আট কুঠুরি নয় দরজা - Aat kuthuri noi dorja by সমরেশ মজুমদার - Samaresh Majumder, chapter name আট কুঠুরি নয় দরজা - বত্রিশ

আট কুঠুরি নয় দরজা - বত্রিশ

সন্তর্পণে ব্যান্ডেজটা মুখে জড়িয়ে ঘরে ফিরে এল সে। একটু চিন্তা করলেই মাথার ভেতর যে কষ্টটা দপদপিয়ে ওঠে সেটা জানান দিচ্ছে। খাটে শুয়ে সে সামনের দিকে তাকাতেই হায়দারকে দেখতে পেল । হায়দার তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

            
অস্বস্তি হল ওর। হায়দারকে তার চেনা চেনা মনে হচ্ছে কিন্তু ঠিক ঠাওর করতে পারছিল না । হায়দার তার শক্র না বন্ধু তাও বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে। বরং যে-বুড়োমানুষটা একটু আগে এসেছিল তাকে অনেক স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছিল । সে দেখল হায়দার চোখ ফিরিয়ে জানলার বাইরে তাকাল । যেন খুব দুশ্চিন্তায় পড়েছে এমন ভাব। হঠাৎ মনে হল ওই লোকটা তাকে আটকে রেখেছে। এই ঘরে এমন অসুস্থ হয়ে তার থাকার কথা নয়। তবে তাকে এখানে আটকে রাখার পেছনে কি উদ্দেশ্য কাজ করছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। ও কি তাকে মেরে ফেলতে চায়। অথবা কারও হাতে তুলে দেবার জন্যে অপেক্ষা করছে ? মাথার যন্ত্রণা তীব্র হয়ে উঠতেই সে অস্ফুট শব্দ উচ্চারণ করল । চমকে তার তাকাল। তারপর দ্রুত উঠে এল পাশে, শরীর খারাপ লাগছে নাকি ?

            
সে মাথা নাড়ল, না।

            
হায়দার কয়েক মুহুর্ত চুপ করে রইল। তারপর বলল, তোমার কি সব কথা মনে আছে ?

            
সে চোখ বন্ধ করল। কি উত্তর দেওয়া উচিত ? কোনও কথা মনে ঠিকঠাক আসছে না, সেটা জানিয়ে দেবে ?

            
উত্তর না পেয়ে হায়দার বলল, “এইজন্যে আমি ঝুঁকি নিতে নিষেধ করেছিলাম। যে কোনও মুহুর্তে আমার মৃত্যু হতে পারত। কবরের নীচে শুয়ে যে বেরিয়ে আসে তার কাছে জীবনমৃত্যু সমান। তুমি ভাগ্যবান যে এখনও বেঁচে আছ। কিন্তু কিভাবে বেঁচে আছ তা তোমার জানা দরকার। শুনতে পাচ্ছ আমার কথা ?’

           হু
।’ সে খুব নিচু স্বরে জানাল ।

         
‘দ্যাখো আকাশলাল, তুমি নেতা আমাদের দেশের নেতা। তোমার মুখের দিকে সমস্ত দেশের নির্যাতিত মানুষ তাকিয়ে আছে। কিন্তু অপারেশনের ফলে যদি তোমার মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্থ হয় তা হলে তুমি কারও উপকারে আসবে না। আমার কথা বুঝতে পারছ ? হায়দার ঝুঁকে কথা বলছিল।

            
‘হ্যাঁ।’ সে ঠোট ফাঁক করল।

           
 পুলিশ তোমাকে খুব শিগগির আবার খুঁজতে শুরু করবে। এখন পর্যন্ত তেমার ডেডবডিরখবর নিচ্ছিল ওরা। কিন্তু আমাদের কিছু মানুষকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। যে কোনও মুহুর্তেই তারা জেনে যেতে পারে তুমি বেঁচে আছ। আমার কথা তুমি বুঝতে পারছ ?

            
সে উত্তর দিল না। তার মস্তিষ্ক কাজ করছিল না। অদ্ভুত অবসাদ তাকে আচ্ছন্ন করে ঘুমের দেশে নিয়ে গেল। হায়দার সেটা লক্ষ করে বিরক্তি নিয়ে সরে এল। তার মনে হল সেই মানুষটা আর নেই। এখনকার আকাশলালকে পাহারা দেওয়া আর মৃতদেহ আগলে বসে থাকা একই ব্যাপার।

            
ঘুম ভাঙতেই সে জানলারর দিকে তাকাল। কেউ নেই ওখানে। জানলাটাও বন্ধ। ঘরে একটা আবছা অন্ধকার। সে মুখ ফেরাল, কেউ নেই এখানে। হায়দার কোথায় গেল ? টয়লেটের দরজাটাও খোলা । সে উঠে বসল। তোমার মস্তিষ্ক যদি ক্ষতিগ্রস্থ হয় তা হলে তুমি কারও উপাকারে আসবে না। হায়দারের কথাগুলো মনে পড়তেই সে শক্ত হল। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কি না সে জানে না কিন্তু কিছুই মনে পড়ছে না এখনও । উপকারে না এলে হায়দার কি তাকে মেরে ফেলবে ? সে শঙ্কিত হল।

           
তাকে আকাশলাল বলে ডেকেছে হায়দার। ওটাই তার নাম। তার অপারেশন হয়েছিল, কবরের নীচে ছিল। সেখান থেকে নিশ্চয়ই তুলে আনা হয়েছে। তার মানে মরে গেলেও আবার তাকে বাচানো হয়েছে। সেটা কিভাবে সম্ভব হল তা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু পুলিশ তার খোজ করছে কারণ দেশের নির্যাতিত মানুষের জন্যে সে কিছু করতে গিয়েছিল। কি সব ধোয়াশা ধোঁয়াশা কথা।

          
আকাশলাল খাট থেকে অন্যমনস্ক হয়ে নামতে যেতেই টাল সামলাতে পারল না। উল্টে পড়ে গেল মেঝের ওপর। মাথাটা বেশ জোরেই ঠুকে গেল খাটের পায়ায়। তীব্য ব্যাথায় চিৎকার করে উঠল সে। সেই চিৎকার শুনে কেউ ছুটে এল না। বেশ কয়েক মিনিট মড়ার মতো পড়ে রইল আকাশলাল। দপদপ করছে সমস্ত মাথা। সেটা একটু কমতে সে টলত টলতে টয়লেটে পৌছে গেল। শরীরের ভার হালকা করে মনে হল অনেকটা ভাল লাগছে। আয়নার দিকে তাকাল সে । ব্যান্ডেজ মোড়া মুণ্ডুখানা কি বীভৎস দেখাচ্ছে। সে নিজের বুকে হাত দিল । চামড়া উচু ঠেকল। ক্রমশ হাত নামাতে সে একটা সরলরেখায় মোটা আলোর মত কিছু টের পেল বুকের ওপর। চটচলদি জামা সরিয়ে সে শুকিয়ে যাওয়া সেলাই দেখতে পেল। অপারেশন। এখানে অপারেশন হয়েছিল। কেউ চায়নি, সে জোর করেছিল। হঠাৎ বুড়ো ডাক্তারের মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠতেই আকাশলাল উত্তেজিত হল। হ্যা, মনে পড়ছে। তার একটু একটু করে মনে পড়ছে। বুড়ো ডাক্তারকে রাজি করতে তার অনেক সময় লেগেছিল। এ রকম এক্সপেরিমেন্ট এখনও পৃথিবীতে কেউ করেনি। কিন্তু বুড়ো নামের জন্যে লোভী হয়ে ছিল শেষ পর্যন্ত। ভার্গিসের হাত থেকে বাঁচার আর কোনও পথ ছিল না। ভার্গিস ? একটা বিশাল শরীরের মানুষকে মনে পড়ল। বুলডগ । হাতে চুরুট নিয়ে সারা দেশ খুঁজে বেড়াচ্ছে তাকে। তারপরেই খেয়াল হল হায়দারের কথা। হায়দার বলছিল ভার্গিসের আর চাকরি নেই। কেন ?

            
এলোমেলো ভাবে ছুটে আসা স্মৃতিকে সাজাতে অনেক সময় লাগলেও কিছু কিছু জায়গায় জোড় লাগছিল না। খাটে শুয়ে শুয়ে আকাশলাল সেই চেষ্টা করছিল। কিছু কিছু ঘটনার কথা স্পষ্ট মনে পড়ছিল আবার কোনও কোনও মুখ বা ঘটনা উধাও । শেষপর্যন্ত আকাশলাল যা ভাবতে পারল তা হল স্বৈরাচারী রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল সংগ্রাম চালিয়েছিল তারা। দেশের অনেক মানুষ শুধু প্রাণের ভয়ে এবং সংস্কারের কারণে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়নি। তার সঙ্গী-সাথীদের অনেকেই পুলিশের হাতে মারা গিয়েছে। তার মাথার মূল্য অনেক টাকা ঘোষণা করা হয়েছিল। ভার্গিস নামের এক পুলিশ অফিসার তাকে ধরার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। সেই বুড়ো ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে সে ধরা দেয়। বুড়ো তার বুকের মধ্যে অপারেশ করেছিল। প্রথমবার কে জানত। দ্বিতীবার, যখন তাকে মৃত ভেবে পুলিশ কবর দিয়েছিল তখন সঙ্গীরা সেখান থেকে তুলে নিয়ে আসার পর বুড়ো অপারেশন করে বাচিয়ে তোলে। সে যে বেঁচে আছে তার প্রমাণ এ সব ভাবতে পারছে। কিন্তু অনেক কিছু তার মনে আসছে না। তার নিজস্ব বাড়ি কোথায় ছিল ? তার কোনও আত্মীয়স্বজন আছে কি না ? এই ছোট্ট ঘরে সে কেন পড়ে আছে ? আর ওই লোকটা যে তাকে পাহারা দিচ্ছে সে তার মিত্র কি না! লোকটাকে সে আগে দেখেছে। কিন্তু ডেভিড অথবা ত্রিভুবনের সঙ্গে এই লোকটার মুখ গুলিয়ে যাচ্ছিল তার কাছে। ত্রিভুবন অথবা ডেভিডের নাম স্পষ্ট মনে আসছিল না ।

            
দরজায় শব্দ এল । কেউ সেটা খুলল। পায়ের আয়োজ কাছে আসার পর সে মেয়েটিকে দেখতে পেল। ওর হাতে দুটো কৌটো। চোখাচোখি হতে হাসল মেয়েটা, তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘খিদে পেয়েছে ?”

           
আকাশলাল মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।’

          
মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে একটা কেটা নিয়ে এগিয়ে এল। ঢাকনা খুলে সামনে ধরে জিজ্ঞাসা করল, উঠে বসে খেতে পারেনা ?

           
আকাশলালের ভাল লাগল। সে ধীরে ধীরে উঠে বসে দেখল দুটো মোটা রুটি আর আলুর তরকারী রয়েছে কৌটোর ভেতরে। সে হাত বাড়িয়ে কোটোটা নিল ।

        
 মেয়েটা বলল, ‘ওরা বলে তোমার মাথায় অপারেশন হয়েছে। কিন্তু তা হলে মুখ ঢাকা থাকবে কেন ? মুখে কি হয়েছিল ?

        
 ‘আমি জানি না।" রুটি ছিড়ল আকাশলাল । খুব শক্ত।

       
 মেয়েটা হাসল, “তোমার মুখ কেমন দেখতে আমি জানি না।"

       
 কি জবাব দেবে আকাশলাল । সে রুটি চিবোতে লাগল। চোয়ালে সামান্য চিনচিনে ব্যাথা হলেও সে উপেক্ষা করল। মেয়েটা বলল, “তোমার সঙ্গী খুব রাগী নয় ?

       
'জানি না।" গ্রাম্য রান্নাও এখনও ভাল লাগছে আকাশলালের ।

         
ও বলেছে আর কেউ যেন এ ঘরে না ঢোকে। তোমাদের পুলিশ খুঁজছে ?

      
 “কি জানি!'

       
‘তোমাকে যেদিন প্রথম এখানে ভ্যানে চাপিয়ে এনেছিল সেদিন তুমি মড়ার মতো শুয়েছিলে । আমি ভেবেছিলাম ঠিক মরে যাবে।'

      
‘মরে তো যাইনি।”

     
'হুম।

      
এক একজনের জান খুব কড়া হয়।"

    
 "এই জায়গাটার নাম কি ?’

      
কুংলু।

      
এখান থেকে শহর কতদূরে ?

     
'একদিন হাটলে একটা শহরে যাওয়া যায়। সেখানে দুটো সিনেমা হল আছে বলে শুনেছি।

     
'ও। বড় শহর ? সেখানে মেলা হয় ?

     
'ও, সে অনেকদূর । গাড়িয়ে একদিন লাগে ।

      
‘তুমি খুব ভাল মেয়ে।'

      
"ডে বলে না এ-কথা।" মেয়েটা যেন লজ্জা পেল।

        
‘তোমার বিয়ে হয়নি ?

         
হয়েছিল। কিন্তু তাকে পুলিশ জেলে রেখে দিয়েছে।"

        
"কেন ?"

        
"কেন আবার ? সে আকাশলালের দলে কাজ করত। সবাই বলে আর কখনও সে ফিরে  
আসবে না। আর এক বছর দেখি-।"

        
আকাশলালের বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠল, তারপর ?

        
তারপর আবার বিয়ে করব। আমাকে বিয়ে করার জন্যে সাতজন হ্যা করে বসে আছে।  
আমিও তো মানুষ। কতদিন আর উপোস করে বসে থাকি বলো ?

       
'ওই সাতজন এই গ্রামের ছেলে ?

       
না। চারজন বাইরের। একজনের আবার ঘোড়ার গাড়ি আছে।’

       
তুমি কি তাকেই বিয়ে করবে ?

       
‘দেখি। ঘোড়ার গাড়িতে চড়তে আমার খুব ভাল লাগে। আমি চালাতেও পারি। তুমি যদি চড়তে চাও তা হলে আমি ব্যবস্থা করতে পারি।"

       
‘সেটা মন্দ হয় না।’

        
কিন্তু ওই গাড়ি এই গ্রামে আনা যাবে না। সবার চোখ টাটাবে ঘোড়ার গাড়িতে যতি তোমাকে উঠতে হয়, তা হলে হেঁটে নীচের ঝরনা পর্যন্ত যেতে হবে। ওইখানে আমি গাড়িটাকে নিয়ে আসতে পারি, ও রাগ করবে না।"

       
‘তার মানে তুমি ওকেই বিয়ে করবে।'

       
উপায় কি ? সাতজনের মধ্যে ওই সবচেয়ে ভাল। তবে একবছর অপেক্ষা করতে হবে আমাকে ?

      
‘তোমার স্বামীর নাম কি ?

      
‘বীর বিক্রম ।’

       
খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। আকাশলাল কেীটোটা ফেরত জল চাইলে মেয়েটা ঘরে এক কোণে রাখা পাত্র থেকে কৌটোয় ঢেলে এনে খাওয়াল।

       
আকাশলাল জিজ্ঞাসা করল, তা হলে কখন তুমি আমাকে ঘোড়ার গাড়িতে চড়াচ্ছ ?

      
‘কাল ভোরবেলা। খুব ভোরে। সে সময় গ্রামের সবাই ঘুমিয়ে থাকে। কিন্তু তুমি কি রাস্তা চিনে ঝরনার ধারে একা যেতে পারবে ?"

        
'কিভাবে যাব বলে দাও।”

        
মেয়েটা চোখ বন্ধ করে ভেবে নিয়ে বলল, এখান থেকে বেরিয়েই বাদিকে হাটবে। সরু পায়ে চলা পথ সোজা নীচে নেমে গিয়েছে। তারপর একটা মাঠ পাবে। মাঠের ডানদিক দিয়ে একটু এগোলেই নীচে আর একটা রাস্তা দেখতে পাবে। তার গায়েই ঝরনা।'

       
‘কাল ভোরবেলায় তো ?’

        হ্যাঁ।
’ মেয়েটা কয়েক পা পিছিয়ে গেল, কিন্তু এমন মুখ নিয়ে কি যাওয়া ঠিক হবে ?

       
আমি ব্যান্ডেজ খুলে যাব। তোমার চিন্তা নেই।’

      
মেয়েটা খালি কৌটো নিয়ে বেরিয়ে গের একগাল হেসে । দ্বিতীয় কোটোটা রেখে গেল ঘরে হায়দারের জন্যে। আবার শুয়ে পড়ল আকাশলাল। তার মন বলছিল এই ভাল হল । এখানে থাকতে তার একটুও ইচ্ছে হচ্ছে না। হায়দারকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। কিন্তু পায়ে হেঁটে নিকটবর্তী শহরেও তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। এ ভাবে শুয়ে থাকলেও শরীর সারতে কতদিন লাগবে তা ঈশ্বরই জানেন । এই মেয়েটা সরল। তাই ধরে নেওয়া যায় সত্যি কথা বলছে। ওর ঘোড়ার গাড়িতে চেপে যদি নিকটবর্তী শহরে যাওয়া যায় তাহলে—! কিন্তু অতটা পথ মেয়েটা যেতে রাজি হবে কেন ?

           
দরজায় শব্দ কানে আসতেই চোখ বন্ধ করল আকাশলাল। তার কানে হায়দারের গলা পৌছালেও সে ফিরে তাকাল না।'এখন তো ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি না, তবু দিনরাত ঘুমাচ্ছে কি করে ? হায়দার বলল ।

          
বুড়োর গলা কানে এল, অতবড় ধকল গেছে, শরীরের সব শক্তি তো বেরিয়ে গেছে। লিডার আবার আগের মতো হয়ে যাবে তো ?

         
"সেটাই সন্দেহের । মনে হচ্ছে ওর ব্ৰেন চোট খেয়েছে।’

         
'সে কি ? '

          হ্যাঁ
। সবকথা ঠিকঠাক বুঝতে পারছে বলে মনে হয় না।’

        
‘তাহলে কি হবে ?

         
দেখি, ভেবে দেখি।' হায়দারের গলা একটু থেমেই আবার সরব হল, আরো খাবার দিয়ে গেছে! একটা কৌটো কেন ?

        
ভুলে গেছে হয় তো। বড্ড চঞ্চল। আমি দেখছি। বুড়ো বেরিয়ে গেল ।

            
আকাশলাল টের পেল হায়দার একা বসে খাবার খেয়ে যাচ্ছে। আগে কখনই সে তার জন্যে অপেক্ষা না করে খাবার খেতে পারত না। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে মানুষের ব্যবহার কি দ্রুত বদলে যেতে শুরু করে। আকাশলাল নিঃশ্বাস ফেলল। সেটা কানে যেতেই খাওয়া থামিয়ে  
হায়দার তাকাল, ‘তুমি কি জেগে আছো ?

            হ্যাঁ
। ,

          
কেমন লাগছে ?

          
ঠিক অছি।',

         
‘রুটি তরকারি খাবে ?

         
'খেয়েছি।”

         
তাই নাকি ? তা হলে তো ভালই হয়ে গেছ। তোমার কি সব কথা মনে পড়ছে ?

         
‘হ্যাঁ ।

         
সব ? হায়দারের গলায় এখনও সন্দেহ, ইন্ডিয়া থেকে একজন ডাক্তার তার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিল তোমার অপারেশনের জন্যে। মনে আছে কি অপারেশন করেছিল ?

         
ব্যাপারটা মুহূর্তে ধোঁয়াশা। সেরকম কিছু হয়েছিল বলে মনে পড়ছে না। কেন এসেছিল ? কে এসেছিল ? অপারেশন তো বুড়ো ডাক্তার করেছিল। সেটা হয়েছিল বুকের ভেতরে। তা হলে কি মুখে কোনও অপারেশন হয়েছিল ? সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল ।

           
হায়দার উত্তেজিত, কি অপারেশন ? কোথায় করেছিল ?

           
নিঃশব্দে হাত তুলে নিজের মুখ দেখিয়ে দিল আকাশলাল ।

           
গুড। ওঃ, বাঁচালে তুমি । তোমাকে নিয়ে কি করা যায় ভেবে পাচ্ছিলাম না। শোন, ভার্গিস নেই। রাজধানীতে এখন অনেকরকম গোলমাল শুরু হয়ে গেছে । আমাদের সেখানে যাওয়া উচিত। কিন্তু তোমার

          
যা শরীরের অবস্থা গাড়ি ছাড়া যেতে পারবে না। আমাদের ভ্যানটার এখানে ফিরে আসার কথা ছিল ।

         
এখনও যে কেন সেটা আসছে না তা বুঝতে পারছি না। তুমি কিছুদিন । এখানেই থেকে যাও। এই বুড়ো খুবই বিশ্বস্ত। পাশের গ্রামে একটা ঘোড়ার গাড়ির সন্ধানে পেয়েছি। লোকটা রাজি হচ্ছে না অত দূরে গাড়ি নিয়ে যেতে । কিন্তু দরকার হলে জোর করতে হবে । আমি আগামী কাল সকাল নটা নাগাদ রওনা হয়ে যাব। ওখান থেকে খবর না পাঠানো পর্যন্ত তুমি এখানেই যেয়ো । সুস্থ হলে ভোমায় নিয়ে যাওয়া হবে।' হায়দার বলল ।

           
তুমি এখন সেখানে গিয়ে কি করবে ?

           
ম্যাডামের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। ম্যাডাম সাহায্য না করলে তোমাকে নিয়ে ভার্গিস আসার আগে বেরিয়ে আসতে পারতাম না।"

          
ম্যাডাম ? খুব চেনা চেনা লাগছিল সম্বোধনটা ।

তোমার সঙ্গে ম্যাডামের যে গোড়া থেকে সংযোগ ছিল তা তুমি আমাদের বলেনি। নেতা হলেও এতটা ঝুঁকি নেওয়া তোমার উচিত হয়নি। তুমি মারা যাওয়ার পর উনি আমাদের সঙ্গে মানে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রথমে আমার বিশ্বাস হয়নি ঠিক, পরে— । যাকগে। আমি কি তোমার মুখের ব্যান্ডেজ খুলে ড্রেস করে দেব ?

       
"এখন নয়।’

       
ঠিক আছে। কাল সকালেই করব । যাওয়া আগে তোমার পরিবর্তিত মুখটাকে আমার দেখে যাওয়া দরকার। হায়দার খাওয়া শেষ করে বাইরে রেরিয়ে গেল ।

       
 আকাশলাল নিঃশ্বাস ফেলল। সব কথা তার মাথায় ঠিকঠাক ঢুকছে না। ম্যাডাম কে ? তিনি কেন তাদের সাহায্য করছেন ? চোখ বন্ধ করতেই তার ঘুম এসে গেল ।

       
ঘুম ভাঙামাত্র আকাশলালের অস্বস্তি শুরু হল। কি যেন করতে হবে ? তারপরেই মনে পড়ে গেল। ঘরের ভেতরটা এখন অন্ধকারে ঠাসা । শুধু ওপাশ থেকে ডাকার শব্দ ভেসে আসছে। সে হায়দারের আবছা মূর্তি দেখতে পেল । ইজিচেয়ারে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। এখন কত রাত ?

       
নিঃশব্দে খাট থেকে নামল আকাশলাল। গতকালের চেয়ে আজ শরীর বেশ ঝরঝরে। মাথার যন্ত্রণাটা তেমন নেই। সে সোজা হয়ে দাড়াল। তারপর পা টিপে টিপে জানলার কাছে পৌছে আকাশ দেখল। আকাশে এখন শুকতারা জুলছে। বাইরের অন্ধকার তেমন গাঢ় নয়। সে নীচের দিকে তাকাল। হায়দার ঘুমাচ্ছে মড়ার মতো। হঠাৎ অন্ধকারেই কিছু একটা চোখে পড়ল। কালো মতো বস্তুটা ইজিচেয়ারে হাতলের ওপর হায়দারের নেতিয়ে থাকা হাতের পাশে পড়ে আছে। আকাশলাল সেটা তুলে নিতেই রিভরভারটাকে অনুভব করল। তা হলে হায়দারের কাছে রিভলভার ছিল।

         
অস্ত্রটাকে পকেটে পুরে সে দরজার দিকে এগোল। এখনও রাত শেষ হয়নি। মেয়েটা কি এরই মধ্যে একা বেরিয়ে গেছে পাশের গ্রামের প্রেমিকের ঘোড়ার গাড়ির নিয়ে আসতে ? এত সাহস কি ওর হবে ? কিন্তু ও যখন বলেছে তখন তার যাওয়া উচিত । না হলে বেলা বাড়লে হায়দার তাকে একা এখানে রেখে চলে যাবে। তারপর কি হবে কে বলতে পারে ?

           
দরজাটা খোলার সময় সামান্য আওয়াজ হল । আকাশলাল মুখ ফিরিয়ে দেখল শায়িত শরীরটা নড়ছে না । সে চট করে বাইরে বেরিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে হিম বাতাসে তার সর্বাঙ্গে কেপে উঠল। ভোরের আগে পৃথিবীর বোধহয় বেশি শীতের দরকার হয়। অন্ধকার পাতলা হলেও সে যখন ঢালু পথ বেয়ে নেমে যাচ্ছিল তখন অসুিবিধেটাকে টের পেল। মন যা চাইছে শরীর তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না। নিঃশ্বাসের কষ্ট বাড়ছে, সেই সঙ্গে ক্লান্তি । মাঝেমাঝেই দাড়িয়ে বিশ্রাম নিতে হচ্ছিল তার ৷ পকেটে হাত যেতেই অস্ত্রটির টের পেয়ে মনে অন্য ধরণের সাহস তৈরি হচ্ছিল ।

           
এখন গ্রামের সমস্ত মানুষ ঘুমে অচেতন । আকাশলাল ধীরে ধীরে মাঠে নেমে এল। এটুকু আসতেই মনে হচ্ছিল তার শরীরের সমস্ত শক্তি শেষ হয়ে গিয়েছে। সে ওপরের দিকে তাকাল । গ্রামটা এখন কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে। এবং তখনই নিজের মুখের কথা মনে এল। এই অবস্থায় যে দেখবে সেই অবাক হবে। ভয়ও পেতে পারে। একটা পাথরের ওপর বসে পড়ল আকাশলাল । তারপর সস্তপর্ণে ব্যান্ডেজ খুলতে লাগল পাকগুলো খুলে সহজেই। গতকালের জড়ানোটা সম্ভবত ঠিক ছিল না। এবার তুলোর প্যাড । সেগুলো যেন চামড়ার সঙ্গে শক্ত হয়ে এটে আছে। অনেকটা তোলার পরও হাতের তালুতে ওদের অস্তি ভূ ধরা পড়ছিল। টেনে ছিড়তে ভয় লাগছিল তার। একটা আয়না থাকলে বোঝা যেত মুখের চেহারা এখন কি রকম দেখাচ্ছে। কিন্তু ব্যান্ডেজ খোলার পর বেশ হালকা লাগছে মাথাটা। অনেকদিন পরে দুই গালে মুখে হাওয়া লাগায় অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। আকাশলাল উঠল। একসময় সে যখন ঝরনার কাছে পৌছাতে পারল তখন শুকতারা ডুবে গেছে। পূবের আকাশে হালকা ছোপ লাগছে। সুনসান রাস্তার ধারে কাছে কেউ নেই। ধীরে ধীরে ঝরনার কাছে পৌছে সে জলে হাত দিল। কনকনে ঠান্ডা হঠাৎ খেয়াল হতে সে এক আঁজলা জল তুলে নিয়ে মুখের ওপর রাখল। মনে হচ্ছিল ঠান্ডা জল চামড়া কেটে ফেলছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর কয়েক আজলা জলের ঝাপটা পাওয়ার পর মুখটা বেশ পরিস্কার হয়ে গেল। আকাশলাল টের পেল তার মুখে এখন তুলোর অস্তিত্ব নেই। ঠিক তখনই তার কানে একটা শব্দ এল । ঘোড়ার নলের শব্দ ।