রাণী-সন্দর্শন
একদিন সম্মুখের গলির মোড়ে দেখিলাম, এক ভিক্ষুক বিকট অঙ্গ-ভঙ্গী করিয়া পথ-যাত্রীর করুণা উদ্রেক করিবার চেষ্টা করিতেছে। লোকটা একেবারেই ভণ্ড; প্রতারণা করিয়া সকলকে ঠকাইতেছে বলিয়া আমার রাগ হইল। এই সময় সেখান দিয়া একটি স্ত্রীলোক যাইতেছিল। তাহার পরনে ছেঁড়া কাপড়। ভিক্ষুকের কান্না শুনিয়া স্ত্রীলোকটি থমকিয়া দাড়াইল এবং তাহার দিকে কাতর নয়নে চাহিয়া দেখিল। তাহার অঞ্চলের কোণে একটি মাত্র পয়সা বাঁধা ছিল; হয়ত তাহাই তাহার সর্ব্বস্ব। বিনা বাক্যব্যয়ে সে সেই পয়সাটি ভিক্ষুককে দিয়া চলিয়া গেল। সেই দিনেই আমার প্রকৃত রাণী-সন্দর্শন লাভ হইয়ছিল- মাতৃরুপিনী জগদ্ধাত্রী রাণী! এইজন্যই তো বয়স নির্ব্বিশেষে ছোট মেয়ে হইতে বর্ষীয়সী পর্য্যন্ত সকল নারীকেই আমরা মা বলিয়া সম্বোধন করি।
বাঘিনী মাতৃস্নেহে মমতাপন্ন হয়। একবার ১০।১২ বৎসরের একটি ছেলে দেখিলাম। শিশুকালে নেকড়ে-বাঘিনী তাহাকে লইয়া যায়। ক্ষুধার্ত্ত শিশু বাঘিনীর স্তন্যপান করিতে চেষ্টা করিয়ছিল, তাহাতে তাহার প্রাণরক্ষা হইল। সেই অবধি বাঘিনী স্বীয় শাবকের ন্যায় তাহাকে পালন করিয়াছিল। কিন্তু শাবকদিকের প্রাণরক্ষার জন্য সে অন্যমূর্ত্তি ধরিয়াছিল এবং শেষ মুহূর্ত্ত পর্য্যন্ত যু্দ্ধ করিয়া মরিয়াছিল। মাতৃস্নেহে দুইটি রূপ দেখা যায়; উভয়ই আশ্রিতের রক্ষা হেতু। একটি মমতাপন্না করুণাময়ী, অন্যটি সংহাররূপিনী শক্তিময়ী।
নারীর হৃদয়ের যে সন্তান-স্নেহ উথলিত হইয়া সমস্ত দুস্থজনকে সন্তান জ্ঞানে আগুলিয়া রাখিবে, তাহা আশ্চর্য্য নহে। এতদ্ব্যতীত নারী স্বতঃই অভিমানিনী; প্রিয়জনের লাঞ্ছনা তাহাকে মর্ম্মে মর্ম্মে বিদ্ধ করে। হে অভিমানিনী রমণী, ভাবিয়া দেখিয়াছ কি, তুমি যাহার গৌরবে গৌরবিনী, এ জগতে তাহার স্থান কোথায়? পৃথিবী হইতে শান্তি পলায়ন করিয়াছে, সম্মুখে ঘোর দুর্দ্দিন। যাহার উপর তুমি নির্ভর করিয়া আছ, সে কি এই দুর্দ্দিনে তোমাকে ঘোরতর লাঞ্ছনা হইতে রক্ষা করিতে পারিবে? বাক্য ছাড়া যে তাহার আর কোন অস্ত্র নাই। কে তাহার বাহু সবল করিবে, হৃদয়ের শক্তি দুর্দ্দম রাখিবে এবং মৃত্যুর বিভীষিকার অতীত করিবে? এ সকল শিক্ষা তো মাতৃ-ক্রোড়েই হইয়া থাকে। কি তোমার দীক্ষা, যাহা দিয়া তুমি সন্তানকে মানুষ করিয়া গড়িবে? কৃচ্ছ্রসাধনা অথবা বিলাসিতা-ইহার কোন্ পথ তুমি গ্রহণ করিবে? রাণী হইয়া জন্মিয়াছিলে, দাসী হইয়াই কি তুমি মরিবে?