পথের দাবী - Pather Dabi by শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় Sarat Chandra Chattapadhya, chapter name ২০

২০

গাড়ি চলিবার উপক্রম করিতেই ভারতী অপূর্ব্বর বাসার ঠিকানা বলিয়া দিতে মুখ বাড়াইয়া কহিল, দেখো গাড়োয়ান, ত্রিশ নম্বর।

 তাহার কথা শেষ না হইতেই গাড়োয়ান বলিয়া উঠিল, আই নো।

 গাড়ির পরিসর ছোট বলিয়া দুজনে ঘেঁষাঘেষি বসিয়াছিল, গাড়োয়ানের মুখের ইংরাজী কথায় অপূর্ব্বর সমস্ত দেহ যে শিহরিয়া উঠিল ভারতী তাহা স্পষ্ট অনুভব করিল। ইহার পরে প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরিয়া ঘড়র্ ঘড়র্ ছড়র্ ছড়র্ করিয়া ভাড়াটে গাড়ি চলিতেই লাগিল, কিন্তু উভয়ের মধ্যে কোন কথাই হইল না। অন্ধকার নিঃস্তব্ধ নশীথে গাড়ির চাকা ও পথের পাথরের সংঘর্ষে যে কঠোর শব্দ উঠিতে লাগিল, তাহাতে অপূর্ব্বর সর্ব্বাঙ্গে ক্ষণে ক্ষণে কাঁটা দিয়া কেবলই ভয় হইতে লাগিল, পাড়ার কাহারও ঘুম ভাঙ্গিতে আর বাকি থাকিবে না এবং সহরের সমস্ত পুলিশ ছুটিয়া আসিল বলিয়া। কিন্তু কোন দুর্ঘটনা ঘটিল না, গাড়ি আসিয়া বাসার দরজায় থামিল। ভারতী ভিতর হইতে গাড়ির দরজা খুলিয়া দিয়া অপূর্ব্বকে নামিতে ইঙ্গিত করিয়া নিজেও তাহার পিছনে পিছনে নামিয়া আসিয়া মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, কত ভাড়া?

 গাড়োয়ান একটুখানি হাসিয়া কহিল, নট এ পাই। পরক্ষণেই বার দুই মাথা নাড়িয়া বলিল, গুড নাইট টু ইউ! এই বলিয়া গাড়ি হাঁকাইয়া দিয়া সোজা বাহির হইয়া গেল।

 ভারতী জিজ্ঞাসা করিল, তেওয়ারী আছে ত?

 আছে।

 উপরে উঠিরা দ্বারে করাঘাত করিয়া অপূর্ব্ব তেওয়ারীর ঘুম ভাঙ্গাইল; কপাট খুলিয়া তেওয়ারী দীপালোকে প্রথমেই দেখিতে পাইল ভারতীকে। কাল অপূর্ব্ব বাসায় ফিরিয়াছিল প্রায় ভোরবেলায়, আজ ফিরিয়াছে রাত্রি শেষ করিয়া। সঙ্গে আছে ভারতী। তাই বুঝিতে তেওয়ারীর বাকি কিছুই রহিল না; ক্রোধে সর্ব্বাঙ্গ জ্বলিতে লাগিল এবং একটা কথাও না কহিয়া সে দ্রুতবেগে নিজের বিছানায় গিয়া চাদর মুড়ি দিয়া শুইয়া পড়িল। এই মেয়েটিকে তেওয়ারী ভালবাসিত, একদিন তাহাকে আসন্ন মৃত্যুমুখ হইতে রক্ষা করিয়াছিল বলিয়া খ্রীষ্টান হওয়া সত্ত্বেও মনে মনে শ্রদ্ধা করিত। কিন্তু, কিছুদিন হইতে ব্যাপার যেরূপ দাঁড়াইয়াছিল, তাহাতে অপূর্ব্বর সম্বন্ধে নানা প্রকার অসম্ভব দুশ্চিন্তা তেওয়ারীর মনে উঠিতেছিল—এমন কি জাতিনাশ পর্য্যন্তও। সেই সর্ব্বনাশের প্রকট মূর্ত্তি আজ যেন তেওয়ারীর মানসপটে একেবারে মুদ্রিত হইয়া গেল। তাহাকে এমন করিয়া শুইয়া পড়িতে দেখিয়া কেবল অভ্যাসবশতঃই অপূর্ব্ব জিজ্ঞাসা করিল, দোর দিলিনি তেওয়ারী?

 তাহার মুর্চ্ছাহত উদভ্রান্ত চিত্ত লক্ষ্য কিছুই করে নাই, কিন্তু লক্ষ্য করিয়াছিল ভারতী। সে-ই তাড়াতাড়ি জবাব দিল, আমি বন্ধ করে দিচ্ছি।

 অপূর্ব্ব শোবার ঘরে আসিয়া দেখিল, খাটের উপর শয্যা তেমনি গুটানো রহিয়াছে, পাতা হয় নাই। বস্তুতঃ বারান্দায় বসিয়া পথ চাহিয়া থাকিতেই আজ তেওয়ারীর সমস্ত সন্ধ্যাটা গিয়াছে, বিছানা করার কথা মনেও পড়ে নাই। কিন্তু সে উত্তর দিবার পূর্ব্বেই ভারতী ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, আপনি আরাম কেদারটায় একটুখানি বসুন, আমি এক মিনিটে সব ঠিক করে দিচ্চি।

 চেয়ারে হেলান দিয়া পড়িয়া অপূর্ব্ব পুনশ্চ ডাকিল, এক গেলাস জল দে তেওয়ারী।

 তাহার পাশের টুলের উপরেই খাবার জলের কুঁজা ও গেলাস ছিল, বিছানা পাতিতে পাতিতে তাহা দেখাইয়া দিয়া ভারতী বলিল, ঘুমন্ত মানুষকে আর কেন তুলবেন অপূর্ব্ববাবু, আপনি নিজেই একটু ঢেলে নিন।

 অপূর্ব্ব হাত বাড়াইয়া কুঁজাটা তুলিতে গিয়া তুলিতে পারিল না; তখন উঠিয়া আসিয়া কোনমতে জল গড়াইয়া লইয়া এক নিশ্বাসে তাহা পান করিয়া পুনরায় বসিতে যাইতেছিল, ভারতী মানা করিয়া কহিল, আর ওখানে না, একেবারে বিছানায় শুয়ে পড়ুন।

 অপূর্ব্ব শান্ত বালকের ন্যায় নিঃশব্দে আসিয়া চোখ বুজিয়া শুইয়া পড়িল। ভারতী মশারী ফেলিয়া ভাল করিয়া গুঁজিয়া দিতেছিল, অপূর্ব্ব হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কোথায় শোবে?

 আমি? ভারতী কিছু আশ্চর্য্য হইল। কারণ, এইরূপ ঘটনা নূতনও নয় এবং এ ঘরের কোথায় কি আছে তাহাও অবিদিত নয়। এই অনাব্যক প্রশ্নের উত্তরে সে শুধু আরাম চৌকিটা দেখাইয়া দিয়া বলিল, সকাল হতে আর ঘণ্টা দুই মাত্র দেরি আছে। ঘুমোন।

 অপূর্ব্ব হাত বাড়াইয়া তাহার হাতটা ধরিয়া ফেলিয়া বলিল, না ওখানে নয়, তুমি আমার কাছে বোস।

 আপনার কাছে? বাস্তবিকই ভারতীর বিস্ময়ের অবধি রহিল না। অপূর্ব্ব আর যাহাই হৌক, এ সকল ব্যাপারে কখনও আত্মবিস্মৃত হইত না। এমন কতদিন কত উপলক্ষ্যেই ত তাহারা একঘরে রাত্রি যাপন করিয়াছে, কিন্তু মর্য্যাদাহানিকর একটা কথা, একটা ইঙ্গিতও কোনদিন তাহার আচরণে প্রকাশ পায় নাই।

 অপূর্ব্ব কহিল, এই দেখ, এরা আমার হাত ভেঙে দিয়েছে। কেন তুমি এদের মধ্যে আমাকে টেনে আনলে? তাহার কথার শেষ দিকটা অকস্মাৎ কান্নায় রুদ্ধ হইয়া গেল। ভারতী মশারীর একটা দিক তুলিয়া দিয়া তাহার কাছে বসিল, পরীক্ষা করিয়া দেখিল, বহুক্ষণ ধরিয়া শক্ত বাঁধনের ফলে হাতের স্থানে স্থানে কালশিরা পড়িয়া ফুলিয়া আছে। চোখ দিয়া তাহার জল পড়িতেছিল, ভারতী আঁচল দিয়া তাহা মুছাইয়া লইয়া সাহস দিয়া বলিল, কিচ্ছু ভয় নেই, তোয়ালে ভিজিয়ে আমি ভাল করে জড়িয়ে দিচ্চি, দু-এক দিনেই সমস্ত ভাল হয়ে যাবে। এই বলিয়া সে উঠিয়া গিয়া স্নানের ঘর হইতে একটা গামছা ভিজাইয়া আনিল এবং সমস্ত নীচের হাতটা বাঁধিয়া দিয়া স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিল, একটু ঘুমোবার চেষ্টা করুন, আমি আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্চি। এই বলিয়া সে ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল।

 অপূর্ব্ব অশ্রুবিকৃত-স্বরে বলিল, কাল জাহাজ থাকলে আমি কালই চলে যেতুম!

 ভারতী কহিল, বেশ ত পরশুই যাবেন। একটা দিনের মধ্যে আপনার কোন অমঙ্গল হবে না।

 অপূর্ব্ব ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া কহিতে লাগিল, গুরুজনের কথা না শুনলেই এই সব ঘটে। মা আমাকে পুনঃ পুনঃ নিষেধ করেছিলেন।

 মা বুঝি আপনাকে আসতে দিতে চাননি?

 না, একশবার মানা করেছিলেন, কিন্তু আমি শুনিনি। তার ফল হ’ল এই যে, কতকগুলো ভয়ানক লোকের একেবারে চিরকালের জন্য বিষ দৃষ্টিতে পড়ে রইলুম। সে যা হবার হবে, দুর্গা দুর্গা বলে পরশু একবার জাহাজে উঠতে পারলে হয়। এই বলিয়া সে সহসা দীর্ঘশ্বাস মোচন করিল। কিন্তু সেই সঙ্গে যে ইহা অপেক্ষাও শতগুণ গভীর নিশ্বাস আর একজনের হৃদয়ের মূল পর্য্যন্ত নিঃশব্দে তরঙ্গিত হইয়া উঠিল, তাহা সে জানিতেও পারিল না। আর একটা দিনও যেন না অপূর্ব্বর বিলম্ব ঘটে, দুর্গা দুর্গা বলিয়া একবার সে জাহাজে উঠিতে পারিলে হয়! বর্ম্মায় আসা তাহার সর্ব্বাংশেই বিফল হইয়াছে, বাড়ি গিয়া এ দেশের জন-কয়েকের বিষ দৃষ্টির কথাই শুধু তাহার চিরদিন স্মরণে থাকিবে, কিন্তু সকল চক্ষুর অন্তরালে একজনের কুণ্ঠিত দৃষ্টির প্রতি বিন্দু হইতেই যে নীরবে অমৃত ঝরিয়াছে, একটা দিনও হয়ত সে কথা তাহার মনে পড়িবে না।

 অপূর্ব্ব কহিতে লাগিল, এ বাড়িতে পা দিয়েই তোমার বাবার সঙ্গে ঝগড়া হ’ল, কোর্টে জরিমানা পর্য্যন্ত হয়ে গেল, যা জন্মে কখনো আমার হয়নি। এর থেকেই আমার চৈতন্য হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হ’ল না।

 ভারতী চুপ করিয়া ছিল, চুপ করিয়াই রহিল। অপূর্ব্ব নিজেও একমুহূর্ত্ত মৌন থাকিয়া তাহার দুরদৃষ্টের সূত্র ধরিয়া বলিল, তেওয়ারী আমাকে বার বার সাবধান করেছিল,— বাবু, ওরা এক জাত, আমরা এক জাত, এ সব করবেন না। রূপালে দুর্ভোগ থাকলে কে খণ্ডাবে বল? চাকরি সেই গেল,—পাঁচশ’ টাকা মাইনে এ বয়সে কটা লোক পায়? তা’ ছাড়া এ হাত আমি লোকের সুমুখে বার করব কি করে?

 ভারতী আস্তে আস্তে বলিল, ততদিন হাতের দাগ ভাল হয়ে যাবে। ইহার বেশি কথা মুখ দিয়া তাহার বাহির হইল না। মাথায় হাত বুলাইয়া দিতেছিল, সে হাত আর চলিতে চাহিল না এবং এই অত্যন্ত সাধারণ তুচ্ছ লোকটাকে সে মনে মনে ভালবাসিয়াছে মনে করিয়া নিজের কাছেই যেন সে লজ্জায় মরিয়া গেল। এ কথা দলের অনেকেই জানিয়াছে, আজ অপূর্ব্বর প্রাণ বাঁচাইতে গিয়া তাহাদের কাছে অপরাধী এবং সুমিত্রার চক্ষে সে ছোট হইয়া গেছে, কিন্তু এই অতি তুচ্ছ মানুষটাকে হত্যা করিবার অসম্মান ও ক্ষুদ্রতা হইতে সে যে তাহাদের রক্ষা করিতে পারিয়াছে ইহাই মনে করিয়া এখন তাহার গর্ব্ব বোধ হইল।

 অপূর্ব্ব বলিল, দাগ সহজে যাবে না! কেউ জিজ্ঞাসা করিলে যে কি জবাব দেব জানিনে। কিন্তু শ্রোতার নিকট হইতে সায় না পাইয়া আপনিই কহিতে লাগিল, সকলে ভাববে কাজ চালাতে আমি পারলুম না। তাই ত লোকে বলে বাঙালীর ছেলেরা বি. এ., এম. এ. পাশ করে বটে, কিন্তু বড় চাকরি পেলে রাখতে পারে না। আমার কলেজের ছেলেরা আমাকে ছি ছি করতে থাকবে, আমি উত্তর দিতে পারব না।

 যা হোক কিছু একটা বলে দেবেন। আচ্ছা আপনি ঘুমোন, এই বলিয়া ভারতী উঠিয়া দাঁড়াইল।

 আরও একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দাও না ভাবতী!

 না, আমি বড় ক্লান্ত।

 তবে থাক্‌, থাক্‌। রাতও আর নেই।

 ভারতী পাশের ঘরে আসিয়া দেখিল, আলোটা তখনও মিট মিট করিয়া জ্বলিতেছে এবং তেওয়ারী তেমনি চাদর মুড়ি দিয়া ঘুমাইতেছে। অদূরে ভাঙাগোছের একখানা ডেক চেয়ার পড়িয়াছিল তাহাতেই আসিয়া সে উপবেশন করিল। অপূর্ব্বর ঘরে ভাল আরাম চৌকি ছিল, কিন্তু ঐ লোকটিকে সুমুখে রাখিয়া একই ঘরের মধ্যে রাত্রি যাপন করিতে আজ তাহার অত্যন্ত ঘৃণা বোধ হইল। চেয়ারটায় কোনমতে একটু হেলান দিয়া পড়িয়া মনের মধ্যে যে তাহার কি করিতে লাগিল তাহার সীমা নাই। ইতিপূর্ব্বে এই ঘরের মধ্যেই সে একাধিকবার কঠিন ধাক্কা খাইয়াছে, কিন্তু আজিকার সহিত তাহার তুলনা হয় না। ভারতীর প্রথমেই মনে হইল, কি করিয়া এবং কাহার অপরিসীম করুণায় অপূর্ব্ব সুনিশ্চিত ও প্রত্যাসন্ন মৃত্যুর হাত হইতে আজ রক্ষা পাইল, অথচ রাত্রিটাও প্রভাত হইল না, এতবড় কথাটা সে ভুলিয়াই গেল! তাহার পরম বন্ধু তলওয়ারকরের প্রতি, এবং বিশেষ করিয়া এই ডাক্তার লোকটির প্রতি যে কি অপরিসীম অপরাধ করিয়াছে সে কথাই তাহার মনে নাই। সেখানে বড় চাকরি ও হাতের দাগটাই তাহার সমস্ত স্থান জুড়িয়া বসিয়াছে! সেইখানে বসিয়া হঠাৎ ভারতীর চোখে পড়িল, সুমুখের খোলা জানালার ফাঁক দিয়া ভোরের আলো দেখা দিয়াছে। সেই মুহূর্ত্তে উঠিয়া নিঃশব্দে দ্বার খুলিল এবং কদর্য্য অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত স্থানে মাতালের নেশা কাটিয়া গেলে সে যেমন করিয়া মুখ ঢাকিয়া পলায়ন করে, ঠিক তেমনি করিয়া সে দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়া নামিয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল।