১৫
বেলা যে যায়! উঠুন!
অপূর্ব্ব চোখ রগড়াইয়া উঠিয়া বসিল। দেওয়ালের ঘড়ির প্রতি চাহিয়া কহিল, ইস্! তিন-চার ঘণ্টার কম নয়। আমাকে তুলে দেননি কেন? বাঃ—মাথায় একটা বালিশ পর্য্যন্ত কখন দিয়ে দিয়েছেন। এতে কি আর কারও ঘুম ভাঙে!
ভারতী কহিল, ঘুম ভাঙবার হ’লে তখনি ভাঙতো। এটা না দিলে মাঝে থেকে ঘাড়ে শুধু একটা ব্যথা হোতো। যান, মুখ-হাত ধুয়ে আসুন, সরকারমশায় জলখাবারের থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর ঢের কাজ, একটু চট্ করে তাঁকে ছুটি দিন।
দ্বারের বাহিরে যে লোকটি দাঁড়াইয়াছিল, মুখ বাড়াইয়া সে তাহার ত্বরা নিবেদন করিল।
নীচে হইতে হাত-মুখ ধুইয়া আসিয়া অপূর্ব্ব খাবার খাইয়া সুপারি, এলাচ প্রভৃতি মুখে দিয়া হৃষ্টচিত্তে কহিল, এবার আমাকে ছুটি দিন, আমি বাসায় যাই।
ভারতী মাথা নাড়িয়া বলিল, সেটি হবে না। তেওয়ারীকে খবর দিয়েছি যে, অফিসের ফেরত কাল বিকালে আপনি বাসায় যাবেন এবং খবর নিয়েচি যে সে সুস্থ দেহে, বহাল তবিয়তে ঘর আগলাচ্ছে,—কোন চিন্তা নেই।
কিন্তু কেন?
ভারতী বলিল, কারণ সম্প্রতি আপনি আমাদের অভিভাবক। আজ সুমিত্রাদিদি অসুস্থ, নবতারা গেছেন অতুলবাবুকে সঙ্গে নিয়ে ওপারে, আপনাকে যেতে হবে আমার সঙ্গে। আপনার প্রতি প্রেসিডেন্টের এই আদেশ। ওই ধুতি এনে রেখেচি, পরে নিয়ে চলুন।
কোথায় যেতে হবে?
মজুরদের লাইনের ঘরে। অর্থাৎ, বড় বড় কারখানার ক্রোড়পতি মালিকেরা ওয়ার্কমেনদের জন্যে লাইনবন্দী যে সব নরককুণ্ড তৈরী করে দিয়েছে সেইখানে। আজ রবিবারে ছুটির দিনেই সেখানে কাজ।
অপূর্ব্ব জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু সেখানে কেন?
ভারতী উত্তর দিল, নইলে পথের দাবীর সত্যিকারের কাজ কি এই ঘরে হতে পারে? একটু হাসিয়া কহিল, আপনি এ-সভার মাতব্বর সভ্য, সরেজমিনে না গেলে ত কাজের ধারা বুঝতে পারবেন না অপূর্ব্ববাবু!
চলুন, বলিয়া অপূর্ব্ব আফিসের পোষাক ছাড়িয়া মিনিট পাঁচেকের মধ্যে প্রস্তুত হইয়া লইল।
ভারতী আলমারী খুলিয়া কি একটা বস্তু লুকাইয়া তাহার জামার পকেটে রাখিতে অপূর্ব্ব দেখিতে পাইয়া কহিল, এটা কি নিলেন?
গাদা পিস্তল।
পিস্তল। পিস্তল কেন?
আত্মরক্ষার জন্যে।
ওর পাশ আছে?
না।
অপূর্ব্ব বলিল, পুলিশে যদি ধরে ত আত্মরক্ষা দু’জনেরই হবে। ক’বছর দেয়?
দেবে না,—চলুন!
অপূর্ব্ব নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, দুর্গা-শ্রীহরি। চলুন।
বড় রাস্তা ধরিয়া উত্তরে বর্ম্মী ও চীনা পল্লী পার হইয়া বাজারের পাশ দিয়া দুজনে প্রায় মাইলখানেক পথ হাঁটিয়া একটা প্রকাণ্ড কারখানার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল এবং বন্ধ ফটকের কাটা দরজার ফাঁক দিয়া গলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল। ডানদিকে সারি সারি করোগেট লোহার গুদাম ও তাহারই ও-ধারে কারিগর ও মজুরদিগের বাস করিবার ভাঙা কাঠ ও ভাঙা টিনের লম্বা লাইনবদী বস্তি। সুমুখ দিয়া সারি সারি কয়েকটা জলের কল এবং পিছন দিকে সারি সারি টিনের পায়খানা। গোড়াতে হয়তো দরজা ছিল, এখন থলে ও চট-ছেঁড়া ঝুলিতেছে। ইহাই ভারতবর্ষীয় কুলী-লাইন। পাঞ্জাবী, মাদ্রাজী, বর্ম্মী, বাঙালী, উড়ে, হিন্দু, মুসলমান, স্ত্রী ও পুরুষে প্রায় হাজার খানেক জীব এই ব্যবস্থাকে আশ্রয় করিয়া দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর জীবন যাত্রা নির্ব্বাহ করিয়া চলিয়াছে।
ভারতী কহিল, আজ কাজের দিন নয়, নইলে এই জলের কলেই দু’একটা রক্তারক্তি কাণ্ড দেখতে পেতেন।
অপূর্ব্ব ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ছুটির দিনের ভিড় দেখেই তা অনুভব করতে পারচি।
এই জনতার সম্মুখেই একজন মাদ্রাজী স্ত্রীলোক পর্দ্দা ঠেলিয়া পায়খানায় ঢুকিতেছিল, পর্দ্দার অবস্থা দেখিয়া অপূর্ব্ব লজ্জায় রাঙা হইয়া উঠিয়া বলিল, পথের দাবী করতে হয় ত আর কোথাও শীঘ্র চলুন, এখানে আমি দাঁড়াতে পারব না।
ভারতী নিজেও তাহা লক্ষ্য করিয়াছিল, কিন্তু প্রত্যুত্তরে শুধু একটুখানি হাসিল। অর্থাৎ মানুষের ধাপ হইতে নামাইয়া যাহাদের পশু করিয়া তোলা হইয়াছে তাহাদের আবার এসকল বালাই কেন?
কয়েকখানা ঘর পরে উভয়ে আসিয়া একজন বাঙালী মিস্ত্রির ঘরে প্রবেশ করিল। লোকটার বয়স হইয়াছে, কারখানায় পিতল ঢালাইয়ের কাজ করে, মদ খাইয়া কাঠের মেঝের উপর পড়িয়া অত্যন্ত মুখ ধারাপ করিয়া কাহাকে গালি পাড়িতেছিল, ভারতী ডাকিয়া কহিল, মানিক, কার ওপরে রাগ করচ? সুশীলা কই? সে আজ দু’দিন পড়তে যায় না কেন?
মানিক কোন মতে হাতে পায়ে ভর দিয়া উঠিয়া বসিল, চোখ চাহিয়া চিনিতে পারিয়া বলিল, দিদিমণি। এসো, ব’সো। সুশী কি ক’রে তোমার ইস্কুলে যাবে বল? রাঁধা-বাড়া বাসন মাজা মায় ছেলেটাকে সামলানো পর্য্যন্ত—বুক ফেটে যাচ্চে দিদিমণি, বোর্দো শালাকে আমি খুন না করি ত আমি কৈবর্ত্ত থেকে খারিজ। বড় সাহেবকে এমনি দরখাস্ত দেব যে শালার চাকরি খেয়ে দেব।
ভারতী সহাস্যে কহিল, তা দিয়ো। আর বল ত না হয়, সুমিত্রাদিদিকে দিয়ে আমিই তোমার দরখাস্ত লিখে দেব। কিন্তু কাল আমাদের ফয়ার মাঠে মিটিং, তা মনে আছে ত?
এখন সময় বছর দশ-এগারোর একটি মেয়ে আসিয়া প্রবেশ করিল। সে অঞ্চলের ভিতর হইতে এক বোতল মদ বাহির করিয়া সাবধানে মেঝের উপর রাখিয়া কহিল, বাবা, ঘোড়া মার্কা মদ আর নেই, তাই টুপি মার্কা মদ নিয়ে এলুম। চারটে পয়সা বাকী রইল। দেখ বাবা, রাম আইয়া মাতাল হয়ে আমাকে কি বলছিল জানো?
প্রত্যুত্তরে তাহার পিতা রামিয়ার উদ্দেশে একটা কদর্য্য ভাষা উচ্চারণ করিল। ভারতী কহিল, ও-সব জায়গায় তুমি আর যেয়ো না। তোমার মা কোথায় সুশীলা?
মা? মা তো পরশু রাত্তিরে যদুকাকার সঙ্গে বেরিয়ে গিয়ে লাইনের বাইরে ঘর ভাড়া করেছে। মেয়েটা আরও কি বলিতেছিল, কিন্তু বাপ গর্জ্জন করিয়া উঠিল,—করাচ্চি। এ বাবা বিয়ে করা পরিবার, বেউশ্যে নয়! এই বলিয়া সে অনিশ্চিত কম্পিত হস্তে স্ক্রুর অভাবে ভাঙা খুন্তির ডগা দিয়া নূতন বোতলের ছিপি খুলিতে প্রবৃত্ত হইল।
ভারতী হঠাৎ তাহার অঞ্চল-প্রান্তে একটা প্রবল আকর্ষণ অনুভব করিয়া পিছন ফিরিয়া দেখিল, অপূর্ব্বর মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হইয়া গেছে। কখনো সে ভারতীকে স্পর্শ করে নাই, কিন্তু এখন সে জ্ঞানই তাহার ছিল না। কহিল, চলুন এখান থেকে।
একটু দাঁড়ান।
না, এক মিনিট না। এই বলিয়া সে একপ্রকার জোর করিয়া তাহাকে বাহিরে আনিল। ঘরের ভিতরে মানিক ছিপি বোতল ও খুন্তির বাঁট লইয়া বীরদর্পে গর্জ্জাইতে লাগিল যে, খুন করিয়া ফাঁসি যাইতে হয় সে ভি আচ্ছা। সে দেশো গুণ্ডার ছেলে, সে জেল বা ফাঁসি কোনটাকেই ভয় করে না।
বাহিরে আসিয়া অপূর্ব্ব যেন অগ্নিকাণ্ডের ন্যায় জ্বলিয়া উঠিল,—হারামজাদা, নচ্ছার, পাজি মাতাল। যেন পিশাচের নরককুণ্ড বানিয়ে রেখেছে। এখানে পা দিতে আপনার ঘৃণা বোধ হ’ল না?
ভারতী তাহার মুখের পানে চাহিয়া আস্তে আস্তে বলিল, না। তার কারণ, এ নরককুণ্ড ত এরা বানায়নি। এরা শুধু তার প্রায়শ্চিত্ত করেচে।
অপূর্ব্ব কহিল, না, এরা বানায়নি আমি বানিয়েচি। মেয়েটার কথা শুনলেন! ওর মা যেন কোন্ তীর্থযাত্রা করেছে। নির্লজ্জ বেহায়া শয়তান। তার কখ্খনো যদি এখানে আসবেন ত টের পাবেন বলে দিচ্ছি।
ভারতী একটুখানি হাসিয়া কহিল, আমি ম্লেচ্ছ ক্রীশ্চান, আমার এখানে আসতে দোষ কি?
অপূর্ব্ব রাগ করিয়া বলিল, দোষ নেই? ক্রীশ্চানের জন্য কি সৎ-অসৎ বস্তু নেই, নিজেদের সমাজের কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হয় না?
ভারতী উত্তর দিল, কে আছে আমার যে জবাবদিহি করবো? কার মাথাব্যথা পড়েচে আমার জন্যে, আপনি বলুন?
অপূর্ব্ব সহসা কোন প্রত্যুত্তর খুঁজিয়া না পাইয়া শুধু বলিল, এসব আপনার চালাকি। আপনি ঘরে ফিরে চলুন।
আমাকে আরও পাঁচ জায়গায় যেতে হবে। আপনার ভাল না লাগে আপনি ফিরে যান।
ফিরে যান বললেই কি আপনাকে এখানে রেখে আমি যেতে পারি?
তাহলে সঙ্গে থাকুন। মানুষের প্রতি মানুষে কত অত্যাচার করচে চোখ মেলে দেখতে শিখুন। কেবল ছোঁয়া-ছুঁয়ি বাঁচিয়ে নিজে সাধু হয়ে থেকে ভেবেচেন পুণ্য সঞ্চয় করে একদিন স্বর্গে যাবেন? মনেও করবেন না। বলিতে বলিতে ভারতীর মুখের চেহারা কঠোর এবং গলার সুর তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিল, এই মূর্ত্তি ও কণ্ঠ অপূর্ব্বর অত্যন্ত পরিচিত। ভারতী কহিল, ওই মেয়েটার মা এবং যদু যে অপরাধ করেছে সে শুধু ওদের দণ্ড দিয়েই শেষ হবে? আপনি তার কেউ নয়? কখ্খনো না। ডাক্তারবাবুকে না জানা পর্য্যন্ত আমিও ঠিক এমনি করেই ভেবে এসেছি। কিন্তু আজ আমি নিশ্চয় জানি, এই নরককুণ্ডে যত পাপ জমা হবে তার ভার আপনাকে পর্য্যন্ত স্বর্গের দোর থেকে টেনে এনে এই নরককুণ্ডে ডোবাবে। সাধ্য কি আপনার এই দুষ্কৃতির ঋণ শোধ না করে পরিত্রাণ পান। আমরা নিজের গরজেই আসি অপূর্ব্ববাবু, এই উপলব্ধিই আমাদের ‘পথের দাবী’র সবচেয়ে বড় সাধনা। চলুন।
অপূর্ব্ব নিরীহ ও নিস্পৃহের ন্যায় কহিল, চলুন। ভারতীর কথা কিন্তু সে বুঝিতেও পারিল না, বিশ্বাসও করিল না।
কিছুদূরে একটা সেগুন গাছ ছিল, ভারতী আঙুল দিয়া দেখাইয়া কহিল, ওই সামনে ক’ঘর বাঙালী থাকে,—চলুন।
অপূর্ব্ব জিজ্ঞাসা করিল, বাঙালী ভিন্ন অপর জাতের মধ্যে আপনারা কাজ করেন না?
ভারতী বলিল, করি। সকলকেই আমাদের প্রয়োজন, কিন্তু প্রেসিডেন্ট ছাড়া আর ত কেউ সকলের ভাষা জানে না, তিনি সুস্থ থাকলে এ কাজ তাঁরই, আমার নয়।
তিনি ভারতবর্ষের সমস্ত ভাষা জানেন?
জানেন।
আর ডাক্তারবাবু?
ভারতী হাসিয়া বলিল, ডাক্তারবাবুর সম্বন্ধে আপনার ভারী কৌতূহল। একথা আপনি বিশ্বাস করতে পারেন না কেন যে, পৃথিবীতে যা’ কিছু জানা যায় তিনি জানেন, যা’ কিছু পারা যায় তিনি পারেন। কে তাঁর সব্যসাচী নাম রেখেছিল আমরা কেউ জানিনে, কিন্তু তাঁর অসাধ্য, তাঁর অজ্ঞাত সংসারে কিচ্ছু নেই। এই বলিয়া সে নিজের মনে চলিতেই লাগিল, কিন্তু তাহারই পিছনে সহসা থমকিয়া দাঁড়াইয়া অপূর্ব্বর মুখ দিয়া গভীর নিশ্বাস পড়িল। অকস্মাৎ এই কথাটা তাহারা বুকের মধ্যে উদ্বেলিত হইয়া উঠিল যে, এই হতভাগ্য পরাধীন দেশে এতবড় একটা প্রাণের কোন মূল্য নাই, যে-কোন লোকের হাতে যে-কোন মুহূর্ত্তে তাহা কুকুরশিয়ালের মত বিনষ্ট হইতে পারে। সমস্ত জগৎ-বিধানে এতবড় নিষ্ঠুর অবিচার আর কি আছে! ভগবান মঙ্গলময় এই যদি সত্য, এ তবে কাহার ও কোন পাপের দণ্ড?
উভয়ে একটা ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল। ভারতী ডাকিল, পাঁচকড়ি, কেমন আছ আজ?
অন্ধকার কোণ হইতে সাড়া আসিল, আজ একটু ভাল। এই বলিয়া একজন বুড়া গোছের লোক ডান হাত উঁচু করিয়া সুমুখে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার আগাগোড়া কি কতকগুলি প্রলেপ দেওয়া, কহিল, মা, মেয়েটা রক্ত আমাশায় বোধ হয় বাঁচবে না, ছেলেটার আবার কাল থেকে বেহুঁস জ্বর, এমন একটা পয়সা নেই যে এক ফোঁটা ওষুধ কিনে দি, কি এক বাটি সাগু-বার্লি রেঁধে খাওয়াই। তাহার দুই চোখ ছল ছল করিয়া আসিল।
অপূর্ব্বর মুখ দিয়া হঠাৎ বাহির হইয়া গেল, পয়সা নেই কেন?
এই অপরিচিত বাবুটিকে লোকটা কয়েক মুহূর্ত্ত নীরবে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, পুলির শেকল পড়ে ডানহাতটাই জখম হয়ে গেছে, মাসখানেক ধরে কাজে বার হতে পারিনি, পয়সা থাকবে কি করে বাবুমশায়?
অপূর্ব্ব প্রশ্ন করিল, কারখানার ম্যানেজার এর ব্যবস্থা করেন না?
পাঁচকড়ি কপালে একবার বাম হাতটা স্পর্শ করিয়া কহিল, হায়! হায়! দিন-মজুরদের আবার ব্যবস্থা! এতেই বলচে কাজ করতে না পারো ত ঘর ছেড়ে দাও, আবার যখন ভাল হবে তখন এস—কাজ দেব। এ অবস্থায় কোথায় যাই বলুন ত মশায়? ছোট সাহেবের হাতে-পায়ে ধরে বড় জোর হপ্তাহখানেক থাকতে পাব। বিশ বচ্ছর কাজ করচি মশায়, এরা এখনি নেমকহারাম!
কথা শুনিয়া অপূর্ব্ব রাগে জ্বলিতে লাগিল। তাহার, এমনি ইচ্ছা করিতে লাগিল, ম্যানেজার লোকটাকে পায় ও কান ধরিয়া টানিয়া আনিয়া দেখায় সুদিনে যাহারা লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জ্জন করিয়া দিয়াছে, আজ দুর্দ্দিনে তাহারা কি দুঃখই ভোগ করিতেছে! অপূর্ব্বদের বাটীর কাছে গরুর গাড়ির আড্ডা, তাহার মনে পড়িল, এক জোড়া গরু সমস্ত জীবন ধরিয়া বোঝা টানিয়া অবশেষে বৃদ্ধ ও অক্ষম হইয়া পড়িলে লোকটা তাদের কসাইখানার বিক্রী করিয়া দিয়াছিল। এই হৃদয়হীনতা নিবারণ করিবার উপায় নাই, লোকে করে না, কেহ করিতে চাহিলে সবাই তাকে পাগল বলিয়া উড়াইয়া দেয়। সেই পথ দিয়া যখনই সে গিয়াছে, তখনই এই কথা মনে করিয়া তাদের চোখে জল আসিয়াছে। গরুর জন্য নয়, কিন্তু অর্থের পিপাসায় এই বর্ব্বর নিষ্ঠুরতার মানুষে আমাকে আপনি কত ছোটই না প্রতিদিন করিয়া আনিতেছে। সহসা ভারতীর কথাটা স্মরণ করিয়া সে মনে মনে কহিল, ঠিক কথাই ত! কে কোথায় করিতেছে—আমি ত করি না, অথবা, এমনিই ত হয়, এই ত চিরদিন হইয়া আসিতেছে—এই বলিয়াই ত এত বড় ত্রুটির জবাবদিহি হয় না। গরু-ঘোড়া শুধু উপলক্ষ্য। এই হাত-ভাঙা পাঁচকড়িটাও তাই। আপনাকে যে বাঁচাইতে পারে না তাহার হত্যায়, যে দুর্ব্বল তাহার পীড়নে, যে নিরুপায় তাহার লজ্জাহীন বঞ্চনায় এই যে মানুষে আপনার হৃদয়-বৃত্তির জীবন হরণ করিতেছে, সকলের এই যে আত্মহত্যার অহোরাত্রব্যাপী উৎসব চলিতেছে, ইহার বাতি নিভিবে কবে? এই সর্ব্বনাশা উন্মত্ততার পরিসমাপ্তি ঘটিবে কোন পথ দিয়া। মরণের আগে কি আর তাহার চেতনা ফিরিবে না!
ঘরের একধারে মলিন শতচ্ছিন্ন শয্যায় ছেলে-মেয়ে দুটি মৃতকল্পের ন্যায় পড়িয়াছিল, ভারতী কাছে গিয়া তাহাদের গায়ে হাত দিয়া পরীক্ষা করিতে লাগিল। অপূর্ব্ব ভয়ে সেখানে যাইতে পারিল না, কিন্তু দরিদ্র, পীড়িত শিশু দুটির নিঃশব্দ বেদনা তাহার বুকের মধ্যে যেন মুগুরের ঘা মারিতে লাগিল। সে সেইখানে দাঁড়াইয়া উচ্ছ্বসিত আবেগে আপনাকে আপনি বলিতে লাগিল, লোকে বলে, এই ত দুনিয়া। এমনি ভাবেই ত সংসারের সকল কাজ চিরদিন হইয়া আসিয়াছে। কিন্তু এই কি যুক্তি! পৃথিবী কি শুধু অতীতেরই জন্য। মানুষ কি কেবল তাহার পুরাতন সংস্কার লইয়া অচল হইয়া থাকিবে! নতুন কিছু কি সে কল্পনা করিবে না! উন্নতি করা কি তাহার শেষ হইয়া গেছে! যাহা বিগত, যাহা মৃত, কেবল তাহারই ইচ্ছা, তাহারই বিধান মানুষের সকল ভবিষ্যৎ, সকল জীবন, সকল বড় হওয়ার দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিয়া চিরকাল ধরিয়া প্রভুত্ব করিতে থাকিবে!
চলুন।
অপূর্ব্ব চমকিয়া দেখিল, ভারতী। পাঁচকড়ি নীরবে ম্লানমুখে দাঁড়াইয়াছিল, তাহাকে উদ্দেশ করিয়া ভারতী স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিল, ভয় নেই তোমার, এরা সেরে উঠবে। কাল সকালেই আমি ডাক্তার, ওষুধ, পথ্য সব পাঠিয়ে দেব—
তাহার কথা শেষ না হইতেই অপূর্ব্ব পকেটে হাত দিয়া টাকা বাহির করিতেছিল, সেই হাত ভারতী হাত বাড়াইয়া চাপিয়া ধরিয়া নিবারণ করিল। পাঁচকড়ির দৃষ্টি অন্যত্র ছিল, সে ইহা দেখিতে পাইল না, কিন্তু অপূর্ব্বও ইহার হেতু বুঝিল না। ভারতী তখন নিজের জামার পকেট হইতে চার আনা পয়সা বাহির করিয়া তাহার হাতে দিয়া কহিল, ছেলেদের চার পয়সার মিছরি, চার পয়সার সাগু, আর বাকী দুআনার চাল ডাল এনে তুমি এ-বেলার মত খাও পাঁচকড়ি, কাল তোমার ব্যবস্থা করে দেব। আজ আমরা চললাম। এই বলিয়া অপূর্ব্বকে সঙ্গে লইয়া বাহির হইয়া আসিল।
পথে আসিয়া অপূর্ব্ব ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিল, আপনি ভারি কৃপণ। আমাকেও দিতে ছিলেন না, নিজেও দিলেন না।
ভারতী কহিল, দিয়েই ত এলাম।
একে দিয়ে আসা বলে? তার এই দুঃসময়ে পাই-পয়সার হিসেব করে চার আনা মাত্র হাতে দেওয়া ত শুধু অপমান।
ভারতী জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কত দিতে যাচ্ছিলেন?
অপূর্ব্ব ঠিক কিছুই করে নাই, খুব সম্ভব হাতে যাহা উঠিত, তাহাই দিত। কিন্তু এখন ভাবিয়া বলিল, অন্ততঃ গোটা-পাঁচেক টাকা।
ভারতী জিভ কাটিয়া কহিল, ওরে বাপ্রে! সর্ব্বনাশ করেছিলেন আর কি। বাপ ত মদ খেয়ে সারারাত বেহুঁস হয়ে পড়ে থাকতো, কিন্তু ছেলে-মেয়ে দুটো মরে যেতো।
মদ খেতো?
খেতো না! হাতে টাকা পেলে মদ খায় না এমন অসাধারণ ব্যক্তি সংসারে কে আছে?
অপূর্ব্ব ক্ষণকাল অভিভূতের ন্যায় স্তব্ধভাবে থাকিয়া বলিল, আপনার সব কথায় তামাসা। রুগ্ন সন্তানের চিকিৎসার টাকায় বাপ মদ কিনে খাবে, এ কি কখনো সত্যি হতে পারে?
ভারতী কহিল, সত্যি না হয় ত আপনি যে ঠাকুরের দিব্যি করতে বলবেন,—মা মনসা, ওলা বিবি—হঠাৎ হাসিয়া ফেলিয়াই কিন্তু আপনাকে তৎক্ষণাৎ সংযত করিয়া লইয়া বলিল, নইলে, দাতার হাত চেপে ধরে দুঃখীকে পেতে দেব না, সত্যি বলুন ত আমি কি এতই ছোট?
অপূর্ব্ব জিজ্ঞাসা করিল, এদের মা নেই?
না।
কোথাও কোন আত্মীয় নেই বোধ করি!
ভারতী বলিল, থাকলেও কাজে লাগবে না। বছর দশ-বারো পূর্ব্বে পাঁচকড়ি একবার দেশে যায়, কোন এক প্রতিবেশীর বিধবা মেয়েকে ভুলিয়ে সাগর পার করে নিয়ে আসে। ছেলে-মেয়ে দুটি তারই; বছর দুই হল, গলায় দড়ি দিয়ে সে ভবযন্ত্রণা এড়িয়েচে,—এই ত পাঁচকড়িদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
অপূর্ব্ব নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, নরককুণ্ডই বটে!
ভারতী নিতান্ত সহজকণ্ঠে মাথা নাড়িয়া বলিল, তাতে আর লেশমাত্র মতভেদ নেই। কিন্তু মুস্কিল হয়েছে এই যে, এরা সব ভাই-বোন। রক্তের সম্বন্ধ অস্বীকার করেই রেহাই মিলবে না অপূর্ব্ববাবু, উপরে বসে যে ব্যক্তিটি সমস্ত দেখছেন তিনি কড়ায় গণ্ডার এর কৈফিয়ৎ নিয়ে তবে ছেড়ে দেবেন।
অপূর্ব্ব গম্ভীর হইয়া বলিল, এখন মনে হচ্ছে যেন একেবারে অসম্ভব নয়। ক্ষণকাল পূর্ব্বে পাচকড়ির ঘরের মধ্যে দাঁড়াইয়াই যে সকল চিন্তা তাহার মনে হইয়াছিল, বিদ্যুদ্বেগে সেই সমস্তই আর একবার তাহার মনের মধ্যে বহিয়া গেল। বলিল, আমিও যখন মানুষ তখন দায়িত্ব আছে বৈ কি।
ভারতী সায় দিল। বলিল, আগে আগে আমিও দেখতে পেতাম না, রাগ করে ঝগড়া করতাম। এই সব অজ্ঞান, দুঃখী, দুর্ব্বল-চিত্ত ভাই-বোনের ঘাড়ে অসহ্য় পাপের বোঝা কে অহরহ চাপাচ্ছে এখন স্পষ্ট দেখতে পাই অপূর্ব্ববাবু
পাশের ঘরে একজন উড়িয়া মিস্ত্রী থাকে, তাহাব পাশের ঘর হইতে মাঝে মাঝে তীক্ষ্ণ হাসি ও উচ্চ কোলাহল আসিতেছিল, পাঁচকড়ির ঘরের ভিতর হইতেও অপূর্ব্ব তাহা শুনিতে পাইয়াছিল। সে ঘরে আসিয়া দুজনে উপস্থিত হইল। ভারতী ইহাদের পরিচিত, সকলে সমস্বরে তাহার অভ্যর্থনা করিল। একজন ছুটিয়া গিয়া একটা টুল ও একটা বেতের মোড়া আনিয়া বসিতে দিল। অনাবৃত কাঠের মেঝেতে বসিয়া ছয়-সাতজন পুরুষ ও আট-দশজন স্ত্রীলোক মিলিয়া মদ খাইতে ছিল। একটা ভাঙ্গা হারমোনিয়ায় ও একটা বাঁয়া মাঝখানে, নানা রঙের ও নানা আকারের খালি বোতল চতুর্দ্দিকে গড়াইতেছে, একজন বুড়া গোছের স্ত্রীলোক মাতাল হইয়া ঘুমাইতেছে,—তাহাকে বিবস্ত্রা বলিলেই হয়। ষাট হইতে পঁচিশ-ছাব্বিশ পর্য্যন্ত সকল বয়সের স্ত্রী-পুরুষই বসিয়া গিয়াছে,—আজ রবিবার, পুরুষদের ছুটির দিন। পিঁয়াজ-রশুনের তরকারির সঙ্গে মিশিয়া সস্তা৷ জারমান মদের অবর্ণনীয় গন্ধ অপূর্ব্বর নাকে লাগিতে তাহার গা বমি-বমি করিয়া আসিল। একজন অল্পবয়সী স্ত্রীলোকের হাতে মদের গেলাস ছিল, সে বোধ হয় তখনও পাকা হইয়া উঠে নাই, হয়ত অল্পদিন পূর্ব্বেই গৃহত্যাগ করিয়াছে, সে বাঁ হাতে সজোরে নিজেকে নাক টিপিয়া ধরিয়া গেলাসটা মুখে ঢালিয়া দিয়। তক্তার ফাঁক দিয়া অপর্য্যাপ্ত থুথু ফেলিতে লাগিল। একজন পুরুষ তাড়াতাড়ি তাহার মুখে খানিকটা তরকারি গুঁজিয়া ছিল। বাঙালী মেয়েমানুকে চোখের সুমুখে মদ খাইতে দেখিয়া অপূর্ব্ব যেন এক্কেবারে শীর্ণ হইয়া গেল। কিন্তু সে আড়চোখে চাহিয়া দেখিল, এতবড় ভয়ঙ্কর বীভৎস দৃশ্যেও ভারতীর মুখের উপরে বিকৃতির চিহ্ন মাত্র নাই। এসব তাহার সহিয়া গেছে। কিন্তু ক্ষণেক পরে গৃহস্বামীর ফরমাসে টুনি যখন গান ধরিল, এই যমুনা সেই যমুনা—এবং পাশের লোকটা হারমোনিয়াম টানিয়া লইয়া খামোকা একটা চাবি টিপিয়া ধরিয়া প্রাণপণে বোলো করিতে শুরু করিল, তখন এত ভার ভারতীর বোধ হয় সহিল না। সে ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, মিস্ত্রীমশায়, কাল আমাদের মিটিং। এ কথা বোধ হয় ভোলনি? যাওয়া কিন্তু চাই-ই।
চাই বই কি দিমিণি! এই বলিয়া কালাচাঁদ একপাত্র মদ গলায় ঢালিয়া দিল।
ভারতী কহিল, ছেলেবেলায় পড়েচ ত খড় পাকিয়ে দড়ি করলে হাতী বাঁধা যায়? এক না হলে তোমরা কখনোও কিছু করতে পারবে না। কেবল তোমাদের ভালর জন্যই সুমিত্রাদিদি কি পরিশ্রম করেছেন বল ত!
এ কথায় সকালে একবাক্যে সায় দিল। ভারতী বলিতে লাগিল, তোমরা ছাড়া কি এতবড় কারখানা একদিন চলে? তোমরাই ত এর সত্যিকারের মালিক, এ তো সোজা কথা কালাচাঁদ, এ তোমরা না বুঝতে চাইলে হবে কেন?
সবাই বলিল, এ ঠিক কথা। তাহারা না চালাইলে সমস্ত অন্ধকার।
ভারতী কহিল, অথচ, তোমাদের কত কষ্ট একবার ভেবে দেখ দিকি। যখন তখন বিনা দোষে সাহেবরা তোমাদের লাথি জুতো মেরে বার করে দেয়। এই পাশের ঘরেই দেখ, কাজ করতে গিয়ে পাঁচকড়ির হাত ভেঙেচে বলে আজ সে খেতে পায় না, তার ছেলে-মেয়ে দুটো ওষুধ-পথ্যির অভাবে মারা যাচ্চে। ঘর থেকে পর্য্যন্ত বড়সাহেব তাকে দূর করে দিতে চায়। এই যে ক্রোর ক্রোর টাকা এরা লাভ করচে সে কাদের দৌলতে? আর তোমরা পাও কতটুকু? এই যে সেদিন শ্যামলালকে ছোটসাহের ঠেলে ফেলে দিলে, আজও সে হাসপাতালে, এ তোমরা সহ্য করবে কেন? একবার সবাই এক হয়ে দাঁড়িয়ে জোর করে বলত, এ নির্য্যাতন আমরা আর সইব না, কেমন তোমাদের গায়ে হাত দিতে সাহস করে দেখি! কেবল একটি বার তোমাদের সত্যিকার জোরটুকু তোমরা চেয়ে দেখতে শেখো—আর আমরা তোমাদের কাছে কিছুই চাইনে কালাচাঁদ।
একজন মাতাল হাঁ করিয়া শুনিতেছিল, সে কহিল, বাবা! পারিনে কি? এমন একটি বণ্টু ঢিল করে রেখে দিতে পারি, যে—কড় কড় কড়াৎ! ব্যস? অর্দ্ধেক কারখানাই ফরসা!
ভারতী সভয়ে বলিয়া উঠিল, না না, দুলাল, ওসব কাজ কখ্খনো ক’রো না। ওতে তোমাদেরই সর্ব্বনাশ; হয়ত লোক মারা যাবে, হয়ত—না না, এসব কথা স্বপ্নেও ভাবতে যেও না দুলাল। ওর চেয়ে ভয়ানক পাপ আর নেই।
লোকটা মাতালের হাসি হাসিয়া বলিল, নাঃ—তা কি আর জানিনে! কথার কথা বলচি, আমরা পারিনে কি!
ভারতী বলিতে লাগিল, তোমাদের সৎপথে, সত্যিকার পথে দাঁড়ানো চাই—তাতেই তোমরা সমস্ত পাবে। ওদের কাছে তোমাদের বহু বহু টাকা পাওনা—তাই কেবল কড়ায়-গণ্ডায় আদায় করে নিতে হবে।
মেয়ে-পুরুষে এই লইয়া গণ্ডগোল করিতে লাগিল। ভারতী কহিল, সন্ধ্যা হয়, এখনো আর এক জায়গায় যেতে হবে। আমরা তবে এখন আসি, কিন্তু কালকের কথা যেন কিছুতেই না ভুল হয়। এই বলিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল।
এই কালাচাঁদের আড্ডার সমস্ত ব্যাপারই অপূর্ব্বর অত্যন্ত বিশ্রী লাগিয়াছিল, কিন্তু শেষের দিকে যে-সব আলোচনা হইল তাহাতে তাহার বিরক্তির অবধি রহিল না। বাহিরে আসিয়া ভয়ানক রাগ করিয়া কহিল, তুমি এসব কথা এদের বলতে গেলে কেন?
ভারতী জিজ্ঞাসা করিল, কি সব কথা?
অপূর্ব্ব বলিল, ওই ব্যাটা হারামজাদা মাতাল! দুলাল না কি নাম,—কি বললো শুনলে ত? ধর এ কথা যদি সাহেবের কানে যায়?
কানে যাবে কি করে?
আরে, এরাই বলে দেবে। এরা কি যুধিষ্ঠির নাকি? মদের ঝোঁকে কখন কি কাণ্ড করে বসবে, তখন তোমার নামেই দোষ হবে। হয়ত বলবে তুমিই শিখিয়ে দিয়েচ।
কিন্তু সে তো মিছে কথা?
অপূর্ব্ব অধীর হইয়া বলিল, মিছে কথা! আরে, ইংরেজ-রাজত্বে মিছে কথায় কখনো কারো জেল হয়নি নাকি? রাজত্বটাই ত মিছের ওপর দাঁড়িয়ে।
ভারতী কহিল, আমারও না হয় জেল হবে।
অপূর্ব্ব বলিল, তুমি বলে ফেললে, না হয় জেল হবে! না, না, এসব হবে না, এখানে আসা তোমার আর কখ্খনো চলবে না।
কিছুদূরে একজনের কাছে প্রয়োজন ছিল, কিন্তু দ্বারে তাহার তালা দেওয়া দেখিয়া উভয়েই সেই পথেই ফিরিল। কালাচাঁদের ঘরের কাছে আসিয়া দেখিল সেই ‘যমুন৷ প্রবাহিনী’র গান তখন থামিয়াছে, কিন্তু তৎপরিবর্ত্তে মদ-মত্ত তর্ক একেবারে উদ্দাম হইয়া উঠিয়াছে! একজন স্ত্রীলোক মাতাল হইয়া তাহার স্বামীর শোকে কান্না শুরু করিয়াছে, আর একজন তাহাকে এই বলিয়া সান্ত্বনা দিতেছে যে, দেশের কথা বলিয়া আর লাভ নাই, এইখানেই আবার তোর সব হবে, তুই বরঞ্চ মানত করিয়া পূর্ণিমায় পূর্ণিমায় সত্যনারায়ণের কথা দে। অনেকে এই বলিয়া ঝগড়া করিতেছে যে, এই ক্রীশ্চান মেয়েগুলো কারখানায় ধর্ম্মঘট বাধাইয়া দিতে চায়। তাহা হইলে তাহাদের কষ্টের সীমা থাকিবে না, উহাদের লাইনের ধরে আর আসিতে দেওয়া উচিত নয়। কালাচাঁদ মিস্ত্রী বুঝাইয়া বলিতেছে যে সে বোকা ছেলে নয়। ইহাদের দৌড়টাই কেবল সে দেখিতেছে। একজন অতিসাবধানী মেয়েমানুষ পরামর্শ ছিল যে, খোকা, সাহেবকে এই বেলা সাবধান করিয়া দেওয়া ভাল।
সেখান হইতে ভারতীকে জোর করিয়া দূরে টানিয়া লইয়া গিয়া অপূর্ব্ব তিক্ত কণ্ঠে কহিল, আর করবে এদের ভাল? নেমকহারাম। হারামজাদা! পাজি! নচ্ছার উঃ—পাশের ঘরে দুটো অনাথ ছেলেমেছে মরে, একজন কেউ চেয়ে দেখে না। নরক আর কোথায়?
ভারতী মুখপানে চাহিয়া বলিল, হঠাৎ হল কি আপনার?
অপূর্ব্ব কহিল, আমার কিছুই হয়নি, আমি জানতাম। কিন্তু তুমি শুনলে কি না, তাই বল?
ভারতী বলিল, নূতন কিছুই নয়, এ রকম তো আমরা রোজ শুনি।
অপূর্ব্ব গর্জ্জিয়া উঠিয়া কহিল, এমনি শয়তানি? এমনি কৃতঘ্নতা? এদের চাও তুমি দলে আনতে—দলবদ্ধ করতে? এদের চাও তুমি ভাল?
ভারতীর কণ্ঠস্বরে কোন উত্তেজনা প্রকাশ পাইল না। বরঞ্চ, সে একটুখানি মলিন হাসি হাসিয়া বলিল, এরা কারা অপূর্ব্ববাবু? এরা ত আমরাই। এই ছোট্ট কথাটুকু যখনই ভুলচেন, তখনি আপনার গোল বাধচে। আর ভাল? ভাল করা বলে যদি সংসারে কোন কথা থাকে, তার যদি কোন অর্থ থাকে সে তো এইখানে। ভাল ত ডাক্তারবাবুর করা যায় না অপূর্ব্ববাবু।
অপূর্ব্ব একথার কোন জবাব দিল না।
দুজনে নিঃশব্দে ফটক পার হইয়া আবার বর্ম্মী পাড়ার ভিতর দিয়া বাজারের পথ ঘুরিয়া বড় রাস্তায় আসিয়া পড়িল। তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গেছে, গৃহস্থের ঘরে আলো জ্বলিতেছে, পথের দুধারে ছোট ছোট রাত-দোকান বসিয়া বেচা-কেনা আরম্ভ হইয়াছে,—ইহারই মধ্যে দিয়া ভারতী মাথার কাপড় কপালের নীচে পর্য্যন্ত টানিয়া দিয়া নিঃশব্দে দ্রুতবেগে পথ হাঁটিয়া চলিল। অবশেষে লোকালয় শেষ হইয়া যেখানে জলা ও মাঠ শুরু হইল, সেইখানে তে-মাথায় আসিয়া সে পিছনে চাহিয়া কহিল, আপনি বাসায় যান ত সহরে যাবার এই ডানদিকের পথ।
অপূর্ব্ব অন্যমনস্ক হইয়াছিল, জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি বলেন?
ভারতী বলিল, এতক্ষণে আপনার মাথা ঠাণ্ডা হয়েচে। যথাযোগ্য সম্বোধনের ভাষা মনে পড়েচে?
তার মানে?
তার মানে রাগের মাথায় এতক্ষণ আপনি-তুমির ভেদাভেদ ছিল না! এখন ফিরে এল।
অপূর্ব্ব অতিশয় লজ্জিত হইয়া স্বীকার করিয়া কহিল, আপনি রাগ করেননি?
ভারতী হাসিয়া ফেলিল। বলিল, একটু করলেই বা। চলুন।
আবার যাবো?
যাবেন না ত কি অন্ধকার পথে আমি একলা যাবো?
অপূর্ব্ব আর দ্বিরুক্তি করিল না! আজ মনের মধ্যে তাহার অনেক বিষ, অনেক জ্বালা দাউ দাউ করিয়া জ্বলিতেছিল। মাতালগুলার কথা সে কোন মতে ভুলিতে পারিতেছিল না। চলিতে চলিতে হঠাৎ কটুকণ্ঠে সে বলিয়া উঠিল, এ সব হ’ল সুমিত্রার কাজ, আপনার ওখানে মোড়লি করতে যাবার দরকার কি? কে কোথায় কি করে বসবে, আর আপনাকে নিয়ে টানাটানি পড়বে।
ভারতী বলিল, পড়লেই বা।
অপূর্ব্ব বলিল, বা রে, পড়লেই বা! আসল কথা হচ্চে সর্দ্দারি করাই আপনার স্বভাব। কিন্তু আরো ত ঢের জায়গা আছে।
একটা দেখিয়ে দিন না।
আমার বয়ে গেছে।
খানিকটা খুঁড়িয়া রাস্তার এই স্থানটা মেরামত হইতেছিল। যাইবার সময় দিনের বেলায় কষ্ট হয় নাই, কিন্তু দুপাশের কৃষ্ণচূড়ার গাছের নীচে ভাঙা পথটা অন্ধকারে একেবারে দুর্গম হইয়া উঠিয়াছিল। ভারতী হাত বাড়াইয়া অপূর্ব্বর বাঁ হাতটা শক্ত করিয়া ধরিয়া বলিল, স্বভাব ত আমার যাবে না অপূর্ব্ববাবু, কিছু একটা করাই চাই। কিন্তু আপনার মত আনাড়ির ওপরে মোড়লি করতে পাই ত আমি আর সমস্ত ছেড়ে দিতে পারি।
আপনার সঙ্গে কথায় পাররার জো নেই। এই বলিয়া সে সাবধানে ঠাওর করিয়া করিয়া পথ চলিতে লাগিল।