১০
শেষোক্ত ঘটনার পরে মাসাধিক কাল অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে। তেওয়ারী আরোগ্য লাভ করিয়াছে, কিন্তু গায়ে এখনও জোর পায় নাই। যে লোকটি সঙ্গে ভামোর গিয়াছিল সে-ই রাঁধিতেছে। তেওয়ারীকে বাঁচাইবার জন্য প্রায় আফিসসুদ্ধ সকলেই অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করিয়াছে, রামদাস নিজে কতদিন ত বাসায় পর্য্যন্ত যাইতে পারে নাই। শহরের একজন বড় ডাক্তার চিকিৎসা করিয়াছেন, তাঁহারই সুপারিশে তাহাকে বসন্ত-হাসপাতালে লইয়া যায় নাই। এই ব্রহ্মদেশটা তেওয়ারীর কোনদিনই ভাল লাগে নাই, অপূর্ব্ব তাহাকে ছুটি দিয়াছে, স্থির হইয়াছে আর একটু সারিলেই বাড়ি চলিয়া যাইবে। আগামী সপ্তাহে বোধ হয় তাহা অসম্ভব হইবে না, তেওয়ারী নিজে এইরূপ আশা করে। ভারতী সেই যে গিয়াছে, কোনদিন খবর লইতেও আসে নাই। অথচ, এত বড় একটা আশ্চর্য্য ব্যাপার নিজেদের মধ্যে তাহার উল্লেখ পর্য্যন্ত হইত না। ইহাতে তেওয়ারীর বিশেষ অপরাধ ছিল না; বরঞ্চ সে যেন ভয়ে ভয়েই থাকিত, পাছে কেহ তাহার নাম করিয়া ফেলে। ভারতী শত্রুপক্ষীয়া, এখানে আসা অবধি তাহাদের অশেষ প্রকারে দুঃখ দিয়াছে, মিথ্যা সাক্ষের জোরে অপূর্ব্বকে জেল খাটাবার চেষ্টা পর্য্যন্ত করিয়াছে; মনিবের অবর্ত্তমানে তাহাকেই ঘরে ডাকিয়া আনার কথায় সে লজ্জা ও সংকোচ দুই-ই অনুভব করিত। কিন্তু সে কবে এবং কি ভাবে চলিয়া গেছে তেওয়ারী জানে না, জানিবার অন্য ছট্ফট্, করিত,—তাহার উদ্বেগ ও আশঙ্কার অবধি ছিল না, কিন্তু কি করিয়া যে জানা যায় কিছুতেই খুঁজিয়া পাইত না। কখনো ভাবিত ভারতী চালাক মেয়ে, অপূর্ব্বর আসার সংবাদ পাইয়া সে নিজেই লুকাইয়া পলাইয়াছে। কখনো ভাবিত অপূর্ব্ব আসিয়া পড়িয়া হয়ত তাহাকে অপমান করিয়া দুর করিয়া দিয়াছে। কিন্তু এই দু’য়ের যাহাই কেননা ঘটিয়া থাক্, ভারতী আপনি ইচ্ছা করিয়া যে এ বাটীতে আর তাহাকে দেখিতে আসিবে না, সে বিষয়ে তেওয়ারী নিশ্চিত ছিল। অপূর্ব্ব নিজে কিছুই বলে না, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতে তেওয়ারীর এই ভয়টাই সবচেয়ে বেশী করিত, পাছে তাহারই জিজ্ঞাসাবাদের দ্বারা সকল কথা ব্যক্ত হইয়া পড়ে। ঝগড়া-বিবাদের কথা চুলোয় যাক, সে যে তাহার হাতে জল খাইয়াছে, তাহার রাঁধা সাগু-বার্লি খাইয়াছে,—হয়ত এমন ভয়ানক জাত গিয়াছে যে তাহার প্রায়শ্চিত্ত পর্য্যন্ত নাই। তেওয়ারী স্থির করিয়াছিল কোনমতে এখান হইতে কলিকাতায় গিয়া সে সোজা বাড়ি চলিয়া যাইবে। সেখানে গঙ্গাস্নান করিয়া, গোপনে গোবর প্রভৃতি খাইয়া কোন একটা ছল-ছুতায় ব্রাহ্মণাদি ভোজন করাইয়া দেহটাকে কাজ-চলা-গোছের শুদ্ধ করিয়া লইবে। কিন্তু ঘাঁটাঘাঁটি করিয়া কথাটাকে একবার মায়ের কানে তুলিয়া দিলে যে কিসে কি দাঁড়াইবে তাহার কিছুই বলা যায় না। হালদার বাড়ির চাকরি ও ঘুচিবেই, এমন কি তাহাদের গ্রামের সমাজ পর্য্যন্ত গিয়া টান ধরাও বিচিত্র নয়।
কিন্তু ইহাই তেওয়ারীর সবটুকু ছিল না। এই স্বার্থ ও ভয়ের দিক ছাড়া তাহার অন্তরের আর একটা দিক ছিল যেমন মধুর, তেমনি বেদনায় ভরা। অপূর্ব্ব অফিসে চলিয়া গেলে দুপুরবেলায় সে প্রত্যহ একখানি বেতের মোড়া লইয়া বারান্দায় আসিয়া বসিত। দুর্ব্বল দেহটিকে দেওয়ালের গায়ে এলাইয়া দিয়া গলির যে অংশটি গিয়া বড় রাস্তায় মিলিয়াছে সেইখানে একদৃষ্টে চাহিয়া থাকিত। এই পথে ভারতীর কোনদিন প্রয়োজন হইবে না, ওই মোড় অতিক্রম করিবার বেলা অভ্যাসবশতঃ একবার এদিকে সে চাহিবে না, এমন হইতেই পারে না। অপূর্ব্ব ভামোয় চলিয়া গেলে এই মেয়েটির সহিত তাহার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয় যেদিন দুপুরবেলা হঠাৎ তাহার মা মরিয়া যায়। তখনও তেওয়ারীর খাওয়া হয় নাই, মেয়েটা কাঁদিয়া আসিয়া তাহার রুদ্ধ দ্বারে করাঘাত করে। দিন-দুই পূর্ব্বে জোসেফ সাহেব মরিয়াছে, তাহার সে ভয় ছিল না, আসিয়া কপাট খুলিতেই ভারতী ঘরে ঢুকিয়া তাহার দুই হাত ধরিয়া সে কি কান্না! কে বলিবে সে ম্লেচ্ছ, কে বলিবে সে ক্রীশ্চানের মেয়ে! তেওয়ারীর রাঁধা ভাত হাঁড়িতেই রহিল, সারাদিন চিঠি লইয়া তাহাকে কোথায় না সেদিন ঘুরিয়া বেড়াইতে হইল। পরদিন কফিন লইয়া যাইবার বেলা এই বারান্দায় দাঁড়াইয়া চোখের জল যেন তাহার আর থামিতেই চাহে না। এই সময় হইতে ভারতীকে সে কখনো মা, কখনো দিদি বলিতে শুরু করিয়াছিল। এবং জোর করিয়া তাহাকে সে চার-পাঁচদিন রাঁধিতে দেয় নাই, নিজে রাঁধিয়া খাওয়াইয়াছিল। তারপরে যেদিন ভারতী জিনিসপত্র লইয়া স্থানান্তরে গেল, সেদিন সন্ধ্যাবেলাটা তাহার যেন আর কাটিবে না এমনি মনে হইয়াছিল। তাহার বসন্ত রোগে ভারতী কতখানি কি করিয়াছিল তাহা সে ভাল জানিতও না, ভাবিতও না। মনে হইলেই মনে হইত জাত যাইবার কথা। কিন্তু এই সঙ্গেই আয় একটা কথা সে সর্ব্বদাই ভাবিবার চেষ্টা করিত। সকালবেলা স্নান করিয়া মস্ত ভিজা চুলের রাশি পিঠে মেলিয়া দিয়া সে একবার করিয়া তেওয়ারীয় তত্ত্ব লইতে আসিত। রান্নাঘরেও ঢুকিত না, কোন কিছু স্পর্শ করিত না, চৌকাঠের বাহিরে মেঝের উপর বসিয়া পড়িয়া বলিত, আজ কি কি রাঁধলে দেখি তেওয়ারী।
দিদি, একটা আসন পেতে দিই।
না, আবার ত কাচতে হবে!
তেওয়ারী কহিত, বাঃ, আসন কি কখনও ছোঁয়া যায় নাকি?
ভারতী বলিত, যায় বই কি। তোমার বাবু ত ভাবেন আমি থাকার জন্যে সমস্ত বাড়িটাই ছোঁয়া গেছে। নিজের হ’লে বোধ হয় আগুন ধরিয়ে একে পুড়িয়ে শুদ্ধ করে নিতেন। ঠিক না তেওয়ারী?
তেওয়ারী হাসিয়া কহিত, তোমার এক কথা দিদি। তুমি নিজে দেখতে পারো না বলে সবাইকে তাই ভাবো। কিন্তু আমার বাবুকে যদি একবার ভাল করে জানতে ত তুমিও বলতে এমন মানুষ সংসারে নেই।
ভারতী বলিত, নেই তা আমিও ত বলি। নইলে যে চুরি করা আটকালে, তাকেই গেলেন চোর বলে ধরিয়ে দিতে।
এই ব্যাপারে নিজের অপরাধ স্মরণ করিয়া তেওয়ারী মর্ম্মাহত হইয়া পড়িত। কথাটাকে চাপা দিয়া তাড়াতাড়ি কহিত, কিন্তু তুমিও ত কিছু কম করনি? সমস্ত মিথ্যে জেনেও ত বাবুর কুড়ি টাকা দণ্ড করালে, দিদি।
ভারতী অপ্রতিভ হইয়া বলিত, তেমনি দণ্ড ত নিজেই নিলাম তেওয়ারী, তোমার বাবুকে ত আর দিতে হ’ল না।
দিতে হ’ল না কি রকম? স্বচক্ষে দেখলাম যে দু’খানা নোট দিয়ে তবে তিনি বার হলেন।
আমিও যে স্বচক্ষে দেখলাম তেওয়ারী, তুমি ঘরে ঢুকেই দু’খানা নোট কুড়িয়ে পেয়ে তা বাবুর হাতে দিলে।
তেওয়ারীর হাতের খুন্তি হাতেই থাকিত,—ও! তাই বটে।
কিন্তু ভাজাটা যে পুড়ে উঠল তেওয়ারী, ও যে আর মুখে দেওয়া চলবে না।
তেওয়ারী কড়াটা নামাইয়া কহিত, বাবুকে কিন্তু একথা আমি বলে দেব দিদি।
ভারতী সহাস্যে জবাব দিও, দিলেই বা। তোমার বাবুকে কি আমি ভয় করি নাকি?
কিন্তু এত বড় আশ্চর্য্য কথাটা ছোটবাবুকে জানাইবার তেওয়ারীর আর সুযোগ মিলিল না। কবে এবং কেমন করিয়া যে মিলিবে ইহাও সে খুঁজিয়া পাইত না। একদিন আলস্যবশতঃ সে বাসি হলুদ দিয়া তরকারী রাঁধিতে গিয়া ভারতীর কাছে বকুনি খাইয়াছিল। আর একদিন স্নান না করিয়াই রাঁধিয়াছিল বলিয়া ভারতী তাহার হাতে খায় নাই। তেওয়ারী রাগ করিয়া বলিয়াছিল, তোমরা ক্রীশ্চান দিদি, তোমাদের এত বাচ-বিচার? এ যে দেখি আমাদের মা-ঠাকরুণকেও ছাড়িয়ে গেলে!
ভারতী শুধু হাসিয়া চলিয়া গিয়াছিল, জবাব দেয় নাই। বস্তুতঃ রান্নার ব্যাপারে এক মা-ঠাকুরাণী ছাড়া তাহার শুচিতায় কেহ প্রশ্ন করিতেও পারে ইহাতে সে মনে মনে আহত হইয়াছিল, কিন্তু আচার-বিচার লইয়া এই ম্লেচ্ছ মেয়েটার কাছেই সে সতর্ক না হইয়াও পারে নাই। তখন এ-সকল তাহার ভাল লাগে নাই, যাহা ভালো লাগিয়াছে তাহারও তেমন করিয়া মর্য্যাদা উপলব্ধি করে নাই, অথচ, এই সব চিন্তাই যেন এখন তাহাকে বিভোর করিয়া দিত। বর্ম্মায় সে আর ফিরিবে না। যাইবার পূর্ব্বে দেখা হইবার আর আশা নাই, দেখা করিবার হেতু নাই, যত কিছু সে জানে বলিবার লোক নাই— দিনের পর দিন একই পথের প্রান্তে নিষ্ফল দৃষ্টি পাতিয়া একাকী চুপ করিয়া বসিয়া তাহার বুকের মধ্যেটা যেন আঁচড়াইতে থাকিত ।
সেধিন আফিস হইতে ফিরিয়া অপূর্ব্ব হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল, ভারতীর বাসাটা ঠিক কোন্ জায়গায় রে তেওয়ারী?
তেওয়ারী সংশয়তিক্তকণ্ঠে জবাব দিল, আমি কি গিয়ে দেখে এসেচি নাকি?
যাবার সময় তোকে বলেনি?
আমাকে বলতে যাবে কিসের জন্যে।
অপূর্ব্ব কহিল, আমাকে বলেছিল বটে, কিন্তু জায়গাটা ঠিক মনে নেই। কাল একবার খুঁজে দেখতে হবে।
তেওয়ারীর মনটা দুলিতে লাগিল, হয়ত কি আবার একটা ফ্যাসাদ জুটিয়াছে,—কিন্তু এ সাহস তাহার হইল না যে কারণ জিজ্ঞাসা করে। অপূর্ব্ব নিজেই বলিল। কহিল, সে চুরির জিনিসগুলো এখন পুলিশের লোকে দিতে চায়, কিন্তু ভারতীর একটা সই চাই।
তেওয়ারী আর একদিকে চাহিয়া চুপ করিয়া রহিল, অপূর্ব্ব বলিতে লাগিল, সেদিন একথাই ত জানাতে এসে তোর অবস্থা দেখে আর ফিরতে পারলেন না। তিনি না দেখলে ত তুই কবে মরে ভূত হয়ে যেতিস্ তেওয়ারী, আমার সঙ্গে পর্য্যন্ত দেখা হ’ত না!
তেওয়ারী হাঁ-না কিছুই কহিল না, শেষ কথাটা শুনিবার জন্য নিঃশব্দে কাঠের মত বসিয়া রহিল। অপূর্ব্ব বলিল, এসে দেখি অন্ধকার ঘরে তুই আর তিনি। দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই, কি যে ঘটবে তার ঠিক নেই, কোথায় খাওয়া, কোথায় শোওয়া, দুদিন আগে নিজের বাপ-মা মরে গেছে,—কিন্তু কি শক্ত মেয়েমানুষ তেওয়ারী, কিছুতে অক্ষেপ নেই!
তেওয়ারী আর থাকিতে না পারিয়া বলিল, কবে গেলেন তিনি?
অপূর্ব্ব কহিল, আমার আসার পরদিনই। ভোর না হতেই ‘চললুম’ বলে যেন একেবারে উবে গেলেন।
রাগ করে চলে গেলেন নাকি?
রাগ করে। অপূর্ব্ব একটু ভাবিয়া কহিল, কি জানি হতেও পারে। তাঁকে বোঝাই তো যায় না,—নইলে তোর উপর এত যত্ন, একবার খবর নিতেও ত এলেন না তুই ভাল হলি কিনা!
এই কথা তেওয়ারীর ভাল লাগিল না। বলিল, তাঁর নিজেরই হয়ত অসুখ-বিসুখ কিছু করেচে।
নিজের অসুখ-বিসুখ! অপূর্ব্ব চমকিয়া গেল। তাহার সম্বন্ধে অনেক দিন অনেক কথাই মনে হইয়াছে, কিন্তু কোনদিন এ আশঙ্কা মনেও উদয় হয় নাই। যাবার সময় সে হয়ত রাগ করিয়াই গিয়াছে এবং এই রাগ করা লইয়াই মন তাহার যত কিছু কারণ খুঁজিয়া ফিরিয়াছে। কিন্তু অন্য সম্ভাবনাও যে থাকিতে পারে এদিক পানে ক্ষুব্ধ চিত্ত তাহার দৃষ্টিপাতই করে নাই। হঠাৎ অসুখের কথায় এ লইয়া যত আলোচনা সে রাত্রে হইয়াছিল সমস্ত এক নিমিষে মনে পড়িয়া অপূর্ব্ব বসন্ত ছাড়া আর কিছুই ভাবিতে পারিল না। তাহার নূতন বাসায় দেখিবার কেহ নাই, হয়ত হাসপাতালে লইয়া গেছে, হয়ত এতদিনে বাঁচিয়াও নাই, মনে মনে সে একেবারে অস্থির হইয়া উঠিল। একটা চেয়ারে বসিয়া আফিসের কলার নেকটাই ওয়েস্টকোট খুলিতে খুলিতে তাহাদের আলাপ শুরু হইয়াছিল, হাতের কাজ তাহার সেইখানেই বন্ধ হইয়া গেল, মুখে তাহার শব্দ রহিল না, সেই চেয়ারে মাটির পুতুলের মত বসিয়া এই এক প্রকারের অপরিচিত, অস্পষ্ট অনুভূতিে যেন তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিল যে সংসারে আর তাহার কোন কাজ করিবার নাই।
কিছুক্ষণ অবধি কেহই কথা কহিল না। এমনি একভাবে মিনিট কুড়ি-পঁচিশ কাটিয়া গেলেও যখন অপূর্ব্ব নড়িবার চেষ্টা পর্য্যন্ত করিল না, তখন তেওয়ারী মনে মনে শুধু আশ্চর্য্য নয়, উদ্বিগ্ন হইল। আস্তে আস্তে কহিল, ছোটবাবু, বাড়িওয়ালার লোক এসেছিল; যদি তেতালার ঘরটাই নেওয়া হয় ত, এই মাসের মধ্যেই বদলানো চাই বলে গেল। আমার ভাবনা হয় পাছে কেউ আবার এসে পড়ে।
অপূর্ব্ব মুখ তুলিয়া বলিল, কে আর আসচে।
তেওয়ারী কহিল, আজ মায়ের একখানা পোস্টকার্ড পেয়েচি। দরোয়ানকে দিয়ে তিনি লিখিয়েচেন।
কি লিখেচেন?
আমি ভাল হয়েচি বলে অনেক আহ্লাদ করেচেন। দরোয়ানের ভাই ছুটি নিয়ে দেশে যাচ্ছে, তার হাতে বিশ্বেশ্বরের নামে পাঁচ টাকার পুজো পাঠিয়েচেন।
অপূর্ব্ব কহিল, ভালই ত! মা তোকে ছেলের মত ভালবাসেন।
তেওয়ারী শ্রদ্ধার বিগলিত হইয়া কহিল, ছেলের বেশি। আমি চলে যাবো, মার ইচ্ছে ছুটি নিয়ে আমরা দুজনেই যাই। চারিদিকে অসুখ-বিসুখ—
অপূর্ব্ব কহিল, অসুখ-বিসুখ কোথায় নেই? কলকাতায় হয় না? তাই বুঝি ভয় দেখিয়ে নানা কথা লিখেছিলি?
আজ্ঞে না ৷ তেওয়ারী ভাবিয়া রাখিয়াছিল আসল কথাটা সে রাত্রে আহারাদির পরে ধীরে-সুস্থে পাড়িবে। কিন্তু আর অপেক্ষা করা চলিল না। কহিল, কালীবাবু একেবারে নাছোড়বান্দা হয়ে ধরেচেন। বোধহয় সকলেরই ইচ্ছে মাঝের চোত্ মাসটা বাদ দিয়ে বোশেখের প্রথমেই শুভ কাজটা হয়ে যায়।
কালীবাবু অতিশয় নিষ্ঠাবান্ ব্রাহ্মণ, তাঁহার পরিবারের আচার-পরায়ণতার খ্যাতি প্রসিদ্ধ। তাঁহারই কনিষ্ঠা কন্যাকে মাতাঠাকুরাণী পছন্দ করিয়াছেন এ আভাস তাঁহার কয়েকখান৷ পত্রেই ছিল। তেওয়ারীর কথাট৷ অপূর্ব্বর ভাল লাগিল না। কহিল, এত তাড়াতাড়ি কিসের? কালীবাবুর গৌরীদানের সবুর না সয়, তিনি ত আর কোথাও চেষ্টা করতে পারেন।
তেওয়ারী একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, তাড়াতাড়ি তাঁর কি মা’র কি করে জানবো ছোটবাবু? লোকে হয়ত তাঁকে ভয় দেখায় বর্ম্মা দেশটা তেমন ভাল নয়,—এখানে ছেলেরা বিগড়ে যায়।
অপূর্ব্ব খামোকা ভয়ানক জ্বলিয়া উঠিয়া কহিল, দেখ্ তেওয়ারী, তুই আমার ওপর অত পণ্ডিতি করিসনে বলে দিচ্ছি। মাকে তুই রোজ রোজ অত চিঠি লিখিস কিসের? আমি ছেলেমানুষ নই!
এই অফারণ ক্রোধে তেওয়ারী প্রথমে বিস্মিত হইল, বিশেষতঃ রোগ হইতে উঠিয়া নানা কারণে তাহারও মেজাজ খুব ভাল ছিল না, সে রাগিয়া বলিল, আসবার সময় মাকে একথা বলে আসতে পারেননি। তাহলে ত বেঁচে যেতাম, জাত-জম্ম খোয়াতে জাহাজে চড়তে হোত না।
অপূর্ব্ব চোখ রাঙ্গাইয়া চট্ করিয়া কলার ও নেকটাই তুলিয়া লইয়া গলার পরিতে লাগিল। তেওয়ারী বহুকাল হইতেই ইহার অর্থ জানিত। কহিল, তাহলে জলটল কিছু খাবেন না?
অপূর্ব্ব তাহার প্রশ্নের জবাবে আলনা হইতে কোট লইয়া তাহাতে হাত গলাইতে গলাইতে দুম দুম করিয়া বাহির হইয়া গেল।
তেওয়ারী গরম হইয়া বলিল, কাল রবিবার চাটগাঁ দিয়ে একটা জাহাজ যায়—আমি তাতেই বাড়ি যাব বলে রাখলাম। অপূর্ব্ব সিঁড়ি হইতে কহিল, না যাস্ তো তোর দিব্বি রইল!—বলিয়া নীচে চলিয়া গেল।
মিনিট-পাঁচেকের মধ্যে প্রভু ও ভৃত্যের কিসের জন্য যে এমন একটা রাগারাগি হইয়া গেল অনভিজ্ঞ কেহ উপস্থিত থাকিলে সে একেবারে আশ্চর্য্য হইয়া যাইত, সে ভাবিয়াও পাইত না যে, এমনি অর্থহীন আঘাতের পথ দিয়াই মানুষের ব্যথিত বিক্ষুব্ধ চিত্ত চিরদিন আপনাকে সহজের মধ্যে ফিরাইয়া আনিবার পথ খুঁজিয়া পাইয়াছে।