেকে বেরোই, বে। ভোলা বাতাসে যাই।”

আকাশে মেঘ জমেছে। ঝড়ো বাতাসে বেইটার চুল এলোমেলো হয়ে গেল। ম্যাগনিফিসো এতক্ষণ হামাগুড়ি দিয়ে পড়েছিল, এবার পায়ে পায়ে বেরিয়ে এল তাদের সাথে।

“এবলিং মিস কে তুমি খুন করেছ, কারণ তোমার ধারণা সেই জীবাণুর উৎস?” বেইটার চোখের দিকে তাকিয়ে একটা ধাক্কা খেল সে। ফিসফিস করে বলল, “সেই মিউল?” কথাগুলো নিজেরই বিশ্বাস হল না।

“এবলিং মিউল? গ্যালাক্সি; না! ও মিউল হলে আমি তাকে খুন করতে পারতাম না। আমার অঙ্গভঙ্গি থেকে সহজেই আমার ইমোশন ধরে ফেলত সে, তারপর সেটাকে ভালভাসা, অনুরাগ ভয়, আতঙ্ক যা ইচ্ছা হয় তাই বানিয়ে দিত না। এবলিংকে আমি খুন করি। কারণ সে মিউল না; আমি তাকে খুন করি, কারণ সে জেনে ফেলেছিল সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন কোথায় এবং দুই সেকেণ্ডের মধ্যেই গোপন কথাটা মিউলকে জানিয়ে দিত।

গোপন কথাটা মিউলকে জানিয়ে দিত,” বোকার মতো পুনরাবৃত্তি করল টোরান। “মিউলকে জানাতো”

তারপর আর্তনাদ করে তীব্র আতঙ্কে ফিরে তাকাল মিউলের ভাড়ের দিকে যে মাটিতে গুটিসুটি মেরে বসে আছে, কী নিয়ে আলোচনা চলছে সেই ব্যাপারে পুরোপুরি অচেতন।

“ম্যাগনিফিসো?”

“শোন, নিওট্রানটরে কী হয়েছিল মনে আছে? ওহ, একটু ভাবো, টোরি-”

কিন্তু শুধু মাথা নেড়ে বিড় বিড় করতে লাগল টোরান।

ক্লান্ত সুরে বলে চলেছে বেইটা, “নিওট্রানটরে একজন মানুষ মারা যায়। অথচ কেউ তাকে স্পর্শ করেনি। তাই না? ভিজি সোনার বাজাচ্ছিল ম্যাগনিফিসো, যখন তার বাজনা শেষ হয় ক্রাউন প্রিন্স তখন মৃত। অদ্ভুত, তাই না? এটা কী অস্বাভাবিক না, যে ক্রিয়েচার জগতের সবকিছুর ভয়ে তটস্থ শুধু ইচ্ছা শক্তি দিয়ে খুন করার ক্ষমতা তার আছে।”

“লাইট-ইফেক্ট এবং বাজনা দুটোর নিখুঁত ইমোশনাল ইফেক্ট”

“হ্যাঁ, ইমোশনাল ইফেক্ট। যথেষ্ট বড়। ইমোশনাল ইফেক্ট হচ্ছে মিউলের বিশেষত্ব। দৈবঘটনা হিসেবে ধরে নেওয়া যায় যে সে এরকম ভয়ংকরভাবে খুন করতে পারে। কারণ মিউল তার মাইণ্ড টেম্পার করেছে। কিন্তু টোরান ভিজি-সোনারের যে কম্পোজিশনটা প্রিন্সকে খুন করে সেটার এক ঝলক আমি দেখেছি। সামান্য কিন্তু তাতেই টাইম ভল্টে যে অনুভূতি হয়েছিল সেই রকম অনুভূতি হয়। সীমাহীন হতাশা। টোরান, সেই অনুভূতি চিনতে আমার ভুল হয় না।”

মেঘ জমল টোরানের মুখে। “আমিও…অনুভব করেছি। মনে ছিল না। কখনো চিন্তাও করিনি-”

“সেই সময় প্রথম আমার মাথায় চিন্তাটা আসে। একটা অস্পষ্ট অনুভূতি-ইনটুইশন। কোনো প্রমাণ ছিল না। কিন্তু তারপর প্রিচার এসে মিউল এবং তার মিউট্যাশনের কথা জানায়। মুহূর্তের মধ্যে সব পরিষ্কার হয়ে যায় আমার কাছে। টাইমভল্টের হতাশা তৈরি করেছিল মিউল; নিওট্রানটরে হতাশা তৈরি করে ম্যাগনিফিসো। সেই একই ইমোশন। কাজেই মিউল আর ম্যাগনিফিসো একই ব্যক্তি। খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে না, টোরি? ঠিক যেন জ্যামিতির অনুমিতি। থিংস ইকুয়াল টু সেম থিংস আর ইকুয়াল টু ইচ আদার।”

হিস্টিরিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে সে। কিন্তু অপরিসীম জোর খাঁটিয়ে নিজেকে আরস্থ করল, “আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। যদি ম্যাগনিফিসোই হয় মিউল, আমার আবেগ সে জানে-এবং নিজের উদ্দেশে ব্যবহার করতে পারবে। ওকে জানতে দেওয়ার সাহস আমার ছিল না। তাকে এড়িয়ে চলতে লাগলাম। সৌভাগ্যক্রমে, সেও আমাকে এড়িয়ে চলতে লাগল; এবলিং মিস এর প্রতি খুব বেশি আগ্রহী হয়ে উঠে। মিস কথা বলার আগেই তাকে খুন করার পরিকল্পনা করি আমি। গোপনভাবে, এতই গোপনভাবে যে নিজেকে বলারও সাহস হয়নি। যদি মিউলকে খুন করতে পারতাম কিন্তু ঝুঁকি ছিল তাতে। ধরা পড়ে যেতাম হয়তো। তখন সব হারাতে হত।”

কর্কশ গলায় বলল টোরান, “অসম্ভব। ওই অদ্ভুত ক্রিয়েচারটার দিকে দেখো। সে মিউল? আমাদের কথা পর্যন্ত শুনছে না।”

কিন্তু নির্দেশিত আঙুল অনুসরণ করে যখন তাকাল সে, ম্যাগনিফিসো তখন দৃঢ় সতর্ক, দৃষ্টি ধারালো, গভীর উজ্জ্বল। বাচনভঙ্গি অচেনা, “আমি শুনেছি, বন্ধু। শুধু বসে বসে ভাবছিলাম, এত কৌশলে এবং বুদ্ধি খাঁটিয়ে চমৎকার একটা পরিকল্পনা করেছিলাম, কিন্তু সামান্য ভুলে কত বড় ক্ষতি হল।”

হোঁচট খেয়ে পিছিয়ে এল টোরান, যেন ভয় পাচ্ছে ক্লাউন তাকে স্পর্শ করবে বা তার নিশ্বাস সংক্রামিত হবে।

মাথা নেড়ে অনুচ্চারিত প্রশ্নের জবাব দিল ম্যাগনিফিসো, “আমি মিউল।”

শারীরিক দিক দিয়ে তাকে আগের চেয়ে বিশাল কিছু মনে হল না; কাঠির মতো সরু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, লম্বা নাকের ভাঁজ থেকে শুধু হাস্যকর রূপটা সরে গেছে; তার আচরণ দৃঢ় আরবিশ্বাসী।

জন্মগত সহজতায় পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলেছে সে।

প্রশ্রয়ের সুরে বলল সে, “বসুন আপনারা। যেভাবে আরাম বোধ করবেন। খেলা শেষ, আমি আপনাদের একটা গল্প শোনাবো। আমার একটা দুর্বলতা-আমি চাই মানুষ যেন আমাকে বোঝে।

এবং যখন সে বেইটার দিকে তাকাল, তার দৃষ্টি হয়ে গেল আবার কোমল বাদামি; ম্যাগনিফিসো দ্য ক্লাউনের দৃষ্টি।

“মনে রাখার মতো উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা আমার শৈশবে ঘটেনি। হয়তো আপনারা বুঝবেন। আমার অস্বাভাবিক দৈহিক আকৃতি, অদ্ভুত নাক, এসব নিয়েই জন্মাই। আমাকে দেখার আগেই আমার মা মারা যায়। বাবার পরিচয় জানি না। স্বাভাবিক শৈশব আমার জন্য ছিল অসম্ভব। সীমাহীন মানসিক নির্যাতনের মধ্যে আমি বেড়ে উঠতে থাকি, নিজের প্রতি করুণা এবং অন্যের ঘৃণা নিয়ে। তখন থেকেই সবাই আমাকে জানত অস্বাভাবিক বলে। সবাই এড়িয়ে চলত; বেশিরভাগ ঘৃণায়, কিছু কিছু ভয়ে। অদ্ভুত ঘটনা ঘটত-নেভার মাইণ্ড-আমি যে মিউট্যান্ট, এটা বের করতে ক্যাপ্টেন প্রিচারকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কিন্তু নিজে বুঝতে পেরেছিলাম বিশ বছর বয়সে।”

মেঝেতে বসে কথা শুনছে টোরান আর বেইটা। ম্যাগনিফিসো-বা মিউল পায়চারি করছে তাদের সামনে। বুকের উপর হাত বেঁধে মাথা নিচু করে কথা বলছে।

“আমার স্বাভাবিক ক্ষমতার ব্যাপারটা বুঝতে শুরু করি ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে। আমার নিজেরই বিশ্বাস হয়নি। আমার কাছে মানুষের মাইণ্ড এক ধরনের ডায়াল, ইমোশন চিহ্নিত করার জন্য যে ডায়ালে অনেকগুলো পয়েন্টার আছে। দুর্বল চিত্র, কিন্তু এর চাইতে ভালো ব্যাখ্যা আমি কীভাবে দেব? ধীরে ধীরে শিখলাম যে আমি মানুষের মাইণ্ডে পৌঁছতে পারি এবং পয়েন্টারটাকে যেখানে ইচ্ছা নিয়ে যেতে পারি। সেখানেই আটকে রাখতে পারি। অন্যেরা এই কাজটা পারে না, সেটা বুঝতে আরো বেশি সময় লেগেছিল।

“যাই হোক, আমার ক্ষমতার ব্যাপারে আমি সচেতন হয়ে উঠলাম। এবং সেই সাথে প্রথম জীবনের ভোগ করা দুঃসহ যন্ত্রণার ক্ষতি পূরণের ইচ্ছা প্রবল হল। আপনারা হয়তো বুঝবেন। হয়তো বোঝার চেষ্টা করবেন। অদ্ভুত, অস্বাভাবিক হয়ে উঠা কতো কঠিন-যার মন আছে, সে বুঝতে পারে। মানুষের কৌতুককর নিষ্ঠুরতা। অন্যের থেকে আলাদা! বহিরাগত।

“সেই অভিজ্ঞতা আপনাদের কখনো হয়নি।”

আকাশের দিকে তাকিয়ে গোড়ালি দিয়ে মেঝেতে তাল ঠুকতে লাগল ম্যাগনিফিসো। “কিন্তু আমি শিখে নিলাম, এবং সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমি গ্যালাক্সি বদলে দিতে পারি। ওরা ওদের ইনিংস খেলেছে। আর আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছি-প্রায় বাইশ বছর। এবার আমার পালা। এবং গ্যালাক্সির জন্য অস্বাভাবিক কিছুই উপযুক্ত! আমি একা! ওরা কোয়াড্রিলিয়ন!”

থেমে দ্রুত তাকাল একবার বেইটার দিকে। কিন্তু আমার একটা দুর্বলতা ছিল। আমার নিজের কিছু ছিল না। যা পেয়েছি, সব অন্যের হাত দিয়ে মিডলম্যানের মাধ্যমে। সব সময়ই! প্রিচারের কাছে তো শুনেছেনই কীভাবে আজকের অবস্থানে পৌঁছাই। ফাউণ্ডেশন যখন দখল করি-তখনই দৃশ্যপটে আপনাদের আবির্ভাব ঘটে।

“ফাউণ্ডেশন দখল ছিল আমার সবচেয়ে কঠিন কাজ। তাকে পরাজিত করার জন্য শাসকশ্রেণীর বিশাল অংশের উপর আমার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হয়। হালকা পাতলাভাবে করতে পারতাম-কিন্তু সহজ কোনো উপায় নিশ্চয় আছে, সেটাই আমি খুঁজতে লাগলাম। আসলে একজন শক্তিশালী লোক যদি পাঁচ শ পাউণ্ড ওজন তুলতে পারে তার মানে এই না যে সবসময়ই তুলবে। ইমোশনাল কন্ট্রোল বেশ কঠিন। প্রয়োজন ছাড়া আমি এটাকে ব্যবহার করতে চাই না। তাই ফাউণ্ডেশনে হামলা করার আগে আমার মিত্র খুঁজে বের করার প্রয়োজন হয়।

“ক্লাউনের ছদ্মবেশে, ফাউণ্ডেশন থেকে যেসব এজেন্ট আমার সম্পর্কে খোঁজ, খবর করতে আসে তাদের উপর নজর রাখতে শুরু করি। আমি এখন জানি যে ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচারকেই আমি খুঁজছিলাম। ভাগ্যক্রমে পেয়ে যাই আপনাদের। আমি একজন টেলিপ্যাথ আর, মাই লেডি, আপনি এসেছিলেন ফাউণ্ডেশন থেকে। ওটাই আমাকে বিপথে পরিচালিত করে। পরে প্রিচারের আমাদের সাথে যোগ দেয়াটা মারারক ছিল না, কিন্তু ঠিক ওই সময় থেকেই আমি মারারক ভুল করা শুরু করি।

প্রচণ্ড রাগের সাথে বলল টোরান, “দাঁড়াও। কালগানে যখন একটা স্টান্ট পিস্তল নিয়ে লেফটেন্যান্টের মুখোমুখি হয়ে তোমাকে বাঁচাই তখন তুমি আমাকে ইমোশন্যালি কন্ট্রোল করছিলে। অর্থাৎ পুরো সময়ই তুমি আমাকে টেম্পার করে রেখেছ।”

ম্যাগনিফিসোর মুখে চিকন হাসি। “কেন নয়? আপনার কাছে কী স্বাভাবিক মনে হয়েছে? নিজেকেই প্রশ্ন করুন-স্বাভাবিক অবস্থায় কী আমার মতো অস্বাভাবিক কাঠামোর একজনকে বাঁচানোর জন্য জীবনের উপর ঝুঁকি নিতেন? পরে নিশ্চয়ই বেশ অবাক হয়েছিলেন।”

“হ্যাঁ, হয়েছিল,” নিরাসক্ত গলায় বলল বেইটা।

“যাই হোক, টোরানের কোনো বিপদ হত না। লেফটেন্যান্টকে কড়া নির্দেশ দেওয়া ছিল আমাদেরকে যেন ছেড়ে দেয়। আমরা তিনজন এবং প্রিচার চলে আসি ফাউণ্ডেশন এবং দ্রুত আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উপায় খুঁজতে থাকি। যখন প্রিচারের কোর্ট মার্শাল হচ্ছে, তখন আমরাও ছিলাম সেখানে। আমি ব্যস্ত ছিলাম। ওই বিচার অনুষ্ঠানের সামরিক বিচারকরাই পরে যুদ্ধে স্কোয়াড্রনগুলোর নেতৃত্ব দেয়। খুব সহজেই ওরী আত্মসমর্পণ করে এবং হোরলেগরে আমার নেভি জয়ী হয়।

“প্রিচার এর মাধ্যমে ড. মিস এর সাথে আমার দেখা হয়। সেই সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় একটা ভিজি সোনার এনে দিয়ে আমার কাজ আরো সহজ করে দেয়।”

“কনসার্টগুলো!” বাধা দিল বেইটা। “আমি মিলানোর চেষ্টা করছিলাম। এখন বুঝতে পারছি।”

“হ্যাঁ। ভিজি সোনার একরকম ফোকাসিং ডিভাইস হিসেবে কাজ করে। ইমোশনাল কন্ট্রোলের জন্য এটা আসলেই একটা পুরোনো ডিভাইস। এটা দিয়ে আমি বহুসংখ্যক মানুষকে একসাথে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হই। ফাউণ্ডেশন এবং হেভেনে কনসার্টের মাধ্যমেই আমি আসমর্পণের অনুভূতি তৈরি করি।

“কিন্তু, এবলিং মিস ছিল আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। সে হয়তো-” একটা হতাশা গ্রাস করল ম্যাগনিফিসোকে, কিন্তু কাটিয়ে উঠল সেটা, “ইমোশনাল কন্ট্রোলের কতগুলো বিশেষ দিক আছে, যা আপনারা জানেন না। ইনটুইশন, দিব্যজ্ঞান যাই বলুন না কেন সবই ইমোশন। আমি তাই মনে করি। বুঝতে পারেননি। তাই না?”

একটা না বোধক উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল, “হিউম্যান মাইণ্ড সর্বনিম্ন ক্ষমতায় কাজ করে। নিজের ক্ষমতার মাত্র বিশ পার্সেন্ট ব্যবহার করে। যখন কেউ তার চেয়ে বেশি ব্যবহার করে আমরা সেটাকেই বলি ইনটুইশন বা দিব্যজ্ঞান। আমি মানুষের মস্তিষ্ককে সম্পূর্ণ প্রচেষ্টা নিয়োগ করতে উদ্দীপ্ত করতে পারি। যার উপর প্রয়োগ করা হয়, সে মারা যায়, কিন্তু কার্যকরী-নিউক্লিয়ার ফিল্ড-ডিপ্রেসর কালগানের এক টেকনিশিয়ানের উপর এরকম অধিক চাপ প্রয়োগ করে বানিয়েছিলাম।

“এবলিং মিস এর যোগ্যতা ছিল অনেক বেশি। ফাউণ্ডেশন-এর সাথে যুদ্ধের অনেক আগেই আমি এম্পায়ারের কাছে প্রতিনিধি পাঠাই-তখনই সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন-এর কথা জানতে পারি। তখন থেকেই আমি খুঁজছি। স্বভাবতই পাইনি এবং স্বভাবতই জানি যে আমি পাবই-এবং সমাধান ছিল এবলিং মিস। একটা উঁচু মানের দক্ষ মাইণ্ড থাকাতে সে হয়তো হ্যারি সেলডনের পুরো গবেষণা ডুপ্লিক্যাট করতে পারত।

“আংশিকভাবে, সে সফল। আমি তাকে সামর্থ্যের শেষ সীমায় নিয়ে যাই। নিষ্ঠুর কাজ কিন্তু ফলদায়ক। শেষ পর্যন্ত সে মারাই যেত। কিন্তু” আবারো একটা হতাশা বাধা দিল তাকে। “সে যথেষ্ট দিন বেঁচে থেকেছে। আমরা তিনজনে মিলে সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশনে যেতে পারতাম। এটাই হতে পারত শেষ যুদ্ধ-কিন্তু আমার ভুলের জন্য।”

কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করল টোরান, “তুমি কী ভুল করেছো?”

“কেন, আপনার স্ত্রী। আপনার স্ত্রী অসাধারণ মানুষ। জীবনে কখনো এমন কারো সাথে দেখা হয়নি। আমি…আমি…” হঠাৎ করেই ম্যাগনিফিসোর কণ্ঠ ভেঙে গেল। আরস্থ হল অনেক কষ্টে। তার চার পাশে একটা আনন্দের আভা। “তার ইমোশন কন্ট্রোল না করলেও সে আমাকে পছন্দ করে। প্রথম দেখায়। আমাকে দেখে সে অবাক হয়নি বা হাসেনি। পছন্দ করে।

“বুঝতে পারছেন না? বুঝতে পারছেন না আমার কাছে তার অর্থটা কি? এর আগে কেউ-যাই হোক, আমি…সেটা সযত্নে লালন করতে থাকি। তার মাইণ্ড আমি টেম্পার করিনি। মূল অনুভূতি বজায় রাখতে দেই। এটাই আমার ভুল। আমার নিজের ইমোশন আমাকে ভুল পথে পরিচালিত করে। যেখানে আমি অন্য সকলের মাস্টার।

“আপনি টোরান সবসময় ছিলেন কন্ট্রোল্ড। অথচ কখনো সন্দেহ করেননি, আমাকে কখনো প্রশ্ন করেননি; আমার ভেতরে অদ্ভুত বা অস্বাভাবিক কিছু দেখেননি। যেমন যখন ‘ফিলিয়ান’ শিপ আমাদের থামায়। ওরা আমাদের অবস্থান জানতো, কারণ আমি সব সময় তাদের সাথে যোগাযোগ রেখেছিলাম যেমন সব সময় যোগাযোগ ছিল আমার জেনারেলদের সাথে। যখন থামানো হল আমাকে নিয়ে যাওয়া হল হ্যান প্রিচারকে কনভার্ট করার জন্য। যখন বেরিয়ে আসি তখন সে একজন কর্নেল। পুরো ঘটনা আপনার সামনে ঘটে, কিন্তু কিছুই ধরতে পারেননি। আমার ব্যাখ্যা বিনা প্রশ্নে মেনে নেন। বুঝতে পারছেন?

দাঁত বের করে হাসল টোরান এবং চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল, “জেনারেলদের সাথে কীভাবে যোগাযোগ রেখেছিলে?”

“তেমন জটিল কিছু না। হাইপারওয়েভ ট্রান্সমিটার চালানো সহজ এবং পোর্টেবল। আমি ধরাও পড়তাম না। কেউ দেখে ফেললেও তার স্মৃতিতে ঘটনাটা থাকত না।

“নিওট্র্যানটরে আমার ইমোশন আবার আমার সাথে বেঈমানি করে। বেইটা আমার কন্ট্রোলে ছিল না তারপরেও সন্দেহ করতে পারত না যদি ক্রাউন প্রিন্সের ব্যাপারটা অন্যভাবে সামলাতাম। বেইটার প্রতি তার আচরণ আমাকে রাগিয়ে তোলে। আমি তাকে খুন করি। চরম বোকামি হয়েছে সেটা।

“এবং এখনো আপনারা সন্দেহ করলেও, নিশ্চিত হতে পারতেন না। যদি আমি প্রিচারের বকবকানি থামিয়ে দিতাম এবং মিস এর দিকে আরেকটু কম মনযোগ দিতাম।” শ্রাগ করল সে।

“এখানেই শেষ?” জিজ্ঞেস করল বেইটা।

“এখানেই শেষ।”

“এবার কী হবে তা হলে?”

“আমি আমার পরিকল্পনা এগিয়ে নিয়ে যাবে। যদি এবলিং মিস এর মতো বুদ্ধিমান এবং উচ্চ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত আরেকজনকে পাই। নয়তো অন্য কোনোভাবে আমাকে সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন খুঁজে বের করতে হবে। একদিক দিয়ে আপনারা আমাকে পরাজিত করেছেন।”

এবার উঠে দাঁড়াল বেইটা, বিজয়িনীর মতে, “একদিক দিয়ে? শুধু একদিক দিয়ে। আমরা তোমাকে পুরোপুরি পরাজিত করেছি। ফাউণ্ডেশন-এর বাইরে তোমার বিজয়গুলোর কোনো মূল্য নেই। ফাউণ্ডেশন-এর দখলটাও খুব সামান্য বিজয়, কারণ তাতে তোমার সমস্যাগুলো কমছে না। তোমাকে অবশ্যই সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন পরাজিত করতে হবে-এবং এই সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশনই তোমাকে পরাজিত করবে। তোমার একমাত্র সুযোগ হচ্ছে হামলা করার জন্য প্রস্তুত হওয়ার আগেই সেটাকে খুঁজে বের করে নিঃশেষ করে দেওয়া। কিন্তু তুমি পারবে না। এখন থেকে প্রতি মুহূর্তে তারা তোমার জন্য তৈরি হতে থাকবে। এই মুহূর্তে, এই মুহূর্ত থেকেই হয়তো কাজ শুরু হয়ে গেছে। বুঝতে পারবে-যখন তারা আক্রমণ করবে। তোমার স্বল্প দিনের ক্ষমতা শেষ। তুমি ইতিহাসের পাতায় একজন রক্তলোলুপ হানাদার ছাড়া আর কিছুই না।”

জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল সে, প্রায় হাঁপানোর মতো, “আমরা তোমাকে পরাজিত করেছি, আমি আর টোরান। এখন আমি মরলেও খুশি।”

কিন্তু মিউলের বিষণ্ণ চোখগুলো আবার ম্যাগনিফিসোর অনুরক্ত বাদামি চোখে পাল্টে গেছে। “আমি আপনাকে বা আপনার স্বামীকে মারব না। আমাকে আঘাত করাও আপনাদের পক্ষে অসম্ভব। আর আপনাদের মেরে ফেললেও এবলিং মিস ফিরে আসবে না। আমার ভুলের দায় বহন করতে হবে আমাকেই। আপনি আর আপনার স্বামী যেতে পারেন। নির্বিঘ্নে চলে যান, আমি যাকে বলি-বন্ধুত্ব-সেই খাতিরে।”

তারপর হঠাৎ গর্বের সুরে বলল, “কিন্তু আমি এখনো মিউল। গ্যালাক্সির সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ। এখনো আমি সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশনকে পরাজিত করতে পারি।”

শান্ত শীতল দৃঢ়তার সাথে শেষ তীরটা ছুঁড়ে দিল বেইটা, “তুমি পারবে না। সেলডনের উপর এখনো আমার বিশ্বাস আছে। তুমি তোমার ডাইন্যাস্টির প্রথম এবং শেষ শাসক।

নতুন একটা চিন্তা আঁকড়ে ধরল ম্যাগনিফিসোকে। “আমার ডাইন্যাস্টি? হ্যাঁ, কথাটা অনেকবারই ভেবেছি যে আমি একটা ডাইন্যাস্টি তৈরি করব।”

তার দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে বরফের মতো জমে গেল বেইটা। মাথা নাড়ল ম্যাগনিফিসো, “কী ভাবছেন বুঝতে পারছি। অকারণ ভয় পাচ্ছেন। পরিস্থিতি অন্যরকম হলে আমি খুব সহজেই আপনাকে সুখী করতে পারতাম। হয়তো কৃত্রিম, কিন্তু আসল ইমোশনের সাথে কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু পরিস্থিতি অন্যরকম না। আমি নিজেকে বলি মিউল-কিন্তু সেটা আমার ক্ষমতার কারণে না-অবশ্যই।”

সে চলে গেল। পিছন ফিরে তাকাল না।