Bishbriksha by Bankim Chandra Chattopadhyay, chapter name একত্রিংশত্তম পরিচ্ছেদ : সকল সুখেরই সীমা আছে

একত্রিংশত্তম পরিচ্ছেদ : সকল সুখেরই সীমা আছে

কুন্দনন্দিনী যে সুখের আশা করিতে কখন ভরসা করেন নাই, তাঁহার সে সুখ হইয়াছিল। তিনি নগেন্দ্রের স্ত্রী হইয়াছিলেন। যে দিন বিবাহ হইল, কুন্দনন্দিনী মনে করিলেন, এ সুখের সীমা নাই, পরিমাণ নাই। তাহার পর সূর্যমুখী পলায়ন করিলেন। তখন মনে পরিতাপ হইল–মনে করিলেন, “সূর্যমুখী আমাকে অসময়ে রক্ষা করিয়াছিল–নহিলে আমি কোথায় যাইতাম–কিন্তু আজি সে আমার জন্য গৃহত্যাগী হইল। আমি সুখী না হইয়া মরিলে ভাল ছিল |” দেখিলেন সুখের সীমা আছে।

প্রদোষে নগেন্দ্র শয্যায় শয়ন করিয়া আছেন–কুন্দনন্দিনী শিয়রে বসিয়া ব্যজন করিতেছেন। উভয়ে নীরবে আছেন। এটি সুলক্ষণ নহে; আর কেহ নাই–অথচ দুই জনেই নীরব–সম্পূর্ণ সুখ থাকিলে এরূপ ঘটে না।

কিন্তু সূর্যমুখীর পলায়ন অবধি ইঁহাদের সম্পূর্ণ সুখ কোথায়? কুন্দনন্দিনী সর্বদা মনে ভাবিতেন, “কি করিলে, আবার যেমন ছিল, তেমনি হয় |” আজিকার দিন, এই সময় কুন্দনন্দিনী মুখ ফুটিয়া এ কথাটি জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি করিলে যেমন ছিল তেমনি হয়?”

নগেন্দ্র বিরক্তির সহিত বলিলেন, “যেমন ছিল, তেমনি হয়? তোমাকে বিবাহ করিয়াছি বলিয়া কি তোমার অনুতাপ হইয়াছে?”

কুন্দনন্দিনী ব্যথা পাইলেন। “তুমি আমাকে বিবাহ করিয়া যে সুখী করিয়াছ–তাহা আমি কখনও আশা করি নাই। আমি তাহা বলি না–আমি বলিতেছিলাম যে, কি করিলে সূ বলিলেন,মুখী ফিরিয়া আসে?”

নগেন্দ্র বলিলেন, “ঐ কথাটি তুমি মুখে আনিও না। তোমার মুখে সূর্য্যমুখীর নাম শুনিলে আমার অন্তর্দাহ হয়–তোমারই জন্য সূর্যমুখী আমাকে ত্যাগ করিয়া গেল |”

ইহা কুন্দনন্দিনী জানিতেন–কিন্তু নগেন্দ্রের ইহা বলাতে কুন্দনন্দিনী ব্যথিত হইলেন। ভাবিলেন, “এটি কি তিরস্কার? আমার ভাগ্য মন্দ–কিন্তু আমি ত কোন দোষ করি নাই। সূর্যমুখীই ত এ বিবাহ দিয়াছে |” কুন্দ আর কোন কথা না কহিয়া ব্যজনে রত হইলেন। কুন্দনন্দিনীকে অনেকক্ষণ নীরব দেখিয়া নগেন্দ্র বলিলেন, “কথা কহিতেছ না কেন? রাগ করিয়াছ?” কুন্দ কহিলেন, “না |”

ন। কেবল একটি ছোট্টো “না” বলিয়া আবার চুপ করিলেন। তুমি কি আমায় আর ভালবাস না?

কু। বাসি বই কি?

ন। “বাসি বই কি? এ যে বালক-ভুলান কথা। কুন্দ, বোধ হয়, তুমি আমায় কখন ভালবাসিতে না |”

কু। বরাবর বাসি।

নগেন্দ্র বুঝিয়াও বুঝিলেন না যে, এ সূর্যমুখী নয়। সূর্যমুখী ভালবাসা যে কুন্দনন্দিনীতে ছিল না–তাহা নহে–কিন্তু কুন্দ কথা জানিতেন না। তিনি বালিকা, ভীরুস্বভাব, কথা জানেন না, আর কি বলিবেন? কিন্তু নগেন্দ্র তাহা বুঝিলেন না, বলিলেন, “আমাকে সূর্যমুখী বরাবর ভালবাসিত। বানরের গলায় মুক্তার হার সহিবে কেন? লোহার শিকলই ভাল |”

এবার কুন্দনন্দিনী রোদন সংবরণ করিতে পারিলেন না। ধীরে ধীরে উঠিয়া বাহিরে গেলেন। এমন কেহ ছিল না যে, তাঁহার কাছে রোদন করেন। কমলমণি আসা পর্যন্ত কুন্দ তাঁহার কাছে যান নাই–কুন্দনন্দিনী, আপনাকে এ বিবাহের প্রধান অপরাধিনী বোধ করিয়া লজ্জায় তাঁহার কাছে মুখ দেখাইতে পারেন নাই। কিন্তু আজিকার মর্মপীড়া, সহৃদয়া স্নেহময়ী কমলমণির সাক্ষাতে বলিতে ইচ্ছা করিলেন। সে দিন, প্রণয়ের নৈরাশ্যের সময় কমলমণি তাঁহার দু:খে দু:খী হইয়া, তাঁহাকে কোলে লইয়া চক্ষের জল মুছাইয়া দিয়াছিলেন–সেই দিন মনে করিয়া তাঁহার কাছে কাঁদিতে গেলেন। কমলমণি কুন্দনন্দিনীকে দেখিয়া অপ্রসন্ন হইলেন–কুন্দকে কাছে আসিতে দেখিয়া বিস্মিত হইলেন, কিছু বলিলেন না। কুন্দ তাঁহার কাছে আসিয়া বসিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। কমলমণি কিছু বলিলেন না; জিজ্ঞাসাও করিলেন না, কি হইয়াছে। সুতরাং কুন্দনন্দিনী আপনা আপনি চুপ করিলেন। কমল তখন বলিলেন, “আমার কাজ আছে |” অনন্তর উঠিয়া গেলেন।

কুন্দনন্দিনী দেখিলেন, সকল সুখেরই সীমা আছে।