চক্রপুরের চক্করে by শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, chapter name 4

4

 সুদৰ্শনবাবু খুবই অবাক হয়ে লাখনের মুখের দিকে চেয়ে বললেন, “গোয়েন্দা-পুলিশ! গোয়েন্দা-পুলিশ এসে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করেই লোকটার খোঁজে বেরিয়ে গেল এ কেমন কথা! কেন, আমি কি মরে গেছি? সুদর্শন দারোগাকে ডিঙিয়ে নিজেদের সর্দারি ফলানো!”

      লাখন হাতজোড় করে বলল, “আপনি তো জবরদস্ত দারোগা আছেন। আর ই চারটো আদমি বহুত খতরনাক আছে। শের কা মাফিক আখি আউর বহুত ওয়সা।”

      সুদর্শনবাবু খুবই উত্তেজিতভাবে বললেন,“আইডেন্টিটি কার্ড দেখিয়েছিল?”

      “না মালিক। উ লোক এক কৌন অভয় সরকারকে জানে মারতে এসেছে। ওহি বাত তো বলছিল। হামলোগকা বহুত ডর লাগল। এ ভি বলেছে যে, দারোগীবাবুকে কোই খবর-টবর দিলে খারাবি হেয়ে যাবে।”

      সুদৰ্শনবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “অ্যাঁ, তা হলে তো দেখছি জালি ব্যাপার। এরা তো পুলিশের লোক নয়।”

      “ওহি বাত তো বোলতে আসলম মালিক। ইসব খতরনাক আদমি ডাকু আছে কি খুনি আছে কোন জানে! এখুন তো ভরসা আপনি।”

      “আমি?” বলে সুদর্শনবাবু এই শীতেও কপালের ঘাম হাতের তেলোয় মুছে হাতটা ফের মুছলেন বুকপকেটের ওপর ঘষে। তারপর খুবই থমথমে মুখে বললেন, “দুনিয়ায় কোনও দারোগাই কখনও শান্তিতে থাকে না জানি। কিন্তু তোরা যে আমাকে খেতে-শুতে অবধি দিচ্ছিস না, এটা কি ভাল হচ্ছে রে!”

      লাখন গদগদ হয়ে বলে, “জি মালিক, কিন্তু এখুন তো সবের টাইম আছে। দশটা বাজছ । এখুন তো কোই নিদ যানেক টাইম নেহি মালিক। তোবে ভুখ লাগার কথা আলাদা। ভুখ সোবসময় লাগতে পারে হুজুর।”

      লাখন কথাটা শেষ করার আগেই দরজার কাছ থেকে কে যেন ভারী বিনয়ী গলায় বলে উঠল, “ভুখ লাগলেও কোনও চিন্তা নেই। দারোগাবাবুর যে সবসময় খিদে পায় সে আমরা খুব জানি। আর সেইজন্যই আসা।”

      সুদৰ্শনবাবু একটা হুঙ্কার দিলেন, “তোরা কারা?” দরজার কাছ থেকেই হাতজোড় করে তিনজন ঘরে ঢুকল। একজনের হাতে একটা মেটে হাঁড়ি।

      “আজ্ঞে, আমাকে চিনতে পারছেন না বড়বাবু? আমি রেমো নাপতে। এ হল অক্ষয়। আর ওই যে উঁচু দাঁত, ও হল গে নেতাই। রসময় হালুইকরের গরম-গরম কখানা জিবেগজা এনেছিলুম বাবু। একটু ইচ্ছে করুন।”

      “জিবেগজা।” বলে দারোগাবাবু ঈষৎ প্রসন্ন মুখে বলেন, “ওই একটাই যা সুখ এখনও আছে রে। দুনিয়াটা পচে গেছে বটে, কিন্তু এখনও যে এ-দুনিয়ায় জিবেগজা হয়, জিলিপি হয়, এটাই যা ভরসার কথা। নিয়ে আয় এখানে।”

      রেমো বিগলিত মুখে এগিয়ে এসে হাঁড়িটা টেবিলে রেখে মুখের সরাখানা সরিয়ে নিল। দারোগাবাবু গন্ধটা শুকে বললেন, “আঃ, এ একেবারে স্বর্গের জিনিস। দেবভোগ্য৷”

      “হেঁ-হেঁ, আপনি ছাড়া ভাল জিনিসের কদর আর কে বুঝবে বলুন! সমঝদার কই? তিরিশখানা আছে, আজ্ঞে । আপনার কাছে অবশ্য কিছুই নয়, তিন মিনিটে উড়ে যাবে।”

      এ ত্রিশখানাও যা, তিনশোখানাও তাই।” এই বলে একখানা মুখে দিয়ে চিবোতে-চিবোতে চোখ আধবোজা করে বললেন, “মন্দ নয়।”

      অক্ষয় রেমোর পেছন থেকে বলে উঠল, “আজ্ঞে, রসময় এ গজার নামই দিয়েছে দারোগাভোগ।”

      রেমো বলল, “আর তার জিলিপির নাম শুনলে আপনি হাসবেন। জিলিপি হল গিয়ে সুদর্শনচক্র। খুব বিকোচ্ছে।”

      সুদৰ্শনবাবু গোটা দশেক জিবেগজা উড়িয়ে দিয়ে কথা বলার ফুরসত পেলেন, “হ্যাঁ, এবার বল তোদের সমস্যাটা কী?”

      অক্ষয় এগিয়ে এসে একটা নমো ঠুকে বলল, “আজ্ঞে, কাল রাতেও একটা ডাকাত একেবারে ভরসন্ধেবেলা ঢুকে পড়েছিল আমাদের গাঁয়ে। আপনি তো জানেন আমরা ভেডুয়া নই। মনসাপোঁতার লোকেরা ভগবান আর দারোগীবাবুকে ছাড়া কাউকে ভয় খায় না । তা আমরা ডাকাতটাকে সবাই মিলে এমন দাবড়ে দিলুম যে, পালানোর পথ পায় না। আর পালাল বলেই ভয় হল। ব্যাটা হুকুম সিং-এর দলের লোক। গিয়ে খবর দিলে হুকুম কি আর আমাদের ছেড়ে কথা কইবে।”

      জিবেগজা খাওয়া থামিয়ে দারোগাবাবু ব্যথিত মুখে বললেন, “হাঁ রে, এই জিবেগজা খাওয়ার সময়েই কি ওসব অলক্ষুনে কথা বলতে হয়? তোদের এটুকু খেয়াল হল না যে, হুকুম সিং-এর নাম শুনলে সুদৰ্শন দারোগার জিভ অসাড় হয়ে যায়! দূর, খাওয়াটাই মাটি করলি তোরা।”

      অক্ষয় জিভ কেটে কানে হাত দিয়ে বলল, “এঃ, বড্ড ভুল হয়ে গেছে বড়বাবু। আচ্ছা, আপনি বরং খেয়ে নিন। আমরা একটু বাইরে বসছি গিয়ে।”

      সুদৰ্শনবাবু চেয়ারে হেলান দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,“খাওয়াটাই যখন মাটি করেছিস তখন বাকিটাও বলে ফেল। জিবেগজা না হয় রয়েসয়ে খাওয়া যাবে।”

      লাখন এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার মাথা নেড়ে বলল, “ওই বাত ঠিক বলিয়েছেন। সবেরবেলায় তো আজ বহুত ভারী নাস্তা হয়েছে মালিক। হামি তো বিশটা পুরি-কচেরি আর তিন পৌয়া সবজি আপনার ভোগমে লাগালম। শোচ করছিলাম কি, দারোগা-মালিকের পেটমে আর কত জায়গা হেবে।”

      দারোগাবাবু রোষকষায়িত লোচনে লাখনের দিকে চেয়ে বললেন, “তোর কথা তো শুনেছি। এখন যা তো। একটু শান্তিতে থাকতে দে।”

      লাখন “রাম রাম” বলে নমস্কার জানিয়ে বিদায় নিল। দারোগাবাবু গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "এবার তোরা বল । সকালে যে আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলুম!”

      নেতাই বলল, “আজ্ঞে, বোধ হয় লাখনের মুখ দেখে। ব্যাটা বড় অপয়া। এই তো সেদিন তায়েবগঞ্জ থেকে ভোরবেলা ইস্টিশনে নেমেই দেখি লাখন। আর সেদিনই কিনা জীবনে প্রথম বিনা টিকিটের জন্য ধরা পড়লুম! গত বিশ বছর তায়েবগঞ্জে শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছি-আসছি, কস্মিনকালে টিকিট কাটিনি, হাসতে-হাসতে চলে এসেছি লাইন ধরে হেঁটে। আর সেদিন বারো টাকা গচ্ছা দিয়ে তবে রেহাই পাই।”

      দারোগাবাবু হাতের একটা ঝাপটায় নেতাইকে চুপ করিয়ে বললেন, “ডাকাতের কথাটা বলে ফেল।”

      অক্ষয় গলা-খাঁকারি দিয়ে বলল, “আজ্ঞে। এই বলি। তা হুকুম সিং-এর দলের লোকটা তো রাতে পালাল। সারারাত আমরা শলাপরামর্শ করলুম, এখন কী করা! হুকুম এসে তো গাঁ জ্বলিয়ে দেবে, গুলি চালাবে, লুটপাট করবে। মাথার ওপর আপনি আছেন বটে, কিন্তু পিদিমের নীচেই তো অন্ধকার কিনা, হুকুম ব্যাটার ভাগ্য ভাল যে, এমন ভাল একজন দারোগা পেয়েছে। নইলে এতদিনে তার জারিজুরি বেরিয়ে যেত।”

      দারোগাবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “আসল কথাটা বলবি ত!”

      “আজ্ঞে, সেই কথাই বলছি। আজ সকালেরই ঘটনা। রাত পোয়াতে না পোয়াতেই কী বলব হুজুর, বন্দুক পিস্তল নিয়ে হুকুমের দলের চারজন ষণ্ডামার্কা লোক এসে হাজির৷ তখনও হুজুর, আমাদের বিষয়কর্ম শুরু হয়নি, প্রাতঃকৃত্যও করিনি, কাক অবধি সকালের আবর্জনা খায়নি, সবে মোরগ ডাকতে লেগেছে, এমন সময় চার-চারটে দানো এসে গাঁয়ে সে কী তুলকালাম বাঁধাল, যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই রদ্দা, লাথি, চড় মারছে আর বলছে, বল অভয় সরকারকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস! আমরা তো হুজুর, যাকে বলে একগাল মাছি। ভয়ে আত্মারাম সব খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়। দু-চারজন পালিয়ে যেতে পারল বটে, কিন্তু এই যে রেমো, এ তিনটে লাথি খেয়েছে।”

      রেমো খাঁক করে উঠল, “আর তুমি বুঝি খাওনি! একা আমাকেই বুঝি অপমান করেছে?”

      অক্ষয় সঙ্গে-সঙ্গে বলে, “আজ্ঞে, সে-কথাও ঠিক। আমার কাঁকালেও কী যেন একটা লেগেছিল। সেটা লাথিও হতে পারে।”

      রেমো দৃঢ় স্বরে বলে, “লাথিই। কী হে নেতাই, তুমিই বলো না!”

      নেতাই বলল, “লাথির মতোই মনে হয়েছিল।” অক্ষয় সঙ্গে-সঙ্গে নেতাইয়ের দিকে চেয়ে বলে, “তুমিও বাদ যাওনি নেতাইদা। তিনখানা রদ্দা তোমাকে আমি নিজের চোখে খেতে দেখেছি।”

      নেতাই বলে, “তিনখানা নয় রে বাপু, দুখানা মারতে পেরেছিল, তিন নম্বরটা আমি পাশ কাটিয়ে দিয়েছি, ছুয়ে গেছে বলতে পারিস। তা ওই আড়াইখানাই ধর। তোর কথাও থাক, আমার কথাও থাক।”

      দারোগাবাবু রোষকষায়িত লোচনে চেয়ে বললেন, “ওসব ছেঁদো কথা ছেড়ে আসল কথাটা বলবি?”

       অক্ষয় হাতজোড় করে বলে,“আজ্ঞে, আমরা সকলেইঅল্পবিস্তর মারধর খেয়েছি। বিশের জ্যাঠামশাইয়ের মাথায় পিস্তলের বাঁট দিয়ে মেরে আলু তুলে দিয়েছে। সদানন্দের নাক ভেঙেছে। তারপর এইসব হুজ্জত করে তারা যখন গাঁ একেবারে লণ্ডভণ্ড করে ফেলছে তখন আমরা তাদের বলে দিলুম, বাপু হে, আমাদের মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা দিয়ে আর কী হবে। অভয় সরকার মনসাপোঁতার জঙ্গলে সেঁধিয়েছে। যদি ব্রহ্মদত্যির হাত থেকে বাঁচে তো বুনো কুকুরের মুখে পড়বে। তা ছাড়া নেকড়ে আছে, হাতি আছে। সেই শুনে তারা আমাদের ছেড়ে জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল।”

      দারোগাবাবু অতিশয় ব্যথিত মুখে বললেন, “হ্যাঁ রে, মনসাপোঁতার জঙ্গল ছাড়া কি আর আসামিদের যাওয়ার জায়গা নেই। ওই ভয়ের জায়গাটায় গিয়ে চোর-ডাকাতরা সেঁধোলে আমিই বা কী করি। ওদের যে কবে আক্কেল হবে সেটাই বুঝি না।”

      নেতাই গলা বাড়িয়ে বলে, “আজ্ঞে, সে-কথা আমরাও বলাবলি করি। কলির শেষ কিনা, সবই উলটো হচ্ছে। আমার মেজোমামা তো বলেন, কলির শেষে নদী উজোনে বইবে, মেয়েমানুষ সব পুরুষ হবে আর পুরুষেরা মেয়ে, পাথরে দুবো গজাবে । তা দেখছি সেরকমই সব হচ্ছে।”

      দারোগাবাবু একটু মনমরা হয়ে বললেন, “ভরসা একটাই। ব্যাটা ব্রহ্মদৈত্য যদি পাঁচটাকে ধরে চিবিয়ে খায়৷”

      "একটু নুন দিয়ে।” ফোড়ন কাটে নেতাই।

      অক্ষয় হাতজোড় করে বলে, “আজ্ঞে, তাতে কোনও ভুল নেই। তবে কিনা বেহ্মদত্যিটার আবার জিভের খুব তার। যাকেতাকে খায় না। এই তো শ্ৰীপদ, হারু মল্লিক এরাও সব তেনার খপ্পরে পড়েছিল কিনা, মাথায় মুগুর মেরে ফেলে দিয়ে চেটে দেখেছে, সব ক’টা অখাদ্য। তারপর জঙ্গলের বাইরে টেনে ফেলে দিয়ে গেছে।”

      দারোগাবাবু কৌতুহলী হয়ে বলেন, “তা হলে খায় কাকে?”

      নেতাই হাতজোড় করে বলে, “অভয় দেন তো বলি। হুজুরের মতো নাদুস-নুদুস লোক পেলে বেহ্মদত্যি ব্যাটা চেটেপুটে খাবে। ছিবড়েটুকু অবধি ফেলবে না। আর ভগবানের দয়ায় হুজুর, আপনার শরীরে ছিবড়ের আশটুকু অবধি নেই। একেবারে নধরকান্তি জিনিস, সবটুকুই একেবারে থলথল করছে। কপাকপ খেলেই হল।”

      "মুখ সামলে!" বলে একটা বাঘা হুঙ্কার দিয়ে সুদর্শনবাবু রুমালে কপালের ঘাম মুছে বললেন, “নজর দিয়ে-দিয়েই ব্যাটারা আমার বারোটা বাজাল। তাই তো পিসি আমাকে এখনও কাজলের ফোঁটা দিয়ে তবে বেরোতে দেয়। আর ওরে আহাম্মক, ব্ৰহ্মদৈত্য আমাকে খেলে তোর কিছু সুবিধে হবে?”

      “আপনি গেলে আমরা অনাথ হয়ে যাব। ও-কথা বলবেন না, শুনলেও পাপ হয়। বাড়ি গিয়ে কানে একটু গঙ্গাজল দেব। বলছিলাম কি, হুজুর, বেহ্মদত্যির নজর খুব উঁচু। যেমন-তেমন লোক মুখে রোচে না। হুজুরের মতো মান্যগণ্য উচু থাকের লোক হলে তবেই সে একটু খায়।”

      সুদৰ্শনবাবু দু’চোখে নেতাইকে ভস্ম করার চেষ্টা করতে-করতে বললেন, “ফের যদি ওরকম অলক্ষুনে কথা বলবি তো তিনশো দুই ধারায় ফাটকে পুরে রাখব।”

      নেতাই মাথা মেঝেয় ঠেকিয়ে নমো ঠুকে বলল, “আজ্ঞে, এবার থেকে ওরকম কথা বলার আগে আমার যেন জিভ খসে যায়। তিনশো দুই ধারাটা কীরকম হুজুর? আমাদের মতো চাষাভুষোর বেলায় খাটে?”

      “সে আমিও জানি না। কতরকম ধারা আছে। তবে এই চক্রপুরে আমার মুখের কথাই হচ্ছে ধারা। বুঝলি?”

      বিগলিত নেতাই বলে, “খুব বুঝেছি আজ্ঞে। আমরা হাড়ে-হাড়ে জানি যে, হুজুর শুধু ধারাই নন, তিনিই আমাদের আইন-আদালত, মা-বাপ, তিনিই ভগবান। এ আর নতুন কথা কী?”

      “কথাটা মনে রাখিস। এখন ছেদো কথা ছেড়ে কাজের কথায় আয়। পাঁচ-পাঁচটা ডাকাত মনসাপোঁতার জঙ্গলে ঢুকে বসে আছে, এ নিয়ে তদন্ত না করলে সরকারকে আমি বলব কী? তার ওপর লাখনটা খবর দিয়ে গেল, কাল সন্ধেবেলায় চারটে লোক গোয়েন্দা-পুলিশ বলে নিজেদের জাহির করে এ-তল্লাটেই কোথাও ঘাপটি মেরে আছে। তাদের ধরলে হয় মোট ন’জন। এতগুলো বদমাশকে ঠাণ্ডা করা কি যে-সে কথা! দারোগাদের জীবন সুখের নয় জানি, কিন্তু তা বলে এরকম নাকালও হতে হয় বাপ!”

      নেতাই তদ্‌গত হয়ে বলল, “আপনার কষ্ট চোখে দেখা যায় না হুজুর। শক্ত মানুষ বলেই এখনও বর্তে আছেন। তবে কিনা কুঞ্জখুড়ো এক লাখ টাকায় উঠেছে।”

      এ-কথায় সুদর্শনবাবু ঝাঁকুনি মেরে সোজা হয়ে বললেন, “বলিস কী! এ-কথা আগে বলতে হয়। এবার তো তা হলে গতর নাড়তেই হচ্ছে।”

      অক্ষয় হাতজোড় করে বলে, “হুজুর, একটা কথা আছে। কালকে যে ডাকাতটাকে ধরেছিলুম সে নিজে মুখে কবুল করেছে যে, হুকুম সিং শুখানালার সরকারদের পোড়ো বাড়িতে লুটের মালপত্র পুঁতে রেখেছে। আর সেখানেই তার ঘাঁটি।”

      “শুখানালা! ও বাবা, সে তো ভীম সরকারের তল্লাট। মাছিটাও গলতে পারে না।”

      রেমো শুকনো মুখে বলল, “হুজুর, কথাটা ধরবেন না। লোকটা ভয় খেয়ে উলটোপালটা বলেছে।”

      সুদৰ্শনবাবু কাহিল মুখে বললেন, “যাঃ, লাখ টাকা জলে গেল। ওঃ, দারোগাদের দুঃখ যদি এইসব চোর-ডাকাত একটু বুঝত!”

      নেতাই বলল, “বুঝবে হুজুর, সত্যযুগটা আসতে দিন। তখন বুঝবে। কলির শেষ কিনা, তাই হুজুরের মতো লোকদের এত কষ্ট। তা হলে হুজুর, আমরা বিদেয় হচ্ছি। শুধু যদি দয়া করে আমাদের গাঁয়ে দু-একজন সেপাইকে দু-চারদিন একটু রোঁদে পাঠান তবে ভাল হয় । কিছু করুক না করুক, পুলিশ দেখলেই আমাদের বুকে একটু বল-ভরসা আসে। এই কথাটুকুই বলতে আসা।”

      “সে হবেখন৷” বলে লোকগুলোকে বিদেয় করে সুদর্শনবাবু চোখ বুজে ষ্ট্র্যাটেজি ভাবতে লাগলেন।

      

      চারজনের হাতেই অত্যন্ত ধারাল চপার, বাঁ হাতে পিস্তল। তারা চারজনই খুব শক্তপোক্ত এবং দুর্গম জায়গায় যাওয়ার অভ্যাস আছে। জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে তারা একটু দূরে-দূরে ছড়িয়ে গেল বটে, কিন্তু যোগাযোগ হারাল না। শিস দিয়ে-দিয়ে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিল। চপার দিয়ে ঘন ঝোপঝাড় বা লতাপাতা কেটে পথ করে নিচ্ছিল তারা । ভয়ডরের লেশমাত্র তাদের হাবভাবে দেখা যাচ্ছিল না । ইন্দ্রিয় তাদের খুবই সজাগ । চোখ তীক্ষ্ণ এবং দয়ামায়ার লেশমাত্র সেখানে নেই। হাতে-পায়ে চিতাবাঘের মতো তৎপরতা।

      একটা বাঁশঝাড়ের কাছ বরাবর এসে তিনু হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। তার স্পষ্টই মনে হয়েছে কেউ তাকে আড়াল থেকে লক্ষ করছে। সে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে দেখে নিল। তারপর সঙ্গীদের সতর্ক করতে একটা টু-হিট শিস দিল। তারপরই সে শুনতে পেল, তার সঙ্গীরা নয়, অন্য কেউ ঠিক দোয়েলের মতো শিস দিল। খুবই নিখুঁত। অভ্যস্ত কান না হলে অবশ্যই পাখি বলেই ধরে নিত।

      শিসটা লক্ষ করে বাঁদিকে একটা ঘাসজঙ্গলের মধ্যে ঢুকেই আবছা সে একটা লোকের দ্রুত অপসৃয়মাণ অবয়ব দেখতে পেল । চোখের পলকে পিস্তল তুলে গুলি করল তিনু। সামনে একটা পতনের শব্দ হল। লেগেছে!

      তিনু দৌড়ে গিয়ে দেখল, এক জায়গায় ঘাসের কিছুটা শুয়ে পড়েছে! কেউ এখানেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। তবে সে পালিয়েছে। ঘাসে এবং জমিতে রক্তের দাগ খুঁজল তিনু পেল না। লোকটা যেই হোক, অভয় সরকার হতে পারে না। কারণ, অভয় সরকারকে সে দেখেছে। মোটাসোটা নাড়গোপাল-মার্কা লোক । দৌড়ঝাঁপ তার কর্ম নয়।

      রক্তের দাগ না পেলেও লোকটা কোন পথে গেছে তার হদিস পেয়ে গেল তিনু। আর এই পথেই যাওয়া উচিত কাজ হবে। সে শিস দিয়ে সঙ্গীদের ইশারা করে এগোতে লাগল।

      একটু বাদে একটা ঝোপ পেরিয়ে সে একটা ফাঁকা জায়গায় পা দিয়েই অবাক হয়ে গেল। জঙ্গলের মধ্যে এত পরিষ্কার জায়গা মানুষের কাজ ছাড়া হতে পারে না। অতএব, কাছেপিঠে মানুষ আছে।

      একে-একে পচা, ল্যাংড়া আর সত্ত্বও এসে ফাঁকা জায়গাটায় জড়ো হল।

      তিনু তার সঙ্গীদের দিকে চেয়ে বলল, “ব্রহ্মদৈত্যের কথা বলছিল না স্টেশনের ওই কুলিটা?”

      পচা বলল, “গাঁয়ের লোকগুলোও বলছিল।” তিনু গম্ভীর মুখে বলে, “মনে হচ্ছে ব্রহ্মদৈত্যকে এবার আমরা পেয়ে যাব৷”

      একটু খুঁজতেই শুড়িপথটার সন্ধান পেয়ে গেল তারা। সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে তিনু আগে এবং পেছনে তার তিন খুনে সঙ্গী দ্রুত-পায়ে এগোতে লাগল।

      দশ মিনিটের মধ্যেই তারা ধ্বংসস্তুপটার সামনে এসে দাঁড়াল। তিনু ঘড়ি দেখল। বেলা প্রায় বারোটা বাজে। সে সঙ্গীদের দিকে চেয়ে বলে, “অভয়কে এখানেই পেয়ে যাব মনে হচ্ছে। কাজ সেরে সন্ধের ডাউন গাড়ি ধরা যাবে।”

      তারা ধ্বংসস্তুপটা খুব অনায়াসেই ডিঙিয়ে গেল। উঠোনে জন্তু-জানোয়ারের খাঁচাটার দিকে একটু ভুক্ষেপ করল মাত্র তারা। তারপর সোজা গিয়ে দরদালানে উঠল।

      দরজা খোলাই ছিল। একটা কাঠের চেয়ারে একজন অত্যন্ত দীর্ঘকায়, গৌরবর্ণ প্রৌঢ় বসে একখানা বই পড়ছেন। চারজনকে দেখে বিস্মিত চোখে তাকালেন, “আপনারা!”

      তিনু তীক্ষু চোখে লোকটাকে দেখে নিয়ে বলল, “বাংলা জানেন দেখছি! নিশ্চয়ই ইউরোপিয়ান!”

      প্রৌঢ় মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, “জঙ্গলে কী করছেন আপনারা?”

       তিনু মৃদু হেসে বরে,“আপনার ভয় নেই। আমরা ব্ৰহ্মদৈত্যকে খুঁজছি না। আপনার হাইট কত? সাড়ে ছ’ফুট?”

      “ছ ফুট সাত ইঞ্চি।”

      “ব্রহ্মদৈত্য সাজবার পক্ষে চমৎকার হাইট।”

      প্রৌঢ় বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “আপনারা পরিশ্রান্ত হয়ে এসেছেন। বসুন।”

      তিনু মাথা নেড়ে বলল, “বসবার সময় নেই। আমরা পুলিশের লোক। একজন ফেরারি খুনি আসামিকে খুঁজছি। তার নাম অভয় সরকার। মনে হচ্ছে, আপনার কাছে তার খোঁজ পেয়ে যাব৷”

      প্রৌঢ় একটু দোনোমোনো করলেন, তারপর বললেন, “অতিথি নারায়ণ।”

      তিনু হেসে বলে, “তার মানে কি? অতিথি শুধু আমরাই নই, অভয় সরকারও! শুনুন, আমার অনুমান অভয় সরকার এখানে আছে।”

      প্রৌঢ় একটু চুপ করে থেকে বললেন, “ভারতবর্ষের পুলিশ সার্ভিস রিভলভার ব্যবহার করে। তাদের কাছে অত্যাধুনিক বারো শটের জামান পিস্তল থাকে না। আর ওই প্রফেশনাল চপার, ও-জিনিসও পুলিশের জিনিস নয়।”

      “বন্দুক-পিস্তল তো আপনি ভালই চেনেন দেখছি। নাড়াচাড়া করার অভ্যাস আছে নাকি?”

      “ছিল। যখন মিলিটারিতে ছিলুম।”

      তিনু হাসল, “আলাপ করে ভালই লাগল। কিন্তু গল্প করতে তো আসিনি বুঝতেই পারছেন। অভয় সরকারকে আমাদের চাই।”

      প্রৌঢ় গম্ভীর মুখে বললেন, “আপনাদের উদ্দেশ্য কী, তা জানি না। তবে অভয় সরকারকে আমি লুকিয়ে রাখিনি৷”

      তিনুও এবার গম্ভীর হল। গুরুগম্ভীর গলায় বলল, “আমাদের উদ্দেশ্য একজন অতি-বদমাশ লোককে ধরে নিয়ে সরকারের হাতে তুলে দেওয়া। যদি সেটা সম্ভব না হয় তা হলে তাকে হত্যা করারও হুকুম আছে। আমরা আমাদের কর্তব্য করতে এসেছি মাত্র।”

      “আপনারা কি সত্যিই পুলিশ?”

      “হ্যাঁ, স্পেশাল ব্র্যাঞ্চ।”

      “আইডেন্টিটি কার্ড দেখাতে পারবেন?”

      নেই। বিশেষ কারণ ছাড়া। আমরা সেগুলো সঙ্গেও আনিনি। স্টেশনে আমাদের মালপত্র রয়েছে, তার মধ্যেই আছে। জঙ্গলে আইডেন্টিটি কার্ড দেখাতে হবে বলে জানতাম না।” এই বলে তিনু ঘড়ি দেখল।

      প্রৌঢ় গম্ভীর মুখে বললেন, “অভয় সরকার এখানে নেই। অনেকক্ষণ আগেই সে চলে গেছে।”

      “কোথায় গেছে?”

      “তার যাওয়ার বিশেষ জায়গা আছে বলে জানি না। তবে আপনারা বা অন্য কেউ তার সন্ধানে আসতে পারেন বলে তার ভয় ছিল। তাই সে স্থানত্যাগ করেছে মাত্র।”

      তিনু মাথা নেড়ে বলে, “এত জলের মতো সহজ গল্প আমরা বিশ্বাস করব ভেবেছেন? অভয় সরকার স্থানত্যাগ করলে আমাদের হাত এড়াতে পারত না। আমরা এ-জায়গা খুঁজে দেখব।”

      প্রৌঢ় বইটা আবার খুলে চোখের সামনে ধরে বললেন, “স্বচ্ছন্দে। শুধু অনুরোধ, আমার সামান্য জিনিসপত্র আছে, ওগুলো বিনষ্ট করবেন না।”

      “ভাল কথা। আপনার কোনও অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে? জঙ্গলের মধ্যে কেউ একজন আমাদের ওপর নজর রাখছিল। কিন্তু সে লোক আপনি নন। সে কে?”

      প্রৌঢ় অসহায় ভঙ্গিতে হাত উলটে বললেন, “কে জানে?”

      তিনু একটু হেসে বলে, “আমি কিন্তু তাকে গুলি করেছি। গুলি খেয়েও সে পালিয়ে যায়।”

      প্রৌঢ় এ-কথায় কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন, “গুলি করেছেন। সর্বনাশ! গুলি করলেন কেন?”

      “বললাম তো সে আমাদের ওপর নজর রাখছিল।”

      প্রৌঢ় বিদ্যুদ্বেগে উঠে দাঁড়িয়ে আপনমনে বললেন, “সেইজন্যই অনেকক্ষণ কোনও সঙ্কেত দেয়নি! হায়, আপনি কি তাকে মেরে ফেলেছেন?”

      “সে মরলেও মরেছে নিজের দোষে। কিন্তু আমরা জঙ্গলে কোনও রক্তের দাগ দেখিনি।”

      “সর্বনাশ! সে তো কোনও অন্যায় করেনি! সে কেবল জঙ্গলে কাঠুরে আর চোরাশিকারীদের খবর আমাকে দেয়।”

      তিনু পরম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, “তা হবে। কিন্তু সে-কথা আমাকে সে জানাতে পারত!”

      প্রৌঢ় হাত বাড়িয়ে তিনুর ডান হাতটা চেপে ধরে বললেন, “হাতে পিস্তল থাকলেই বুঝি গুলি চালাতে ইচ্ছে হয়?”

      প্রৌঢ়ের থাবায় তিনুর কবজি। তিনু যথেষ্ট বলবান। তবু এই প্রৌঢ়ের হাতের জোর তাকে স্তম্ভিত করে দিল। হাত থেকে পিস্তলটা খটাস করে পড়ে গেল মাটিতে এবং যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল তিনু। লোহার মতো শক্ত আঙুলের চাপে তার কবজি ভেঙে যাচ্ছে।

      তবে কয়েক সেকেণ্ড মাত্র । পচা ত্বরিত গতিতে তার ভারী পিস্তলের বটটা সজোরে বসিয়ে দিল প্রৌঢ়ের মাথায়। প্রৌঢ় ঢলে পড়ে গেলেন অজ্ঞান হয়ে। পচা পিস্তলটা ঘুরিয়ে ভূপাতিত সংজ্ঞাহীন প্রৌঢ়ের দিকে তাক করে তিনুর দিকে চেয়ে বলল, “শেষ করে দেব? তা হলে আর সাক্ষী থাকবে না।”

      তিনু একটু চিন্তিতভাবে বলল, “দিবি? দে তা হলে। কিন্তু আমরা কত সাক্ষী লোপাট করব? আমাদের খুনখারাপির তো হাজার-হাজার সাক্ষী আছে। হয়েছে তো কাঁচকলা। একে মারার ইচ্ছে আমার ছিল না। তবে লোকটা সাহেব, হয়তো ঝামেলা পাকাবে।”

      পচা পিস্তলের সেফটি ক্যাপটা খুলে ট্রিগারে আঙুল দিতেই দরদালানের ওপাশে ধপ করে একটা শব্দ হল। চারজন চেয়ে দেখল, দরদালানের শেষ মাথায় একজন লোক ভীত মুখে দাঁড়িয়ে। তারা তাকাতেই লোকটা হাতজোড় করে বলল, “ওঁকে মারবেন না। উনি সাধু মানুষ। জঙ্গলের মধ্যে আমিই আপনাদের ওপর নজর রেখেছিলাম। আমি কালু।”

      নিষ্কম্প তিনটে পিস্তল কালুর বুকের দিকে একচক্ষু হয়ে চেয়ে ছিল। তিনু তার তিন সঙ্গীকে হাত তুলে নিবারণ করে কালুকে বলল, “গুড বয় কালু। তোমাকেই বোধ হয় জঙ্গলের মধ্যে আমি গুলি করেছিলাম। তোমার কপাল দেখছি খুব ভাল। ভয় পেও না, আমরা ঝামেলা করতে আসিনি। অভয় সরকার কোথায়?”

      “আজ সকালে উনি চলে গেছেন।”

      “কোথায় গেছে?”

      “শুখানালা।”

      “সেটা কোথায়?”

      “উত্তর দিকে। দু-তিন মাইল হতে পারে। পাহাড়ের নিচে।”

      “ঠিক আছে কালু, তুমিই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।

       যদি অভয় সরকারকে না পাই তাই তোমাকে জামিন রাখছি। তার আগে তোমাদের এই ডেরাটা অবশ্য আমরা সার্চ করব। সাবধানের মার নেই। আর তোমার সাধুবাবার জন্য চিন্তা কোরো না । উনি শক্ত ধাতের জিনিস। কয়েক মিনিটের মধ্যেই গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়বেন।”

      চারজন পিস্তলধারী কালুকে পথপ্রদর্শক নিয়ে তন্নতন্ন করে সারা বাড়িটা খুঁজল। তারপর আশপাশে ঝোপঝাড়ে এবং ছাদের ওপরেও।

      অনুসন্ধান করে ফিরে এসে তারা দেখল, সাধুবাবা উঠে বসেছেন। দু হাতে মাথা রেখে উবু হয়ে ফোঁটা-ফোঁটা রক্ত পড়তে দেখছেন মেঝের ওপর।

      তিনু একটু নম্র স্বরে বলল, “আপনার সঙ্গে আমাদের কোনও ঝগড়া নেই। মাফ করবেন।”

তারপর কালুকে নিয়ে তারা চারজন বেরিয়ে পড়ল।

      ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথচলা যে কী কঠিন ব্যাপার তা যার অভিজ্ঞতা নেই সে বুঝবে না। দুর্ভাগ্যের বিষয়, অভিজ্ঞতা অভয়েরও নেই। লতাপাতা, কাঁটাঝোপ এবং মাঝে-মাঝে দুর্ভেদ্য বাঁশঝাড় এমন শক্ত বেড়ার মতো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় যে, চলা বন্ধ হয়ে যায়। সাপখোপ জন্তু-জানোয়ারের ভয় তো আছেই। তবু ঘণ্টা দুই অভয় একটানা হাঁটল। না, ঠিক হাঁটা বলা যায় না। কখনও হামাগুড়ি, কখনও স্রেফ বুক ঘেঁষটে, কখনও ছোটখাটাে গাছের ডাল ধরে ঝুল খেয়ে নানা কায়দায় তাকে এগোতে হচ্ছে। কিন্তু বিস্ময়ের কথা, তার যে এত এলেম ছিল এটাই জানত না অভয়। কাল সারাদিন ওরকম দৌড়ঝাঁপ, তারপর সন্ধেবেলা হাঁটুরে মার, অনাহার সত্ত্বেও আজ এই কঠিন অভিযান, সে পারছে কী করে? স্বাভাবিক নিয়মে তার তো এখন বিছানায় পড়ে থাকার কথা!

      শুধু চলছেই না অভয়, জঙ্গলের সবুজ সৌন্দর্য, নির্জনতা এবং পাখির ডাক সে উপভোগও করছে। এত সবুজ, এত গভীর নির্জনতা যে কোথাও আছে তা তার খেয়ালই হয়নি। ঠিক বটে, নানা পাতা আর ঝোপঝাড়ে ঘষা লেগে তার গা চুলকোচ্ছে, মৌমাছির হুলও খেতে হয়েছে কয়েকবার, অল্পের জন্য একটা কাঁকড়া-বিছেকে মাড়িয়ে দেয়নি, কাঁটা লেগে হাত-পা কিছু ছড়ে গেছে, তবু বেশ ভালই লাগছে তার। বনের মধ্যে সে দু জায়গায় দুটাে চেনা ফলের গাছ পেয়ে গেল। প্রথমে পেল একটা পেয়ারা গাছ। দিব্যি কাঁচা-পাকা পেয়ারা ধরে আছে। গোটকয়েক খেয়ে গোটাকয়েক পকেটেও পুরে নিল। বেশ কিছুক্ষণ পরে পেয়ে গেল একটা পেপে গাছ। পাকা পেপের মতো জিনিস হয় না। সে একটা নরম গাছের ডাল ভেঙে আঁকশি বানিয়ে টপাটপ দুটাে পেপে পেড়ে মহানন্দে খেয়ে নিল । ব্রহ্মদৈত্যের পাঁচনের গুণ এবং হাঁটার ফলে যে ব্যায়াম হচ্ছে তাতে খিদেটা বেশ চাগাড় দিচ্ছে। ফলটল খেয়ে একটা বড় গাছের তলায় বসে জিরোতে-জিরোতে সে খানিকক্ষণ পাখির ডাক শুনে নিল । জীবনে শিস দেয়নি অভয়, চেষ্টাও করেনি। ওসব তার আসেও না। আজ হঠাৎ পাখির ডাক শুনে তার শিস দিতে ইচ্ছে হল। দেখল, বেশ ভালই শিস দিতে পারে সে । গুনগুন করে একটু গান গাইতে গিয়ে বুঝতে পারল, গলায় তার সুরের খুব একটা অভাব নেই তো ! তা হলে সে এতকাল এসবের চর্চা করেনি কেন?

      ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ গা-ঝাড়া দিয়ে খাড়া হয়ে বসল অভয়। নিজের সম্পর্কে আজ তার নতুনরকমের ধারণা হচ্ছে। অত দৌড়েও সে তেমন জব্দ হয়নি, অত মার খেয়েও সে মরেনি এবং জঙ্গলের দুর্গম রাস্তায় প্রায় টারজানের কায়দায় দিব্যি তো সে এতখানি চলে এল। তা হলে কি নিজেকে সে যতটা অপদার্থ ভাবত ততটা সত্যিই নয়? তা হলে কি অভয় সরকার নামে এই থলথলে, বিদিকিচ্ছিরি লোকটাকে একেবারে বাতিলের দলে না ধরলেও চলে? ইস, জীবনের ছাব্বিশ-সাতাশটা বছর কেবল কুঁড়েমি করে, খেয়ে আর ঘুমিয়ে, তেমন কোনও কাজ না করে সে তো বরবাদ করে দিয়েছে। বাপের কিছু টাকা আর সম্পত্তি ছিল, সেটাই ভাঙিয়ে কেবল পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে জীবনটা কাটিয়ে দিচ্ছিল । অথচ তার মধ্যে তো জিনিস ছিল!

      নিজের সম্পর্কে এই আবিষ্কার করে অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে উঠে দাঁড়াল অভয়। আত্মবিশ্বাস আসার সঙ্গে-সঙ্গে তার শরীরেও যেন দুনো বল চলে এল । গা বেশ গরম হয়ে উঠল । মনে চলে এল দুর্জয় একটা সাহসের ভাব। জঙ্গলে শোনার কেউ নেই, তবু অভয় হঠাৎ বেশ হেঁকে বলে উঠল, “আমি কাউকে ভয় খাই না।”

      অভয় এত উত্তেজিত হয়ে পড়ল যে, এক্ষুনি একটা বীরত্বের কাজ না করলে যেন তার রক্তের টগবগানিটা থামবে না। সে গিয়ে সামনে যে গাছ পেল তারই একটা ডাল মড়াত করে ভেঙে ফেলল। তারপর বই-বাই করে সেটা কিছুক্ষণ লাঠির মতো ঘোরাল। বিড়বিড় করে বলতে লাগল, “কাউকে না! কাউকে না! কাউকে ভয় খাই না! আয় না ব্যাটারা কে আসবি! আয় না!”

      কেউ অবশ্য এগিয়ে এল না, তবে দুটাে ঘুঘু পাখি গাছের ডালে বসে বিশ্রাম করছিল, বিরক্ত হয়ে উড়ে গেল।

      অভয় লাঠি হাতে এবার সদৰ্পে জঙ্গল ভেঙে এগোতে লাগল। ঠোঁট ছুঁচোলো করে মাঝে-মাঝে শিস দিচ্ছিল। মাঝে-মাঝে বেশ জোর গলায় গান গাইছিল। আবার মাঝে-মাঝে বাঘা চোখে চারদিকে চেয়ে দেখছিল কেউ তার সঙ্গে লাগতে আসছে কিনা। আর এই দেখতে-দেখতেই হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে সে একটা গর্তের মতো জায়গায় ধপাস করে পড়ে গেল। অবশ্য লাগল না। কারণ গর্ত হলেও লম্বা-লম্বা ঘাসে একেবারে নরম গদি হয়ে আছে। গর্ত থেকে উঠতে গিয়ে অভয়ের মাথায় ব্রহ্মদৈত্যের কথাটা চড়াক করে গেল। এই সেই শুখানালা নয়তো! শুকনো নালার খাত!

      কাল রাতে গাঁয়ের একটা লোক ভীম সরকারের কথা বলেছিল। আজ ব্রহ্মদৈত্যও বলছিলেন। ভীম সরকার কে এবং কেন তাঁকে এদের এত ভয়, তা অভয় জানে না। সরকার পদবি যখন, তখন হয়তো অভয়দের কোনও আত্মীয় হবেন । কিন্তু শুখানালায় তাদের কোনও আত্মীয় আছেন বলে সে শোনেনি । তার দাদুর আমলেই এখানকার বাস উঠে যায়।

      অভয় অতশত ভাবল না। বস্তুত ভেবে তার লাভও নেই। সামনে যদি বিপদ থেকে থাকে, পেছনেও বিপদ। বিপদের অভাব যখন নেই তখন বিপদের সঙ্গে ভাব করে ফেলাই ভাল।

      লাঠিটা বাগিয়ে বীরদর্পে অভয় সামনে এগোতে লাগল। একটু বাদেই বুঝল, এটা শুখানালাই বটে। কোমরসমান গভীর এবং হাতচারেক মাত্র চওড়া নালাটায় অবশ্য এখন উদ্ভিদ ভরে আছে। এগোন শক্ত। বেশ বাঁক খেয়ে-খেয়ে খাতটা কোথায় যে গেছে, তা বোঝা যাচ্ছে না। অভয় বনের শোভা দেখতে-দেখতে আনমনে এগোচ্ছে। কিছু খারাপ লাগছে না তার । হাতের লাঠিগাছ দিয়ে মাঝে-মাঝে সমুখের জঙ্গল ভাঙছে। শীতের রোদ ক্ৰমে-ক্রমে মরে আসছে। জঙ্গলের মধ্যে অন্ধকার নামতে আর দেরি নেই।

      হঠাৎ অভয় উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। এ কী! সামনে থেকে কলকল করে জলের আওয়াজ আসছে নাকি? না, কোনও ভুল নেই। শুখানালার শুকনো খাতে তীরবেগে এক জলস্রোত ছুটে আসছে যেন! প্রথমে দূরে শোনা যাচ্ছিল। দ্যাখ না-দ্যাখ শব্দটা কাছে চলে এল। প্রলয়ঙ্কর এক জলস্রোত মেল ট্রেনের মতো এসে পড়ল যে!

      অভয় আর দেরি না করে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে পাড়ে উঠে পড়ল। তারপর সম্পূর্ণ বোকা বনে চেয়ে দেখল, এক ফোঁটাও জল নেই, কিন্তু জলের স্রোতের শব্দ ভীমবেগে বয়ে যাচ্ছে। সে চোখ কচলাল, ভাল করে দেখল। না, কোথায় জল? কিন্তু শব্দটায় কোনও ভুল নেই।

      মিনিট-পাঁচেক পর শব্দটা বন্ধ হয়ে বনভূমি আবার নির্জন হয়ে গেল। ভয় পাবে কিনা তা বুঝতে পারছিল না অভয় । ভয় পাওয়াই বোধ হয় উচিত।

      তবে কিনা দুদিন ধরে সে এত ভয়ের মধ্যে আছে যে, নতুন করে আরও ভয় পাওয়া একটু কঠিন। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতের লাঠিটা কয়েকবার নীরবে আস্ফালন করে খাতের ধার ধরে-ধরে হাঁটতে লাগল।

      আচমকাই ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে ফের তাকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল। কারা ওরকম হুঙ্কারে তেড়ে আসছে ঘোড়ায় চেপে? কয়েকশো ঘোড়ার ছুটন্ত খুরের আওয়াজ আর সেইসঙ্গে মানুষের রণং দেহি চিৎকার দূর থেকে ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে তারই দিকে! হাতের লাঠিটার দিকে কাতরভাবে একবার তাকাল অভয়। একটু আগেই সে “কে আসবি আয়" বলে খুব বীরত্ব দেখিয়েছিল। এখন সেটা বেবাক ভুলে গিয়ে সামনের দিকে চেয়ে রইল বোকার মতো। কারা আসছে তা এখনও দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু এল বলে। অভয় লাঠি ফেলে সভয়ে পাশের একটা ঝুপসি গাছে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে উঠে পড়ল। জীবনে গাছে ওঠেনি সে, গাছ বাইতে জানেও না। কিন্তু প্রাণের দায়ে যতটা পারে ওপরদিকে উঠে একটা বেশ লতাপাতার আড়াল দেখে ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসল। ওদিকে সৈন্য-সামন্তরা তেড়ে আসছে। ঘোড়ার ডাক; রণহুঙ্কার এবং অস্ত্রের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সেইসঙ্গে ঘোড়ার পায়ের খটখট শব্দ।

      অভয় চোখ পলকহীন করে চেয়ে রইল নীচের দিকে। ঘোড়ার লেজটুকু বা মানুষের একটা মাথাও তার নজরে পড়ল না। অথচ বনভূমি প্রকম্পিত করে তার গাছের তলা দিয়ে এবং আশপাশ দিয়ে ওই ভয়ঙ্কর শব্দ বয়ে গেল খানিকক্ষণ ধরে। তারপর আবার সব চুপচাপ। নির্জন। শান্ত।

      অভয় টপ করে নামল না। বুদ্ধিটা কেমন ঘুলিয়ে যাচ্ছে। চোখেও কি কম দেখছে আজকাল? খানিকক্ষণ বসে দম নিয়ে সে আবার ধীরেসুস্থে গাছ থেকে নেমে তার লাঠিগাছ কুড়িয়ে নিল।

      জঙ্গলের মধ্যে এখন অন্ধকার বেশ ঘনিয়ে এসেছে। একটু বাদেই ঘুটঘুটি হয়ে যাবে। অভয় আর এগোবে কিনা ভাবতে-ভাবতে এগনোই সাব্যস্ত করল। পিছিয়ে লাভ নেই। তার খোঁজে খুনিরা এসে পড়েছে। পেছনে জানা বিপদ, সামনে অজানা বিপদ। এগনোই ভাল।

      দুপাও ভাল করে এগোয়নি অভয়, অমনই হঠাৎ তাকে আপাদমস্তক শিউরে দিয়ে সামনেই ধাঁ-ধাঁ করে একটা আগুনের শিখা মাটি থেকে উঠে খাড়া হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে গেল। এরকম সোজা আর লম্বা আগুন জীবনে দেখেনি অভয়। অন্তত বিশ হাত উঁচু হয়ে লকলক করছে। চারদিক সেই আগুনের হলকায় একেবারে রাঙা হয়ে গেল। অভয়ের অবশ্য হাত থেকে লাঠিটা খসে পড়ে গেল মাটিতে মুখটা এমন হাঁ হয়ে গেল তার যে, একটা ছোটখাটো এরোপ্লেন ঢুকে যেতে পারে।

      কিন্তু অভয় ভয় পেতে-পেতে ভয় থেকেই খানিক শিক্ষা নিয়েছে। কাজেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সে হাঁ বুজিয়ে ফেলতে পারল এবং লাঠিটাও কুড়িয়ে নিল। সামনে আগুনের শিখা তখন কোমর দুলিয়ে-দুলিয়ে নাচছে। বেশ একটা হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে সরু শিখার সবঙ্গে। অভয় চোখ চেয়ে আগুনের নাচ কিছুক্ষণ দেখল । তারপর হঠাৎ সে এক দুঃসাহসী কাণ্ড করে বসল। হাততালি দিয়ে বেশ হেঁকে বলে উঠল, “বাঃ, সুন্দর নাচ নেচেছ তো বাপু!”

      অমনই দপ করে আগুনের শিখা মিলিয়ে গেল। চারদিকে নেমে এল ঘুটঘুটি অন্ধকার। জোনাকি পোকা জ্বলতে লাগল। ঝিঁঝিঁ ডাকতে লাগল। গাছে-গাছে পাখিদের তীব্র ঝগড়া, কাজিয়া চলতে লাগল। শেয়াল ডাকল দূরে। একটা অট্টহাসির মতো শব্দও শোনা গেল। বোধ হয় সেটা হয়েনার ডাক।

      কাণ্ডগুলো যে ভুতুড়ে, তাতে অভয়ের সন্দেহ নেই। তবে ভয়ের ব্যাপারে মানুষ আর ভূত দুই-ই তার কাছে একাকার। ভূতে মারলেও মারবে, মানুষে মারলেও মারবে। সমুদ্রে শয়ান যার, শিশিরে কী ভয় তার? বরং তার মনে হল এখন ভূতটুতকে ভয় খাওয়া তার পক্ষে এক বাবুগিরি বা শৌখিনতার জিনিস। ওসব যারা সুখে আছে তাদেরই মানায়। তার মতো প্রাণ-হাতে-করা মানুষের কি ভূতের ভয় খেয়ে থেমে থাকলে চলে?

      অভয় সুতরাং খানিকটা ভয়ে এবং খানিকটা অকুতোভয়ে এগোতে লাগল। সামনে যম-অন্ধকার, জঙ্গল, আঘাটা, কিন্তু হাতে লাঠি বাগিয়ে অভয় দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়েই যেতে থাকল। আর বিড়বিড় করে বলতে লাগল, “কাউকে না, আমি কাউকে ভয় খাই না। আয় না ব্যাটা কে আসবি! আয় না।”

      হঠাৎ ফের উৎকৰ্ণ হতে হল অভয়কে। বহুদূরে কে একজন যেন বলে উঠল, “গায়৷”

      শোনার ভুলই হবে। এ জঙ্গলে কে কার গানের কথা বলবে? কিন্তু ফের কে যেন বলে উঠল, “খায়।”

      খায়! অভয় মাথা নাড়ল, এ তো হতে পারে না । কে খায়? কী খায়? খাওয়ার কথা ওঠে কেন?

      আবার আবছা সেই স্বরটা শোনা গেল, “যায়।”

      যায়? উহুঁ, এটারও তো কোনও অর্থ হচ্ছে না! এর মানে কী?

      অভয় দ্রুত হাঁটতে লাগল। পায়ের নীচে এখন ঘাস ছাড়া আর বিশেষ কোনও বাঁধা নেই। ঝোপঝাড়ও যেন কম। আর নালার পাশে বড় গাছও বিশেষ নেই যে, ধাক্কা খাবে।

      খানিকটা এগনোর পর হঠাৎ এবার গলার স্বরটা বেশ স্পষ্টই শুনতে পায় অভয় । গায়, খায় বা যায় নয়। তবে কি হায়? না, তাও নয়। বহুদূর থেকে কে যেন করুণ স্বরে ধীরে ধীরে ডাকছে, “আয়...আয়...আয়...আয়…”

      গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল অভয়ের। শরীরে একটা শীতল শিহরন বয়ে গেল। এরকম করুণ, কান্নায় ভরা, অপার্থিব কণ্ঠস্বর সে কখনও শোনেনি। তার মনে হল, এ স্বর বহুকাল ধরে আয়... আয়... আয়...”

      অভয় দাঁড়িয়ে পড়েছিল। পায়ে যেন পাথর বাঁধা, বুকটা ধকধক করছে। আর এগনো কি ঠিক হবে। তার মনে হচ্ছে সে যেন এক মহাভয়, মহাসর্বনাশ, মহাশোকের সমুদ্রের খুব কাছাকাছি এসে গেছে। ওই শোক-সমুদ্রের ঢেউই যেন অনাদিকালের বিরহ বুকে নিয়ে ক্রমান্বয়ে নিরবধি ডেকে চলেছে, “আয়. আয়... আয়...আয়...”

      অভয় হাতের লাঠিটা বড় জোরে চেপে ধরেছিল নিজের অজান্তেই। আঙুলগুলো টনটন করে ওঠায় তার খেয়াল হল। মুঠোটা একটু আলগা করল সে। শরীরটাও আড়ষ্ট, শক্ত হয়ে গিয়েছিল। শরীরও এবার সহজ হল। অভয় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বুকভরে শ্বাস নিল। তারপর লাঠিটা মাটিতে কয়েকবার ঠুকে নিয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, “কাউকে না, আমি কাউকে ভয় খাই না। আয় না ব্যাটা কে আসবি।” এই বলে সে এগোতে লাগল। বুক কাঁপছে, পা কাঁপছে। তবু অভয় থামল না।

      টেনে-টেনে দীর্ঘ করুণ স্বরে কে যেন কাকে ডেকেই চলেছে, “আয়... আয়... আয়... আয়---” বিরামহীন। বিরক্তিহীন।

      অভয় হাঁটতে লাগল। হাঁটতেই লাগল। রাত গাঢ় হল। গাছে-গাছে পাখিদের ঝগড়া থেমে গেছে অনেকক্ষণ। চারদিক বড্ড নিঝঝুম। ঝিঁঝিঁর ডাক, নিজের পায়ের শব্দ আর সামনে ওই ক্ষীণ “আয়... আয়...” ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।

      হঠাৎ বনে মর্মরধ্বনি তুলে এই শীতের কুয়াশামাখা রহস্যময় রাতে একটা দমকা বাতাস বয়ে গেল। শুকনো পাতা গড়িয়ে গেল বনময়। কোনও জঙ্গুলে ফুলের মোহময় গন্ধ ছড়াল হঠাৎ। আর তারপরেই অভয় একটা পেল্লায় হোচট খেয়ে পড়তে-পড়তে সামলে গেল।

      অন্ধকারেও সে টের পেল, তার সামনে একটা বাধা।

হাতড়ে-হাতড়ে সে বুঝতে পারল, একটা পাথর বা সিমেন্টের থাম বা ওই জাতীয় কিছু। সেটা ডিঙিয়ে অভয় যেখানে পা দিল সেটা আগাছায় ভরা বটে, কিন্তু পায়ের তলায় ইট-সুরকি, পাথরের টুকরো, লোহার বিম, কাঠের বরগা ইত্যাদির একটা বিরাট ধ্বংসস্তুপ। টিলার মতো উচু সেই ধ্বংসস্তুপের ওপর হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে লাগল অভয়। এখন সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল, মাটির গভীর থেকে কে যেন ডাকছে, “আয়... আয়... আয়... আয়...”

      অভয় ধীরে-ধীরে ধ্বংসস্তুপের ওপরে উঠে এসে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই সেই “আয়... আয়...” শব্দটা স্তব্ধ হয়ে গেল। আর তারপরেই চারদিকে যেন মৃদু একটা ঘূর্ণিঝড় উঠল। তার সঙ্গে উঠল গাছে-গাছে মর্মরধ্বনি। পাখিরা ঘুম ভেঙে ডেকে উঠল । তারপর সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল। পায়ের নীচে মাটিটা কি একটু দুলে উঠল? কে জানে! কিন্তু এটা স্পষ্ট টের পেল অভয়, ধ্বংসস্তুপে এতকাল যেন একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা ছিল। সে এসে দাঁড়ানোর পর হঠাৎ সেই চাপা দীর্ঘশ্বাসটা বহুকাল পরে মুক্তি পেয়ে আকাশে মিলিয়ে গেল।

      অন্ধকারে চারদিকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবু অভয়ের স্পষ্ট মনে হল, এই তার পূর্বপুরুষের ভিটে। শুখানালার সরকারবাড়ি। মস্ত বাড়ি ছিল একসময়ে, পাইক-বরকন্দাজ ছিল, মস্ত আস্তাবল ছিল, অনেক কিছু ছিল। সেই বাড়িতে বহুকাল পর একজন বংশধর ফিরে এসেছে। অভয় শীতে অন্ধকারে অনিশ্চিত অবস্থায় দাঁড়িয়েও আপনমনে একটু হাসল, তারপর মাটিতে লাঠিটা ঠুকে বলল, “এটা আমার বাড়ি। বুঝলে সবাই? এটা আমার বাড়ি।”

      এ-কথা শুনে একটা তক্ষক ডেকে উঠল, “ঠিক ঠিক।”