Aranyak by Bibhutibhushan Bandyopadhyay, chapter name তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

গ্রীষ্মকাল পড়িতে গ্র্যাণ্ট সাহেবের বটগাছের মাথায় পীরপৈঁতি পাহাড়ের দিক হইতে একদল বক উড়িয়া আসিয়া বসিল, দূর হইতে মনে হয় যেন বটগাছের মাথা সাদা থোকা থোকা ফুলে ভরিয়া গিয়াছে। একদিন অর্ধশুষ্ক কাশের বনের ধারে টেবিল-চেয়ার পাতিয়া কাজ করিতেছি, মুনেশ্বর সিং সিপাহী আসিয়া বলিল-হুজুর, নন্দলাল ওঝা গোলাওয়ালা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।

একটু পরে প্রায় পঞ্চাশ বছরের একটি বৃদ্ধ ব্যক্তি আমার সামনে আসিয়া সেলাম করিল ও আমার নির্দেশ মতো একটা টুলের উপর বসিল। বসিয়াই সে একটি পশমের থলে বাহির করিল। তাহার পর থলেটির ভিতর হইতে খুব ছোট একখানি জাঁতি ও দুইটি সুপারি বাহির করিয়া সুপারি কাটিতে আরম্ভ করিল। পরে কাটা সুপারি হাতে রাখিয়া দুই হাত একত্র করিয়া আমার সামনে মেলিয়া ধরিয়া সসম্ভ্রমে বলিল- সুপারি লিজিয়ে হুজুর।

সুপারি ও-ভাবে খাওয়া অভ্যাস না-থাকিলেও ভদ্রতার খাতিরে লইলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম- কোথা হতে আসা হচ্ছে, কি কাজ?

তাহার উত্তরে লোকটি বলিল, তাহার নাম নন্দলাল ওঝা, মৈথিল ব্রাহ্মণ। জঙ্গলের উত্তর-পূর্ব কোণে কাছারি হইতে প্রায় এগার মাইল দূরে সুংঠিয়া-দিয়ারাতে তাহার বাড়ি। বাড়িতে চাষবাস আছে, কিছু সুদের কারবারও আছে-সে আসিয়াছে তার বাড়িতে আগামী পূর্ণিমার দিন আমায় নিমন্ত্রণ করিতে-আমি কি তাহার বাড়িতে দয়া করিয়া পদধূলি দিতে রাজি আছি? এ সৌভাগ্য কি তাহার হইবে?

এগার মাইল দূরে এই রৌদ্রে নিমন্ত্রণ খাইতে যাইবার লোভ আমার ছিল না- কিন্তু নন্দলাল ওঝা নিতান্ত পীড়াপীড়ি করাতে অগত্যা রাজি হইলাম- তা ছাড়া এদেশের গৃহস্থসংসার সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিবার লোভও সংবরণ করিতে পারিলাম না।      পূর্ণিমার দিন দুপুরের পরে দীর্ঘ কাশের জঙ্গলের মধ্যে দিয়া কাহাদের একটি হাতি আসিতেছে দেখা গেল। হাতি কাছারিতে আসিলে মাহুতের মুখে শুনিলাম হাতিটি নন্দলাল ওঝার নিজের- আমাকে লইয়া যাইতে পাঠাইয়া দিয়াছে। হাতি পাঠাইবার আবশ্যক ছিল না- কারণ আমার নিজের ঘোড়ায় অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে পৌঁছিতে পারিতাম।

যাহাই হউক, হাতিতে চড়িয়াই নন্দলালের বাড়িতে রওনা হইলাম। সবুজ বনশীর্ষ আমার পায়ের তলায়, আকাশ যেন আমার মাথায় ঠেকিয়াছে- দূর, দূর-দিগন্তের নীল শৈলমালার রেখা বনভূমিতে ঘিরিয়া যেন মায়ালোক রচনা করিয়াছে- আমি সে-মায়ালোকের অধিবাসী- বহু দূর স্বর্গের দেবতা। কত মেঘের তলায় তলায় পৃথিবীর কত শ্যামল বনভূমির উপরকার নীল বায়ুমণ্ডল ভেদ করিয়া যেন আমার অদৃশ্য যাতায়াত। পথে চাম্‌টার বিল পড়িল, শীতের শেষেও সিল্লী আর লাল হাঁসের ঝাঁকে ভর্তি। আর একটু গরম পড়িলেই উড়িয়া পলাইবে। মাঝে মাঝে নিতান্ত দরিদ্র পল্লী। ফণীমনসা-ঘেরা তামাকের ক্ষেত ও খোলায় ছাওয়া দীনকুটির।

সুংঠিয়া গ্রামে হাতি ঢুকিলে দেখা গেল পথের দু-ধারে সারবন্দি লোক দাঁড়াইয়া আছে আমায় অভ্যর্থনা করিবার জন্য। গ্রামে ঢুকিয়া অল্প দূর পরেই নন্দলালের বাড়ি।

খোলায় ছাওয়া মাটির ঘর আট-দশখানা- সবই পৃথক পৃথক, প্রকাণ্ড উঠানের মধ্যে ইতস্তত ছড়ানো। আমি বাড়িতে ঢুকিতেই দুইবার হঠাৎ বন্দুকের আওয়াজ হইল। চমকাইয়া গিয়াছি- এমন সময়ে সহাস্যমুখে নন্দলাল ওঝা আসিয়া আমায় অভ্যর্থনা করিয়া বাড়িতে লইয়া গিয়া একটা বড়ঘরের দাওয়ায় চেয়ারে বসাইল। চেয়ারখানি এদেশের শিশুকাঠের তৈয়ারি এবং এদেশের গ্রাম্য মিস্ত্রির হাতেই গড়া। তাহার পর দশ-এগার বছরের একটি ছোট মেয়ে আসিয়া আমার সামনে একখানা থালা ধরিল-থালায় গোটাকতক আস্ত পান, আস্ত সুপারি, একটা মধুপর্কের মতো ছোট বাটিতে সামান্য একটু আতর, কয়েকটি শুষ্ক খেজুর; ইহা লইয়া কি করিতে হয় আমার জানা নাই- আমি আনাড়ির মতো হাসিলাম ও বাটি হইতে আঙুলের আগায় একটু আতর তুলিয়া লইলাম মাত্র। মেয়েটিকে দু-একটি ভদ্রতাসূচক মিষ্টকথাও বলিলাম! মেয়েটি থালা আমার সামনে রাখিয়া চলিয়া গেল।

তারপর খাওয়ানোর ব্যবস্থা। নন্দলাল যে ঘটা করিয়া খাওয়াইবার ব্যবস্থা করিয়াছে, তাহা আমার ধারণা ছিল না। প্রকাণ্ড কাঠের পিঁড়ির আসন পাতা-সম্মুখে এমন আকারের একখানি পিতলের থালা আসিল, যাহাতে করিয়া আমাদের দেশে দুর্গাপূজার বড় নৈবেদ্য সাজায়। থালায় হাতির কানের মতো পুরী, বাথুয়া শাক ভাজা, পাকা শশার রায়তা, কাঁচা তেঁতুলের ঝোল, মহিষের দুধের দই, পেঁড়া। খাবার জিনিসের এমন অদ্ভুত যোগাযোগ কখনো দেখি নাই। আমায় দেখিবার জন্য উঠানে লোকে লোকারণ্য হইয়া গিয়াছে ও আমার দিকে এমনভাবে চাহিতেছে যে, আমি যেন এক অদৃষ্টপূর্ব জীব। শুনিলাম, ইহারা সকলেই নন্দলালের প্রজা। সন্ধ্যার পূর্বে উঠিয়া আসিবার সময় নন্দলাল একটি ছোট থলি আমার হাতে দিয়া বলিল-হুজুরের নজর। আশ্চর্য হইয়া গেলাম। থলিতে অনেক টাকা, পঞ্চাশের কম নয়। এত টাকা কেহ কাহাকেও নজর দেয় না, তা ছাড়া নন্দলাল আমার প্রজাও নয়। নজর প্রত্যাখ্যান করাও গৃহস্থের পক্ষে নাকি অপমানজনক- সুতরাং আমি থলি খুলিয়া একটা টাকা লইয়া থলিটা তাহার হাতে ফিরাইয়া দিয়া বলিলাম- তোমার ছেলেপুলেদের পেঁড়া খাইতে দিও।

নন্দলাল কিছুতেই ছাড়িবে না- আমি সে-কথায় কান না-দিয়াই বাহিরে আসিয়া হাতির পিঠে চড়িলাম।

পরদিনই নন্দলাল ওঝা আমার কাছারিতে গেল, সঙ্গে তাহার বড় ছেলে। আমি তাহাদিগকে সমাদর করিলাম- কিন্তু খাইবার প্রস্তাবে তাহারা রাজি হইল না। শুনিলাম মৈথিল ব্রাহ্মণ অন্য ব্রাহ্মণের হস্তের প্রস্তুত কোনো খাবারই খাইবে না। অনেক বাজে কথার পরে নন্দলাল একান্তে আমার নিকট কথা পাড়িল, তাহার বড় ছেলে ফুলকিয়া বইহারের তহসিলদারির জন্য উমেদার- তাহাকে আমায় বহাল করিতে হইবে। আমি বিস্মিত হইয়া বলিলাম- কিন্তু ফুলকিয়ার তহসিলদার তো আছে – সে পোস্ট তো খালি নেই। তাহার উত্তরে নন্দলাল আমাকে চোখ ঠারিয়া ইশারা করিয়া বলিল, হুজুর, মালিক তো আপনি। আপনি মনে করলে কি না হয়?

আমি আরো অবাক হইয়া গেলাম। সে কি রকম কথা! ফুলকিয়ার তহসিলদার ভালোই কাজ করিতেছে- তাহাকে ছাড়াইয়া দিব কোন্ অপরাধে?

নন্দলাল বলিল- কত রুপেয়া হুজুরকে পান খেতে দিতে হবে বলুন, আমি আজ সাঁজেই হুজুরকে পৌঁছে দেব। কিন্তু আমার ছেলেকে তহসিলদারি দিতে হবেই হুজুরের। বলুন কত, হুজুর। পাঁচ-শ’? এতক্ষণে বেশ বুঝিতে পারিলাম, নন্দলাল যে আমাকে কাল নিমন্ত্রণ করিয়াছিল তাহার প্রকৃত উদ্দেশ্য কি। এদেশের লোক যে এমন ধড়িবাজ, তাহা জানিলে কখনো ওখানে যাই? আচ্ছা বিপদে পড়িয়াছি বটে!

নন্দলালকে স্পষ্ট কথা বলিয়াই বিদায় করিলাম। বুঝিলাম নন্দলাল আশা ছাড়িল না।

আর একদিন দেখি, ঘন বনের ধারে নন্দলাল আমার অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া আছে।

কি কুক্ষণেই উহার বাড়িতে নিমন্ত্রণ খাইতে গিয়াছিলাম-দুখানা পুরী খাওয়াইয়া সে যে আমার জীবন এমন অতিষ্ঠ করিয়া তুলিবে-তাহা আগে জানিলে কি উহার ছায়া মাড়াই?

নন্দলাল আমাকে দেখিয়া মিষ্টি মোলায়েম হাসিয়া বলিল-নোমোস্কার হুজুর।

-হুঁ। তারপর, এখানে কি মনে করে?

-হুজুর সবই জানেন। আমি আপনাকে বারো-শ’ টাকা নগদ দেব। আমার ছেলেকে কাজে লাগিয়ে দিন।

-তুমি পাগল নন্দলাল? আমি বহাল করবার মালিক নই। যাদের জমিদারি তাদের কাছে দরখাস্ত করতে পারো। তা ছাড়া বর্তমানে যে রয়েছে-তাকে ছাড়ব কোন্ অপরাধে?

বলিয়াই বেশি কথা না বাড়াইয়া ঘোড়া ছুটাইয়া দিলাম।

ক্রমে আমার কড়া ব্যবহারে নন্দলালকে আমি আমার ও স্টেটের মহা শত্রু করিয়া তুলিলাম। তখনো বুঝি নাই, নন্দলাল কিরূপ ভয়ানক প্রকৃতির মানুষ। ইহার ফল আমাকে ভালো করিয়াই ভুগিতে হইয়াছিল।

উনিশ মাইল দূরবর্তী ডাকঘর হইতে ডাক আনা এখানকার এক অতি আবশ্যক ঘটনা। অতদূরে প্রতিদিন লোক পাঠানো চলে না বলিয়া সপ্তাহে দুবার মাত্র ডাকঘরে লোক যাইত। মধ্য-এশিয়ার জনহীন, দুস্তর ও ভীষণ টাক্‌লামাকান মরুভূমির তাঁবুতে বসিয়া বিখ্যাত পর্যটক সোয়েন হেডিনও বোধ হয় এমনি আগ্রহে ডাকের প্রতীক্ষা করিতেন। আজ আট-নয় মাস এখানে আসিবার ফলে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত এই জনহীন বন-প্রান্তরে সূর্যাস্ত, নক্ষত্ররাজি, চাঁদের উদয়, জ্যোৎস্না ও বনের মধ্যে নীলগাইয়ের দৌড় দেখিতে দেখিতে যে বহির্জগতের সঙ্গে সকল যোগ হারাইয়া ফেলিয়াছি-ডাকের চিঠি কয়েকখানির মধ্য দিয়া আবার তাহার সহিত একটা সংযোগ স্থাপিত হইত।

নির্দিষ্ট দিনে জওয়াহিরলাল সিং ডাক আনিতে গিয়াছে-আজ দুপুরে সে আসিবে। আমি ও বাঙালি মুহুরীবাবুটি ঘন ঘন জঙ্গলের দিকে চাহিতেছি। কাছারি হইতে মাইল দেড় দূরে একটা উঁচু ঢিবির উপর দিয়া পথ। ওখানে আসিলে জওয়াহিরলাল সিংকে বেশ স্পষ্ট দেখা যায়।

বেলা দুপুর হইয়া গেল। জওয়াহিরলালের দেখা নেই। আমি ঘন ঘন ঘর-বাহির করিতেছি। এখানের আপিসের কাজের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। বিভিন্ন আমিনের রিপোর্ট দেখা, দৈনিক ক্যাশবই সই করা, সদরের চিঠিপত্রের উত্তর লেখা, পাটোয়ারী ও তহসিলদারের আদায়ের হিসাব-পরীক্ষা, নানাবিধ দরখাস্তের ডিগ্রি-ডিস্মিস্ করা, পূর্ণিয়া মুঙ্গের ভাগলপুর প্রভৃতি স্থানে নানা আদালতে নানাপ্রকার মামলা ঝুলিতেছে-ঐ সকল স্থানের উকিল ও মামলা-তদ্বিরকারকদের রিপোর্ট পাঠ ও তার উত্তর দেওয়া-আরো নানা প্রকার বড় ও খুচরা কাজ প্রতিদিন নিয়ম-মতো না করিলে দু-তিনদিনে এত জমিয়া যায় যে, তখন কাজ শেষ করিতে প্রাণান্ত হইয়া ওঠে। ডাক আসিবার সঙ্গে সঙ্গে আবার একরাশি কাজ আসিয়া পড়ে। শহরের নানা ধরনের চিঠি, নানা ধরনের আদেশ, অমুক জায়গায় যাও, অমুকের সঙ্গে অমুক মহালের বন্দোবস্ত কর, ইত্যাদি।

বেলা তিনটার সময় জওয়াহিরলালের সাদা পাগড়ি রৌদ্রে চক্চক্ করিতেছে দেখা গেল। বাঙালি মুহুরীবাবু হাঁকিলেন- ম্যানেজারবাবু, আসুন, ডাকপেয়াদা আসছে- ঐ যে-

আপিসের বাহিরে আসিলাম। ইতিমধ্যে জওয়াহিরলাল আবার ঢিবি হইতে নামিয়া জঙ্গলের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িয়াছে। আমি অপেরাগ্লাস আনাইয়া দেখিলাম, দূরে জঙ্গলের মধ্যে দীর্ঘ দীর্ঘ ঘাসের ও বনঝাউয়ের মধ্যে সে আসিতেছে বটে। আর আপিসের কাজে মন বসিল না। সে কি আকুল প্রতীক্ষা! যে জিনিস যত দুষ্প্রাপ্য মানুষের মনের কাছে তাহার মূল্য তত বেশি। এ কথা খুবই সত্য যে, এই মূল্য মানুষের মনগড়া একটি কৃত্রিম মূল্য, প্রার্থিত জিনিসের সত্যকার উৎকর্ষ বা অপকর্ষের সঙ্গে এর কোনো সম্বন্ধ নাই। কিন্তু জগতের অধিকাংশ জিনিসের উপরই একটা কৃত্রিম মূল্য আরোপ করিয়াই তো আমরা তাকে বড় বা ছোট করি। জওয়াহিরলালকে কাছারির সামনে একটা অপরিসর বালুময় নাবাল জমির ও-পারে দেখা গেল। আমি চেয়ার ছাড়িয়া উঠিলাম। মুহুরীবাবু আগাইয়া গেলেন। জওয়াহিরলাল আসিয়া সেলাম করিয়া দাঁড়াইল এবং পকেট হইতে চিঠির তাড়া বাহির করিয়া মুহুরীবাবুর হাতে দিল।

আমারও খান-দুই পত্র আছে-অতি পরিচিত হাতের লেখা। চিঠি পড়িতে পড়িতে চারিপাশের জঙ্গলের দিকে চাহিয়া নিজেই অবাক হইয়া গেলাম। কোথায় আছি, কখনো ভাবি নাই আমি এখানে কোনোদিন থাকিব, কলিকাতার আড্ডা ছাড়িয়া এমন জায়গায় দিনের পর দিন কাটাইব। একখানা বিলাতি ম্যাগাজিনের গ্রাহক হইয়াছি, আজ সেখানা আসিয়াছে। মোড়কের উপরে লেখা “উড়ো জাহাজের ডাকে”। জনাকীর্ণ কলিকাতা শহরের বুকে বসিয়া বিংশ শতাব্দীর এই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সুখ কি বুঝা যাইবে? এখানে-এই নির্জন বন-প্রদেশ- সকল বিষয়েই ভাবিবার ও অবাক হইবার অবকাশ আছে-এখানকার পারিপার্শ্বিক অবস্থা সে-অনুভূতি আনয়ন করে।

যদি সত্য কথা বলিতে হয়, জীবনে ভাবিয়া দেখিবার শিক্ষা এইখানে আসিয়াই পাইয়াছি। কত কথা মনে জাগে, কত পুরোনো কথা মনে হয়-নিজের মনকে এমন করিয়া কখনো উপভোগ করি নাই। এখানে সহস্র প্রকার অসুবিধার মধ্যেও সেই আনন্দ আমাকে যেন একটা নেশার মতো পাইয়া বসিতেছে দিন দিন।

অথচ সত্যই আমি প্রশান্ত মহাসমুদ্রের কোনো জনহীন দ্বীপে একা পরিত্যক্ত হই নাই। বোধ হয় বত্রিশ মাইলের মধ্যে রেলস্টেশন। সেখানে ট্রেনে চড়িয়া এক ঘণ্টার মধ্যে পূর্ণিয়া যাইতে পারি-তিন ঘণ্টার মধ্যে মুঙ্গের যাইতে পারি। কিন্তু প্রথম তো রেলস্টেশনে যাইতেই বেজায় কষ্ট-সে-কষ্ট স্বীকার করিতে পারি, যদি পূর্ণিয়া বা মুঙ্গের শহরে গিয়া কিছু লাভ থাকে। এমনি দেখিতেছি কোনো লাভই নাই, না আমাকে সেখানে কেউ চেনে, না আমি কাউকে চিনি। কি হইবে গিয়া?

কলিকাতা হইতে আসিয়া বই আর বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে গল্প ও আলোচনার অভাব এত বেশি অনুভব করি যে কতবার ভাবিয়াছি এ জীবন আমার পক্ষে অসহ্য। কলিকাতাতেই আমার সব, পূর্ণিয়া বা মুঙ্গেরে কে আছে যে সেখানে যাইব? কিন্তু সদর-আপিসের বিনা অনুমতিতে কলিকাতায় যাইতে পারি না- তা ছাড়া অর্থব্যয়ও এত বেশি যে দু-পাঁচ দিনের জন্য যাওয়া পোষায় না।

কয়েক মাস সুখে-দুঃখে কাটিবার পর চৈত্র মাসের শেষ হইতে এমন একটা কাণ্ডের সূত্রপাত হইল, যাহা আমার অভিজ্ঞতার মধ্যে কখনো ছিল না। পৌষ মাসে কিছু কিছু বৃষ্টি পড়িয়াছিল, তার পর হইতে ঘোর অনাবৃষ্টি দেখা দিল। মাঘ মাসে বৃষ্টি নাই, ফাল্গুনে না, চৈত্রে না, বৈশাখে না। সঙ্গে সঙ্গে যেমন অসহ্য গ্রীষ্ম, তেমনি নিদারুণ জলকষ্ট।

সাদা কথায় গ্রীষ্ম বা জলকষ্ট বলিলে এ বিভীষিকাময় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের স্বরূপ কিছুই বোঝানো যাইবে না। উত্তরে আজমাবাদ হইতে দক্ষিণে কিষণপুর- পূর্বে ফুলকিয়া বইহার ও লবটুলিয়া হইতে পশ্চিমে মুঙ্গের জেলার সীমানা পর্যন্ত সারা জঙ্গল-মহালের মধ্যে যেখানে যত খাল, ডোবা, কুণ্ডী অর্থাৎ বড় জলাশয় ছিল- সব গেল শুকাইয়া। কুয়া খুঁড়িলে জল পাওয়া যায় না- যদি বালির উনুই হইতে কিছু কিছু জল ওঠে, ছোট এক বালতি জল কুয়ায় জমিতে এক ঘণ্টার উপর সময় লাগে। চারিধারে হাহাকার পড়িয়া গিয়াছে। পূর্বে একমাত্র কুশী নদী ভরসা-সে আমাদের মহালের পূর্বতম প্রান্ত হইতে সাত আট মাইল দূরে বিখ্যাত মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্টের ওপারে। আমাদের জমিদারি ও মোহনপুরা অরণ্যের মধ্যে একটা ছোট পাহাড়ি নদী নেপালের তরাই অঞ্চল হইতে বহিয়া আসিতেছে-কিন্তু বর্তমানে শুধু শুষ্ক বালুময় খাতে তাহার উপলঢাকা চরণচিহ্ন বিদ্যমান। বালি খুঁড়িলে যে জলটুকু পাওয়া যায়, তাহারই লোভে কত দূরের গ্রাম হইতে মেয়েরা কলসি লইয়া আসে ও সারা দুপুর বালি-কাদা ছানিয়া আধ-কলসিটাক ঘোলা জল লইয়া বাড়ি ফেরে।

কিন্তু পাহাড়ি নদী- স্থানীয় নাম মিছি নদী- আমাদের কোনো কাজে আসে না- কারণ আমাদের মহাল হইতে বহু দূরে। কাছারিতেও কোনো বড় ইঁদারা নাই-ছোট যে বালির পাতকুয়াটি আছে, তাহা হইতে পানীয় জলের সংস্থান হওয়াই বিষম সমস্যার কথা দাঁড়াইল। তিন বালতি জল সংগ্রহ করিতে দুপুর ঘুরিয়া যায়।

দুপুরে বাহিরে দাঁড়াইয়া তাম্রাভ অগ্নিবর্ষী আকাশ ও অর্ধশুষ্ক বনঝাউ ও লম্বা ঘাসের বন দেখিতে ভয় করে- চারিধার যেন দাউ দাউ করিয়া জ্বলিতেছে, মাঝে মাঝে আগুনের হল্কার মতো তপ্ত বাতাস সর্বাঙ্গ ঝলসাইয়া বহিতেছে- সূর্যের এ রূপ, দ্বিপ্রহরের রৌদ্রের এ ভয়ানক রুদ্র রূপ কখনো দেখি নাই, কল্পনাও করি নাই। এক-এক দিন পশ্চিম দিক হইতে বালির ঝড় বয়- এ সব দেশে চৈত্র-বৈশাখ মাস পশ্চিমে বাতাসের সময়- কাছারি হইতে একশ’ গজ দূরের জিনিস ঘন বালি ও ধূলিরাশির আড়ালে ঢাকিয়া যায়।

অর্ধেক দিন রামধনিয়া টহলদার আসিয়া জানায়- কুঁয়ামে পানি নেই ছে, হুজুর। কোনো-কোনো দিন ঘণ্টাখানেক ধরিয়া ছানিয়া ছানিয়া বালির ভিতর হইতে আধ বালতি তরল কর্দম স্নানের জন্য আমার সামনে আনিয়া ধরে। সেই ভয়ানক গ্রীষ্মে তাহাই তখন অমূল্য।

একদিন দুপুরের পরে কাছারির পিছনে একটা হরীতকী গাছের তলায় স্বল্প ছায়ায় দাঁড়াইয়া আছি- হঠাৎ চারিধারে চাহিয়া মনে হইল দুপুরের এমন চেহারা কখনো দেখি তো নাই-ই, এ জায়গা হইতে চলিয়া গেলে আর কোথাও দেখিবও না। আজন্ম বাংলা দেশের দুপুর দেখিয়াছি-জ্যৈষ্ঠ মাসের খররৌদ্রভরা দুপুর দেখিয়াছি কিন্তু এ-রুদ্রমূর্তি তাহার নাই। এ ভীম-ভৈরব রূপ আমাকে মুগ্ধ করিল। সূর্যের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, একটা বিরাট অগ্নিকুণ্ড- ক্যালসিয়াম পুড়িতেছে, হাইড্রোজেন পুড়িতেছে, লোহা পুড়িতেছে, নিকেল পুড়িতেছে, কোবাল্ট পুড়িতেছে- জানা অজানা শত শত রকমের গ্যাস ও ধাতু কোটি যোজন ব্যাসমুক্ত দীপ্ত ফার্নেসে একসঙ্গে পুড়িতেছে- তারই ধূ-ধূ আগুনের ঢেউ অসীম শূন্যের ইথারের স্তর ভেদ করিয়া ফুলকিয়া বইহার ও লোধাইটোলার তৃণভূমিতে বিস্তীর্ণ অরণ্যে আসিয়া লাগিয়া প্রতি তৃণপত্রের শিরা উপশিরায় সব রসটুকু শুকাইয়া ঝামা করিয়া, দিগ্‌দিগন্ত ঝলসাইয়া পুড়াইয়া শুরু করিয়াছে ধ্বংসের এক তাণ্ডব লীলা। চাহিয়া দেখিলাম দূরে দূরে প্রান্তরের সর্বত্র কম্পমান তাপ-তরঙ্গ ও তাহার ওধারে তাপজনিত একটি অস্পষ্ট কুয়াশা। গ্রীষ্ম-দুপুরে কখনো এখানে আকাশ নীল দেখিলাম না- তাম্রাভ, কটা- শূন্য, একটি চিল-শকুনিও নাই- পাখির দল দেশ ছাড়িয়া পালাইয়াছে। কি অদ্ভুত সৌন্দর্য ফুটিয়াছে এই দুপুরের! খর উত্তাপকে অগ্রাহ্য করিয়া সেই হরীতকীতলায় দাঁড়াইয়া রহিলাম কতক্ষণ। সাহারা দেখি নাই, সোয়েন হেডিনের বিখ্যাত টাক্‌লামাকান্ মরুভূমি দেখি নাই, গোবি দেখি নাই- কিন্তু এখানে মধ্যাহ্নের এই রুদ্রভৈরব রূপের মধ্যে সে-সব স্থানের অস্পষ্ট আভাস ফুটিয়া উঠিল।

কাছারি হইতে তিন মাইল দূরে একটি বনে-ঘেরা ক্ষুদ্র কুণ্ডীতে সামান্য একটু জল ছিল, কুণ্ডীটাতে গত বর্ষার জলে খুব মাছ হইয়াছিল বলিয়া শুনিয়াছিলাম- খুব গভীর বলিয়া এই অনাবৃষ্টিতেও তাহার জল একেবারে শুকাইয়া যায় নাই। কিন্তু সে জলে কাহারো কোনো কাজ হয় না- প্রথমত, তার কাছাকাছি অনেক দূর লইয়া কোনো মানুষের বসতি নাই- দ্বিতীয়ত, জল ও তীরভূমির মধ্যে কাদা এত গভীর যে, কোমর পর্যন্ত বসিয়া যায়- কলসিতে জল পুরিয়া পুনরায় তীরে উত্তীর্ণ হবার আশা বড়ই কম। আর একটি কারণ এই যে, জলটা খুব ভালো নয়- স্নান বা পানের আদৌ উপযুক্ত নয়, জলের সঙ্গে কি জিনিস মিশানো আছে জানি না- কিন্তু কেমন একটা অপ্রীতিকর ধাতব গন্ধ।

একদিন সন্ধ্যায় পশ্চিমে বাতাস ও উত্তাপ কম পড়িয়া গেলে ঘোড়ায় বাহির হইয়া ঐ কুণ্ডীটার পাশের উঁচু বালিয়াড়ি ও বনঝাউয়ের জঙ্গলের পথে উপস্থিত হইয়াছি। পিছনে গ্র্যাণ্ট সাহেবের সেই বড় বটগাছের আড়ালে সূর্য অস্ত যাইতেছিল। কাছারির খানিকটা জল বাঁচাইবার জন্য ভাবিলাম, এখানে ঘোড়াটাকে একবার জল খাওয়াইয়া লই। যত কাদা হোক, ঘোড়া ঠিক উঠিতে পারিবে। জঙ্গল পার হইয়া কুণ্ডীর ধারে গিয়া এক অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়িল। কুণ্ডীর চারিধারে কাদার উপর আট-দশটা ছোট-বড় সাপ, অন্য দিকে তিনটি প্রকাণ্ড মহিষ একসঙ্গে জল খাইতেছে। সাপগুলি প্রত্যেকটি বিষাক্ত, করাত ও শঙ্খচিতি শ্রেণীর, যাহা এদেশে সাধারণত দেখা যায়।

মহিষ দেখিয়া মনে হইল এ ধরনের মহিষ আর কখনো দেখি নাই। প্রকাণ্ড একজোড়া শিং, গায়ে লম্বা লোম-বিপুল শরীর। কাছেও কোনো লোকালয় বা মহিষের বাথান নাই-তবে এ মহিষ কোথা হইতে আসিল বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। ভাবিলাম, চরির খাজনা ফাঁকি দিবার উদ্দেশ্যে কেহ লুকাইয়া হয়তো জঙ্গলের মধ্যে কোথাও বা বাথান করিয়া থাকিবে। কাছারির কাছাকাছি আসিয়াছি মুনেশ্বর সিং চাকলাদারের সহিত দেখা। তাহাকে কথাটা বলিতেই সে চমকিয়া উঠিল-আরে সর্বনাশ! বলেন কি হুজুর! হনুমানজী খুব বাঁচিয়ে দিয়েছেন আজ! ও পোষা ভঁইস নয়, ও হোলো আড়ন্, বুনো ভঁইস হুজুর, মোহনপুরা জঙ্গল থেকে এসেছে জল খেতে। ও অঞ্চলে কোথাও জল নেই তো। জলকষ্টে পড়ে এসেছে।

 

কাছারিতে তখনই কথাটা রাষ্ট্র হইয়া গেল। সকলেই একবাক্যে বলিল- উঃ, হুজুর খুব বেঁচে গিয়েছেন। বাঘের হাতে পড়লে বরং রক্ষা পাওয়া যেতে পারে, বুনো মহিষের হাতে পড়লে নিস্তার নেই। আর এই সন্ধ্যাবেলা নির্জন জায়গায় যদি একবার আপনাকে ওরা তাড়া করত, ঘোড়া ছুটিয়ে বাঁচতে পারতেন না হুজুর।

তার পর হইতে জঙ্গলে-ঘেরা ওই ছোট কুণ্ডীটা বন্য জানোয়ারের জলপানের একটা প্রধান আড্ডা হইয়া দাঁড়াইল। অনাবৃষ্টি যত হইতে লাগিল, রৌদ্রের ক্রমবর্ধমান প্রখরতায় দিক্দিগন্তে দাবদাহ যত প্রচণ্ড হইয়া উঠিতে লাগিল- খবর আসিতে লাগিল-সেই জঙ্গলের মধ্যে কুণ্ডীতে লোকে বাঘকে জল খাইতে দেখিয়াছে, বন-মহিষকে জল খাইতে দেখিয়াছে, হরিণের পালকে জল খাইতে দেখিয়াছে, নীলগাই ও বুনো শুয়োর তো আছেই- কারণ শেষের দুই প্রকার জানোয়ার এ জঙ্গলে অত্যন্ত বেশি। আমি নিজে আর একদিন জ্যোৎস্নারাত্রে ঘোড়ায় করিয়া কুণ্ডীতে যাই শিকারের উদ্দেশ্যে-সঙ্গে তিন-চার জন সিপাহী ছিল- দু-তিনটি বন্দুকও ছিল। সে যা দৃশ্য দেখিয়াছিলাম সে রাত্রে, জীবনে ভুলিবার নয়। তাহা বুঝিতে হইলে কল্পনায় ছবি আঁকিয়া লইতে হইবে এক জনহীন জ্যোৎস্নাময়ী রাত্রি ও বিস্তীর্ণ বনপ্রান্তরের! আরো কল্পনা করিয়া লইতে হইবে সারা বনভূমি ব্যাপিয়া এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতার, অভিজ্ঞতা না থাকিলে যদিও সে নিস্তব্ধতা কল্পনা করা প্রায় অসম্ভব।

উষ্ণ বাতাস অর্ধশুষ্ক কাশ-ডাঁটার গন্ধে নিবিড় হইয়া উঠিয়াছে, লোকালয় হইতে বহু দূরে আসিয়াছি, দিগ্বিদিকের জ্ঞান হারাইয়া ফেলিয়াছি।

কুণ্ডীতে প্রায় নিঃশব্দে জল খাইতেছে এক দিকে দুটি নীলগাই, অন্য দিকে দুটি হায়েনা; নীলগাই দুটি একবার হায়েনাদের দিকে চাহিতেছে, হায়েনারা একবার নীলগাই দুটির দিকে চাহিতেছে- আর দু’দলের মাঝখানে দু-তিন মাস বয়সের এক ছোট নীলগাইয়ের বাচ্চা। অমন করুণ দৃশ্য কখনো দেখি নাই-দেখিয়া পিপাসার্ত বন্য জন্তুদের নিরীহ শরীরে অতর্কিতে গুলি মারিবার প্রবৃত্তি হইল না। এদিকে বৈশাখও কাটিয়া গেল। কোথাও একফোঁটা জল নাই। এক বিপদ দেখা দিল। এই সুবিস্তীর্ণ বনপ্রান্তরের মাঝে মাঝে লোকে দিক হারাইয়া আগেও পথ ভুলিয়া যাইত- এখন এইসব পথহারা পথিকদের জলাভাবে প্রাণ হারাইবার সমূহ আশঙ্কা দাঁড়াইল, কারণ ফুলকিয়া বইহার হইতে গ্র্যাণ্ট সাহেবের বটগাছ পর্যন্ত বিশাল তৃণভূমির মধ্যে কোথাও একবিন্দু জল নাই। এক-আধটা শুষ্কপ্রায় কুণ্ড যেখানে আছে, অনভিজ্ঞ দিগ্‌ভ্রান্ত পথিকদের পক্ষে সে সব খুঁজিয়া পাওয়া সহজ নয়। একদিনের ঘটনা বলি।

সেদিন বেলা চারটার সময় অত্যন্ত গরমে কাজে মন বসাইতে না পারিয়া একখানা কি বই পড়িতেছি, এমন সময় রামবিরিজ সিং আসিয়া এত্তেলা করিল, কাছারির পশ্চিমদিকে উঁচু ডাঙার উপরে একজন কে অদ্ভুত ধরনের পাগলা লোক দেখা যাইতেছে-সে হাত-পা নাড়িয়া দূর হইতে কি যেন বলিতেছে। বাহিরে গিয়া দেখিলাম সত্যই দূরের ডাঙাটার উপরে কে একজন দাঁড়াইয়া- মনে হইল মাতালের মতো টলিতে টলিতে এদিকেই আসিতেছে। কাছারি সুদ্ধ লোক জড়ো হইয়া সেদিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া আছে দেখিয়া আমি দুজন সিপাহী পাঠাইয়া দিলাম লোকটাকে এখানে আনিতে।

 

লোকটাকে যখন আনা হইল, দেখিলাম তাহার গায়ে কোনো জামা নাই- পরনে মাত্র একখানা ফর্সা ধুতি, চেহারা ভালো, রং গৌরবর্ণ। কিন্তু তাহার মুখের আকৃতি অতি ভীষণ, গালের দুই কশ বাহিয়া ফেনা বাহির হইতেছে, চোখদুটি জবাফুলের মতো লাল, চোখে উন্মাদের মতো দৃষ্টি। আমার ঘরের দাওয়ায় একটা বালতিতে জল ছিল- তাই দেখিয়া সে পাগলের মতো ছুটিয়া বালতির দিকে গেল। মুনেশ্বর সিং চাকলাদার ব্যাপারটা বুঝিয়া তাড়াতাড়ি বালতি সরাইয়া লইল। তাহার পর তাহাকে বসাইয়া হাঁ করাইয়া দেখা গেল জিভ ফুলিয়া বীভৎস ব্যাপার হইয়াছে। অতি কষ্টে জিভটা মুখের এক পাশে সরাইয়া একটু একটু করিয়া তার মুখে জল দিতে দিতে আধ ঘণ্টা পরে লোকটা কথঞ্চিৎ সুস্থ হইল। কাছারিতে লেবু ছিল, লেবুর রস ও গরম জল এক গ্লাস তাহাকে খাইতে দিলাম। ক্রমে ঘণ্টাখানেক পরে সে সম্পূর্ণ সুস্থ হইয়া উঠিল। শুনিলাম তাঁর বাড়ি পাটনা। গালার চাষ করিবার উদ্দেশ্যে সে এ অঞ্চলে কুলের জঙ্গলের অনুসন্ধান করিতে পূর্ণিয়া হইতে রওনা হইয়াছে আজ দুই দিন পূর্বে। তারপর দুপুরের সময় আমাদের মহালে ঢুকিয়াছে, এবং একটু পরে দিগ্‌ভ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছে, কারণ এ রকম একঘেয়ে একই ধরনের গাছে-ভরা জঙ্গলে দিক্ ভুল করা খুব সোজা, বিশেষত বিদেশী লোকের পক্ষে। কালকার ভীষণ উত্তাপে ও গরম পশ্চিমে বাতাসের দমকার মধ্যে সারা বৈকাল ঘুরিয়াছে-কোথাও একফোঁটা জল পায় নাই, একটা মানুষের সঙ্গে দেখা হয় নাই- রাত্রে অবসন্ন অবস্থায় এক গাছের তলায় শুইয়া ছিল- আজ সকাল হইতে আবার ঘোরা শুরু করিয়াছে- মাথা ঠাণ্ডা রাখিলে সূর্য দেখিয়া দিক্ নির্ণয় করা হয়তো তার পক্ষে খুব কঠিন হইত না- অন্তত পূর্ণিয়াও ফিরিয়া যাইতে পারিত- কিন্তু ভয়ে দিশাহারা হইয়া একবার এদিক একবার ওদিক ছুটাছুটি করিয়াছে আজ সারা দুপুর, তাহার উপর খুব চিৎকার করিয়া লোক ডাকিবার চেষ্টা করিয়াছে-কোথায় লোক? ফুলকিয়া বইহারের কুলের জঙ্গল যেদিকে, সেদিক হইতে লবটুলিয়া পর্যন্ত দশ-বারো বর্গমাইলব্যাপী বনপ্রান্তর সম্পূর্ণ জনমানবশূন্য, সুতরাং আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, তাহার চিৎকার কেহ শোনে নাই। আরো তাহার আতঙ্ক হইবার কারণ, সে ভাবিয়াছিল, তাহাকে জঙ্গলের মধ্যে জিনপরীতে পাইয়াছে-মারিয়া না ফেলিয়া ছাড়িবে না। তাহার গায়ে একটা জামা ছিল, কিন্তু আজ অসহ্য পিপাসায় দুপুরের পরে এমন গা-জ্বলুনি শুরু হইয়াছিল যে, জামাটা খুলিয়া কোথায় ফেলিয়া দিয়াছে। এ অবস্থায় দৈবক্রমে আমাদের কাছারির হনুমানের ধ্বজার লাল নিশানটা দূর হইতে তাহার চোখে না পড়িলে লোকটা আজ বেঘোরে মারা পড়িত।

একদিন এই ঘোর উত্তাপ ও জলকষ্টের দিনে ঠিক দুপুরবেলা সংবাদ পাইলাম, নৈর্ঋত কোণে মাইলখানেক দূরে জঙ্গলে ভয়ানক আগুন লাগিয়াছে এবং আগুন কাছারির দিকে অগ্রসর হইয়া আসিতেছে। সবাই মিলিয়া তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া দেখিলাম প্রচুর ধূমের সঙ্গে রাঙা অগ্নিশিখা লক্‌লক্ করিয়া বহুদূর আকাশে উঠিতেছে! সেদিন আবার দারুণ পশ্চিমে বাতাস, লম্বা লম্বা ঘাস ও বনঝাউয়ের জঙ্গল সূর্যতাপে অর্ধশুষ্ক হইয়া বারুদের মতো হইয়া আছে, এক-এক স্ফুলিঙ্গ পড়িবামাত্র গোটা ঝাড় জলিয়া উঠিতেছে- সেদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় ঘন নীলবর্ণ ধূমরাশি ও অগ্নিশিখা- আর চটচট শব্দ। ঝড়ের মুখে পশ্চিম হইতে পূর্ব দিকে বাঁকা আগুনের শিখা ঠিক যেন ডাকগাড়ির বেগে ছুটিয়া আসিতেছে আমাদের কয়খানা খড়ের বাংলোর দিকেই। সকলেরই মুখ শুকাইয়া গেল, এখানে থাকিলে আপাতত তো বেড়া-আগুনে ঝলসাইয়া মরিতে হয়- দাবানল তো আসিয়া পড়িল!

 

ভাবিবার সময় নাই। কাছারির দরকারি কাগজপত্র, তহবিলের টাকা, সরকারি দলিল, ম্যাপ, সর্বস্ব মজুত- এ বাদে আমাদের নিজেদের ব্যক্তিগত জিনিস যার যার তো আছেই। এ সব তো যায়! সিপাহীরা শুষ্কমুখে ভীতকণ্ঠে বলিল- আগ তো আ গৈল, হুজুর! বলিলাম – সব জিনিস বার কর। সরকারি তহবিল ও কাগজপত্র আগে।

জনকতক লোক লাগিয়া গেল আগুন ও কাছারির মধ্যে যে জঙ্গল পড়ে তাহারই যতটা পারা যায় কাটিয়া পরিষ্কার করিতে। জঙ্গলের মধ্যে বাথান হইতে আগুন দেখিয়া বাথানওয়ালা চরির প্রজা দু-দশ জন ছুটিয়া আসিল কাছারি রক্ষা করিতে, কারণ পশ্চিমা-বাতাসের বেগ দেখিয়া তাহারা বুঝিতে পারিয়াছে কাছারি ঘোর বিপন্ন।

কি অদ্ভুত দৃশ্য! জঙ্গল ভাঙ্গিয়া ছিঁড়িয়া ছুটিয়া পশ্চিম হইতে পূর্বদিকে নীলগাইয়ের দল প্রাণভয়ে দৌড়িতেছে, শিয়াল দৌড়িতেছে, কান উঁচু করিয়া খরগোশ দৌড়িতেছে, একদল বন্যশূকর তো ছানাপোনা লইয়া কাছারির উঠান দিয়াই দিগ্বিদিক্ জ্ঞানশূন্য অবস্থায় ছুটিয়া গেল- ও অঞ্চলের বাথান হইতে পোষা মহিষের দল ছাড়া পাইয়া প্রাণপণে ছুটিতেছে, একঝাঁক বনটিয়া মাথার উপর দিয়া সোঁ করিয়া উড়িয়া পলাইল, পিছনে পিছনে একটা বড় ঝাঁক লাল হাঁস। আবার এক ঝাঁক বনটিয়া, গোটাকতক সিল্লি। রামবিরিজ সিং চাকলাদার অবাক হইয়া বলিল- পানি কাঁহা নেই ছে…. আরে এ লাল হাঁসকা জেরা কাঁহাসে আয়া, ভাই রামলগন? গোষ্ঠ মুহুরী বিরক্ত হইয়া বলিল-আঃ বাপু রাখ্। এখন প্রাণ নিয়ে টানাটানি, লাল হাঁস কোথা থেকে এল তার কৈফিয়তে কি দরকার?

 

আগুন বিশ মিনিটের মধ্যে আসিয়া পড়িল। তার পরে দশ-পনের জন লোক মিলিয়া প্রায় ঘণ্টাখানেক আগুনের সঙ্গে সে কি যুদ্ধ! জল কোথাও নাই-আধকাঁচা গাছের ডাল ও বালি এইমাত্র অস্ত্র। সকলের মুখচোখ আগুনের ও রৌদ্রের তাপে দৈত্যের মতো বিভীষণ হইয়া উঠিয়াছে, সর্বাঙ্গে ছাই ও কালি, হাতের শিরা ফুলিয়া উঠিয়াছে, অনেকেরই গায়ে হাতে ফোস্কা- এদিকে কাছারির সব জিনিসপত্র, বাক্স, খাট, দেরাজ, আলমারি তখনো টানাটানি করিয়া বাহির করিয়া বিশৃঙ্খলভাবে উঠানে ফেলা হইতেছে। কোথাকার জিনিস যে কোথায় গেল, কে তার ঠিকানা রাখে! মুহুরীবাবুকে বলিলাম-ক্যাশ আপনার জিম্মায় রাখুন, আর দলিলের বাক্সটা।

কাছারির উঠান ও পরিষ্কৃত স্থানে বাধা পাইয়া আগুনের স্রোত উত্তর ও দক্ষিণ বাহিয়া নিমেষের মধ্যে পূর্বমুখে ছুটিল-কাছারিটা কোনোক্রমে রক্ষা পাইয়া গেল এযাত্রা। জিনিসপত্র আবার ঘরে তোলা হইল, কিন্তু বহু দূরে পূর্বাকাশ লাল করিয়া লোলজিহ্বা প্রলয়ঙ্করী অগ্নিশিখা সারা রাত্রি ধরিয়া জ্বলিতে জ্বলিতে সকালের দিকে মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্টের সীমানায় গিয়া পৌঁছিল।

দু-তিন দিন পরে খবর পাওয়া গেল কারো ও কুশী নদীর তীরবর্তী কর্দমে আট-দশটা বন্য মহিষ, দুটি চিতা বাঘ, কয়েকটা নীলগাই হাবড়ে পড়িয়া পুঁতিয়া রহিয়াছে। ইহারা আগুন দেখিয়া মোহনপুরা জঙ্গল হইতে প্রাণভয়ে নদীর ধার দিয়া ছুটিতে ছুটিতে হাবড়ে পড়িয়া গিয়াছে-যদিও রিজার্ভ ফরেস্ট হইতে কুশী ও কারো নদী প্রায় আট-ন’ মাইল দূরে।