চারমূর্তি by নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, chapter name চিড়িয়া ভাগল বা

চিড়িয়া ভাগল বা

দূরে শেঠ ঢুণ্ডুরামের নীল মোটরটাকে চলে যেতে দেখেই ক্যাবলা বললে, চুকচুক-চ্চু !

      টেনিদা জিজ্ঞেস করলে, কী হল রে ক্যাবলা ?

      —কী আর হবে ? চিড়িয়া ভাগল বা ।

      —চিড়িয়া ভাগল বা মানে ? আমি বললুম, বোধহয় চিড়ে-টিড়ের ভাগ হবে । চিড়ে কোথায় পেলি রে ক্যাবলা ? দে না চাটি খাই ! বড্ড খিদে পেয়েছে।

      ক্যাবলা নাক কুঁচকে বললে, বহুৎ হুয়া, আর ওস্তাদি করতে হবে না । চিড়ে নয় রে বেকুব—চিড়ে নয়—চিড়িয়া ভাগল বা মানে হল, পাখি পালিয়েছে।

      আমি বললুম, পাখি ? নাঃ—পালায়নি তো ! ওই তো দুটাে কাক ওই গাছের ডালে বসে আছে ।

      ক্যাবলা বললে, দুৰ্ত্তোর । এই প্যালাটার মগজে খালি বাসক পাতার রস আর শিঙিমাছ ছাড়া আর কিছু নেই। শেঠ ঢুণ্ডুরামের মোটরে করে সব পালাল দেখছিস না ? স্বামী ঘুটঘুটানন্দের দাড়ি দেখতে পাসনি ?

      —পালিয়েছে তো হয়েছে কী ? টেনিদা বলল, আপদ গেছে !

      হাবুল তখন দাঁড়িয়ে ঝিমুচ্ছিল। একহাঁড়ি রসগোল্লার নেশা ওর কাটেনি। হঠাৎ আলোর-খোঁচা-খাওয়া প্যাঁচার মতো চোখ মেলে বললে, আহা-হা, গজাদা চইল্যা গেল ? বড় ভালো লোক আছিল গজাদা !

      ক্যাবলা বললে, তুই থাম হাবুল, বেশি বকিসনি। গজাদা ভালো লোক ? ভালো লোকই তো বটে। তাই তো বাংলো থেকে আমাদের তাড়াতে চায়—তাই পাহাড়ের গর্তের মধ্যে বসে কুটুর-কুটুর করে কী সব ছাপে । আর শেঠ ঢুণ্ডুরাম কী মনে করে একটা নীল মোটর নিয়ে জঙ্গলের ভেতর ঘুরে বেড়ায় ?

      —ক্যাবলা পণ্ডিতের মতো মাথা নাড়তে লাগল, হুঁ-হুঁ-হুঁ । আমি বুঝতে পেরেছি।

      টেনিদা বললে, খুব যে ডাঁটের মাথায় হুঁ-হুঁ করছিস । কী বুঝেছিস বল তো ?

      ক্যাবলা সে কথার জবাব না দিয়ে হঠাৎ চোখ পাকিয়ে আমাদের সকলের দিকে তাকাল । তারপর গলাটা ভীষণ গম্ভীর করে বললে, আমাদের দলে কাপুরুষ কে কে ?

      এমন করে বললে যে, আমার পালাজ্বরের পিলেটা একেবারে গুরগুর করে উঠল ।

      একবার অঙ্কের পরীক্ষার দিনে পেট-ব্যথা হয়েছে বলে মটকা মেরে পড়েছিলুম। মেজদা তখন ডাক্তারি পড়ে—আমার পেট-ব্যথা শুনে সে একটা আট হাত লম্বা সিরিঞ্জ নিয়ে আমার পেটে ইনজেকশন দিতে এসেছিল, আর তক্ষুনি পেটের ব্যথা উর্ধ্বশ্বাসে পালাতে পথ পায়নি। ক্যাবলার দিকে চেয়ে মনে হচ্ছিল সেও যেন এইরকম একটা সিরিঞ্জ নিয়ে আমায় তাড়া করছে।

      আমি প্রায় বলেই ফেলেছিলুম—একমাত্র আমিই কাপুরুষ, কিন্তু সামলে গেলুম।

      টেনিদা বললে, কাপুরুষ কে ? আমরা সবাই বীরপুরুষ ।

      —তাহলে চলো—যাওয়া যাক ।

      —কোথায় ?

      —ওই নীল মোটরটাকে পাকড়াও করতে হবে।

      বলে কী, পাগল না পাঁপড়-ভাজা ! মাথা-খারাপ না পেট-খারাপ ! মোটরটা কি ঘুটঘুটানন্দের লম্বা দাড়ি যে হাত বাড়িয়ে পাকড়াও করলেই হল ।

      হাবুল সেন বললে, পাকড়াও করবা কেমন কইর‌্যা ? উইর‌্যা যাবা নাকি ?

      ক্যাবলা বললে, চল—বড় রাস্তায় যাই । ওখান দিয়ে অনেক লরি যাওয়া-আসা করে, তাদের কিছু পয়সা দিলেই আমাদের তুলে নেবে। -

      —আর ততক্ষণ নীল মোটরটা বুঝি দাঁড়িয়ে থাকবে ?

      —নীল মোটর আর যাবে কোথায় বড়-জোর রামগড় । আমরা রামগড়ে গেলেই ওদের ধরতে পারব।

      —যদি না পাই ? আমি জিজ্ঞাসা করলুম।

      —আবার ফিরে আসব ।

      —কিন্তু মিথ্যে এ-সব দৌড়ঝাঁপের মানে কী ?

      টেনিদা বললে, খামকা ওদের পিছু-পিছু ধাওয়া করেই বা লাভ কী হবে ? পালিয়েছে, আপদ গেছে। এবার বাংলোয় ফিরে প্রেমসে মুরগির ঠ্যাং চর্বণ করা যাবে। ও-সব বিচ্ছিরি হাসিটাসিও আর শুনতে হবে না রাত্তিরে ।

      ক্যাবলা বুক থাবড়ে বললে, কভি নেহি । আমাদের বোকা বানিয়ে ওর চলে যাবে—সারা পটলডাঙার যে বদনাম হবে তাতে । তারপর আর পটলডাঙায় থাকা যাবে না—সোজা গিয়ে আলু-পোস্তায় আস্তানা নিতে হবে । ও-সব চলবে না, দোস্ত । তোমরা সঙ্গে যেতে না চাও, না গেলে । কিন্তু আমি যাবই।

      টেনিদা বললে, একা ?

      –একা ।

      টেনিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, চল—আমরাও তা হলে বেরিয়ে পড়ি ।

      আমি শেষবারের মতো চাঁদির ওপরটা চুলকে নিলুম।

      —কিন্তু ওদের সঙ্গে যে গজেশ্বর আছে। কাঁকড়াবিছের কামড়ে সেবার একটু জব্দ হয়েছিল বটে, কিন্তু আবার যদি হাতের মুঠোয় পায় তাহলে সকলকে কাটলেট বানিয়ে খাবে। পেয়াজ-চচ্চড়িও করতে পারে। কিংবা পোস্তর বড়া ।

      —কিংবা পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল

      —ক্যাবলা তিনটে দাঁত বের করে দিয়ে আমাকে যাচ্ছেতাই রকম ভেংচে দিলে : তাহলে তুই একাই থাক এখানে—আমরা চললুম।

      পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোলকে অপমান করলে আমার ভীষণ রাগ হয় । পটোল নিয়ে ইয়ার্কি নয়, হুঁ-হুঁ ৷ আমাদের পাড়া হচ্ছে কলকাতার সেরা পাড়া—তার নাম পটলডাঙা । মানুষ মরে গেলে তাকে পটল তোলা বলে । আমার এক মাসতুতো ভাই আছে—তার নাম পটল ; সে একসঙ্গে দেড়শো আলুর চপ আর দুশো বেগুনি খেতে পারে । ছোড়দির একটা পাঁঠা ছিল—সেটার নাম পটল—সে মেজদার একটা শখের শাদা নাগরাকে সাত মিনিট তেরো সেকেন্ডের মধ্যে খেয়ে ফেলেছিল—ঘড়ি ধরে মিলিয়ে দেখেছিলুম আমি । আর, শিঙিমাছের কথা কে না জানে । আর কোন মাছের শিং আছে ? মতান্তরে ওকে সিংহমাছও বলা যায়—মাছেদের রাজ্যে ও হল সিংহ। আর তোরা কী খাস বল । আলু, পোনামাছ। আলু শুনলেই মনে পড়ে আলু প্রত্যয়। সেইসঙ্গে পণ্ডিতমশায়ের বিচ্ছিরি গাঁট্টা। আর পোনা! ছেঃ! লোকে কথায় বলে—ছানাপোনা—পুঁচকে এত্তোটুকু। কোথায় সিংহ, আর কোথায় পোনা ! কোনও তুলনা হয়। রামচন্দ্র ।

      আমি যখন এইসব তত্ত্বকথা ভাবছি, আর ভাবতে ভাবতে উত্তেজনায় আমার কান কটকট করছে, তখন হঠাৎ দেখি ওরা দল বেঁধে এগিয়ে যাচ্ছে আমাকে ফেলেই ।

      অগত্যা পটোল আর শিঙিমাছের ভাবনা থামিয়ে আমাকে ওদেরই পিছু-পিছু ছুটতে হল। বড় রাস্তাটা আমাদের বাংলো থেকে মাইল-দেড়েক দূরে। যেতে-যেতে কাঁচা রাস্তায় আমরা মোটরের চাকার দাগ দেখতে পাচ্ছিলুম। এক জায়গায় দেখলুম একটা শালপাতার ঠোঙা পড়ে রয়েছে। নতুন—টাটকা শালপাতার ঠোঙা । কেমন কৌতুহল হল—ওরা দেখতে না পায় এমনিভাবে চট করে তুলে নিয়ে শুকে ফেললুম। ইঃ—নির্ঘাত সিঙাড়া ! এখনও তার খোশবু বেরুচ্ছে ।

      কী ছোটলোক ! সবগুলো খেয়ে গেছে ! এক-আধটা রেখে গেলে কী এমন ক্ষেতিটা ছিল!

      —এই প্যালা—মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়লি ক্যান র‌্যা ?

      —টেনিদার হাঁক শোনা গেল ।

      এমনিতেই খিদে পেয়েছে—ঘ্রাণে অর্ধভোজন হচ্ছিল, সেটা ওদের সইল না। চটপট ঠোঙাটা ফেলে দিয়ে আবার আমি ওদের পিছু পিছু হাঁটতে লাগলুম। ভারি মন খারাপ হয়ে গেল । ঠোঙাটা আরও একটু শোকবার একটা গভীর বাসনা আমার ছিল । বড় রাস্তায় যখন এসে পড়েছি—তখন, ভোঁক-ভোঁক । একটা লরি । আমি হাত তুলে বলতে যাচ্ছিলুম—রোখকে—রোখকে—কিন্তু ক্যাবলা আমার হাত চেপে ধরলে । বললে, কী যে করিস গাঁড়লের মতো তার ঠিক নেই । ওটা তো রামগড় থেকে আসছে !

      —ওরা তো উল্টোদিকেও যেতে পারে ।

      —তুই একটা ছাগল ! দেখছিস না কাঁচা রাস্তার ওপর ওদের মোটরের চাকা কীভাবে বাঁক নিয়েছে! অর্থাৎ এরা নির্ঘাত রামগড়ের দিকেই গেছে। উল্টোদিকে হাজারিবাগ—সেদিকে যায়নি।

      ইস—ক্যাবলার কী বুদ্ধি ! এই বুদ্ধির জন্যেই ও ফাস্ট হয়ে প্রমোশন পায়—আর আমার কপালে জোটে লাড্ডু ! তাও অঙ্কের খাতায় । আমার মনে হল, লাড্ডু কিংবা গোল্লা দেবার ব্যবস্থাটা আরও নগদ করা ভালো। খাতায় পেনসিল দিয়ে গোল্লা বসিয়ে কী লাভ হয় ? যে গোল্লা খায় তাকে একভাঁড় রসগোল্লা দিলেই হয় ! কিংবা গোটা-আষ্টেক বড়বাজারের লাড্ডু । কিন্তু তিলের নাডু নয়—একবার একটা খেয়ে সাতদিন আমার দাঁত ব্যথা করেছিল ।

      পাশে একটা লরি এসে থামল। কাঠ-বোঝাই। ক্যাবলা হাত তুলে সেটাকে থামিয়েছে। লরি-ড্রাইভার গলা বের করে বললে, কী হয়েছে খোকাবাবু ! তুমরা ইখানে কী করছেন ?

      —আমাদের একটু রামগড়ে পৌঁছে দিতে হবে ড্রাইভার সাহেব !

      —পয়সা দিতে হবে যে ! চার আনা ।

      —তাই দেব ।

      —তবে উঠে পড়ো। লেকিন কাঠকে উপর বসতে হোবে ।

      —ঠিক আছে। কাঠে আমাদের কোনও অসুবিধে হবে না।

      ক্যাবলা আমাদের তাড়া দিয়ে বললে, টেনিদা—ওঠে । হাবলা—আর দেরি করিসনি । তুই হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন প্যালা ? উঠে পড় শিগগির—

      ওরা তো উঠল। কিন্তু আমার ওঠা কি অত সহজ ? টেনে-হিঁচড়ে কোনমতে যখন লরির ওপরে উঠে কাঠের আসনে গদিয়ান হলুম—তখন আমার পেটের খানিক নুন-ছাল উঠে গেছে। সারা গা চিড়-চিড় করে জ্বলছে।

      আর তক্ষুনি—

      ভোঁক-ভোঁক করে আরও গোটা-দুই হাঁক ছেড়ে গাড়ি ছুটল রামগড়ের রাস্তায়। এঃ—কী যাচ্ছেতাই ভাবে নড়ছে যে কাঠগুলো । কখন ধপাস করে উলটে পড়ে যাই—তার ঠিক নেই । আমি সোজা উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে দুহাতে মোটা কাঠের গুড়িটা জাপটে ধরলুম।

      লরিটা পাই-পই করে ছুটতে লাগল। আমার মনে হতে লাগল, পেল্লায় ঝাঁকুনির চোটে আমার পেটের নাড়িতুড়িগুলো সব একসঙ্গে ক্যাঁ-ক্যাঁ করছে।