Aranyak by Bibhutibhushan Bandyopadhyay, chapter name সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

 

সন্ধ্যার পরে লবটুলিয়ার নূতন বস্তিগুলি দেখিতে বেশ লাগে। কুয়াশা হইয়াছে বলিয়া জ্যোৎস্না একটু অস্পষ্ট, বিস্তীর্ণ প্রান্তরব্যাপী কৃষিক্ষেত্র, দূরে দূরে দু-পাঁচটা আলো জ্বলিতেছে বিভিন্ন বস্তিতে। কত লোক, কত পরিবার অন্নের সংস্থান করিতে আসিয়াছে আমাদের মহালে-বন কাটিয়া গ্রাম বসাইয়াছে, চাষ আরম্ভ করিয়াছে। আমি সব বস্তির নামও জানি না, সকলকে চিনিও না। কুয়াশাবৃত জ্যোৎস্নালোকে এখানে ওখানে দূরে নিকটে ছড়ানো বস্তিগুলি কেমন রহস্যময় দেখাইতেছে। যে-সব লোক এইসব বস্তিতে বাস করে, তাহাদের জীবনও আমার কাছে এই কুয়াশাচ্ছন্ন জ্যোৎস্নাময়ী রাত্রির মতো রহস্যাবৃত। ইহাদের কাহারো কাহারো সঙ্গে আলাপ করিয়া দেখিয়াছি- জীবন সম্বন্ধে ইহাদের দৃষ্টিভঙ্গি, ইহাদের জীবনযাত্রাপ্রণালী আমার বড় অদ্ভুত লাগে।

প্রথম ধরা যাক ইহাদের খাদ্যের কথা। আমাদের মহালের জমিতে বছরে তিনটি খাদ্যশস্য জন্মায়- ভাদ্র মাসে মকাই, পৌষ মাসে কলাই এবং বৈশাখ মাসে গম। মকাই খুব বেশি হয় না, কারণ ইহার উপযুক্ত জমি বেশি নাই। কলাই ও গম যথেষ্ট উৎপন্ন হয়, কলাই বেশি, গম তাহার অর্ধেক। সুতরাং লোকের প্রধান খাদ্য কলাইয়ের ছাতু।

ধান একেবারেই হয় না-ধানের উপযুক্ত নাবাল-জমি নাই। এ অঞ্চলের কোথাও- এমন কি কড়ারী জমিতে কিংবা গবর্নমেণ্ট খাসমহালেও ধান হয় না। ভাত জিনিসটা সুতরাং এখানকার লোকে কালেভদ্রে খাইতে পায়-ভাত খাওয়াটা শখের বা বিলাসিতার ব্যাপার বলিয়া গণ্য। দু-চার জন খাদ্যবিলাসী লোক গম বা কলাই বিক্রয় করিয়া ধান কিনিয়া আনে বটে, কিন্তু তাহাদের সংখ্যা আঙ্গুলে গোনা যায়।

তারপর ধরা যাক ইহাদের বাসগৃহের কথা। এই যে আমাদের মহালের দশ হাজার বিঘা জমিতে অগণ্য গ্রাম বসিয়াছে- সব গৃহস্থের বাড়িই জঙ্গলের কাশ ছাওয়া, কাশডাঁটার বেড়া, কেহ কেহ তাহার উপর মাটি লেপিয়াছে, কেহ কেহ তাহা করে নাই। এদেশে বাঁশগাছ আদৌ নাই, সুতরাং বনের গাছের, বিশেষ করিয়া কেঁদ ও পিয়াল ডালের বাতা, খুঁটি ও আড়া দিয়াছে ঘরে।

ধর্মের কথা বলিয়া কোনো লাভ নাই। ইহারা যদিও হিন্দু, কিন্তু তেত্রিশ কোটি দেবতার মধ্যে ইহারা হনুমানজীকে কি করিয়া বাছিয়া বাহির করিয়া লইয়াছে জানি না-প্রত্যেক বস্তিতে একটা উঁচু হনুমানজীর ধ্বজা থাকিবেই-এই ধ্বজার রীতিমতো পূজা হয়, ধ্বজার গায়ে সিঁদুর লেপা হয়। রাম-সীতার কথা ক্বচিৎ শোনা যায়, তাঁহাদের সেবকের গৌরব তাঁহাদের দেবত্বকে একটু বেশি আড়ালে ফেলিয়াছে। বিষ্ণু, শিব, দুর্গা, কালী প্রভৃতি দেবদেবীর পূজার প্রচার তত নাই-আদৌ আছে কি না সন্দেহ, অন্তত আমাদের মহালে তো আমি দেখি নাই।

ভুলিয়া গিয়াছি, একজন শিবভক্ত দেখিয়াছি বটে। তার নাম দ্রোণ মাহাতো, জাতিতে গাঙ্গোতা। কাছারিতে কোথা হইতে কে একটা শিলাখণ্ড আনিয়া আজ নাকি দশ-বারো বছর কাছারির হনুমানজীর ধ্বজার নিচে রাখিয়া দিয়াছে-সিপাহীরা মাঝে মাঝে পাথরখানাতে সিঁদুর মাখায়, একঘটি জলও কেউ কেউ দেয়। কিন্তু পাথরখানা বেশির ভাগ অনাদৃত অবস্থাতেই পড়িয়া থাকে।

কাছারির কিছুদূরে একটা নূতন বস্তি আজ মাস-দুই গড়িয়া উঠিয়াছে-দ্রোণ মাহাতো সেখানে আসিয়া ঘর বাঁধিয়াছে। দ্রোণের বয়স সত্তরের বেশি ছাড়া কম নয়- প্রাচীন লোক বলিয়াই তাহার নাম দ্রোণ, আধুনিক কালের ছেলেছোকরা হইলে নাকি নাম হইত ডোমন, লোধাই, মহারাজ ইত্যাদি। এসব বাবুগিরি নাম সেকালে বাপ-মায়ে রাখিতে লজ্জাবোধ করিত।

যাহা হউক, বৃদ্ধ দ্রোণ একবার কাছারি আসিয়া হনুমান-ধ্বজার নিচে পাথরখানা লক্ষ্য করিল। তারপর হইতে বৃদ্ধ কল্বলিয়া নদীতে প্রাতঃস্নান করিয়া একঘটি জল প্রত্যহ আনিয়া নিয়মিতভাবে পাথরের উপরে ঢালিত ও সাতবার পরম ভক্তিভরে প্রদক্ষিণ করিয়া সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিয়া তবে বাড়ি ফিরিত।

দ্রোণকে বলিয়াছিলাম-কল্বলিয়া তো এক ক্রোশ দূর, রোজ যাও সেখানে, তার চেয়ে ছোট কুণ্ডীর জল আনলেই পার-

দ্রোণ বলিল-মহাদেওজী স্রোতের জলে তুষ্ট থাকেন, বাবুজী। আমার জন্ম সার্থক যে ওঁকে রোজ জল দিয়ে স্নান করাতে পাই।

ভক্তও ভগবানকে গড়ে। দ্রোণ মাহাতোর শিবপূজার কাহিনী লোকমুখে বিভিন্ন বস্তিতে ছড়াইয়া পড়িতেই মাঝে মাঝে দেখি দু-পাঁচজন শিবের পূজারী নরনারী যাতায়াত শুরু করিল। এ অঞ্চলে এক ধরনের সুগন্ধ ঘাস জঙ্গলে উৎপন্ন হয়, ঘাসের পাতা বা ডাঁটা হাতে লইয়া আঘ্রাণ লইলে চমৎকার সুবাস পাওয়া যায়। ঘাস যত শুকায়, গন্ধ তত তীব্র হয়। কে একজন সেই ঘাস আনিয়া শিবঠাকুরের চারিধারে রোপণ করিল। একদিন মটুকনাথ পণ্ডিত আসিয়া বলিল- বাবুজী, – একজন গাঙ্গোতা কাছারির শিবের মাথায় জল ঢালে, এটা কি ভালো হচ্ছে?

বলিলাম- পণ্ডিতজী, সেই গাঙ্গোতাই ওই ঠাকুরটিকে লোকসমাজে প্রচার করেছে যতদূর দেখতে পাচ্ছি! কই তুমিও তো ছিলে, একঘটি জল তো কোনোদিন দিতে দেখি নি তোমায়।

রাগের মাথায় খেই হারাইয়া মটুকনাথ বলিয়া বসিল- ও শিবই নয় বাবুজী। ঠাকুর প্রতিষ্ঠা না করলে পুজো পাওয়ার যোগ্য হয় না। ও তো একখানা পাথরের নুড়ি।

-তবে আর বলছ কেন? পাথরের নুড়িতে জল দিলে তোমার আপত্তি কি?

সেই হইতেই দ্রোণ মাহাতো কাছারির শিবলিঙ্গের চার্টার্ড পূজারী হইয়া গেল।

কার্তিক মাসে ছট্-পরব এদেশের বড় উৎসব। বিভিন্ন টোলা হইতে মেয়েরা হলুদ-ছোপানো শাড়ি পরিয়া দলে দলে গান করিতে করিতে কল্বলিয়া নদীতে ছট্ ভাসাইতে চলিয়াছে। সারাদিন উৎসবের ধুম। সন্ধ্যায় বস্তিগুলির কাছ দিয়া যাইতে যাইতে ছট্-পরবের পিঠে ভাজার ভরপুর গন্ধ পাওয়া যায়। কত রাত পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের হাসি কলরব, মেয়েদের গান- যেখানে নীলগাইয়ের জেরা গভীর রাত্রে দৌড়িয়া যাইত, হায়েনার হাসি ও বাঘের কাশি (অভিজ্ঞ ব্যক্তি জানে, বাঘে অবিকল মানুষের গলায় কাশির মতো একপ্রকার শব্দ করে ) শোনা যাইত- সেখানে আজকাল কলহাস্যমুখরিত, গীতিরবপূর্ণ উৎসবদীপ্ত এক বিস্তীর্ণ জনপদ।

ছট্-পরবের সন্ধ্যায় ঝল্লুটোলায় নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে গেলাম। শুধু এই একটি টোলায় নয়-পনেরোটি বিভিন্ন টোলা হইতে ছট্-পরবের নিমন্ত্রণ পাইয়াছি কাছারিসুদ্ধ সকল আমলা।

ঝল্লুটোলার মোড়ল ঝল্লু মাহাতোর বাড়ি গেলাম প্রথমে।

ঝল্লু মাহাতোর বাড়ির একপাশে দেখি এখনো জঙ্গল কিছু কিছু আছে। ঝল্লু উঠানে এক ছেঁড়া সামিয়ানা টাঙাইয়াছে- তাহারই তলায় আমাদের আদর করিয়া বসাইল। টোলার সকল লোক ফর্সা ধুতি ও মেরজাই পরিয়া সেখানে ঘাসে-বোনা একজাতীয় মাদুরের আসনে বসিয়া আছে। বলিলাম- খাইবার অনুরোধ রাখিতে পারিব না, কারণ অনেক স্থানে যাইতে হইবে।

ঝল্লু বলিল- একটু মিষ্টিমুখ করতেই হবে। মেয়েরা নইলে বড় ক্ষুন্ন হবে, আপনি পায়ের ধুলো দেবেন বলে ওরা বড় উৎসাহ করে পিঠে তৈরি করেছে।

উপায় নাই। গোষ্ঠবাবু মুহুরী, আমি ও রাজু পাঁড়ে বসিয়া গেলাম। শালপাতায় কয়েখখানি আটা ও গুড়ের পিঠে আসিল- এক-একখানি পিঠে এক ইঞ্চি পুরু ইটের মতো শক্ত, ছুঁড়িয়া মারিলে মানুষ মরিয়া না গেলেও দস্তুরমতো জখম হয়। অথচ প্রত্যেকখানা পিঠে ছাঁচে ফেলা চন্দ্রপুলির মতো বেশ লতাপাতা কাটা। ছাঁচে ফেলিবার পরে তবে ঘিয়ে ভাজা হইয়াছে।

অত যত্নে মেয়েদের হাতে তৈরি পিষ্টকের সদ্ব্যবহার করিতে পারিলাম না। আধখানা অতিকষ্টে খাইয়াছিলাম। না মিষ্টি, না কোনো স্বাদ। বুঝিলাম গাঙ্গোতা মেয়েরা খাবারদাবার তৈরি করিতে জানে না। রাজু পাঁড়ে কিন্তু চার-পাঁচখানা সেই বড় বড় পিঠে দেখিতে দেখিতে খাইয়া ফেলিল এবং আমাদের সামনে চক্ষুলজ্জা বশতই বোধ হয় আর চাহিতে পারিল না।

ঝল্লুটোলা হইতে গেলাম লোধাইটোলা। তারপর পর্বতটোলা, ভীমদাসটোলা, আস্রফিটোলা, লছমনিয়াটোলা। প্রত্যেক টোলায় নাচগান, হাসিবাজনার ধুম। আজ সারারাত ইহারা ঘুমাইবে না। এ-বাড়ি ও-বাড়ি খাওয়াদাওয়া করিয়া নাচগান করিয়াই কাটাইয়া দিবে!

একটি ব্যাপার দেখিয়া আনন্দ হইল, মেয়েরা সব টোলাতেই যত্ন করিয়া নাকি খাবার তৈরি করিয়াছে আমাদের জন্য। ম্যানেজারবাবু নিমন্ত্রণে আসিবেন শুনিয়া তাহারা অত্যন্ত উৎসাহের ও যত্নের সহিত নিজেদের চরম রন্ধনকৌশল প্রদর্শন করিয়া পিষ্টক গড়িয়াছে। মেয়েদের সহৃদয়তার জন্য মনে মনে যথেষ্ট কৃতজ্ঞ হইলেও তাহাদের রন্ধনবিদ্যার প্রশংসা করিয়া উঠিতে পারিলাম না, ইহা আমার পক্ষে খুবই দুঃখের বিষয়। ঝল্লুটোলার অপেক্ষা নিকৃষ্টতর পিষ্টকের সহিতও স্থানে স্থানে পরিচয় ঘটিল।

সব জায়গায়ই দেখি রঙিন শাড়ি-পরা মেয়েরা কৌতূলহলপূর্ণ চোখে আড়াল হইতে ভোজনরত বাঙালি বাবুদের দিকে চাহিয়া আছে। রাজু পাঁড়ে কাহাকেও মনে কষ্ট দিল না-পিষ্টক ভক্ষণের সীমা অতিক্রম করিয়া রাজু পাঁড়ে ক্রমশ অসীমের দিকে চলিতে লাগিল দেখিয়া আমি গণনার হাল ছাড়িয়া দিলাম- সুতরাং সে কয়খানা পিষ্টক খাইয়াছিল বলিতে পারিব না।

শুধু রাজু কেন- নিমন্ত্রিত গাঙ্গোতাদের মধ্যে সেই ইটের মতো কঠিন পিষ্টক এক-একজন এক কুড়ি দেড় কুড়ি করিয়া খাইল-চোখে না দেখিলে বিশ্বাস করা শক্ত যে সেই জিনিস মানুষে অত খাইতে পারে।

নাঢ়া-বইহারে ছনিয়া ও সুরতিয়াদের ওখানে গেলাম।

সুরতিয়া আমায় দেখিয়া ছুটিয়া আসিল।

-বাবুজী, এত রাত করে ফেললেন? আমি আর মা দু-জনে বসে আপনার জন্যে আলাদা করে পিঠে গড়েছি-আমরা হাঁ করে বসে আছি আর ভাবছি এত দেরি হচ্ছে কেন। আসুন, বসুন।

নক্ছেদী সকলকে খাতির করিয়া বসাইল।

তুলসীকে খুব যত্ন করিয়া খাইবার আসন করিতে দেখিয়া মনে মনে হাসিলাম। ইহাদের এখানে খাইবার অবস্থা কি আর আছে? সুরতিয়াকে বলিলাম-তোমার মাকে বল পিঠে তুলে নিতে। এত কে খাবে?

সুরতিয়া বিস্মিত দৃষ্টিতে আমার দিকে চাহিয়া বলিল- ও কি বাবুজী, এই ক’খানা খাবেন না? আমি আর ছনিয়াই তো পনর-ষোলখানা করে খেয়েছি। খান- আপনি খাবেন বলে ওর ভেতরে মা কিশমিশ দিয়েছে- ভালো আটা এনেছে বাবা ভীমদাসটোলা থেকে- খাইব না বলিয়া ভালো করি নাই। সারা বছর এই বালকবালিকা এসব সুখাদ্যের মুখ দেখিতে পায় না। এদের কত কষ্টের, কত আশার জিনিস! ছেলেমানুষকে খুশি করিবার জন্য মরিয়া হইয়া দুইখানা পিষ্টক খাইয়া ফেলিলাম।

সুরতিয়াকে খুশি করিবার জন্য বলিলাম- চমৎকার পিঠে! কিন্তু সব জায়গায় কিছু কিছু খেয়েছি বলে খেতে পারলুম না সুরতিয়া। আর একদিন এসে হবে এখন।

রাজু পাঁড়ের হাতে একটা ছোটখাটো বোঁচকা। সে প্রত্যেকের বাড়ি হইতে ছাঁদা বাঁধিয়াছে, এক-একখানি পিষ্টকের ওজন বিবেচনা করিলে রাজুর বোঁচকার ওজন দশ-বারো সেরের কম তো কোনো মতেই হইবে না।

রাজু খুব খুশি। বলিল- এ পিঠে হঠাৎ নষ্ট হয় না হুজুর, দু-তিন দিন আর আমায় রাঁধতে হবে না। পিঠে খেয়েই চলবে।

কাছারিতে পরদিন সকালে কুন্তা একখানি পিতলের থালা লইয়া আসিয়া আমার সামনে সসঙ্কোচে স্থাপন করিল। এক টুক্‌রা ফর্সা নেকড়া দিয়া থালাখানা ঢাকা।

বলিলাম- ওতে কি কুন্তা?

কুন্তা সলজ্জ কণ্ঠে বলিল ছট্-পরবের পিঠে বাবুজী। কাল রাত্রে দু-বার নিয়ে এসে ফিরে গিয়েছি।

বলিলাম- কাল অনেক রাত্রে ফিরেছি, ছট্-পরবের নেমন্তন্ন রাখতে বেরিয়েছিলাম। আচ্ছা রেখে দাও, খাব এখন।

ঢাকা খুলিয়া দেখি, থালায় কয়েকখানি পিষ্টক, কিছু চিনি, দুটি কলা, একখণ্ড ঝুনা নারিকেল, একটা কলম্বা লেবু।

বলিলাম- বাঃ, বেশ পিঠে দেখছি।

কুন্তা পূর্ববৎ মৃদুস্বরে সসঙ্কোচে বলিল- বাবুজী, সবগুলো মেহেরবানি করে খাবেন। আপনি খাবেন বলে আলাদা করে তৈরি করেছি। তবুও আপনাকে গরম খাওয়াতে পারলাম না, বড় দুঃখ রইল।

- কিছু হয় নি তাতে, কুন্তা। আমি সবগুলো খাব। দেখতে বড় চমৎকার দেখাচ্ছে।

কুন্তা প্রণাম করিয়া চলিয়া গেল।

 

একদিন মুনেশ্বর সিং সিপাহী আসিয়া বলিল- হুজুর, ওই বনের মধ্যে গাছের নিচে একটা লোক ছেঁড়া কাপড় পেতে শুয়ে আছে-লোকজনে তাকে বস্তিতে ঢুকতে দেয় না-ঢিল ছুঁড়ে মারে, আপনি হুকুম করেন তো তাকে নিয়ে আসি।

কথাটা শুনিয়া আশ্চর্য হইলাম। বৈকাল বেলা, সন্ধ্যার বেশি দেরি নাই, শীত তেমন না হইলেও কার্তিক মাস, রাত্রে যথেষ্ট শিশির পড়ে, শেষ রাত্রে বেশ ঠাণ্ডা। এ অবস্থায় একটা লোক বনের মধ্যে গাছের তলায় আশ্রয় লইয়াছে কেন, লোকে তাকে ঢিল ছুঁড়িয়াই বা মারে কেন বুঝিতে পারিলাম না।

গিয়া দেখি গ্র্যাণ্ট সাহেবের বটগাছের ওদিকে (আজ প্রায় ত্রিশ বছর আগে গ্র্যাণ্ট সাহেব আমিন লবটুলিয়ার বন্য মহাল জরিপ করিতে আসিয়া এই বটতলায় তাঁবু ফেলেন, সেই হইতেই গাছটির এই নাম চলিয়া আসিতেছে) একটা বনঝোপে একটা অর্জুন গাছের তলায় একটা লোক ছেঁড়া ময়লা নেকড়াখানি পাতিয়া শয্যা রচনা করিয়া শুইয়া আছে। ঝোপের অন্ধকারে লোকটিকে ভালো করিয়া দেখিতে না পাইয়া বলিলাম-কে ওখানে? বাড়ি কোথায়? বের হয়ে এস-

লোকটি বাহির হইয়া আসিল- অনেকটা হামাগুড়ি দিয়া, অতি ধীরে ধীরে- বয়স পঞ্চাশের উপর, জীর্ণশীর্ণ চেহারা, মলিন ছেঁড়া কাপড় ও মেরজাই গায়ে,-যতক্ষণ সে ঝোপের ভিতর হইতে বাহির হইতেছিল, কি একরকম অদ্ভুত, অসহায়ভাবে শিকারির তাড়া-খাওয়া পশুর মতো ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে চাহিয়া ছিল।

ঝোপের অন্ধকার হইতে দিনের আলোয় বাহির হইয়া আসিলে দেখিলাম, তাহার বাম হাতে ও বাম পায়ে ভীষণ ক্ষত। বোধ হয় সেইজন্য সে একবার বসিলে বা শুইলে হঠাৎ আর সোজা হইয়া দাঁড়াইতে পারে না।

মুনেশ্বর সিং বলিল- হুজুর, ওর ওই ঘায়ের জন্যই ওকে বস্তিতে ঢুকতে দেয় না- জল পর্যন্ত চাইলে দেয় না। ঢিল মারে, দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়-

বোঝা গেল তাই এ লোকটা বনের পশুর মতো বন-ঝোপের মধ্যেই আশ্রয় লইয়াছে এই হেমন্তের শিশিরার্দ্র রাত্রে।

বলিলাম- তোমার নাম কি? বাড়ি কোথায়?

লোকটা আমায় দেখিয়া ভয়ে কেমন হইয়া গিয়াছে- ওর চোখে রোগকাতর ও ভীত অসহায় দৃষ্টি। তা ছাড়া আমার পিছনে লাঠিহাতে মুনেশ্বর সিং সিপাহী। বোধ হয় সে ভাবিল, সে যে বনে আশ্রয় লইয়াছে তাহাতেও আমাদের আপত্তি আছে- তাহাকে তাড়াইয়া দিতেই আমি সিপাই সঙ্গে করিয়া সেখানে গিয়াছি।

বলিল- আমার নাম?- নাম হুজুর গিরধারীলাল, বাড়ি তিনটাঙা। পরক্ষণেই কেমন একটা অদ্ভুত সুরে- মিনতি, প্রার্থনা এবং বিকারের রোগীর অসঙ্গত আবদারের সুর এই কয়টি মিলাইয়া এক ধরনের সুরে বলিল- একটু জল খাব- জল-

আমি ততক্ষণে লোকটাকে চিনিয়া ফেলিয়াছি। সেবার পৌষ মাসের মেলায় ইজারাদার ব্রহ্মা মাহাতোর তাঁবুতে সেই যে দেখিয়াছিলাম- সেই গিরধারীলাল। সেই ভীত দৃষ্টি, সেই নম্র মুখের ভাব-

দরিদ্র, নম্র, ভীরু লোকদেরই কি ভগবান জগতে এত বেশি করিয়া কষ্ট দেন! মুনেশ্বর সিংকে বলিলাম- কাছারি যাও- চার-পাঁচজন লোক আর একটা চারপাই নিয়ে এস-

সে চলিয়া গেল।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম- কি হয়েছে গিরধারীলাল? আমি তোমায় চিনি। তুমি আমায় চিনতে পার নি? সেই যে সেবার ব্রহ্মা মাহাতোর তাঁবুতে মেলার সময় তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল- মনে নেই? কোনো ভয় নেই। – কি হয়েছে তোমার?

গিরধারীলাল ঝর্‌ঝর্ করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। হাত ও পা নাড়িয়া দেখাইয়া বলিল- হুজুর, কেটে গিয়ে ঘা হয়। কিছুতেই সে ঘা সারে না, যে যা বলে তাই করি- ঘা ক্রমেই বাড়ে। ক্রমে সকলে বললে- তোর কুষ্ঠ হয়েছে। সেইজন্য আজ চার-পাঁচ মাস এই রকম কষ্ট পাচ্ছি। বস্তির মধ্যে ঢুকতে দেয় না! ভিক্ষে করে কোনো রকমে চালাই। রাত্রে কোথাও জায়গা দেয় না- তাই বনের মধ্যে ঢুকে শুয়ে থাকব বলে-

-কোথায় যাচ্ছিলে এদিকে? এখানে কি করে এলে?

গিরধারীলাল এরই মধ্যে হাঁপাইয়া পড়িয়াছিল। একটু দম লইয়া বলিল- পূর্ণিয়ার হাসপাতালে যাচ্ছিলাম হুজুর- নইলে ঘা তো সারে না।

আশ্চর্য না হইয়া পারিলাম না। মানুষের কি আগ্রহ বাঁচিবার! গিরধারীলাল যেখানে থাকে, পূর্ণিয়া সেখান হইতে চল্লিশ মাইলের কম নয়- মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্টের মতো শ্বাপদসঙ্কুল আরণ্যভূমি সামনে- ক্ষতে-অবশ হাত-পা লইয়া সে চলিয়াছে এই দুর্গম পাহাড়-জঙ্গলের পথ ভাঙিয়া পূর্ণিয়ার হাসপাতালে!

চারপাই আসিল। সিপাহীদের বাসার কাছে একটা খালি ঘরে উহাকে লইয়া গিয়া শোয়াইয়া দিলাম। সিপাহীরাও কুষ্ঠ বলিয়া একটু আপত্তি তুলিয়াছিল, পরে বুঝাইয়া দিতে তাহারা বুঝিল।

গিরধারীকে খুব ক্ষুধার্ত বলিয়া মনে হইল। অনেকদিন সে যেন পেট ভরিয়া খাইতে পায় নাই। কিছু গরম দুধ খাওয়াইয়া দিতে সে কিঞ্চিৎ সুস্থ হইল।

সন্ধ্যার দিকে তাহার ঘরে গিয়া দেখি সে অঘোরে ঘুমাইতেছে।

পরদিন স্থানীয় বিশিষ্ট চিকিৎসক রাজু পাঁড়েকে ডাকাইলাম। রাজু গম্ভীর মুখে অনেকক্ষণ ধরিয়া রোগীর নাড়ি দেখিল, ঘা দেখিল। রাজুকে বলিলাম-দেখ, তোমার দ্বারা হবে, না পূর্ণিয়ায় পাঠিয়ে দেব?

রাজু আহত অভিমানের সুরে বলিল- আপনার বাপ-মায়ের আশীর্বাদে হুজুর, অনেক দিন এই কাজ করছি। পনের দিনের মধ্যে ঘা ভালো হয়ে যাবে।

গিরধারীকে হাসপাতালে পাঠাইয়া দিলেই ভালো করিতাম পরে বুঝিলাম। ঘায়ের জন্য নহে, রাজু পাঁড়ের জড়ি-বুটির গুণে পাঁচ-ছয় দিনের মধ্যেই ঘায়ের চেহারা বদলাইয়া গেল- কিন্তু মুশকিল বাধিল তাহার সেবা-শুশ্রূষা লইয়া। তাহাকে কেহ ছুঁইতে চায় না, ঘায়ে ঔষধ লাগাইয়া দিতে চায় না, তাহার খাওয়া জলের ঘটিটা পর্যন্ত মাজিতে আপত্তি করে।