সম্রাট অশোক Samrat Ashok by বঙ্কিমচন্দ্র দাশগুপ্ত Banchim chandra Dasgupta , chapter name প্রথম অঙ্ক - প্রথম দৃশ্য

প্রথম অঙ্ক - প্রথম দৃশ্য

স্থান—প্রাসাদ-কক্ষ । কাল — অপরাহ্ণ ।

সম্রাট অশোক নিতান্ত অস্থির ভাবে কক্ষ মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতে ছিলেন, দীপঙ্কর-তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ একটা পদ্মকোরকের দলগুলি খুলিতে খুলিতে চলিয়াছে । হঠাৎ থামিয়া সম্রাট অশোক বলিলেন—

অশোক।  না দীপঙ্কর! আমি একটুও উত্ত্যক্ত হইনি। আমি চাই একটা বিরাট সংঘাত। — যে বলবান সে মাথা চাড়া দিয়ে উঠুক,...দুৰ্ব্বল ধূলিষ্ঠ্যাৎ হোক। অক্ষম যে, তার বেঁচে থাকার কোনও প্রয়োজন নেই ।

দীপঙ্কর।  কিন্তু বলিষ্ঠেরা যাকে অক্ষম ও দুর্ব্বল বলে উপেক্ষা করে সেই প্রায়শঃ টিকে থাকে ; —ঝড়ের সঙ্গে যখন বনানীর সংঘাত লাগে, · বনষ্পতিই ভেঙ্গে পড়ে,... ক্ষুদ্রতমা কানন- বল্লরিটি ঝড়ের দুর্দ্দম্য দোলায় দুলে দুলে সে প্রলয়ের মধ্যে নিজের অস্তিত্ব অক্ষত রাখে।

অশোক।  এ কি অস্বাভাবিক নয় বলে তুমি মনে কর ?

দীপঙ্কর। সংসারে অস্বাভাবিক অনেক কিছুই ঘটে সম্রাট !– ভ্রাতার বিরুদ্ধে ভ্রাতার অসি হস্তে অভিযান এও কি অস্বাভাবিক নয় ?

অশোক।  কেন ?—স্বার্থের জন্য পরের মস্তকে যদি খড়্গা হানতে পারে, ভ্রাতার মস্তকটি এমন প্রিয় হল কেন ? পিতামহ চন্দ্রগুপ্তের দিগ্বিজয়ে যারা জয়ধ্বনি তুলেছিল, তারা তাঁর ভাই চান্দের হত্যা কেন অনুমোদন কলে না আমি বুঝতে পারি না ।

দীপঙ্কর।  নন্দই রাজ্যের ন্যায্য উত্তরাধিকারী ছিলেন।

অশোক।  কি কারণে ? শুধু জন্মের আভিজাত্যই বড় হল ? চন্দ্রগুপ্তের অপূর্ব্ব শৌর্য্য, —যার পদতলে মেসিডোনিয়ার বিশ্ব- বিজয়িনী শক্তি মস্তক নত করেছে ; তাঁর অলৌকিক সাহস, প্রখরা বুদ্ধি, —যাদের জগদ্বিখ্যাত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম শূর আলেকজেণ্ডার বার বার অভিনন্দন জানিয়েছেন, —সবকে স্বেচ্ছাচারী কৌলিন্যের যুপকাষ্ঠে বলি দিয়ে শুধু কি জাতের আভিজাত্যই তার উদ্ধত শির উঁচু করে দাঁড়াবে ?

দীপঙ্কর।  দীন ব্রাহ্মণ,— রাজনীতি বুঝি না সম্রাট!—তুচ্ছ স্বার্থের জন্য বিদ্রোহের রক্ত চক্ষু মেলে কি পিতা, ভ্রাতার মস্তকের উপরও খড়্গ উদ্যত কৰ্ব্ব ? –

অশোক।  তুমি ব্রাহ্মণ রাজনীতি বুঝছ না ; কিন্তু সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সিংহাসন যাঁর আশীর্ব্বাদে প্রতিষ্ঠিত, সে চাণক্যও ব্রাহ্মণ ছিলেন,—তিনিই ভ্রাতৃহত্যার জন্য চন্দ্রগুপ্তের অসিখানি পিধান হতে টেনে নিয়ে নিজ হাতে শাণিত করে দিয়েছিলেন ; কর্ম্ম জগতে স্নেহ,মমতার স্থান নেই দীপঙ্কর ! — দীনের উটজ কুটীর কক্ষে,—ভাব- রাজ্যের অধিকারীদের বুকে তারা মাথা খুঁড়ে মরুক গে,...যারা বাস্তব রাজ্যে সিংহাসন নিয়ে রঙ্গমঞ্চে নেমেছে তারা স্নেহ, মমতার আর্দ্র ধারায় নিজের পথকে কখনো পিচ্ছল করে তুলে না।

দীপঙ্কর।  শ্রীরামচন্দ্রের জীবন-কথায় রামানুজ ভরতের যে ভক্তি ভরে ভ্রাতার পাদুকা পূজার কথা উল্লেখ আছে তাহা বৰ্ত্তমান সাম্রাজ্য লোলুপ ব্যক্তিদের কাছে তবে একটা ব্যঙ্গের বিষয় ?

অশোক।  ভরত জানতেন যে দুদিন পরে অযোধ্যার সাম্রাজ্য তাকে ছেড়ে দিতে হবে, তাই তাঁর এত ভ্ৰাতৃপ্রেম, – সিংহাসনের উপর এতটা বৈরাগ্য।

দীপঙ্কর।  কেন সম্রাট ? – সাম্রাজ্য হাতে নিয়ে তিনি কি রাজ্যের সৈন্য সামন্তকে নিজের পক্ষে চিরদিন বশে রেখে তাঁর দাদা রামচন্দ্রকে বাধা দিতে পার্ডেন না, আজ কালের অনেক রাজা মহারাজারা যেমন কচ্ছেন? রামচন্দ্রের মস্তকটি এমন কোন নিরাপদ স্থানে ছিল না যেখানে আততায়ীর আক্রমণ দুঃসাধ্য হত !

অশোক।  তুমি বেশ তর্ক কর্তে জান দীপঙ্কর !

[ রুদ্রদেবের প্রবেশ ]

রুদ্র।  সম্রাটের জয় হোক ।

অশোক।  সংবাদ শুভ সেনাপতি ?

রুদ্র।  ভারতের সকল নৃপতিই মগধেশ্বরকে সম্রাট বলে স্বীকার

করেছেন,—একমাত্র কলিঙ্গরাজ, – অশোক। স্বীকার কর্তে চায় না বুঝি ?-

রুদ্র।  আজ্ঞে।—তিনি মগধের মৃত জ্যেষ্ঠ রাজকুমার সুসীমের পুত্রের জন্য অপেক্ষা কৰ্ব্বেন ।

অশোক।  হুঁ ! সেনাপতি ! —

রুদ্র।  সম্রাট !

অশোক।  কলিঙ্গ রাজের এই ঔদ্ধত্যের কারণ কি তার অপ্রমেয় দুৰ্দ্ধৰ্ষ সৈন্যবল ?

রুদ্র।  তাই বোধ হয় সম্রাট! কলিঙ্গ রাজের উদ্দাম ব্যবহার মগধেশ্বরের সিংহাসনকে অবমানিত করেছে।

অশোক।  বেশ। কলিঙ্গ ধ্বংস কব্বার জন্য বিরাট সৈন্যদল চালিত কর সেনাপতি। —ঐ মহাসাগরের বেলাভূমি স্পর্শ করে আর একটা যেন শোণিত-সাগর রচিত হয় । অতি দ্রুত,—এক মুহূৰ্ত্তও বিলম্ব কর না ৷

রুদ্র।  দেশে অশান্তির অগ্নি যে এখনো নির্ব্বাপিত হয় নি সম্রাট ! “বোধিক্রমে” আঘাত করার দরুণ সমস্ত বৌদ্ধজগতে, বিদ্রোহের অগ্নি ধূমায়িত হচ্ছে ।

অশোক।  অশোকের একটা ফুৎকারে সে অগ্নি নির্ব্বাপিত হবে।—অশোকের শাসনমুষ্টি যে ইস্পাতে নির্ম্মিত দেশ এখনো তা বুঝতে পারেনি । রুদ্র। আমি যাই তবে সম্রাট! কলিঙ্গ অভিযানের আয়োজন করিগে।

অশোক।  যাও। —উদ্বেল সাগরের জলোচ্ছ্বাসের প্রবেশ পথ যদি রুদ্ধ না কর— শেষে প্রলয় প্লাবন রোধ করা দুঃসাধ্য হবে। অতি সত্ত্বর তৈইরি হও ।

রুদ্র।  যে আজ্ঞে।

[ প্রস্থানো্দ্যোগ] 

অশোক।  শোন ।

রুদ্র।  কি আদেশ সম্রাট ?

অশোক।  নগরপাল চণ্ডকে আমার আদেশ জানিয়ে দাও, সাত দিনের মধ্যে আমি দেশের বিদ্রোহের অবসান চাই । ন্যায় অন্যায়ের মুখ পানে তাকাইবার কোন প্রয়োজন নেই, বিচারের কোন আবশ্যকতা নেই,– যদি অত্যাচার কর্ত্তে হয়, তার জন্য কেউ কারণ দর্শাইবার জন্য জোর করেনা,—হত্যার জন্য কেউ দায়ী হবে না। যেমন করে হোক, বিবেক, সহানুভূতি সব ধূলিসাৎ করে।—

রুদ্র।  যে আজ্ঞে।

[প্রস্থান ]

দীপঙ্কর।  একজন সম্রাটের পক্ষে এ কি রকম আদেশ হল ?

অশোক।  তুমি ব্রাহ্মণ, রাজনীতি বুঝ না বল্লে, তোমার তুলার কি প্রয়োজন ?

দীপঙ্কর।  একজন কূট রাজনীতিজ্ঞ সম্রাটের এতদিন সাহচর্য্য করেও যে কিছু বুঝ তে পাচ্ছি না, এই জন্য নিজের মেধাকে ধিক্কার দিচ্ছি।

অশোক।  সম্রাটের সঙ্গে তুমি বেড়িয়েছ মাধবী রাত্রির জ্যোৎস্নালোকে,... সে যখন অন্ধকার পথের যাত্রী ছিল তখন যদি তার সঙ্গে থাকতে, তার এই নির্মম রাষ্ট্রনীতি বুঝবার জন্য নিজের বুদ্ধিকে ধিক্কার দিতে হত না ।

দীপঙ্কর।  এও ত দীর্ঘ দিন কেটে গেল, সম্রাটের সঙ্গে সমান তালে পা ফেলে চলেছি তবু ত প্রজ্ঞা প্রথরা হল না ।

অশোক।  তুমি চলেছ তোমার বন্ধু যখন জীবনসংগ্রামে জয়ী হয়ে পুষ্পবনের বকুল বিছানো পথ দিয়ে চলেছে;– সে যখন পিতৃস্নেহ বঞ্চিত হয়ে গহন কান্তারে ঘুরে বেড়াত,...যখন তাকে কুৎসিত কুষ্ঠরোগগ্রস্থ ভেবে আত্মীয়, পরিজন ঘৃণায় তার মুখে নির্দয় ভাবে থুথু ছুড়ে মারত,... ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় উন্মাদ প্রায় হয়ে নিদাঘের প্রথর রৌদ্রে সে যখন প্রাণপণে চক্ষু বিস্ফারিত করে বাতাসের আর্দ্র বায়ু টেনে নেবার জন্য দীর্ঘ জিভ বের করে আকাশ পানে চেয়ে থাকত.... না বন্ধু, থাক।—অতীত স্মৃতি আমার হয়ত আবার উন্মাদ করে তুলবে ।

দীপঙ্কর।  অনেক সৌভাগ্যবানের অতীত জীবনপথ পুষ্পাত্তীর্ণ ছিল না।—পঞ্চ পাণ্ডব সম্রাট ভবনের স্বর্ণ ঝিনুক মুখে নিয়ে মাথার উপর দিয়ে বয়ে গেল ! – কি কঠোর সংগ্রামে নেমে তাঁদের আত্ম প্রতিষ্ঠা করতে হল! কিন্তু অতীত জীবনের এ দুঃখের জন্য তাঁরা দানবের মত বিশ্বশান্তির উপর কখনো আপতিত হননি, — পর - ধর্ম্মের প্রতি প্রতিহিংসার খড়্গাও উচ্চত করেন নি।

অশোক।  বিনা কারণে সম্রাট অশোকও কাহারো উপর অত্যাচার করে না ।

দীপঙ্কর।  অলৌকিক ধী-সম্পন্ন পণ্ডিত চাণক্য যদি আজ বেঁচে থাকতেন,—তিনিও বোধ হয় সম্রাট অশোকের, ঐ শান্ত, ক্ষমাশীল নিরীহ বৌদ্ধগণের উপর এ নির্মম অত্যাচার,—একটা পুণ্যস্মৃতি জড়িত পবিত্র বোধিবৃক্ষ কর্তনের কোন নৈতিক কারণ খুঁজে পেতেন না।

অশোক।  তিনি যত বড় পণ্ডিতই হোন, যত বড় রাজনীতিজ্ঞ হোন, তা’হলে আমি তাঁর ভবিষ্যৎ দৃষ্টির প্রখরতা কখনো স্বীকার কর্ত্তেম না।—প্রেমধর্ম্মের পুরোহিত ঐ বৌদ্ধগণের কর্ম্মসন্ন্যাস ক্রিয়া- কলাপ কিছু লক্ষ্য করেছ ? - কি সর্ব্বনাশ ভারতের উপর নিয়ে আছে তারা... পরাধীনতার কি দৃঢ় নিগড় ভারতের কণ্ঠে পরাবার জন্য উদ্যত হয়েছে? প্রাণীজগতের যা ধর্ম্ম নয়, স্বভাব নয় তাই আজ বৌদ্ধগণ শান্তির পীতপতাকা ঘাড়ে নিয়ে প্রচার কচ্ছে।—প্রাণী রাজ্যে অহিংসা তুমি কোথাও দেখছ ? — শার্দ্দূল মৃগশিশুর বক্ষঃ  ছিন্ন করে চুমুক মারে, শ্যেন শালিকের কণ্ঠ চিরে রক্ত খায়,... ভূজঙ্গ মাটীতে বুক দিয়ে চলে কিন্তু সামান্য আঘাত পেলে ফোঁস্ করে ফণা তুলে হিংসার তীব্র হলাহল উদগার করে । ভারতের প্রবেশদ্বারে হূন, শক, পলব রণতূর্য্যের ভৈরব নিশ্বন ভুলে, অসি উদ্ধৃত করে দাড়িয়ে আছে, আর বৌদ্ধগণ ভারতের বুকে প্রচার কচ্ছে,—আনন্দশীতল অহিংসা ধর্ম্মের মর্ম্ম কথা ।  

দীপঙ্কর।  কিন্তু ভারতের শ্রেষ্ঠ মহামহিম মনস্বিগণ বৌদ্ধধর্ম্মের স্নিগ্ধ ছায়ার নীচে আশ্রয় নিয়েছেন।

অশোক।  তা জানি, তাই প্রচণ্ড আঘাতে তাঁদের অশেষ ভক্তি অভিষিক্ত বোধিবৃক্ষ ছেদন করেছি, —আঘাতে আঘাতে যদি তাঁদের মধ্যে হিংসা জাগাতে পারি।—ভারতের শ্রেষ্ঠ মস্তিষ্কগুলি যদি নিভৃত চৈত্যের আড়ালে লুক্কাইত থেকে রাত্রি দিন অহিংসার মন্ত্র জপ করে,ভারতের এই আসন্ন সর্বনাশের কে গতি রোধ কর্ব্বে ? কিন্তু কৈ? দীপঙ্কর! এত আঘাতেও বৌদ্ধগণের মধ্যে একটা ব্যক্তি বজ্রমুষ্টি তুলে অশোকের বিরুদ্ধে দাঁড়াল না ; –এম্‌নি ক্লীব, কাপুরুষ হয়ে পড়েছে এরা ! এরাই হতে পারত আলেকজেণ্ডার মত দুর্দ্ধর্ষ দিগ্বিজয়ী,—শ্রীকৃষ্ণের মত কুরুক্ষেত্রের নায়ক,—পরশুরামের মত কঠোর তেজস্বী ।

দীপঙ্কর।  সম্রাটের নীতির বিরুদ্ধে আমি বার বার বিদ্রোহ তুলেছি, আজ আপনার দূরদর্শিনী বুদ্ধিকে অভিনন্দন জানাচ্ছি ।

[ চণ্ডের প্রবেশ ]

চণ্ড।  সম্রাটের জয় হোক! চণ্ডাল রুহিদাস ধরা পড়েছে সম্রাট !

অশোক।  এখনো নরকে নিক্ষেপ করনি তাকে ?

চণ্ড।  সম্রাটের আদেশ—

অশোক।  কোন প্রয়োজন নেই। সম্রাটের আদেশ সেনাপতি জানিয়ে দেয় নাই ?

চণ্ড।  দিয়েছেন সম্রাট ! তবু – অশোক। সামান্য বিষয় নিয়ে সম্রাটকে ত্যক্ত কর না । সম্রাট তাঁর শাসনের লৌহ দণ্ড নগরপালের হস্তে তুলে দিয়েছে। যাও—

চণ্ড।  যে আজ্ঞে।

[ প্রণাম করিয়া প্রস্থান ]

দীপঙ্কর।  সম্রাট অশোকের প্রদীপ্ত রোষ কুমার সুসীম ত মাথা পেতে নিয়েছেন, তাঁর অনাথ পুত্রটিও কি এ রোষ হতে অব্যাহতি পাবে না ?

অশোক।  কলিঙ্গরাজ তার জন্য অপেক্ষা করে আছে, তাকে খুঁজে বের কব না?—এস আমার সঙ্গে, —একটা কৌতুক দেখাচ্ছি ।  [ উভয়ের প্রস্থান ]