আট কুঠুরি নয় দরজা - Aat kuthuri noi dorja by সমরেশ মজুমদার - Samaresh Majumder, chapter name আট কুঠুরি নয় দরজা - তেত্রিশ

আট কুঠুরি নয় দরজা - তেত্রিশ

ঝরনার ধারে পাহারে গায়ে শরীরটা আড়ালে রেখে আকাশলাল দাঁড়িয়ে ছিল। যে আসছে তাকে না দেখে দেখা দেওয়া উচিত নয়। নিজের বৃদ্ধিসুদ্ধি ফিরে আসছে ভেবে সে খুশি হল। একটু বাদেই শব্দ টা কাছে এগিয়ে এল। হঠাৎই আড়াল থেকে একটা ঘোড়া এবং তার পেছনে সাধারণ চেহারার গাড়ি বেরিয়ে এল যেন গাড়িটি চালাচ্ছে সেই মেয়েটি, তার পাশে একজন তরুণ। এই কাকভোরে ওরা দুই গ্রাম থেকে এসে কোথায় মিলিত হল কে জানে!

           
আকাশলাল দেখতে পেল ঘোড়ার গাড়িটাকে থামিয়ে মেয়েটা ওপরের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলল, ছেলেটাকে । ছেলেটা মাথা নেড়ে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে । তারপর ঝরনার দিকে এগিয়ে এল। হয়তো মেয়েটা একাই তার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে কিন্তু ছেলেটা আর একটু এলে সে ধরা পড়ে যাবে। আকাশলাল বাধ্য হয়ে আড়াল থেকে বেরিয়ে এল।"

         
 তাকে দেখতে পেয়ে ছেলেটা বেশ অবাক হয়ে দাড়িয়ে গেল । দাড়িযে পেছন ফিরে মেয়েটাকে বলল । মেয়েটা এদিকে তাকাতেই আকাশলাল হাত নাড়ল । ততক্ষণে ছেলেটার পাশ কাটিয়ে সে কাছে এগিয়ে এসেছে। মেয়েটা ৰলল, “আপনাকে একদম চিনতে পারছি না।"

         
 ‘ব্যান্ডেজ খোলার পর কি রকম দেখাচ্ছে ? খুব খারাপ ?

         
 যাঃ! আপনি খুৰ সুন্দর। ও আমার বন্ধু'

         
"সাতজনের একজন ?"

         
একটু লজ্জা পেল না মেয়েটি। মাথা নেড়ে বলল, না। সাতজনের মধ্যে সেরা। আপনার সঙ্গী আজ ওর এই গাড়ি নিয়ে শহরে চলে যাচ্ছে। ওকেও সঙ্গে যেতে হৰে । আমার সেটা একদম ইচ্ছে নয়।'

       
"কেন ? আকাশলাল জিজ্ঞাসা করল।

      
 'লোকটাকে আমার একদম পছন্দ নয়।'

       
তোমার বন্ধু যদি আমাকে নিয়ে শহরে যেত তা হলে কি তুমি আপত্তি করতে ?

       
মেয়েটি হাসল, “না। আপনি ভাল লোক ।

        
আকাশলাল ছেলেটির দিকে তাকাল, তা হলে ভাই, তুমি আমার একটা উপকার করো। আমার এখনই এই জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। তুমি আমাকে এমন কোথাও পৌছে দাও যেখান থেকে আমি সদরে যাওয়ার গাড়ি পেয়ে যেতে পারি।"

       
 "এখনই ছেলেটা যেন অবাক হয়েই ছিল।"

        
'হ্যাঁ। নইলে তোমার বিপদ হতে পারে। আমার সঙ্গী আগে শহরে পৌছালে বীর বিক্রমকে মুক্ত করবে। সে ফিরে এলে তোমার বান্ধবী আর কখনই কোনও পুরুষকে বিয়ে করতে পারবে না।"

      
 আপনার বন্ধু কি আকাশলালের লোক ?

     
 ‘হ্যাঁ।’

      
কিন্তু আমরাও আকাশলালের সমর্থক।

      
বেশ । আকাশলাল তোমাদের কথা জানতে পারলে বীরবিক্রমকে এবছরের মধ্যে গ্রামে ফিরতে দিত না। এটা আমি বাজি রেখে বলতে পারি।"

       
ছেলেটা মেয়েটার কাছে এগিয়ে গেল। ওদের মধ্যে নিচু গলায় কিছু কথা হল যা শোনার চেষ্টা করল না আকাশলাল। মেয়েটা এবার তাকে বলল, আপনার শরীর খারাপ। আপনার যেতে খুব অসুবিধে হবে। আপনি কাল পর্যন্ত ঘরের বাইরে যেতে পারেননি।"

      
 আকাশলাল বলল, তুমি ঠিকই বলেছ বোন। কিন্তু চলে যাওয়া ছাড়া আমার উপায় নেই।'

     
 শেষ পর্যন্ত ওরা রাজি হল । মেয়েটা নেমে এল গাড়ি থেকে। ছেলেটি লাগাম ধরে আকাশলালকে ইশারা করতে সে মেয়েটির কাছে গেল, তোমাকে একটা অনুরোধ করব। আমাদের এই যাওয়ার কথা তুমি কাউকে বোলো না। এতে আমার যেমন ক্ষতি হবে তেমনি তোমার বন্ধুরও হবে।'

        
মেয়েটি হাসল, আপনি ভয় পাবেন না। আমি কাউকে কিছু বলব না।

       
 মিনিট পাঁচেক বাদে ওরা পাহাড়ি পথ দিয়ে চলছিল। ছেলেটি গম্ভীর মুখে লাগাম ধরে তার ঘোড়াটিকে চালনা করছিল। গাড়ি চলা শুরু করলে আকাশলাল বেশ বিপাকে পড়েছিল। গাড়ির দুলুনি তার শরীরকে স্বচ্ছদে রাখছিল না। একটু বাদেই পেট গুলিয়ে উঠল। বমি বমি পাচ্ছিল। কিন্তু সে নিজেকে ঠিক রাথকে প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। ধীরে ধীরে চলনটা অভ্যেসে এসে যাওয়ার পর সে কিছুটা সুস্থ বোধ করল।

       
এখন সূর্য উঠে গেছে কিন্তু রোদ পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়েনি। হিম হিম বাতাস আর ভেজা গাছপালার ছাউনির মধ্যে দিয়ে পাহাড়ি পথ বেয়ে গাড়িটা ছুটে যাচ্ছিল।

        
আকাশলাল জিজ্ঞাসা করল, “তোমার নাম কি ভাই ?

       
‘জীবনলাল ?

        
কি করো তুমি ?

        
চাষাবাদ দেখি । জিনিসপত্র বিক্রি করি। মাঝে মাঝে শহরে যাই, প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে এনে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিক্রি করি। আপনি কি করেন ? ‘

       
আমি ? আকাশলালের বিপ্লবী দলে আছি।

       
মিছিমিছি সময় নষ্ট করছেন। আকাশলাল মরে যাওয়ামাত্র বিপ্লব শেষ হয়ে গিয়েছ।

     
 ‘তুমি তাই মনে কারো ?

        হ্যাঁ। আমার মনে হয় আকাশলালও দেশের মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।
 

        কি রকম?
 

       
পুলিশ ওঁকে খুঁজে পাচ্ছিল না। উনি যদি কোনও মতে গ্রামে চলে আসতেন তা হলে আগামী একশো বছরেও খুঁজে পেত না। উনি নিশ্চয়ই সেটা জানতেন। অথচ উনি স্বেচ্ছায় মেলার মাঠে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা দিলেন । ওঁর মতো নেতা কেন ধরা দিতে যাবে ? উনি জানতেন না ধরা দেওয়ার মানে বিপ্লব শেষ হয়ে যাওয়া ?

      
 'হ্যাঁ। এটা ওর ভাবা উচিত ছিল।

       
'দেখুন না, ওঁর দেওয়ার পরই ডেভিডকে পুলিশ ধরে গুলি করে মারল। কয়েকদিন আগে ত্রিভুবনকে সীমান্তের কাছে পুলিশ হত্যা করেছে।’

        
তুমি এদের চোখে দেখেছ ?

        
না। নাম শুনেছি।"

       
"হায়দারকে দেখেছ ?

       
 না কাল একটা লোক এসেছিল আমার গাড়িটার জন্যে। সন্দেহ হচ্ছিল খুব কিন্তু লোকটা অন্য নাম বলেছে। শুনলাম ও আপনার সঙ্গে থাকে।"

        
কিন্তু আকাশলালালের মৃতদেহ তো কবর থেকে ওর বন্ধুরা তুলে নিয়ে গেছে।

       
 সেটা জানি। কিন্তু মৃত মানুষ বিপ্লব করে না।

        
আকাশলাল মাথা নাড়ল। কথাটা ঠিক। মৃত মানুষ বিপ্লব করে না। সে নিজে এখন সব অর্থে মৃত। হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় সে প্রশ্ন করল, “তুমি কখনও আকাশলালকে দেখেছ ?

       
 জীবনলাল এমন ভাবে তাকাল যেন কোনও ছেলেমানুষি প্রশ্ন শুনল। সে হাসল, আকাশলাল কোথায় থাকত কেউ জানত না । কিন্তু তাকে দ্যাখেনি এমন মানুষ এদেশে খুঁজে পাবে না। সামনা সামনি না দেখতে পেলেও ছবিতে দেখেছে। এমন কোনও এলাকা নেই যেখানে তার ছবি টাঙিয়ে ধরিয়ে দিতে বলিনি এই সরকার।’

      
‘তুমি তা হলে দেখলেই চিনতে পারবে ?

       
পারতাম। এখন তিনি নেই, সেই সুযোগও আমি পাব না।

      
 আকাশলাল নিঃশ্বাস চাপল । বেশ জোর দিয়ে কথাগুলো বলল ছেলেটা। ও যে মিথ্যে বড়াই করছে, তা মনে হচ্ছে না। তা হলে তার মুখে কি এমন অপারেশন হয়েছে যাতে চেহার এত পাল্টে গেল ? সেই ডাক্তার দম্পতি, যার কথা হায়দার বলেছিল, যদি তার মুখে অপারেশন করে থাকে তা হলে কেন করল ? যাতে তার চেহারা বদরে যায়, লোকে দেখে চিনতে না পারে সেই কারণে কি ? আকাশলালেরর মনে দুটো প্রশ্ন তীব্র হল। তার পরিবর্তিত মুখের সঙ্গে কে কে পরিচিত ? অপারেশন করার সময় ডাক্তার নিশ্চয়ই দেখেছিল। কিন্তু ব্যান্ডেজ খোলার সময় না থাকায় মুখের পরিবর্তিত আকার তার অজানা থেকে গেছে। হায়দার তার সঙ্গে ছিল, ধরে নেওয়া যেতে পারে কিন্তু ব্যান্ডেজ খোলার সুযোগ সে পায়নি। এই জীবনলাল যদি তাকে আকাশলাল বলে চিনতে না পারে তা হলে বদলে যাওয়া মুখ দেখে হায়দারও তাকে চিনতে পারবে না ।

          
দ্বিতীয় চিন্তাটা জোরালো। সত্যি কি সে নিজে আকাশলাল ? তার স্মৃতিতে যা কিছু শেষ পর্যন্ত ধরা দিচ্ছে তাতে আকাশলাল হবার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সেই ফাকগুলো যা সে মনে করতে পারছে না, তা মনে না পড়া পর্যন্ত সে নিজেকে আকাশলাল ভাবতে পাচ্ছে না। বোঝা যাচ্ছে দেশের মানুষের কাছে আকাশলাল মৃত। লোকটা স্বেচ্ছায় পুলিশের হাতে ধরা দিয়েছিল। কেন ? এ প্রশ্নের উত্তর তার নিজের জানা নেই। ধরা পড়ার পর তার মৃত্যু হল কিভাবে ? মৃত্যুর পরে তাকে কবর দেওয়া হয়েছিল। সেই কবর থেকে যদি সঙ্গীরা বের করে আনে তা হলে মৃত মানুষকে কি করে আবার জীবন্ত করে তুলল ডাক্তার। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য ? ফলে আকাশলাল কিছুতেই বেঁচে থাকতে পারে না। তা হলে সে কে ?

          
প্রশ্নটা তাকে পীড়িত করলেও সে ধন্ধে পড়েছে স্মৃতিগুলোর জন্যে, যা তার মনে মেঘের মতো ভেসে আসছে মাঝে মাঝে । এগুলো কেউ তাকে বলেনি। অথচ সে মনে করতে পারছে। তা হলে এর পেছনে সত্য আছে। আর একটা কথা, গতকাল খাট থেকে নামবার সময় পড়ে গিয়ে আঘাত লাগার পর থেকে সে এগুলো মনে করতে পারছি। কেন ?

          
আকাশলাল জীবনলালকে বোঝাল আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের অত্যাচারে সে এমন অসুস্থ ছিল যে দেশের খবরাখবর জানার সুযোগ হয়নি । এমনকি আকাশলাল কি ভাবে মারা গেল তাও তার জানা নেই। ফিরে গিয়ে বোকা বনে যাওয়ার আগে সে যদি এ ব্যাপারে জানতে পারে তা হলে ভাল হয়। জীবনলাল ছেলেটি সদাসিধে। সে গল্প করার সুযোগ পেয়ে এক এক করে সব ঘটনা বলে যেতে লাগল। অবশ্য এই বর্ণনার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার খুঁটিনাটির মিল ছিল না। সরকারি রেডিও এবং মুখে মুখে প্রচারিত ঘটনায় যে কল্পনার মিশেল থাকে তাকেই জীবনলাল সত্য ভেবে বলে গেল। তবু তার মধ্যে অনেকটা জেনে নিতে পারল আকাশলাল । সে আরও জানতে পারল, আকাশলালকে যে ডাক্তার চিকিৎসা করত সেই বুড়োমানুষটা সীমান্ত পার হতে গিয়ে মরে গেছে।

           
অনেক অনেক দিন বাদে বিছানা থেকে সরাসরি উঠে যে পরিশ্রম আজ হয়েছে সেটা টের পাওয়ার আগেই গাড়ির একপাশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল আকাশলাল। গাড়ির চলার সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরে দুলুনি লাগছিল তাতে ঘুমটা আরও গভীর হয়ে গেল। তার মাথাটা কাঠের সিটে মাঝে মাঝে ঠুকে গেলেও সে টের পাচ্ছিল না।

          
 জীবনলালের বয়স বেশি নয়। কিন্তু সে উৎসাহী এবং কর্মঠ বলে ওই অল্প বয়সেই ভাল রোজগার করতে আরম্ভ করেছে। অবশ্য গায়ের মানুষের কাছে যে রোজগার ভাল বলে মনে হয় সেটা ওই রকমই। ছেলেটার সঙ্গে প্রেম করার জন্যে অনেক মেয়ে মুখিয়ে আছে, কিন্তু তার মন সে দিয়ে ফেলেছে বীরবিক্রমের বউকে। অবশ্য আর এক বছর পরে ওকে কারও বউ বলা যাবে না। গ্রামের আইন অনুযায়ী যত বছর আলাদা থাকলে এবং সেই সময় সন্তান না জনালে স্ত্রীর ওপর স্বামী অধিকার হারাবে তত বছর পার হতে একবছর বাকি আছে। বীরবিক্রমের জেল খেটে বেরিয়ে আসার কোনও সম্ভাবনা নেই। যদিও জীবনলাল আকাশলালের সমর্থক এবং সেই কারণে বীরবিক্রমের মিত্র তবু এই একটি ক্ষেত্রে সে লোকটাকে পছন্দ করছে না। তাছাড়া বিয়ের পর লোকটা বউকে যত্ন করেনি, মাত্র চারদিনের জন্যে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল আর তা থেকেই প্রমাণ হয় ও বউকে ভালবাসে না । সে যে বীববিক্রমের বউকে ভালবাসে তা অনেকেই পছন্দ করে না। সে জানে অনেকেই মেয়েটার সঙ্গে মিশে ফালতু মজা করতে চায়। কিন্তু মেয়েটা যে তাকে ছাড়া আর কাউকে পাত্তা দেয় না এ-কথাটাও তো ঠিক। তাই কাল রাত্রে যখন মেয়েটা তাকে বলল, অসুস্থ মানুষটাকে একটু ঘোড়ার গাড়িতে চাপিয়ে ঘোরাতে হবে তখন সে আপত্তি করেনি। বস্তুত গাড়িটা তার গর্ব। এবং ঘোড়াটাও । আশেপাশের কয়েকটা গ্রামেও এমন ঘোড়ার গাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে না। কাল বিকেলে যখন লোকটা তার গাড়ি ভাড়া করতে এল তখন সে রাজি হতে চায়নি। অনেক কম টাকা দিচ্ছিল লোকটা। ব্যবসা করতে এসে সে খদের পেলে ফিরিয়ে দেয় না। যদিও লোকটাকে পছন্দ হচ্ছিল না তবু টাকাটার জন্যে একবারে হ্যা বলেনি। এখন মনে হচ্ছে সেটা না বলে ঠিকই করেছে। এই লোকটা যে তার পাশে ঘুমিয়ে আছে সে যে অনেক টাকা দেবে এমন ভরসা নেই কিন্তু যদি বীববিক্রমের জেল থেকে বেরিয়ে আসা বন্ধ করতে পারে তা হলে টাকা না পেলেও তার চলবে ।

           
 ঘন্টা তিনেক টানা চলার পরে গাড়িটা একটা ছোট্ট গাহাড়ি গ্রামে ঢোকার পর জীবনলাল ঠিক করল আধঘন্টাটাক ঘোড়াটাকে বিশ্রাম দেওয়া দরকার। এই গ্রামটা ছোট কিন্তু পথের ধারে একটা চা এবং রুটিতরকারির দোকান আছে। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হনি। জীবনলাল গাড়ি দাড় করিয়ে গাড়ির পেছন থেকে কিছু ঘাস টেনে বের করে ঘোড়াটার সামনে রেখে তার সঙ্গীর দিকে তাকাল। লোকটা মরে গেল নাকি । গাড়ি থেমেছে অথচ ওর ঘুম ভাঙছে না ? সে কাছে গিয়ে আকাশলালের হাটুতে চড় মারল এই যে! উঠবেন ?

          
দ্বিতীয় বারে আকাশলাল চোখ মেলল। যেন গভীর কুয়োর নীচে থেকে যে ওপরে উঠে আসছে এমন মনে হল । চোখ খুলে চার পাশটা অচেনা মনে হল তার।

         
জীবনলাল জিজ্ঞাসা করল, ‘চা খাবেন ?

         
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল সে । জীবনলাল বলল, আপনার শরীর ঠিক আছে তো ?

        
 হ্যাঁ। নীচে নামার চেষ্টা করে আকাশলাল বুঝতে পারল তার মাথা ঘুরছে। সে কোনও রকমে মাটিতে সোজা হয়ে দাড়াতেই জীবনলাল হাকল, 'চারটে রুটি, সবজি আর দুটো চা।”

        
 রুটি এবং সবজি শব্দ দুটো কানে যাওয়ামাত্র আকাশলাল টের পেল তার খুব খিদে পেয়েছে। কিছু খেলে শরীরের আমার হবে সে টলতে টলতে দোকানের সামনে রাখা কাঠের বেঞ্চিতে গিয়ে বসে পড়ল।

         
তার চোখের সামনে একটা ঢালু উপত্যকা রোদে ঝলমল করছে। আহা, কি মিষ্টি রোদ । পৃথিবীটাকে মাঝে মাঝে এমন সুন্দর লাগে । মনটা ঈষৎ ভাল হয়ে গেল তা র ।

         
পাশাপাশি বসে খাবার খেয়ে নিল জীবনলাল। খাওয়া শেষ করে জণ পান করে বলল, একটা কথা, আপনার নামটা জানা হয়নি ।

         
আকাশলাল ছেলেটার দিকে তাকাল। তারপর হেসে বলল, আমাকে আঙ্কেল বলো ।

        
'ও ঠিক আছে। আপনার কাছে টাকা আছে তো ?

         
টাকা ?

            হ্যাঁ
, পথে কয়েকবার খাবারের দাম দিতে হবে। তা ছাড়া আমার গাড়ির ভাড়া। ভাল খদেররা আমাকে খাওয়ার টাকা দিতে দেয় না অবশ্য ।"

          
'আমার কাছে তো কোনও টাকা নেই।'

          
‘তার মানে ?' জীবনলাল আঁতকে উঠল।

          
‘আমি অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়েছিলাম এতদিন। তোমার বান্ধবী বলতে ওর নির্দেশ মতন আজ চলে এসেছি। আমি টাকা কোথায় পাব ?"

         
'সে কি। তা হলে এসব খরচ কে দেবে ? জীবনলাল রেগে গেল ।

          
দ্যাখো ভাই, আমি বুঝতে পারছি সমস্যাটা। তবে তুমি যদি আমাকে বিশ্বাস করো, তা হলে আমি কথা দিচ্ছি যা খরচ হবে দ্বিগুণ আমি শোধ করে দেব।'

         
‘দূর মশাই। আমি আপনার নাম পর্যন্ত জানি না, বিশ্বাস করব কি ? জীবনলাল বলতেই দোকানি বলে উঠল, 'জীবনলাল, তুমি অর্ডার দিয়েছ, দাম তোমার কাছ থেকে নেব ।

          
ঠিক আছে ঠিক আছে। সেটা তোমাকে ভাবতে হবে না। দোকানিকে ঝাঝিয়ে কথাগুলো বলে জীবনলাল তাকাল, আপনার কাছে কিস্যু নেই ?

         
সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল আকাশলালের। সে পকেটে হাত রেখে বলল, ‘আছে। আমার কাছে একটা রিভলভার আছে। ওটা বিক্রি করলে কত দাম পাওয়া যাবে ?

        
রিভলভার ? বিড়বিড় করল জীবনলাল ।

       
“হ্যাঁ । নেবে ?’

         
ঠিক তখনই গাড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল। ওরা মুখ ঘুরিয়ে দেখল দু-দুটো পুলিশ-জিপ উঠে আসছে নীচের রাস্তা ধরে। জিপ দুটোয় অস্ত্রধারী পুলিশ ভর্তি।

         
ঠিক চায়ের দোকানের সামনে জিপ দুটো দাড়িয়ে গেল। আকাশলালের বুকের ভেতর শব্দ হচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল এখনই পালানো দরকার। কিন্তু কি করে সে এখান থেকে পালাবে ? তার দুটো পায়ে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই এখন।

         
প্রথম জিপ থেকে কয়েকজন পুলিশ নামল। একজন অফিসার দোকানিকে জিজ্ঞাসা করল, কুংলু গ্রামটা এখান থেকে কত দূর ?

         
বেশি দূরে না। এই জীবনলাল, কত দূর হবে ? দোকানদার এদিকে তাকাল। জীবনলালের ভাল লাগছিল না। পুলিশদের সে সহ্য করতে পারে না। তাছাড়া তার খদ্দেরের টাকা পয়সা নেই জেনে মেজাজ খারাপ হয়ে ছিল। সে বলল, অনেক দূর ।

          
অফিসার সামনে এগিয়ে এসে সরাসরি একটা বুট পরা পা জীবনলালের ভাজ করা হাঁটুতে রেখে জিজ্ঞাসা করল, 'দোকানি বলছে বেশি দূরে নয় তুই বলছিস অনেক দূর কোনটা সত্যি, মিথ্যে কথা বললে চামড়া ছাড়িয়ে নেব।”

         
হাঁটুর ব্যথা সহ্য করে জীবনলাল বলল, ‘হেঁটে গেলে আট ঘন্টা, ঘোড়ার গাড়িতে চার ঘন্টা। আমি কি করে কাছে বলব ?

         
বুট সরিয়ে নিল অফিসার, "তোর নাম কি ?

        
‘জীবনলাল ।

         
‘আকাশলাল তোর-কে হয় ?

        
‘কেউ নয় ।"

        
‘কুংলু গ্রামে দুটো বিদেশি অনেকদিন ধরে রয়েছে। জানিস ?

         
না। আমি ওই গ্রামে থাকি না। জীবনলাল মাথা নাড়ল, ও থাকত।

        
'আই, তোর নাম কি ?’ অফিসার আকাশলালের দিকে তাকাল ।

        
'গগনলাল ।"

       
"বাঃ । নামের কায়দা খুব । গগনলাল ? আকাশলাল কেউ হয় ?

       
"সে তো মরে গেছে ।"

       
‘শালা মরে গিয়েও ভূত হয়ে আমাদের নাচাচ্ছে। তোদের গ্রামে বিদেশি আছে ?

       
'হ্যাঁ। দুজন। আকাশলাল বলল ।

       
তুই দেখেছিস ?

      
"হ্যাঁ । একজনের মাথায় ব্যান্ডেজ ।”

      
খবর পেয়ে অফিসারকে খুশি দেখাল। "তোরা আমাদের সঙ্গে চল ।

      
আকাশলাল মাথা নাড়ল, ‘মরে যাব সাহেব। আমার শরীর খুব খারাপ। মুখ দিয়ে রক্ত উঠছে। শহরের হাসপাতালে যাচ্ছি ডাক্তার দেখাতে।'

      
সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ছিটকেই সরে গেল অফিসার একটু বাদে জিপ দুটো উঠে গেল ওপরে। জীবনলাল তারিফ করল, তোমার বেশ বুদ্ধি। তা আঙ্কল, মুখ দিয়ে রক্ত বেরুবার মতো গননলাল নামটাও কি বানানো।

            
আকাশলাল হাসল। উত্তর দিল না। দাম মিটিয়ে দিয়ে জীবনলাল বলল, “শোন তোমাকে টাকা পয়সা দিতে হবে না। কিন্তু কথা দিতে হবে যাতে বীববিক্রম এব বছরের মধ্যে ফিরে না আসে সেই ব্যবস্থা তুমি করবে।’

          
‘কথা দিলাম '

          
পরের দিন সন্ধের মুখে ওরা রাজধানীতে পৌছে গেল। পথে যে কটা পুলিশি জেরার সামনে পড়েছিল তা পেরিয়ে আসতে তেমন অসুবিধে হয়নি। আকাশলাল খুবই নিশ্চিত হয়েছিল এই ভেবে যে হয় সে আদৌ আকাশলাল নয় অথবা মুখের ওপর অপারেশন হওয়ায় তার চেহারা এদম বদলে গেছে।

         
শহরে ঢুকে জীবনলাল জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কোথায় যাবে আঙ্কল ?

         
আকাশলাল বলল, জানি না। দেখি ।

        
"তোমার পকেটে তো পয়সাও নেই।"

         হ্যাঁ।  কিন্তু আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকলাম ভাই।'