মিথ্যা প্রচার
পূর্ব্ব-এশিয়ায় আমাদের এক বৎসরের কার্য্যাবলী, আমাদের কৃতিত্ব এবং আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্বন্ধে বিশদভাবে বলেছি। বৃহত্তম জাতীয় বিপ্লবে নিজ সমর-কৌশল কিংবা অভিযানের পরিকল্পনাও গোপন রাখার প্রয়োজন হয় না। ভারতীয় জনগণকে আমাদের পক্ষে নিয়ে আসার উপরই আমাদের পরিকল্পনার সাফল্য নির্ভর করে। কাজেই আমাদের পক্ষে ধাপ্পাবাজির খেলা আত্মহত্যারই সামিল। আমরা শুধু খোলাখুলি স্পষ্ট নীতির দ্বারাই দেশবাসীদের প্রভাবিত করতে পারি। আমাদের জন্মস্বত্ব স্বাধীনতার জন্যে আমরা যুদ্ধ করছি। সে সম্বন্ধে আমাদের বিপক্ষদলেরও কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। আমরা জানি, সাধারণ ভারতীয় জনগণ হৃদয়ের মর্ম্মহলে আমাদের জন্যে সহানুভূতি পোষণ করেন। যে প্রশ্ন তাঁদের চিন্তিত করে তোলে, সে প্রশ্ন হচ্ছে আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী সাফল্যলাভ করতে পারব কিনা। সে সম্বন্ধে তঁরা নিঃসংশয় হলেই সোজাসুজি আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে আসবেন। বিদেশীর দাসত্বের ফলে অনেকেই স্বভাবতঃ ভীরু-হৃদয়; সংগ্রামের চূড়ান্ত ফলাফল সম্বন্ধে সংশয় থাকা পর্য্যন্ত তাঁরা নিজেদের বিপন্ন করতে দ্বিধাবোধ করবেন।
বিপক্ষদলের অবস্থা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের দেশ এবং জনগণের উপর প্রভুত্ব করা এবং তাদের শোষণ করার পিছনে কোন নৈতিক সমর্থন নেই। কাজেই তারা ধাপ্পাবাজি, প্রতারণা এবং পশু-শক্তির অস্ত্র ব্যবহার করে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ভারতে প্রভুত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যে সম্ভাব্য সব পথই অবলম্বন করবে—এ আমি জানি; এর জন্য আমি বিস্মিত নই। যা আমাকে বিস্মিত করে ও ব্যথা দেয় তা হচ্ছে, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা যে জঘণ্য কাজ করতে পারে, সে কাজ করার জন্যে বৃটিশ বেতনভোগী আমার কোন কোন দেশবাসী স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসে। মাসে কয়েকটি মুদ্রার জন্যে আমার দেশবাসী নিজেদের এমন ঘৃণ্যভাবে বিকিয়ে দেবে কেন? গত যুদ্ধে ইংরেজরা যে প্রচার-প্রদ্ধতি অবলম্বন করেছিল, তার ইতিহাস ইংরেজরাই কাগজে কলমে লিখে রেখে গেছে। বৃটিশ প্রচারকরা কি করতে পারে না পারে, তার ইতিহাস জানতে হলে পমসেনবি-র লেখা “Secrets of Crewe House” এবং “Wortime Falsehoods”-এর মতো বই পড়লেই যথেষ্ট। ইংরেজ সেনাপতি—ব্রিগেডিয়ার চার্টেরিসই গত যুদ্ধে এই গুজব রটিয়েছিলেন, জার্ম্মানরা মৃত সৈন্যদের দেহ থেকে চর্ব্বি বের করে নিচ্ছে। তিনি জানতেন, এটা ডাহা মিথ্যা। যুদ্ধের শেষে তিনি স্বীকারও করেছিলেন যে, তার এই প্রচার লোকের মনে এমন দৃঢ়মূল হবে এ তিনি প্রত্যাশা করেন নি। কিন্তু বিশ্বের জনসাধারণের সহজ-বিশ্বাসী একটা অংশ মনে করেছিল, একজন বৃটিশ সেনাপতি মিথ্যা কথা বলতেই পারে না। তাই এ অপকৌশলে কাজ হয়েছিল। তারপর বহু পরিবর্ত্তন হয়ে গেছে। জনসাধারণ আজ আর অত সহজ-বিশ্বাসী নয়। বেতারের দৌলতে উভয় পক্ষের প্রচারই পৃথিবীর সকল জায়গায় পৌঁছুতে পারে। তা সত্ত্বেও চিতাবাঘ তার গায়ের দাগ বদলাতে পারে না। মিথ্যাবাদী যদি জানেও যে তার কথায় কেউ বিশ্বাস করে না, তবু সে মিথ্যা কথা বলা বন্ধ করতে পারে না। আশা না থাকলেও সে আশা করে যে, দুনিয়ায় এমন অনেক বোকা আছে, যাদের উপর মিথ্যাচারের ফল ফলবে। বিরুদ্ধ পক্ষ তাই এত মিথ্যা ও ধাপ্পাবাজির জাল ফেলে চলেছে। এতে আমি বিস্মিত নই। কিন্তু অনুতাপের বিষয় এই যে, ভারতে ভাড়াটে প্রচারকরা তাদের হয়ে এই নোংরা কাজ করে। আমি জানি, ভারতে একটা প্রবল অর্থনৈতিক দুর্দ্দশা চলেছে, এবং জনগণ অনশন ভোগ করছে। কিন্তু তা বলে এটা কখনো উচিত নয়, শিক্ষিত লোকেরা এবং সময় সময় নারীরাও এগিয়ে এসে সস্তায় আত্মবিক্রয় করবেন। কোন কোন সময়ে আমি উচ্চ ডিগ্রিধারী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদেরও ভারত-বিরোধী রেডিওর প্রচার-কেন্দ্র থেকে মিথ্যা প্রচার করতে শুনেছি।
একটা উদাহরণ দিয়ে আমি বিপক্ষীয়দের মিথ্যা প্রচার প্রমাণিত করছি। ভারত-বিরোধী রেডিও একাধিকার বলছে, ভারতে আমি এত অপ্রিয় ছিলাম যে, জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি পদ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলাম এবং দেশ ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছি। ভারতে কে না জানে, যে ১৯৩৯-এর জানুয়ারী মাসে মহাত্মা গান্ধী এবং পণ্ডিত নেহেরুর বিরোধিতা সত্ত্বেও আমি ভোটের সংখ্যাধিক্যে কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে পুনর্নির্ব্বাচিত হয়েছিলাম? কে না জানে, আমি যদি পুরাতন ওয়ার্কিং কমিটিকে পুনরায় মনোনীত করতাম, তবে মহাত্মা গান্ধীর সমর্থনে আমি আর একবৎসরের জন্যে সহজেই প্রেসিডেন্ট থেকে যেতে পারতাম? গান্ধীজী ও আমার মধ্যে বিরোধ বেধেছিল এইনিয়ে যে, পুনর্নির্ব্বাচনের পর আমি নিজের ইচ্ছানুযায়ী ওয়ার্কিং কমিটি মনোনয়নের অধিকার চেয়েছিলাম। আমার পক্ষে দেশে থাকা কিংবা কারাগারে নিরাপত্তা বন্দী হিসাবে থাকা ছিল সহজতম ব্যাপার। ভারতে কে না জানে যে, বৃটিশদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসা আমার পক্ষে ছিল সর্ব্বাপেক্ষা কঠিন এবং সবচেয়ে বেশী বিপদসঙ্কুল ব্যাপার? ভারত-বিরোধী রেডিও এ কথা জানে কি জানে না যে, আমার পলায়নে বাধা দিতে পারে নি বলে কয়েকজন পুলিশ অফিসারের চাকুরী গেছে? ভারত-বিরোধী রেডিও জানে কি জানে না যে আমাকে ধরার জন্যে এবং ধরতে না পারলে হত্যা করার জন্যে গুপ্তচরদের আমার পিছনে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল?
অন্যধরণের প্রচারও আছে যা সমান ঘৃণ্য না হলেও সমান মিথ্যা? উদাহরণ স্বরূপ বলতে পারি, ১৯৪৩ সালে বিশ্ব-পরিভ্রমণ করে আমি যখন টোকিও পৌঁছেছিলাম, বৃটিশদের মুখরক্ষার জন্যে তখন ভারত-বিরোধী রেডিও বলতে বাধ্য হয়েছিল—একবার নয়, বহুবার—যে, জার্ম্মান-গবর্নমেণ্টের সঙ্গে আমার মতভেদ হওয়ায় আমি ইউরোপ ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছি। এই মিথ্যার উপযুক্ত জবাব দেওয়া হল, যখন পূর্ব্ব-এশিয়ায় আজাদ হিন্দ সাময়িক গবর্নমেণ্ট প্রতিষ্ঠার পর জার্ম্মান গবর্নমেণ্ট তাকে পরিপূর্ণ সমর্থন করলেন, এবং গবর্নমেন্টের অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়ে সরকারী বাণী পাঠালেন। সম্প্রতি লর্ড লুই মাউণ্ট ব্যাটেনের ব্রহ্ম পুনরুদ্ধারের ব্যর্থতা এবং আজাদ-হিন্দ ফৌজের অগ্রগতিতে বাধা-দানের ব্যর্থতা ঢাকার জন্যে ভারত-বিরোধী রেডিও আমার সঙ্গে জাপানী গবর্নমেণ্টের মতবিরোধের কাল্পনিক কাহিনী প্রচার করছে। বলছে যে, আমাদের সৈন্য ভারতে প্রবেশ করার পর দেশে কোন বিপ্লব হয় নি বলে জাপানী গবর্নমেণ্ট আমার বিষয়ে হতাশ হয়ে পড়েছে। ভারতে যে কেউ আমার বেতার-বক্তৃতা শুনে থাকেন। তিনিই জানেন, আমি দেশবাসীদের বরাবর এই বলে সতর্ক করে আসছি যে আমরা নির্দ্দেশ না দেওয়া পর্য্যন্ত তাঁদের বিপ্লব কিংবা বৃহদায়তনের কোন নাশকতামূলক কাজ করা উচিত হবে না। নিতান্ত গণ্ডমূর্খও বুঝতে পারবে, আমাদের সেনাদল ভারতের মধ্যে বেশ কিছুদূর প্রবেশ করে বিপ্লবকারীদের সাহায্যদানের অবস্থা সৃষ্টি না করা পর্য্যন্ত দেশবাসীর পক্ষে বিপ্লব কিংবা বিপুলায়তনে নাশকতামূলক কাজের চেষ্টা করা হবে আত্মহত্যারই সামিল। আমি আবার বলছি, এই সব প্রচারকৌশল আমাকে আদৌ বিস্মিত করে না। যারা আমাকে হত্যা করাতে পারলে খুসী হত, তাদের পক্ষে এই প্রকার প্রচারের অর্থ অবোধ্য নয়।
কিন্তু যে বিষয়টি বিস্ময়কর অপমানজনক তা হচ্ছে, এই ১৯৪৪ অব্দেও এমন ভারতীয় পাওয়া যাচ্ছে যারা সামান্য অর্থের জন্যে আত্মবিক্রয় করে সব রকম নোংরা কাজ করে। বৃটিশরা যে আমাকে মনের সুখে গালাগালি করবে—আমাকে ‘কুইস লিং’ “পুতুল’ প্রভৃতি বলবে—এ তো স্বাভাবিকই। কিন্তু মিথ্যা প্রচারকার্য্যের জন্যে এখনও তারা মিরজাফর ও উমিচাঁদদের পাবে কেন? এমন কোন ভারতবাসাই নেই যে বিশ্বাস করবে, আমি জাপানী কিংবা অন্য কোন বিদেশী শক্তির কাছে নিজেকে এবং আমার দেশকে বিক্রী করতে পারি।
বৃটিশের ভাড়াটে ভারতীয় প্রচারকরা আর একটি কুকাজ করছে—সেটি হচ্ছে, জাপানী নৃশংসতা সম্বন্ধে মিথ্যা প্রচারকার্য্য—বিশেষ করে, ভারতীয়দের উপর জাপানীদের নৃশংস অত্যাচারের কথা। কোন ভারতবাসী কি বিশ্বাস করতে পারে, পূর্ব্ব-এশিয়ার কোথাও আমার দেশবাসীদের সঙ্গে জাপানীরা যদি কুব্যবহার করত, তবে আমি এবং পূর্ব্ব-এশিয়াস্থ আমার দেশবাসীরা জাপানীদের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করতাম এবং তাদের সেনাদলের সঙ্গে পাশাপাশি যুদ্ধ করতাম? জাপান যখন নিজের পথ থেকে সরে এসে ভারতীয় স্বাধীনতা-আন্দোলন সর্ব্ব প্রকারে সমর্থন করছে এবং স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী গবর্নমেন্টকে সরকারী সমর্থন দিয়েছে, তখন আমার স্বদেশস্থিত দেশবাসীদের উচিত, ভারতীয় জনগণের উপর জাপানীদের অত্যাচারের মিথ্যা কাহিনী না রটিয়ে আপাতত মুখ বন্ধ করে থাকা। বৃটিশের অধীনে থেকেও যারা বৃটিশের কুব্যবহার নীরবে সহ্য করে নি, তারা পৃথিবীর অন্য কোন বিদেশী শক্তির অত্যাচার কিংবা কুব্যবহার কখনো সহ্য করবে না। অত্যাচারের কাহিনী প্রচার বৃটিশ প্রচারকদের প্রিয় কৌশল। এখন তারা সকল ভারতীয় ধর্ম্মের— বিশেষ করে ইসলামের রক্ষক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যতদিন জার্ম্মাণী ও সোভিয়েটের মধ্যে চুক্তি ছিল এবং সােভিয়েটের পক্ষ থেকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের সাহায্য দেবার সম্ভাবনা ছিল, ততদিন বৃটিশ প্রচারকরা— বিশেষ ভাবে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে প্রচারকার্য্য চালাত যে বলশেভিকরা ধর্ম্ম-বিরোধী। যখন ভারতের উত্তর-পশ্চিম থেকে উত্তর-পূর্ব্ব দিকে বিপদের সম্ভাবনা এসে পড়ল, তখন তারা প্রচারকার্য্য সুরু করল, জাপানীরা ধর্ম্ম-বিরোধী—বিশেষ করে তারা ইসলাম-বিরােধী। ভারতের মধ্যেই মৌলবী ও পণ্ডিতদের এই শিক্ষায় শিক্ষিত করা হল, তারপর তাদের বিভিন্ন সৈন্য়-শিবিরে পাঠানো হল ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে প্রচারকার্য্য চালানাের জন্যে। পূর্ব্ব-এশিয়ায় তারা নবাগত—এই প্রকারের ভাণ করে তারা প্রচারকার্য্য চালাতে লাগল। ভারতে আমরা যে সব লােক পাঠিয়েছি, তাদের জন কয়েক ধরা পড়েছে। তাদের এই মর্ম্মে জাপ-বিরােপী প্রচারকার্য্য করতে বাধ্য করানাে হচ্ছে যে জাপানীরা পূর্ব্ব-এশিয়ায় মুসলমানদের উপর অত্যাচার করছে। আমাদের দিক থেকে এর উত্তর হচ্ছে, পূর্ব্ব-এশিয়ার ভারতীয় মুসলমানরা এখন মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্যে হিন্দু, শিখ ও খৃষ্টানদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযােগিতায় কাজ করে যাচ্ছেন। এই প্রচারের বিরুদ্ধে আরও জোরালাে উত্তর, আজাদ হিন্দ ফৌজে মুসলমানের সংখ্যা শতকরা হিসাবে সকল সম্প্রদায়ের চেয়ে বেশী; সেনাবাহিনীর উচ্চতর পদগুলিতে তাঁদের সংখ্যা আরও বেশী। ভারতীয় জাতীয় বাহিনীর এই সব মুসলমান অফিসার সাধারণ লােক নন। তাঁরা ভারতের কয়েকটি শ্রেষ্ঠ বংশের সন্তান, দেরাদুনের সামরিক বিদ্যালয় এবং অন্যত্র শিক্ষাপ্রাপ্ত—এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীতেও সুপরিচিত।
যে সব ভাড়াটে ভারতীয় জেনে শুনে সামান্য লাভের আশায় আত্মবিক্রয় করেছে, তাদের মনে বিশ্বাস উৎপাদন করবার জন্য কিংবা তাদের আমার মতানুবর্তী করবার জন্যে আমি এসব কথা বলছি না। তারা জেনে শুনেই মিথ্যা বলছে, তা আমরা জানি। সাধারণের সম্পর্কিত ব্যাপারে মিথ্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না জানানো কুনীতি। পৃথিবীতে সত্যই শেষ পর্য্যন্ত বিজয়ী হয়, তবু সত্য যাতে সত্বর বিজয়ী হতে পারে আমরা সেই জন্যেই যুদ্ধ করি। এই আধুনিক যুগে, শুধু সামরিক ক্ষেত্রে নয়, প্রচার-ক্ষেত্রেও এই যুদ্ধ চালাতে হয়। সাধারণ জনগণের বিষয়ে আমি বলতে পারি যে, শত্রুর অপপ্রচার তাদের উপর কণামাত্র প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। এই জন্যে কলকাতা বেতারে বারবার জনসাধারণের উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে হয়, তারা যেন ভারতে প্রেরিত আমাদের সহযোগী ও চরদের প্রচারে প্রভাবিত না হয়। ভারতের মধ্য থেকে আমরা এই মর্ম্মে রিপোর্ট পেয়েছি, আমাদের কার্য্যকলাপে বৃটিশ গবর্নমেন্ট শঙ্কিত হয়ে উঠেছে এবং দেশের মধ্যে আমাদের সহযোগী ও চরদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করার জন্যে তারা কয়েকটি ভয়ঙ্কর রকমের অর্ডিনান্স জারী করতে বাধ্য হয়েছে। ইন্দো-ব্রহ্ম সীমান্ত এবং ভারতের মধ্যে গত কয়েক মাসে যে সব দলিল-দস্তাবেজ আমাদের হাতে এসেছে, তার মধ্যেও এই অভিমতেরই সমর্থন মেলে।
ভারতীয় জনগণের সামনে যে প্রধান প্রশ্ন, এবার আমি তারই আলোচনা করব। আমার সহ-যোদ্ধাদের সঙ্গে মিলে আমি ভারতের স্বাধীনতা-অর্জ্জনের জন্যে একটি পরিকল্পনা— বাস্তব পরিকল্পনা রচনা করেছি; খারাপ হোক আর ভালই হোক, যতক্ষণ পর্য্যন্ত নতুন কোন— পরিকল্পনা না পাওয়া যায়, ততক্ষণ আমাদের এই পরিকল্পনাই মেনে নিতে হবে। একমাত্র অপর পরিকল্পনা হচ্ছে, মহাত্মা গান্ধীর “ভারত ছাড়ো” প্রস্তাব। সে পরিকল্পনা যদি সাফল্যমণ্ডিত হয়, তবে আমাদের পরিকল্পনা এবং আমাদের কার্য্যাবলীর আর কোন মূল্য থাকবে না। অপর পক্ষে মহাত্মা গান্ধীর পরিকল্পনা যদি ব্যর্থ হয়ে যায়—তবে ভারতের বাধীনতা লাভের সব আশা-ভরসা নির্ভর করবে একমাত্র আমাদের পরিকল্পনার সাফল্যের উপর। মহাত্মা গান্ধীর পরিকল্পনা যদি সফল হয়, তবে আমাদের চেয়ে বেশী সুখী কেউ হবেনা—কেননা তার ফলে স্বাধীনতা অতি সহজে পাওয়া যাবে। কিন্তু সে পরিকল্পনা যখন ব্যর্থ হয়েছে, তখন স্বদেশে এবং বিদেশে স্বদেশপ্রেমিক ভারতীয়দের পক্ষে আমাদের পরিকল্পনার আশ্রয় করা ছাড়া অন্য উপায় নেই। যদি বৃটিশ কর্ত্তৃপক্ষ আমাদের কার্য্যাবলী প্রকৃতই ব্যর্থ করতে চান, তবে “ভারত ছাড়ো” প্রস্তাবের ভিত্তিতে মহাত্মা গান্ধী এবং কংগ্রেসের সঙ্গে সন্ধিস্থাপন ছাড়া তাঁদের গত্যন্তর নেই।
বিরুদ্ধ পক্ষ মনে করে, তারা আমাকে স্বপ্নদ্রষ্টা বলে অভিহিত করে ছোট করতে পারবে। স্বীকারই করছি আমি স্বপ্নদ্রষ্টা। ভারতের স্বাধীনতার এই স্বপ্ন দেখার ব্যাপারে আমার বিস্তর ভাল ভাল সঙ্গী আছেন। পৃথিবীতে যাঁরা বড় কিছু করেছেন তাঁরা সকলেই ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা। নেপোলিয়ঁ বোনাপার্টির মতো বস্তুবাদী সৈনিকও ছিলেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্বপ্নদ্রষ্টা। আমি যদি ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্ন না দেখতাম, তবে দাসত্বের শৃঙ্খলকে চিরস্থায়ী বলে মেনে নিতাম। স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করা যায় কিনা, সেইটাই আসল প্রশ্ন। আমার নিজের কথা বলতে পারি, আমি যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তা আমি পূরণ করেছি। আঠারো মাসেরও অধিককাল পূর্ব্বে আমি ঘোষণা করেছিলাম, পৃথিবীর কোন শক্তিই আমার ভারত থেকে বহির্গমনে বাধা দিতে পারে নি, আবার সময় পূর্ণ হলে পুনরায় ভারত-সীমান্ত অতিক্রম করতেও আমাকে পৃথিবীর কোন শক্তি বাধা দিতে পারবে না। তখন লণ্ডনের বি. বি. সি. এবং ভারত-বিরোধী রেডিও আমাকে এই ঘোষণার জন্যে উপহাস করেছিল। আজ তারা এ সম্বন্ধে উচ্চবাচ্য করে না। তার কারণ, তারা সরকারীভাবে স্বীকার করুক আর নাই করুক, সারা পৃথিবী জানে যে আজাদ-হিন্দ ফৌজের সৈন্যরা আজ ভারতের মাটিতে যুদ্ধ করছে। মিত্রপক্ষ আজ আমাদের বিরুদ্ধে একমাত্র সমালোচনা যা করতে পারে সে হচ্ছে এই যে আমরা এখন পর্য্যন্ত দিল্লীতে পৌঁছুতে পারি নি। আমি মণিপুর থেকে ভারতের রাজধানীর প্রকৃত দূরত্ব জানি; ভারতীয় অভিযানের জন্যে তাই আমি মোটামুটি দুবৎসর সময় ঠিক করে রেখেছি। ভাগ্য প্রসন্ন হলে, এ অভিযান তার পূর্ব্বেও সমাপ্ত হতে পারে—কিন্তু লাট-প্রাসাদের উপর আমাদের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের জন্যে আমরা অন্ততঃ দু-বৎসর ধরে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত আছি। বছর খানেক ধরে আমি বলে আসছি, আমাদের পক্ষে ভারত-সীমান্ত অতিক্রম করা সহজতম কাজ। কিন্তু আমরা একবার ভারতে প্রবেশ করলেই প্রকৃত যুদ্ধ শুরু হবে। ভারতের মুক্তিযুদ্ধ মানেই বৃটিশ সাম্রাজ্য ধ্বংসের যুদ্ধ। অতএব এটা খুবই স্বাভাবিক যে, এ যুদ্ধে অন্ততঃ একবারের জন্যও বৃটিশরা প্রাণপণ সংগ্রাম করবে। কিন্তু বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের মৃত্যু পরোয়ানা সই হয়ে গেছে—শুধু দণ্ডাদেশ কার্য্যে পরিণত করাই বাকী। অবস্থা যখন খারাপ হয়ে দাঁড়ায়, তখন বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে মন নিয়ে যাবার জন্যে বৃটিশ প্রচারকরা স্বভাবতঃই চেষ্টা করে। নিজেদের পরাজয় ঢেকে রাখবার জন্যে তারা তখন অন্য কোন রণাঙ্গনে আমেরিকান কিংবা রুশদের সাফল্যের কথা জোরগলায় প্রচার করে। তাও সম্ভব না হলে তারা তখন কোন মজার গল্প বের করে সাধারণের দৃষ্টি দূরে সরিয়ে নিতে চায়। ভারতের পূর্ব্ব-রণাঙ্গনে বৃটিশদের অবস্থা যখন খারাপ যাচ্ছিল, তখন তারা ভারত-বিরোধী রেডিওর মারফৎ এই মর্ম্মে এক গল্প প্রচার করেছিল যে, আমাদের প্রেরিত বারো জন লোক তাদের দিকে যোগ দিয়েছে; তারা তাদের ছয় জনকে দিল্লী থেকে জাপবিরোধী প্রচারকার্য্য করতে বাধ্য করেছিল। তারা ভেবেছিল, এই ভাবে তারা ভারতীয় জনগণের মনে এই ধারণার সৃষ্টি করবে যে, এই লোকগুলি আমাদের হয়ে ভারতে কাজ করতে যায়নি—গেছে জাপানীদের হয়ে। যাদের আমরা কাজ করার জন্যে স্বদেশে পাঠিয়েছিলাম, তাদের কয়েকজন ধরা পড়ে যাওয়া অবশ্য দুর্ভাগ্যের বিষয়। কিন্তু বিরাট সংগ্রামে এ জাতীয় ঘটনা ঘটতে বাধ্য। বৃটিশের কর্ম্মরত আমাদের সেই বন্ধুদের ধন্যবাদ,— যাঁরা তাঁদের প্রভুদের প্ররোচিত করে এই ঘটনাটি বেতার মারফত প্রচার করতে পেরেছেন। ভারতীয় জনগণ দিল্লীর বেতার-ঘােষণা থেকে বুঝতে পেরেছে, আমরা যখন সুদূর বেলুচিস্থানে লােক পাঠাতে পারি, তখন ভারতের এমন কোন অঞ্চল নেই যা আমাদের নাগালের বাইরে। যে চারটি লোক ভারত-বিরােধী রেডিও থেকে বক্তৃতা করেছিল, তারা সবাই প্রায় একই ধরণের জাপবিরোধী কথাবার্ত্তা তােতাপাধীর মতাে আবৃত্তি করেছিল। এটা সত্যি খুব কৌতুকজনক। আর এটাও কৌতুকজনক যে, এই সব বেতার-বক্তৃতার পর, শত্রু-প্রচারকরা আবার এ বিষয়ে অদ্ভুত নীরবতা অবলম্বন করেছে। জার্ম্মানী থেকে ১৯৪১ অব্দে রুডলফ হেস ইংল্যাণ্ডে যাবার পরও ঠিক এমনই ব্যাপার ঘটেছিল; বি. বি. সি. সােৎসাহে এই কথা ঘােষণা করার পর হঠাৎ আবিস্কার করেছিল যে “কথা যদিও রৌপ্যবৎ, নীরবতা স্বর্ণবৎ” (Though speech was silver, silence was golden) সম্প্রতি বৃটিশ প্রচারকরা আজাদ হিন্দ ফৌজ থেকে করেকটির দলত্যাগের সম্বন্ধে নতুন গল্প প্রচার করতে বাধ্য হয়েছে। প্রচারকার্য্যে অত্যধিক ত্বরা খারাপ নীতির পরিচায়ক। তাই আমি আবার ভারত বিরোধী রেডিওকে সেই বহু-উদ্ধৃত প্রবাদবাক্য স্মরণ করিয়ে দিতে চাই: “যে শেষে হাসে তার হাসিই সব চেয়ে ভাল” (He laughs best who laughs last)।
ভারত-বিরােধী রেডিও সম্প্রতি ব্রিটিশ জেনারেল মন্টগােমারির বড় বড় কৃতিত্বের কথা বলছে। তবু ভাল যে তারা ফিল্ড-মার্শাল লর্ড ওয়াভেল, কিংবা জেনারেল অকিনলেক কিংবা উভচর অ্যাডমিরাল লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেনের কথা বলছে না। কিন্তু আমি তাদের মনে করিয়ে দিতে পারি, ইরিট্রিয়া কিংবা আবিসিনিয়ার মতো স্থানে ইটালীয়দের বিরুদ্ধে ছাড়া, বৃটিশরা একা একা এ যুদ্ধে কোন একটি সমরেও বিজয়লাভ করতে পারেনি। জেনারেল মন্টগোমারী যা কিছু কৃতিত্ব অর্জ্জন করেছেন, তার মূলে প্রায় পুরোপুরি আছে আমেরিকার হস্তক্ষেপ এবং আমেরিকার সমর্থন। তা নইলে আমেরিকানরা যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হবার আগেই বৃটিশরা এই সব যুদ্ধে জয় লাভ করত।
বেশ কিছুকাল ধরে বিরোধী প্রচারকরা গল্প বলে যাচ্ছে, আজাদ হিন্দ ফৌজ জাপানের হাতের পুতুল; তারা জাপানের হয়েই যুদ্ধ করছে। কিন্তু শেষ পর্য্যন্ত তারা বুঝতে পেরেছে, এ অপকৌশল কাজে লাগছে না। প্রত্যেকেই প্রশ্ন করছে, একটা পুতুল-বাহিনী কি ভাবে এরূপ সাহস এবং জেদের সঙ্গে লড়াই করতে পারে? তাই প্রচার-কৌশল পালটানো হয়েছে; বিশ্ববাসীদের বলা হচ্ছে, আজাদ-হিন্দ ফৌজ দরিদ্র বাহিনী— তাদের খাদ্যবরাদ্দ খুব কম, সমর-সজ্জা অপ্রচুর। আমি বিস্মিত হয়ে ভাবছি বর্ত্তমানে আজাদ হিন্দ ফৌজ সম্বন্ধে আমাদের বিরুদ্ধদলের শুধু তা হলে এই কথাই মাত্র বলার আছে। আমরা কখনও দাবী করিনি যে, আমাদের সেনাবাহিনী ভারতের বৃটিশ সেনাবাহিনীর মত সুসজ্জিত। বৃটিশের পক্ষে ভারত বিমথিত করে তাদের সেনাবাহিনীকে খাওয়ানো পরানো সহজ হয়েছে। কিন্তু আমাদের মতো বিপ্লবী বাহিনীকে কি অবস্থায় যুদ্ধ করতে হয়, আমাদের সেনাবাহিনী তা পূর্ব্ব থেকেই জানে। বৃটিশ বাহিনী শুধু রিয়ার, রাম, টিনজাত শূকর-মাংস এবং গো-মাংসের জোরেই যুদ্ধ করতে পারে; আর আমাদের সেনাবাহিনীকে চরম অসুবিধাজনক অবস্থার মধ্যেও যুদ্ধ করতে শেখানো হয়েছে। আয়ার্ল্যাণ্ড, ইটালী কিংবা রাশিয়াতেই হোক কিংবা অন্যত্রই হোক, পৃথিবীর যে কোন স্থানে বিপ্লবী বাহিনীকে অনুরূপ অবস্থার মধ্যেই লড়াই করতে হয়। প্রত্যেক স্থানে তারাই শেষ পর্য্যন্ত জিতেছে। আমরাও জিতব। কিন্তু স্বাধীনতার জন্যে আমাদের রক্ত-মূল্য দিতে হবে।
বৃটিশ প্রচারকরা ভারতীয় জনগণকে বলছে, আজাদ-হিন্দ ফৌজ মণিপুরে এলেও তারা কখনও দিল্লী পৌঁছতে পারবে না। আমরা এমন কোন তারিখ নির্দ্দেশ করি নি, যে-তারিখের মধ্যে দিল্লী পৌঁছাবোই। সুস্থমস্তিষ্ক কোন লোকই তা করে না। ভারত-বিরোধী রেডিওই আমাদের দিল্লী-প্রবেশের কাল্পনিক তারিখ আবিষ্কার করছে, এবং আমরা সেই সময়-তালিকা অনুসারে কাজ করতে পারি নি বলে আমাদের সমালোচনা করছে। পৃথিবীর বহু শক্তির দ্বারা সমর্থিত বৃটিশ সাম্রাজ্যের মতো শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রায় পাঁচবৎসর ধরে যুদ্ধ করে চলেছে। কিন্তু তারা লাভ করেছে কি? আমরা আমাদের সামান্য সামর্থ্য নিয়ে যদি ভারতীয় অভিযানের সময় দুই বৎসর নির্দ্ধারণ করি, তবে সেটা কি খুব বেশী হবে? ভারত-বিরোধী রেডিও ১৯৪৬-এর ৪ঠা ফেব্রুয়ারী পর্য্যন্ত অপেক্ষা করুক। তখন যেন তারা আমাদের সময়-তালিকায় ভুল হয়েছে বলে আমাদের সমালোচনা করতে সুরু করে।
বিপক্ষ-প্রচারকার্য্যের প্রধান উদ্দেশ্য দ্বিমুখী বলে মনে হয়। প্রথমত, বৃটিশরা যুদ্ধ-জয় সম্বন্ধে নিশ্চিত—এরূপ ধারণা-সৃষ্টির প্রয়াস; দ্বিতীয়তঃ আমাদের দেশে জাপবিরোধী মনোভাব সৃষ্টির চেষ্টা। প্রথম উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্যে তারা প্রতিনিয়ত যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠনের কথা বলছে, যেন জয়লাভ তাদের করতলের মধ্যে এসে গেছে। তারা অন্যত্র মিত্রপক্ষের প্রত্যেকটি সাফল্যকে অতিরঞ্জিত করছে। কিন্তু আমরা যখন তথাকথিত এই সাফল্যগুলি বিশ্লেষণ করি, তখন কি দেখতে পাই? ধরুন, ইটালীতে মিত্রশক্তি কি করছে? তাদের ইটালীতে আরও সৈন্য, আরও সমরসম্ভার, আরও এরোপ্লেন এবং আরও যুদ্ধ-জাহাজ পাঠাতে হয়েছে। বর্ত্তমান গতিতে ইটালীর যুদ্ধ কখন শেষ হবে? আর মিত্রবাহিনী ব্রেণার-গিরিবর্ত্ম পার হয়ে জার্ম্মানীতেই বা কথন প্রবেশ করবে? ফ্রান্সে জার্ম্মাণদের প্রত্যাক্রমণ এখনও পূর্ণবেগে আরম্ভ হয় নি; সেখানেই বা সাত সপ্তাহ যুদ্ধের পর মিত্রশক্তি কি করেছে? তারা যে গুরুতর ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তার তুলনায় তারা লাভ করেছে কি? ভারতীয় স্বার্থ-বিচারে মিত্রবাহিনী ফ্রান্স ও ইটালীর যতই অভ্যন্তর ভাগে প্রবেশ করবে, আমাদের সুবিধা হবে তত বেশী। তারা যেসব তথাকথিত বিজয়লাভ করেছে কিংবা ভবিষ্যতে করবে, তার ফলে তাদের শক্তিও গুরুতর রকম কমে যাবে। এরূপ সম্ভাবনা এখনও রয়েছে, শেষ পর্য্যন্ত মিত্রশক্তি ফ্রান্স থেকে বিতাড়িত হবে, এবং ইটালীতে তাদের অবরুদ্ধ হবে। ইউরোপের যুদ্ধ প্রথম শেষ করে, তারপর পূর্ব্ব-এশিয়ায় জাপানকে পরাস্ত করতে আসার সম্বন্ধে যেসব কথা উঠেছে, সেসব কথা সৈন্যদলে ব্যবহৃত ভাষায় বলতে হয় “বাজে কথা” (Tommy Rot)। আমি ইতিপূর্ব্বে এক বেতার-বক্তৃতায় বলেছি যে, ইঙ্গ-মার্কিণরা কখনও ইউরোপের যুদ্ধে জয়ী হতে পারবে না। কিন্তু আমি এমন কথাও বলছি, যদি তারা ইউরোপীয় যুদ্ধে জয়ী হতে পারে, তাহলেও তাদের পূর্ব্ব-এশিয়ায় জাপানের সম্মুখীন হবার মতো শক্তি থাকবে না। একথা ভুললে চলবে না যে, যুদ্ধ পণ্যোৎপাদন এবং মানুষের শক্তির সীমা আছে। কাজেই, আজ চোখের সামনে যা দেখা যাচ্ছে, তা সত্ত্বেও মিত্রশক্তির পক্ষে অবস্থা নৈরাশ্যজনক।
মণিপুরের কথা যখন আলোচনা করছিলাম, তখন আমি একটি কথা বলতে ভুলে গেছি। সে কথা বেচারী মণিপুরের মহারাজার সম্বন্ধে। তিনি আজ কোথায়? কংগ্রেস-পূর্ব্ব আমলের দেশীয় রাজারা কোথায়? মহারাজা এবং তাঁর পরিবারবর্গ কি অবস্থায় আছেন? এত এত মহারাজা এবং নবাবরা যখন সৈন্য-সংগ্রহকারী সার্জ্জেন্টরূপে কাজ করছেন, তখন যুদ্ধের সুরু থেকে মণিপুরের মহারাজা এমন নীরব আছেন কেন? আমি তার কারণ জানি। মহারাজা এবং তাঁর প্রজাদের সঙ্গে বৃটিশদের কোন সম্পর্ক নেই। সেদিন পর্য্যন্ত মণিপুরের জনগণ এবং নাগা পর্ব্বতের লোকেরা অর্থাৎ কোহিমা অঞ্চলের লোকেরা—বৃটিশের বিরোধিতা করেছে—এমন কি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছে। সেইজন্যেই তারা আমাদের সৈন্যদলের প্রতি এত বন্ধুভাবাপন্ন, আমাদের তারা সর্ব্বপ্রকারে সাহায্য করছে।
গত আড়াই বৎসর ধরে দেশবাসী অবিচ্ছিন্ন জাপ-বিরোধী প্রচার শুনেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটি প্রশ্নের উত্তর আজ পর্য্যন্ত মেলে নি। জাপান ছাড়া সমগ্র পূর্ব্ব-এশিয়ায় এমন কোন শক্তি আছে কি, যে ইঙ্গ-মার্কিণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে এবং ভারতীয় জনগণকে তাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামে সাহায্য করতে পারে? চীন, রাশিয়া এবং অন্যান্য দেশের সম্পর্কে সহানুভূতির কথা বলা সহজ। কিন্তু আমাদের নিজেদের প্রতিই সর্ব্বাগ্রে সহানুভূতি জানাতে হবে—আমাদের মুক্তির জন্যে সর্ব্বাগ্রে চেষ্টা করতে হবে। নিজেদের আমরা প্রশ্ন করব, বিভিন্ন ভয়ঙ্কর শক্তি সমর্থিত এক শক্তিশালী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের সাহায্য দেবার মতে পৃথিবীতে আজ কে আছে?” এই সহজ প্রশ্নের জবাবে বুঝতে পারি, জাপান ছাড়া আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামে বাস্তব সাহায্য করার মতো অন্য কোন শক্তি নেই। ১৯৩০ অব্দের জাপানের কথা বিবেচনা করলে চলবে না। এ জাপান আজকের জাপান, যে মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তাদের শক্তিক্ষয় করছে এবং এইভাবে আমাদের কাজ সহজ করে দিচ্ছে। এ সেই জাপান, যে স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী গবর্নমেন্টকে স্বীকার করেছে এবং ভারত সম্বন্ধে তার সদভিপ্রায়ের বাস্তব প্রমাণ দিয়েছে। আজকের জাপান এবং সমগ্র পূর্ব্ব-এশিয়ায় তার নতুন নীতি দেখে পৃথিবীর এ অঞ্চলের ত্রিশ লক্ষ ভারতবাসী জাপানের ঐকান্তিকতা সম্বন্ধে নিংসন্দেহ হয়েছে। এই জন্যেই মিত্র শক্তির পতন না হওয়া পর্য্যন্ত আমরা জাপানের সঙ্গে একযোগে যুক্ত চালিয়ে যেতে কৃতসংঙ্কল্প। ভারতের মধ্যে আজ যে যুদ্ধ চলেছে, সে যুক্ত জাপানের নয়—সে যুদ্ধ ভারতের নিজের—তার স্বাধীনতার সংগ্রাম। পুর্ব্ব-এশিয়ার ভারতবাসীদের মতো যদি প্রকৃতই আমরা অকৃত্রিম এবং আত্মত্যাগী হই, তবে আমাদের জয় অনিবার্য্য। উদ্দেশ্য যদি ন্যায়সঙ্গত হয় এবং সেই উদ্দেশ্যের ধারকরা যদি হয় সাধু এবং একনিষ্ঠ— যেমন আমাদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে—তবে শেষ পর্য্যন্ত সাম্রাজ্যবাদের শক্তি পরাস্ত হবেই। আমরা যুদ্ধ করতে এবং যুদ্ধে জয়ী হতে কৃতসংকল্প। সকলে এগিয়ে আসুন—সাহায্য দিয়ে আমাদের কাজ সহজ করে তুলুন।
জয় হিন্দ!
বেতার: ১১ জুলাই, ১৯৪৪