আট কুঠুরি নয় দরজা - Aat kuthuri noi dorja by সমরেশ মজুমদার - Samaresh Majumder, chapter name আট কুঠুরি নয় দরজা - পঁয়ত্রিশ

আট কুঠুরি নয় দরজা - পঁয়ত্রিশ

ভার্গিস বসে পড়ল। তার বা দিকের চিনচিনে ব্যথা শুরু হল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠল। বিশাল মুখের চর্বিগুলো এখন তিরতিরিয়ে কাপছে। আকাশলাল সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভার্গিস ওই অবস্থায় বলল, ‘একই গলা। ইয়েস। কিন্তু আমি কি করতে পারি ? কিছুই না। তুমি যদি আকাশলাল হও তাহলে কবরে গিয়েও তুমি বেঁচে উঠেছ!'

            
নিশ্চয়ই । তোমার সামনে বসে আছি এখন।'

            
তার মানে তোমার মৃত্যু হয়নি। ডাক্তারদের কিনে নিয়েছিল। আগে থেকে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে আমায় বোকা বানিয়ে কবরে গিয়ে শুয়েছিল। এবার হয়তো শুনব কফিনের ভেতরে তোমার জন্যে অক্সিজেন মাস্ক রাখা ছিল।' ভার্গিস বিড় বিড় করল।

           
'আমার কিছুই মনে নেই।'

            
ইয়ার্কি।"

           
না। আমার বুকে দু-তিনবার অপারেশন করা হয়েছে। নিশ্চয়ই আমার অনুমতি নিয়েই সেসব হয়েছিল। বুঝতে পারছি আমি এসময় খুব মূল্যবান লোক ছিলাম। আর মূল্যবান লোকেদের হাতে বেশ ক্ষমতা থাকে। তাই ধরে নিচ্ছি পরিকল্পনা আমার মাথা থেকেই বের হয়েছিল। শুধু বুক নয়, আমার মুখেও অপারেশন করা হয়েছে। কিন্তু পোস্ট-অপারেশন ট্রিটমেন্ট কিছুই হয়নি। আমি শুধু শুধু বুঝতে পারছি আমার মুখের পরিবর্তন ঘটিয়ে আকাশলালকে সত্যি সত্যি মেরে ফেলার মতলব হয়েছিল।

           
‘এসব তুমি জানো না ?

            
না। আমার স্মৃতিশক্তির অনেকটা হারিয়ে গেছে। এই তুমি, তোমার সঙ্গে আমার কি রকম সম্পর্ক ছিল তাও মনে নেই। লোকের মুখে মুখে শুনে আন্দাজ করেছি।

           
‘তোমার কিছুই মনে নেই ? বুকের ব্যথাটাকে এই একবার ভুলতে পারল ভার্গিস।

           
‘ছায়া ছায়া মনে আছে। স্পষ্ট কিছু নেই। আমার বাড়ি কোথায় ছিল, আমার কোনও আত্মীয়স্বজন ছিল কিনা তাও আমার মনে পড়ছে না। আমি বিবাহিত ছিলাম এবং আমার ছেলেমেয়ে আছে কিনা তাও তো জানি না।

           
"নো নো । তুমি অবিবাহিত। মেয়েছেলের ব্যাপারে তোমার কোনও দূর্বলতা ছিল না একথা আমি হলফ করে বলতে পারি। তোমার রেকর্ড আমার মুখস্ত। ভার্গিস চোখ বন্ধ করল, আমার বুকে যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে হার্ট অ্যাটার্ক হবে।'

          
‘দাঁড়াও । আমার সম্পর্কে খবর দিয়ে যাও । আমার কোনও আত্মীয়স্বজন আছে ?

          
আছে। এক বুড়ো কাকা। কাকিও। আর কেউ নেই।'

          
‘আমি এখানে থাকতাম কোথায় ?"

         
ওঃ, সেটা যদি জানতে পারতাম তাহলে অনেক আগে তোমাকে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসাতে পারতাম । ভার্গিস বুক খামচে ধরল।

         
‘আমি কাদের নিয়ে বিপ্লব করতে গিয়েছিলাম ?

         
‘পাবলিককে নিয়ে। হ্যাঁ, ওরা তোমাকে একসময় খুব দেখেছে। আমি আর কথা বলতে পারছি না । তোমার সম্পর্কে ভাল বলতে পারবে ম্যাডাম । তার কাছে যাও ।'

        
‘ম্যাডাম । তিনি কে ?"

        
পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে টেবিলের ওপর রেখেই ককিয়ে উঠল ভার্গিস।

        
অ্যাম্বুলেন্স ডেকে ভার্গিসকে হাসপাতালে ভর্তি করতে কিছুটা সময় খরচ হল। আকাশলাল ফিরে এল ভার্গিসের ঘরে। কিচেনে কিছু খাবার ছিল। সেটা পেটে চালান দিয়ে সে ভার্গিসের বিছানায় শুয়ে পড়ল । সারাদিন যে ধকল গিয়েছিল তাতে ঘুম আসতে দেরি হল না। সেইসময় ভার্গিসকে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছিল ।

            
আকাশলালের যখন ঘুম ভাঙল তখন সন্ধে হয়ে গিয়েছে। এক কাপ কফি বানিয়ে খেয়ে সে ম্যাডামের কার্ডটাকে নিয়ে নীচে নামল। একটা পাবলিক বুথের ভেতর গিয়ে দাড়াল সে। আসবার আগে ভার্গিসের সামান্য সঞ্চয় থেকে কিছু টাকা এবং কয়েন সে পকেটে পুরেছিল। পয়সা ফেলে ডায়াল করল সে। ওপাশে একটা নারী কষ্ঠ জানান দিল, ‘হ্যালো।

       
‘ম্যাডাম বলছেন ?"

       
'আপনার পরিচয় জানতে পারি ?

       
'আমাকে বলা হয়েছে সেটা ম্যাডামের কাছ থেকে জেনে নিতে।'

      
'আপনার নাম ?

      
‘আপাতত গগনলাল।"

      
“প্লিজ হোল্ড অন ।"

       
মিনিটখানেক বাদে দ্বিতীয় গলা পাওয়া গেল, ‘হ্যালো!"

      
‘ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলছি ?

      
'আপনি ?"

     
"আমাকে গগনলাল অথবা আকাশলাল বলতে পারেন।'

     
‘হোয়াট ?

     
'দ্যাটস মাই প্রবলেম। মিস্টার ভার্গিস, আপনাদের এক্স পুলিশ কমিশনার আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে হার্ট অ্যাটাকের কবলে পড়ে হসপিটালাইজড হবার সময় আপনার কার্ড দিয়ে বলেছেন একমাত্র আপনি আমার প্রবলেম সমাধান করতে পারেন।'

       
‘আপনি কি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন ?"

      
একদম না ম্যাডাম। আপনি হাসপাতালে ফোন করলে ভার্গিসের ব্যাপারটা -

      
‘আমি ভার্গিস এর ব্যাপার জানতে চাইছি না। আপনি কে ?' '

      
'আমার মনে হচ্ছে আমি আকাশলাল। লোকে জানতে চাইলে গগনলাল বলছি। আকাশলাল বলল, ম্যাডাম, আমি টােটালি কনফিউজড। অপারেশন টপারেশন হবার পর আমার স্মৃতিশক্তির যে বারোটা বেজে গেছে। যার সঙ্গে আগে আলাপ ছিল তাকে দেখলে চিনতে পারব না। আবার সে-ও যে আমাকে চিনবে তার উপায় নেই। কারণ আমার মুখের আদল একেবারে বদলে গিয়েছে।

      
“আপনি কেন টেলিফোন করেছেন ?"

      
"আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।'

        
“কি জন্যে ?

        
‘আমার সম্পর্কে কিছু জানতে চাই। প্লিজ হেল্প মি ।

        
লুক মিস্টার গগনলাল, আপনি যদি নেহাত বদমতলবে এই ফোন করে থাকনে তাহলে নিজের চরম বিপদ ডেকে আনছেন। আপনি আমাকে কোন জায়গা থেকে টেলিফোন করেছেন ?

ভার্গিসের বাড়ির কাছে একটা টেলিফোন বুথ থেকে। সামনে একটা বড় হোটেল দেখতে পাচ্ছি। নাম প্লাজা। আকাশলাল চারপাশে তাকিয়ে জানিয়ে দিল।

          
বেশ। ঠিক ওইখানেই দাড়িয়ে থাকুন আরও মিনিট পনের। গাড়ি যাচ্ছে।’

          
মিনিট পঁচিশের পরে ম্যাডামের বিদেশী গাড়ি শহরের ঘিঞ্জি এলাকা ছাড়িয়ে বেশ নির্জন এবং বড়লোকি চেহারার এলাকায় ঢুকে পড়ল। আকাশলাল বসে ছিল গাড়ির পেছন সিটে। এই শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়ির ভেতরে সুগন্ধি ভাসছে। বেশ লাগছিল তার। সামনের সিটে বসে থাকা দুটো লোক তার সঙ্গে একটিও বাড়তি কথা বলেনি। এই যে ফোন করা মাত্র এমন গাড়ি পাঠিয়ে দিলেন ম্যাডাম তার একটাই মানে, আকাশলাল লোকটা সত্যিকারের মূল্যবান ছিল।

         
তারও মিনিট পাঁচেক বাদে সে একটা দারুন সাজানো ড্রয়িং রুমে বসে ছিল । অবশ্য ড্রয়িং রুম না বলে হলঘর বললে ভাল মানাত। তাকে এখানে বসিয়ে দিয়ে যে মহিলা চলে গিয়েছেন তারও পাত্তা নেই। ঘরে হালকা নীল আলো জুলছে। এই সময় ভেতরের দরজা দিয়ে সম্পূর্ণ সাদা আলখাল্লা জাতীয় পোশাক পরে দীর্ঘাঙ্গিনী এক রমনী ঘরে ঢুকলেন। মহিলা ইচ্ছে করেই ঘরের বিপরীত প্রান্তে বসলেন যাতে তার মুখ অস্পষ্ট দেখায়।

         
কি জানতে চান, বলুন।"

         
ম্যাডাম ?"

        
‘হ্যাঁ, ওই নামেই আমি পরিচিত।'

         
'হু। আপনি আকাশলালকে তো চিনতেন।

         
মহিলা কোনও জবাব দিলেন না।

         
'আপনি আমাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন। আমার সঙ্গে কি আকাশলালের মিল আছে ?

         
‘অন্তত এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে না।’

         
'দেখুন ম্যাডাম । আমি আপনাকে স্পষ্ট বলছি কয়েকদিন আগে এক পাহাড়ি ঠান্ডা গ্রামে যখন আমার সেন্স আসে তখন দেখলাম আমি অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছি। হায়দার নামের একজন আমাকে পাহারা দিত। জ্ঞান হবার পর আমার নিজের অতীত সম্পর্কে কোনও কথা মনে এল না। অনেকবার আলোচনা করলে আবছা আবছা কিছু মনে পড়ে। ওখানে থাকার সময় আমি হায়দারকে যেমন বিশ্বাস করতে পারিনি তেমনি নিজের ওপর আস্থা কমে আসছিল। ওখানেই জানতে পারলাম ভার্গিসের চাকরি গিয়েছে এবং আমার ব্যাপারে পুলিশ বেশ হতভম্ভ হয়ে আছে। আমি শহরে এলাম। আসার পর শুনলাম পুলিশ ওই গ্রামে গিয়ে হায়দারকে মেরে ফেলেছে। এটা থেকে আমার মনে যে ধারণা তৈরি হল তা ঝেড়ে ফেলতে পারছি না। তারপর ভার্গিসের সঙ্গে আলাপ হল। ভার্গিস আমাকে সন্দেহ করেছিল কিন্তু আমার মুখ দেখে সেটা বিশ্বাস করতে পারছিল না। ওর কাছ থেকে যখন সব খবর নিতে চাইলাম তখনই লোকটা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেল। ওর উপদেশমত আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আকাশলাল থামল।

             
ম্যাডাম অদ্ভুত চোখে তাকালেন। তারপর আকাশলালকে আপাদমস্তক দেখলেন। শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করলেন, 'আপনার মুখে ব্যান্ডেজ ছিল ?

            
'হ্যাঁ ।'

            
'আপনাকে ব্যান্ডেজ খুলতে কেউ দেখেছে ?

            
‘না ।"

            
"খোলার পর কেউ জানে আপনি সেই ব্যান্ডেজ পরা লোক ?”

            
আকাশলাল চিন্তা করল। হ্যাঁ, সেই মেয়েটি জানে যার সাহায্য নিয়ে সে বুড়োর ওখান থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল । ওর প্রেমিক জানে যে তাকে ঘোড়ার গাড়িতে শহরে পৌছে দিয়ে গিয়ছে। কিন্তু ওরা তাকে আকাশলাল বলে জানে না। সেটা এখন জানে ভার্গিস এবং এই ভদ্রমহিলা । আকাশলাল ম্যাডামকে ব্যাপারটা জানাল ।

            
ঠিক আছে। এবার আপনি আপনার জামা খুলুন।

           
"জামা ?"

            
ওটা থেকে কুৎসিত গন্ধ বের হচ্ছে ?

            
'আমার আর কোন পোশাক নেই।'

             
তাই আপনাকে খুলতে বলছি ওটা।

             
আকাশলাল সঙ্কোচে জামা খুলল। তার বুকের ওপর চিরস্থায়ী হয়ে থাকা দাগগুলো এই অল্প আলোতে বীভৎস দেখচ্ছিল। ম্যাডাম এগিয়ে এলেন সামনে। কাটা দাগগুলো খুঁটিয়ে দেখলেন। তারপর ধীরে ধীরে পেছনে এসে দাঁড়ালেন, তাহলে আপনি সেই লোক যাকে খুঁজে পাওয়ার জন্যে আজ সকালে থানায় ডায়েরি করা হয়েছে। মেয়েছেলেটা কে ?"

          
'কার কথা বলছেন বুঝতে পারছি না।

         
"এখানে এসে কোথায় উঠেছিল ?

         
"যে আমাকে নিয়ে এসেছিল তার মাসির বাড়িতে। সেই ভদ্রমহিলা আমাকে স্নানের সময় দেখে ফেলেন। তারপর খুব ভাল ব্যবহার করতে শুরু করেন।'

       
"তাই নাকি ? স্বানের সময় আপনার শরীর তাহলে মহিলাদের ওপর প্রভাব ফেলে। ম্যাডামের গলায় ঈষৎ ব্যঙ্গ। এগিয়ে গিয়ে টেবিলে থেকে একটা সাদা কাগজ টেনে এনে বললেন, আপনার দুই হাতের ছাপ এই কাগজের দুপাশে রাখুন।'

       
"কেন ?"

       
‘আকাশলালের ফিঙ্গারপ্রিন্টের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হবে।'

       
যদি না মেলে ?”

       
‘তাহলে আপনি একজন প্রতারক।"

      
“যদি মেলে ?”

       
‘তাহলে অনেকদূরে যাওয়ার পথ তৈরি হবে। ম্যাডাম ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন কাগজে হাতের ছাপ নিয়ে। তার খানিক বাদে একটি স্ত্রীলোক এল নতুন জামা নিয়ে । সেটা শরীরে গলিয়ে আকাশলাল স্ত্রীলোকটাকে অনুসরণ করে বেরিয়ে এল। স্ত্রীলোকটি বলল, ম্যাডাম বললেন, আপনি যেখানে ছিলেন সেখানে চলে যেতে । গাড়ি তৈরি।"

         
কিন্তু ওঁর সঙ্গে তো আমার কোনও কথাই হয়নি।" আকাশলাল বলে উঠল।

         
'আপনি নীচে চলুন।"

        
অগত্যা আকাশলালকে সেই মূল্যবান গাড়িতে চেপে ফিরে আসতে হল শহরে। গাড়িটা চলে যাওয়ার পর আকাশলাল লক্ষ্য করল আশেপাশে মানুষজন তাকে দেখছে। সম্ভবত গাড়িটিকে ওরা চেনে এবং গাড়ির মালিকানকেও । সে গম্ভীর মুখে একটা দোকানে ঢুকে কিছু খাবার চাইল । রুটি এবং জেলি খেয়ে রাতটা কাটিয়ে দেওয়া যাবে । ভাগিসের পয়সা তার পকেটে আছে । এবং তখনই খেয়াল হল ভার্গিসের সঞ্চয় থেকে নেওয়া টাকা সে রেখেছিল শার্টের পকেটে আর শার্টটা ম্যাডামের বাড়িতে ছেড়ে এসেছে। প্যান্টের পকেটে এখন সামান্য খুচরা পড়ে আছে।

         
দোকানদার অন্য খদ্দের নিয়ে তখনও ব্যস্ত। আকাশলাল চুপচাপ বেরিয়ে এর বাইরে। ঘরে গিয়ে ভার্গিসের সঞ্চয় থেকে আবার টাকা নিতে হবে। এর হিসেবে রাখতে হবে, ঠিকঠাক যাতে সুস্থ হয়ে ফিরে এলে সে লোকটাকে বলতে পারে।

         
ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় খবরটা কানে গেল। ছোট ছোট জটলায় যে বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে তা কানে যেতে সে থমকে গেল। ভার্গিস মারা গিয়েছে। একটু আগে টিভিতে খবরটা ঘোষণা করা হয়েছে। কেউ বা কারা ওর অক্সিজেনের পাইপ খুলে দিয়েছিল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য একে মারাত্মক হার্ট অ্যাটাক বলছেন।

         
হঠাৎ লোকটার মুখ মনে পড়তেই খুব কষ্ট হল আকাশলালের । আজ সকালে লোকটা সুস্থ ছিল । তার সঙ্গে কথা বলতে অসুস্থ হয় শেষ পর্যন্ত। এখন তাকে কারও কাছে হিসেবে দিতে হবে না। ভার্গিসের ওই ঘরে থাকলে আর কার কাছে তাকে জবাবদিহি দিতে হবে তাও জানা নেই। আকাশলালের মনে হল ম্যাডামকে টেলিফোন করা দরকার। ওই শার্টের পকেটে যে-কটা টাকা থাকুক তা তো ভার্গিসেরই।

         
খুচরো পয়সা দিয়ে পাবলিক বুথ থেকে টেলিফোন করল সে। এবার ম্যাডাম লাইনে এলেন অনেক তাড়াতাড়ি। আকাশলাল বলল, 'ভার্গিস মারা গিয়েছে।

       
 'এই খবর শহরের সবাই জানে। আপনি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ামাত্র লোকটা মরে যায়। আপনি যে আকাশলাল তা সন্দেহ করার লোক একজন কমে গেল। এখন থেকে আপনি নিজের পরিচয় গগনলাল হিসেবে দেবেন।'

       
"তার মানে ?"

        
আপনার অতীত জেনে এখন কোনও লাভ হবে না। পুলিশ আপনাকে একসময় খুঁজেছিল। এখন ওদের কাছে আপনি মৃত । যদি জীবিত থাকতেন তাতে ওদের কি এসে যেত। আপনি আর দেশের পক্ষে বিপজ্জনক নন। কিন্তু আমি চাই ব্যাপারটা আর কেউ না জানুক। "আগামীকাল সকালের মধ্যে বাকি দুজন সাক্ষী পৃথিবী থেকে সরে যাবে তখন আর কেউ কখনও আঙুল তুলতে পারবে না। ম্যাডামের গলায় আত্মবিশ্বাস ।

        
'আপনি কি বলছেন ? বাকি দুজন সরে যাবে মানে ?

        
যে আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছিল এবং তার প্রেমিকা। একটু ভুল হল। তৃতীয় আর একজন থেকে যাচ্ছে । যে ভদ্রমহিলার বাড়িতে আপনি উঠেছিলেন তিনি।'

       
 “কি আশ্চর্য! এরা সরে যাবে কেন ?"

        
‘এরা আপনার সম্পর্কে একটু বেশি জেনে ফেলেছে।'

        
'জেনে ফেললে ক্ষতি কি ?"

         
ক্ষতি অনেক। আপনার, আমার এই দেশের। আমি ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ এই তথা জানবে না। আর হ্যা, আপনি ভার্গিসের ঘর থেকে আর বের হবেন না। আপনার যা জিনিস বেঁচে থাকার জন্যে প্রয়োজন হবে তা ঠিক সময়ে পেয়ে যাবেন।

        
 'বেঁচে থাকার জন্যে আমার ঠিক কি প্রয়োজন তা আপনি জানেন ?

         
‘আমি যাকে তৈরি করেছি তার প্রয়োজন আমার চেয়ে বেশি আর কে জানবে।" লাইন কেটে দিলেন ম্যাডাম । আকাশলালের মনে হচ্ছিল তার ভেতরটা এখন একদম ফাকা হয়ে গেছে। তার নিজস্ব বলে কিছু নেই। কোথায় বসে কেউ রিমোট টিপবে এবং তার ইচ্ছেমতন তাকে চলতে হবে। এর থেকে পরিত্রাণ নেই। কিন্তু সেটা এখন থেকে না অনেক অনেক আগে থেকে চলে আসছে তা জানার কোনও উপায় নেই।

         
ভার্গিসের ঘরে শুয়ে বসে হাঁপিয়ে উঠছিল আকাশলাল। প্রতিদিন তার ঘরে সব রকম প্রয়োজনীয় জিনিস পৌছে যায়। সে লক্ষ করেছে তাকে এখানে নিজের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়নি। এই বাড়ির বাইরে দিনরাত তাকে পাহারা দেবার জন্যে লোক থাকছে।

         
গতরাতে মিনিস্টারকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ভার্গিসকে হত্যা করার অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে অক্সিজেনের পাইপ খুলে নেবার পেছনে মিনিস্টারের মদত ছিল। দ্বিতীয় খবর, বোর্ডের সদস্যদের নতুন করে ভোটাভুটির মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে হবে। আজ বিকেলে ম্যাডামের কাছ থেকে খবর পৌছেছে তৈরি থাকার জন্যে । বোর্ডের মেজরিটি যদি ম্যাডামের সমর্থকরা পায় তাহলে তিনি গগনলালের নাম মিনিস্টার হিসেবে সুপারিশ করবেন। আকাশলাল যে বিপ্লবের স্বপ্ন একদিন দেখেছিল তার ফল হল দেশশাসন করার ক্ষমতা পাওয়া। ম্যাডাম সেটা অন্য উপায়ে পাইয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু গগনলালের অস্বিত্ব একমাত্র তিনি জানেন বলে তার পরামর্শকে আদেশ বলে মনে করতে হবে গগনলালকে ।

        
আজ সন্ধ্যার পর আবহাওয়া খারাপ হল। রাত নটা নাগাদ দামি গাড়িটা এল তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। ড্রাইভার ছাড়া দ্বিতীয় মানুষ নেই সেই গাড়িতে। পেছনের আসনে বসামাত্র গাড়ি চলল। খানিকটা যাওয়ামাত্র ড্রাইভার তার মাথায় একটা ধাতব স্পর্শ পেল, 'গাড়ি ঘুড়িয়ে সীমান্তের দিকে নিয়ে যাও নইলে তোমার মাথা উড়ে যাবে।

        
লোকটা হকচকিয়ে গেল কিন্তু আদেশ পালন করতে বাধ্য হল। গাড়ির রেডিও তখনও ঘোষণা করে চলেছে বোর্ডের নির্বাচনে আকাক্তিক্ষত সদস্যরাই বিজয়ী হয়েছেন।

        
ম্যাডাম যথারীতি এবারও নিজেকে আড়ালে রেখেছেন। সাধারণ মানুষের প্রতি সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে বোর্ড দেশের মিনিস্টার হিসেবে নাম গ্রহণ করেছেন তিনি সম্পূর্ণ অপরিজিত মানুষ। তার নাম গগনলাল। এই অরাজনৈতিক মানুষটি নেতা হলে তার কাছ থেকে দেশের মানুষ অনেক ভাল কাজ পাবে বলেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

        
সীমান্তের রক্ষীরা গাড়ি দেখে বাধা দিল না। পাহাড়ি রাস্তার পাকে পাকে এখন ঘন অন্ধকার । গাড়িটা নেমে যাচ্ছিল। হঠাৎ রাস্তার পাশে আগুন জ্বলতে দেখা গেল। আগুনের পাশে একটি মেয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে কারও অপেক্ষায়। আকাশলাল জিজ্ঞাসা করল, ‘মেয়েটা কে ? ড্রাইভার জবাব দিল, ‘পাগলি । ওর প্রেমিককে যে পুলিশ মেরে ফেলেছে তা ও বিশ্বাস করে না। আকাশলাল মেয়েটাকে চিনতে পারল না। আগুন পেরিয়ে গাড়িটা নেমে যাচ্ছে নীচে, অনেক নীচে । সে অপেক্ষা করছিল গাড়িটাকে ছেড়ে দিতে পারে এমন একটা জায়গার জন্যে তারপর-? না, তারপর আর কিছু জানা নেই। যেমন নিজের অতীতটাকেও সে সঠিক জানে না।

 -------------******-----------