তুচ্ছ
আমি সকালে উঠে কাগজপত্র নিয়ে ঘাঁটছি, এমন সময়ে একটি তেরো-চৌদ্দ বছরের ছোট্ট মেয়ে রাঙা শাড়ি পরে আমাদের বাড়িতে ঢুকল। আমাদেরই গ্রামেরই মেয়ে নিশ্চয়, তবে একে কোথাও দেখিনি বলে চিনতে পারলাম না। মেয়েটির এই অল্প বয়সেই বিয়ে হয়েছে, ওর কপালে সিদুঁর, হাতে সোনা-বাঁধানো শাখা। শ্যামবর্ণ, একহারা চেহারার মেয়ে। মুখখানি বেশ ঢলঢল, বড় বড় চোখ। কানে সোনার দুল। জিজ্ঞেস করলুম—কার মেয়ে তুই রে?
মেয়েটি সামান্য একটু হেসে মাটির দিকে চোখ রেখে বললে—বিশ্বনাথ কামারের।
--বিশুর মেয়ে? বেশ বেশ। তোর দেখছি বিয়ে হয়েছে এই বয়েসে। কোথায় শ্বশুর বাড়ি?
মেয়েটির খুব লজ্জা হচ্ছিল শ্বশুরবাড়ির কথায়। সে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে বললে—নারানপুর।
--কোন নারানপুর? ঘিবে-নারানপুর?
--হ্যাঁ।
--কদ্দিন বিয়ে হয়েছে?
--এই ফাল্গুন মাসে।
--শ্বশুরবাড়ি থেকে এলি কবে?
--পরশু এসেছি কাকাবাবু।
--আচ্ছা যা বাড়ির মধ্যে যা।
গ্রামের মেয়ে বাপের বাড়ি এসেছে, এ-পাড়া ও-পাড়ায় সব বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে। বড় স্নেহ হলো খুকিটির উপর। এই গ্রামেরই মেয়ে, আহা!
কিন্তু খানিকক্ষণ পরে বাড়ির মধ্যে ঢুকে দেখি মেয়ের মাঝের ঘরের মেঝেতে চুপ করে বসে আচঁল নিয়ে নাড়ছে। কেউ ওর দিকে মনোযোগ দিচ্ছে না, কেউ ওর সঙ্গে কথা বলছে না। প্রথম প্রথম হয়তো কথা বলেছিল মেয়েরা, এখন আর ওর কাছাকাছি কেউ নেই, ও একাই বসে আছে। কামারদের মেয়ে তার সঙ্গে কে কথা বলে বেশিক্ষণ?
আমায় দেখে মেয়েটি বললে—কাকাবাবু ও কিসের ছবি?
--ও আমার ফটো।
--আপনার ছবি?
মেয়েটি এতক্ষণ বিস্ময় ও প্রশংসার দৃষ্টিতে ঘরের দেওয়ালের কতকগুলো ফটো, সিগারেটের বিজ্ঞাপনের মেমসাহেব, ক্যালেন্ডারের ছবিগুলোর দিকে চেয়ে দেখছিল।
পল্লীগ্রামের ঘরের দেওয়ালে অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, যামিনী রায় বা রেমব্রান্টের ছবি অবিশ্যি টাঙানো ছিল না।
--ও মেমসাহেব কি করছে কাকাবাবু?
--সিগারেট খাচ্ছে।
--ওমা, মেয়েমানুষ সিগারেট খায়?
--মেমসায়েবরা খায়। দেখেছিস কখনো মেমসাহেব?
-হুঁ।
--কোথায়?
রাণাঘাট ইস্টিশানে। আড়ংঘাটা যাচ্ছিলাম। যুগলকিশোর দেখতে। তাই দেখি রেলগাড়িতে বসে আছে। সাদা ধপ ধপ করছে একেবারে।
দেখলুম ও একা বসে থাকলেও দেওয়ালের এই অকিঞ্চিৎকর ছবিগুলো দেখে বেশ আমোদ পাচ্ছে! আরও প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে আমি আবার ঢুকলাম ঘরে কি কাজে। মেয়েটি সেখানে ঠায় বসে আছে সেভাবেই। ওকে কেউ গ্রাহ্য করছে না বাড়ির মেয়েরা। তাতে ওর কোনো দুঃখ নেই, দিব্যি একা একা বসে আছে। চলেও যায়নি।
ও যে আমাদের ঘরে ঢুকে মেঝের ওপর বসে আছে, এই আনন্দে ও ভরপুর। দিব্যি লাল রঙ দেওয়া মাঝাঘষা মেঝে, ঘরের বিছানা আসবাবপত্র দামী নয়, কিন্তু পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। দেওয়ালে যে শ্রেণীর ছবি, সে তো বলাই হলো। একখানা টেবিল, একটা চেয়ারও আছে। টাটার টেবিল ল্যাম্প আছে একটা। কতগুলো মাটির পুতুল—যেমন : গণেশ-জননী, গরু, হরিণ, টিয়া-পাখি, রাধাকৃষ্ণ প্রভৃতি—একটা কাঠের তাকে সাজানো আছে।
গৃহসজ্জার এই সামান্য রূপই ওর চোখে আশ্চর্য ঠেকেছে, খুকির চোখ দেখলে তা বোঝা যায়। আমার কষ্ট হলো ওকে কেউ আদর করে কথা বলছে না। ও সেটা আশাও করেনি। আমাদের গ্রামে তেমন ব্যবহার কামার-কুমোরদের মেয়েদের সঙ্গে কেউ করে না। ওরা ঘরে ঢুকে বসতে পেরেছে, এতেও ওরা অত্যন্ত খুশি হয়েছে।
আমি তেল মেখে নাইতে যাব। নারকেল তেল বের করে মাথায় মাখছি দেখে ও চেয়ে রইল।
আমি বললাম, গন্ধতেল একটু মাখবি খুকি?
মেয়েটি একটু অবাক হয়ে গেল। এমন কথা কেউ ওকে বলেনি, কোনো ব্রাহ্মণ-বাড়ির কর্তা তো নয়ই।
বললে—হ্যাঁ।
--সরে আয় দিকি মা।
তারপর তার দুটি অবাক দৃষ্টিকে অবাকতর করে দিয়ে আমি নিজের হাতে তার মাথায় খানিক গন্ধ তেল ঢেলে দিলাম, খোঁপা-বাঁধা চুলের উপর। ও হেসে ফেললে। অনাদৃতা আদর পেয়ে লজ্জা পেলে।
বললাম—কি রকম গন্ধ?
--চমৎকার কাকাবাবু।
--কি তেল বল দিকি?
--জানি না।
--খুব ভালো গন্ধ তেল।
ভারি খুশি হয়েছে ও।
বললে—আমি তাহলে আসি কাকাবাবু? বেলা হয়েছে—
--এসো মা! আবার এসো একদিন—
চলে গেল খুকি। কতটুকু আর তেল দিলাম ওর মাথায়। কিন্তু কি আনন্দ আমার স্নান করতে নেমে নদীর জলে। উদার নীল আকাশে কিসের যেন সুস্পষ্ট, সৌন্দর্যময় বাণী। অন্তরের ও বাইরের রেখায় রেখায় মিল। চমৎকার দিনটা। সুন্দর দিনটা।
সমাপ্ত