আট কুঠুরি নয় দরজা - Aat kuthuri noi dorja by সমরেশ মজুমদার - Samaresh Majumder, chapter name আট কুঠুরি নয় দরজা - দশ

আট কুঠুরি নয় দরজা - দশ

বেলা যত বাড়তে লাগল তত শহরের পথে মানুষের সংখ্যা বাড়ছিল। এরা সবাই দেহাতি। পিতামহ পিতাদের অনুসরণ করে প্রতি বছর উৎসবের সময় দুরাতের জন্যে শহরে আসে। এবার শহরে ঢোকার রক্ষীরা। উৎসবের সঙ্গে ধর্ম না জড়ানো থাকলে এই অবস্থায় কেউ শহরে ঢুকত না। ঢুকে তটস্থ হয়ে আছে । সরকারী টিভিতে এইসব মানুষদের দেখানো হচ্ছিল। ভাষ্যকার বলছিলেন, যুগ যুগ থেকে এ রাষ্ট্রের মানুষ উৎসবকে দেখে এসেছে ভালবাসার চোখ দিয়ে। সব টান পেছনে ফেলে গ্রামগ্রামান্তর থেকে সাধারণ অসাধারণ সবাই ছুটে আসেন আগামীকালের আয়োজনে সামিল হতে । অথচ কিছু দেশদ্রোহী তাদের বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলে সমস্ত আনন্দ দূষিত করে দিতে চাইছে। এরা শুধু সরকারের শক্র নয় এরা জনসাধারণেরও শত্র। এই দেখুন, পদায় যে বৃন্ধকে নাতির হাত ধরে হেঁটে আসতে দেখছেন দেশদ্রোহীদের কি অধিকার আছে তার শান্তি কেড়ে নেওয়ার। অতএব শান্তি বজায় রাখতে আপনারা আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করুন। আকাশলাল অথবা তার সঙ্গীদের সন্ধান পাওয়ামাত্র যে কোনও পুলিশ অফিসারকে জানিয়ে দিন।' এর পরেই পর্দা সাদা এবং শোকের বাজনা বেজে উঠল । তারপরই ঘোষকের কণ্ঠ শোনা গেল, 'আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে এদেশের পরম মিত্র বাবু বসন্তলাল আর আমাদের মধ্যে নেই। গতরাত্রে তার মৃতদেহ আবিস্কৃত হয়েছে। বিশেষভাবে প্রমাণিত, তিনি দেশদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়েছেন। দেশদ্রোহীরা বাবু বসন্তলালকে ব্ল্যাকমেইল করতে সক্ষম না হয় হত্যা করে। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে এ দেশের অর্থনীতি তার মৃত্যুতে বড় আঘাত পেল। তার মাধ্যামে দেশ বিরাট পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করত। দেশের এই সুসন্তানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আজ সর্বত্র জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে ।’ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পদায় ভেসে উঠেছিল বাবু বসন্তলালের যুবক বয়সের ছবি ।

           
আকাশলাল সঙ্গীদের দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে ডেভিড বলে উঠল, মিথ্যে কথা ।

           
আকাশলাল হাত তুলল, প্রচার খুব বড় অস্ত্র । কিন্তু মনে হয় এটা বুমেরাং হয়ে যাবে।'

          
 হায়দার জিজ্ঞাসা করল, কিভাবে ?

           
বাবু বসন্তলালকে সাধারণ মানুষ অত্যাচারীদের একজন বলেই মনে করত। তার মৃত্যু কোনও ভাবাবেগ তৈরি করবে না। কিন্তু প্রশ্ন হল লোকটা মারা গেল কিভাবে ?

           
সেটা এখনও জানা যাযনি । তবে মারা গিয়েছে কয়েকদিন আগে । ডেভিবডি একটা কফিনে ছিল বলে জানতে পেরেছি। ডেভিড বলল কে খুন করল ওকে ?

           
হায়দার বলল, ‘খুনই যে হয়েছে তার তো প্রমাণ নেই। এমনি মরে যেতে পারে।'

          
'এমনি মরে গিয়ে কেউ কফিনে ঢুকে পড়ে না। যে ঢোকাবে সে সবাইকে না জানিয়ে চুপ করে থাকবে কেন ? হত্যার দায় আমাদের কাধে চাপানো হয়েছে, কিন্তু হত্যাকারী কে ? বোর্ড চাইবে না ওকে মেরে ফেলতে। ম্যাডাম- আকাশলাল আচমকা কথা থামিয়ে চোখ বন্ধ করল। হায়দার হাসল। এই একটা ব্যাপারে আকাশলাল তার সঙ্গে কখনই একমত হয়নি। ওই মহিলা, যাকে ম্যাডাম বলা হয় তার সঙ্গে মিনিস্টার এবং বোর্ডের ঘনিষ্ঠতা আছে। অথচ মিনিস্টার এবং বোর্ড যে সতর্ক প্রহারায় থাকেন ম্যাডাম ততটা আড়ালে থাকেন না। তাকে ইলোপ করে স্বচ্ছন্দে চাপ দেওয়া যেত, কিন্তু আকাশলাল রাজি হয়নি। আজ পর্যন্ত কোনও নারীকে সে আন্দোলনে জড়াতে রাজি হয়নি, তা পক্ষে বা বিপক্ষে, যাই হোক না কেন ! -

            
ডেভিড বলল, "এর প্রতিবাদ করা দরকার। বাবু বসন্তলালের খুনের দায় আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে এটা জনসাধারণকে বোঝাতে হবে।'

          
 আকাশলাল হাত তুলল, জলে যেখানে হাঙরের সঙ্গে লড়াই সেখানে একটা কুমিরের মৃত্যু নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না। আমি ভাবছি, লোকটাকে মারল কে ? যাকগে, ডাক্তার এবং তার স্ত্রী কেমন আছে ?

         
 হায়দার বলল, ‘ওরা খুব ঘাবড়ে গেছে। ভার্গিস যে আচরণ করল তাতে ঘাবড়ে যাওয়া স্বাভাবিক '

         
‘কাল সকালের আগে আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই ।

           
যেভাবেই হোক করতে হবে । আজ ট্যাক্সিতে আমাদের লোক ওকে টুরিস্ট লজে পৌছে দিয়ে এসেছে। তখনই ওকে তুলে আনা যেত। কিন্তু ওর স্ত্রী বিপদে পড়ত। মেয়েটা ভাল।

        
 হায়দার, আমাদের কোনও ভাল মেয়েকে দরকার নেই। একজন ডাক্তার প্রয়োজন । ওদের পেছনে কেউ লেগে থাকলে তাকে সরিয়ে আজই এখানে নিয়ে আসার চেষ্টা করো।"

        
এখানে না এনে যদি দু নম্বর ক্যাম্পে নিয়ে যাই ? ওখানে আমাদের ডাক্তার আছেন ?

       
 ‘না ।একে এখানেই দরকার।’

        
মেকআপ নিয়ে নিজের ভোল বদলাতে হয়দারের জুড়ি নেই। তার অনেকগুলো প্রিয় ছদ্মবেশের মধ্যে একটি হল পুলিশ অফিসারের মেকআপ। টুপি পরলে সেটাই অনেকটা আড়ালের কাজ করে। ড্রাইভারের পাশে বসে জিপে চেপে ওই পোশাকে যাওয়ার সময় বেশ আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় । অথচ কখনও যদি সে কাউকে চরম ঘৃণা করে তাহলে তাকে পুলিশ অফিসার হতেই হবে। দশ বছর বয়স থেকে সেই ঘূণাটা তার বুকে সাপটে বসেছে।

             
অনেকটা পথ। পেছনে হাটলে মনে হবে শেষ নেই পথের। গ্রামটা ছিল শান্ত। পাহাড়ি মানুষগুলো অভাবী । অভাব থাকলেও অসুখ ছিল না। শীতকালে অঢেল কমলালেবু হত, ভুট্টার চাষ হত, আলু ফলত মাটিতে । তাই বিক্রি করে কোনও মতে সারা বছর বেঁচে থাকা । হায়দারের যখন দশ বছর বয়স তখন একটা পুলিশের দল এল গ্রামে। গ্রামের সবাই কৌতুহলী হয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছিল পুলিশ দেখতে । প্রত্যেকের হাতে বন্দুক, মুখ পাথরের মত শক্ত। ওদের অফিসার চিৎকার করে বলল, ‘একজন খুনি আসামি এই গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে বলে খবর এসেছে। আমি চার ঘন্টার মধ্যে লোকটাকে চাই । তোমরা তাকে বের করে দাও।”

           
চিৎকারটায় এমন কিছু ছিল যে সবার মুখ শুকিয়ে গেল। হায়দারের বাবা দু’পা এগিয়ে গেলেন, 'আমাদের গ্রামে কোনও খুনি নেই অফিসার।'

          
 অফিসার বলল, প্রতিবাদে করা আমি পছন্দ করি না। দ্বিতীয়বার এই কথা যেন না শুনি ।

          
ওরা গ্রামের ছোট্ট প্রাথমিক স্কুল বাড়িটা দখল করে বসল। একজন সেপাই এসে হুকুম করল ভাল মন্দ এবং মাংস পাঠিয়ে দিতে। সবাই বুঝে গিয়েছিল আদেশ মান্য করতে হবে । কিন্তু দূরে দাড়িয়ে তারা নিজেদের মধ্যে কাউকে খুনি হিসেবে চিহ্নিত করতে পারল না।

         
খাওয়া দাওয়ার পর হঠাৎ গুলির শব্দ শোনা গেল। বন্দুকটা আকাশের দিকে তুলে অফিসার এগিয়ে এল, ‘খুনি কোথায় ? আর কতক্ষণ বসে থাকব ?

         
গ্রামের যিনি প্রধান এবং বয়স্ক মানুষ তিনি বললেন, ‘হুজুর, তেমন কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না।"

         
হঠাৎ অফিসার প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। তার চোখ হায়দারের বাবার ওপর দুবার ঘুরে গেল, অ্যাই, এদিকে আয়, তোর নাম কি ?

       
ফারুক ।

      
‘তুই চল আমার সঙ্গে । তুই-ই খুনি।'

      
'সে কি! আমি কেন খুনি হতে যাব ?

           
'চোপ! কোনও কথা নয়। এই, একে বেঁধে ফ্যালো। হুকুম পাওয়ামাত্র সেপাইরা এসে সবার সামনে হাত বেঁধে ফেলল ।

          
দশ বছরের হায়দার চিৎকার করল, “তোমরা এ কি করছ ? আমার বাবাকে বাধছ কেন ? সে ছুটে গেল বাবার কাছে। সঙ্গে সঙ্গে একটা সেপাই তার শরীরের লাথি ঝাড়র। ছিটকে পড়ে গেল সে একপাশে। যন্ত্রণায় পা অসাড় হয়ে যাচ্ছিল।

         
 গ্রাম প্রধান বললেন, 'আমরা ফারুককে জানি। সে কখনই খুন করেননি।'

         
‘আমি বলেছি খুন করেছে, এর ওপরে কথা চলবে না। আজ বিকেলের মধ্যে একটা সবল খুনি আমি কোথায় পাব ? সব তো রোগা পটকা। খুনি না নিয়ে গেলে চাকরি থাকবে না। হ্যা, কেউ যদি বাধা দিতে আসো, আপত্তি করো তাহলে— । দ্বিতীয় বার গুলি চালাল লোকটা, আকাশে নয়, তোমাদের মাথায় গিয়ে বিঁধবে।"

          
হায়দারকে জড়িয়ে ধরে তার মা বসেছিল মাটিতে। বসে চুপচাপ কাদছিল। যন্ত্রণা সত্ত্বেও হায়দার তাকে বলেছিল, "আমু আবুকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ওরা। আবু কিছু করেনি। তুমি বাধা দাও।

         
মা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, কি করব বাবা, কি করে বাধা দেব।'

        
পরে, বাহিনী চলে যাওয়ার পরে গ্রামের মানুষরা সিদ্ধান্ত নিল, হয়তো মদ্য পান করেছিল বলেই অফিসারের মাথা ঠিক ছিল না। খবর এসেছে, ওরা পাচ মাইল দূরে জমিদার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে আজ রাত্রে। সেখানে পুলিশের একজন কর্তাও আছেন। তার কাছে গিয়ে সব বুঝিয়ে বললে নিশ্চয়ই তিনি ফারুককে ছেড়ে দেবেন।

         
হায়দার তখন ভাল করে হাঁটতে পারছিল না। পাচ মাইল রাস্তা তাকে বয়ে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। অতএব গ্রাম-প্রধানের সঙ্গে তার মা রওনা দিল। হায়দারের দুই কাকাও সঙ্গী হল । যতই যন্ত্রণা হোক বিছানায় যেতে পারেনি হায়দার সেই রাতে। বাড়ির সামনে ইউক্যালিপটাস গাছের নীটে ঢাউস পাথরটার ওপর বসে ছিল চুপচাপ। অন্ধকার নামল। পাহাড়ময় জোনাকিরা ঘুরে বেড়াতে লাগল মিটমিটিয়ে। ওরা ফিরে আসছিল না। এল যখন তখন রাত দুপুর। এল চোরের মতো। গ্রামে ফিরে যে যার ঘরে ঢুকে যাচ্ছিল। হায়দার দেখল বাবা তো নয় মাও দলটায় নেই। সে চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করেছিল, আমার মা কোথায় ? বাবা নয়, মায়ের কথাই তার আগে মনে পড়েছিল। সেই চিৎকার শুনে ঘুমন্ত মানুষেরা উঠে এল বিছানা ছেড়ে। ভূতের মত মানুষগুলোকে ঘিরে তারা যখন প্রশ্ন করে যাচ্ছিল তখনও হায়দার হাটতে পারছিল না দুই পায়ে। তবু ভিড় ঠেলে সে গ্রাম প্রধানের সামনে পৌছে গিয়েছিল। তাকে দেখে বয়স্ক মানুষটা হঠাৎই সজোরে কেঁদে উঠল। এক কাকা বলল, ও বড় ছোট, ওকে এসব বলার দরকার নেই।'

             
গ্রাম-প্রধান মাথা নাগলেন কাঁদতে কাদতে, না। ওকে বলা দরকার। এ জানুক।

             
তারপর সে ঘটনাটা শুনেছিল । ওরা পাশের সেই জমিদার বাড়িতে পৌছেচিল সন্ধ্যের আগেই ।ওদের বলা হয়েছিল বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সন্তুষ্ট হওয়ামাত্র ছেড়ে দেওয়া হবে । ওরা অপেক্ষায় বাইরে বসেছিল অনেকক্ষণ। তারপর গ্রাম-প্রধান সেই বড় অফিসারের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। তাকে বলা হল দেখা করা যাবে না। ওরা কি করবে যখন বুঝতে পারছি না তখন জমিদারবাবু উদভ্ৰান্তের মত বেরিয়ে এলেন। যেতে যেতে হঠাৎ দলটাকে দেখে থমকে গেলেন। তারপর গ্রাম-প্রধানকে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন তারা ওখানে এসেছে ? লোকটার যতই দুর্নাম থাকুক, গ্রামপ্রধানের মনে হয়েছিল হাজার হোক চেনা মানুষ। তিনি নিজেদের দুঃখের কথা খুলে বলে সাহায্য চাইলেন। জমিদারবাবু বললেন, ‘অফিসার খুব কড়া লোক। তিনি তোমাদের সঙ্গে দেখা করবেন না। অবশ্য একটা উপায় আছে। লোকটা গলা নামাল, ফারুকের বউ যদি গিয়ে অনুরোধ করে তাহলে কাজ হতে পারে।'

          
 গ্রাম-প্রধান বললেন, 'আমরা সবাই একসঙ্গে যাব।'

           
তাহলে গ্রামে ফিরে যাও। তাছাড়া ওই পোশাকে গেলে অফিসার ফারুকের বউকেই ঢুকতে দেবে না। ওকে জমিদার বাড়ির মেয়েদের পোশাক পরতে হবে।’

         
 ‘কেন ? গ্রাম-প্রধানের মাথায় কিছু ঢুকছিল না।

           
উনি শুধু আমার বাড়ির মেয়েদের সম্ভম করেন। এখন ও যদি সেই পেশাকে যেতে চায় তাহলে আমি ব্যবস্থা করতে পারি।

           
 গ্রাম-প্রধানের ইচ্ছে ছিল না কিন্তু হায়দারের মা মরিয়া হয়ে গেলেন। যেভাবেই হোক স্বামীর মুক্তির জন্যে তিনি বড় অফিসারের কাছে পৌছাতে চাইলেন। জমিদারবাবু তাকে নিয়ে গেলেন ভেতরে । তার কিছুক্ষণ পরে একজন সেপাই এসে হামিমুখে বলল, “তোরা গ্রামের মানুষেরা এক একটা গর্দভ। বড় অফিসার ফুর্তি করার জন্যে জমিদারবাবু কাছে মেয়ে মানুষ চেয়েছিল। চাষাভুশো নয়, সম্রান্ত ঘরের মেয়ে। তার মানে জমিদারবাবু বউ অথবা বোন। তিসি সুযোগ পেয়ে তোমাদের ওই মেয়েটাকে নিজের বউ সাজিয়ে বড় অফিসারকে ভেট দিলেন।

          
দশ বছর বয়সে ভেট শব্দটার মানে ঠিকঠাক না বুঝলেও হায়দার বুঝেছিল, মায়ের একটা বড় রকমের ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। গ্রাম-প্রধান বলছিলেন, 'আমরা অনেক চেষ্টা করেও ভেতরে যেতে পারলাম না। সেপাইরা আমাদের ঢুকতে দিল না । শেষ পর্যন্ত একজন দয়া করে জানিয়ে দিল ফারুককে ওখানে নিয়ে যাওয়াই হয়নি। পথেই ওকে গুলি করে নদীর জলে ফেলে দিয়ে গিয়েছে ওরা। বড় অফিসারের কাছে বদলি অপরাধীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি ওরা নিতে চায়নি। ফেরার সময় আমরা নদীর কাছে অনেক খুঁজেছি। এই রাত্রে কিছুই ভাল দেখা যায় না। কিন্তু মনে হচ্ছে জলে ফেলে দিলে ফারুককে খুঁজে পাওয়া যাবে না । গ্রাম-প্রধান দু'হাতে মুখ ঢাকলেন ।

           
কেউ কেউ কাঁদল। বাকিরা মুখ বন্ধ করে রইল অনেকক্ষণ। একজন গ্রামবৃদ্ধা বলল, তোমরা বউটাকে ? ওখানে রেখে চলে এলে ?

          
"সকালের আগে ছাড়বে বলে মনে হয় না। বেরিয়ে এসে যখন শুনবে ফারুক বেঁচে নেই-।"

          
"ছেলেটা তো শুনছে।"

         
এবার সবার চোখ ঘুরে এল হায়দারের ওপর। সবাই দেখল পাথরের মত দাড়িয়ে আছে ছেলেটা। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে, চোখ জ্বলছে। শরীরের যন্ত্রণা অতিক্রম করে অন্যরকম আগুন জ্বললে কখনও কোনও মানুষের চেহারা আমন হয়। একজন মহিলা তাকে ঘরে নিয়ে যেতে চাইলে হায়দার তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠেছিল, 'আমি ওদের ছাড়ব না। ওদের না মারা পর্যন্ত আমি থামব না।’

      
  
গ্রাম-প্রধান বললেন, "চুপ কর বাবা, এসব কথা বলতে নেই।"

লেংচে লেংচে জটলা থেকে সরে এসেছিল হায়দার। তারপর ভোর হবার আগে ওই শরীর নিয়ে হাটতে শুরু করেছিল। গ্রামের কিছু লোক তার পেছন পেছন এসেছিল কিন্তু জমিদার বাড়ি পর্যন্ত যেতে হয়নি তাদের। নদীর ধারে রাস্তার পাশে একটা গাছের ডালে হায়দার তার মাকে ঝুলে থাকতে দেখেছিল। উঃ, কী বীভৎস বাবার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। মাকে সৎকার করেও তার চোখে জল আসেনি। কান্না তার চোখ থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল চিরদিনের জন্যে ।

       
 অনেক অনেকদিন পরে, বিপ্লবী পরিষদ গঠন হবার পর সরকার যখন তাদের হণ্যে হয়ে খুঁজে তখন এক শীতের সকালে হায়দার ফিরে এসেছিল গ্রামে। সংগঠনের কাজে জড়িয়ে পড়ায় তার নামও ততদিনে দেশের মানুষ কিছুটা জেনেছে। গ্রাম-প্রধান তখনও বেঁচে, কিন্তু অশক্ত। হায়দারকে দেখে তিনি খুশি হলেও ভয় পেলেন, "কেন এলি ? খবর পেলেই ওরা ছুটে আসবে। দরকার থাকলে কাউকে দিয়ে জানিয়ে দিলেই আমরা কাজটা করে দিতাম।”

           
 ‘আমি যে দরকারে এসেছি তা না এলে হবে না। তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।’

           
“কোথায় ?

           
‘জমিদার বাড়িতে।'

          
 ‘সর্বনাশ! সেখানে কেন ?

          
 'আমার একটা হিসেব মেটাতে হবে । চলো ।

          
 সঙ্গে ছেলেরা ছিল অস্ত্র নিয়ে। পাহাড়ি পথে হেঁটে ওরা পৌছে গেল জমিদারবাড়িতে। গ্রাম-প্রধানের হাটতে কষ্ট হচ্ছিল। এখন সেপাইরা গ্রামে নেই। বাড়ির দরজায় একজনমাত্র পাহারাদার। তাকে গ্রামপ্রধান বললেন, “জমিদারবাবু সঙ্গে দেখা করব। ভাই!’

          
'দেখা হবে না। এখন তিনি তেল মালিশ করাচ্ছেন।'

         
 বল গিয়ে, খুব জরুরি খবর নিয়ে এসেছি। দেরি হলে আফশেস হবে।’

         
এসব কথা হায়দার তাকে শিখিয়েছিল। এবার পাহারাদার ভেতরে চলে গেল। গ্রাম-প্রধান জিজ্ঞাসা করলেন, "তোদের মতলবটা কি তা এখন পর্যন্ত বললি না।’

        
 ‘আমি অন্যায় কাজ করব না।’

         
একটু বাদে লোকটা ফিরে এল আর একজনকে সঙ্গে নিয়ে। সে শুধু গ্রাম-প্রধানকে ভেতরে আসতে বলল, বাকিরা বাইরে থাকবে। গ্রাম-প্রধান মাথা নাড়লেন, ‘এই ছেলেকে ছাড়া আমি তো হাটতে পারব না ভাই। লোকটা বিরক্ত হয়ে হায়দারকেও অনুমতি দিল ।

         
সঙ্গীদের ইশারা করে হায়দার বৃদ্ধকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। বাগানটা একটু অগোছালো, দেখলেই বোঝা যায় মালিকের ক্ষমতা আর আগের মত নেই। বিশাল বাড়িটার যে কক্ষে ওদের নিয়ে আসা হল তাতে অবশ্য বিলাস দ্রব্যের ছড়াছড়ি। শ্বেতপাথরের চেয়ারে বসে সাদা শুয়োরের মত একটা লোক তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল লোকটার মেদ তেলে চকচক করছে। দুজন মেয়ে মানুষ তাঁর দুপায়ে তেল মালিশ করছিল। যে লোকটা হায়দারদের নিয়ে এসেছিল সে এগিয়ে গিয়ে কানে কানে কিছু বলল । জমিদারবাবু হাসলেন । হায়দার লক্ষ করল তার একটাও দাত নেই।

         
‘খবরটা কি ?”

          
গ্রাম-প্রধান হায়দারের দিকে তাকালেন, তারপর বললেন, ‘হুজুর । আমরা অসুবিধেয় পড়েছি। শহর থেকে খুব সুন্দরী এক যুবতী এসে গ্রামে বাস করছে, তা জোর করেই আছে।

          
সুন্দরী যুবতী ? পাঠিয়ে দে, পাঠিয়ে দে।" জমিদারবাবু চিৎকার করে উঠলেন আনন্দে।

          
হায়দার বলল, বলেছিলাম। আসবে না।’

         
‘কেন ? আমি জমিদার, আসবে না কেন ?"

           
বলল, আপনি নাকি অনেকবছর আগে আপনার বাড়ির বউকে ভেট দিয়েছিলেন এক পুলিশ অফিসারকে। তারা তখন আপনার বাড়ি দখল করে ছিল।"

          
শুয়োরের বাচ্চা। যে একথা বলে তার জিভ টেনে ছিড়ে ফেলব। অওঁক্ত প্রায় পঙ্গু জমিদারবাবু এমন রেগে গেলেন যে তার চর্বি কাপতে লাগল, যাকে দিয়েছিলাম সে ছিল এক চাষার বউ। কি নাম যেন তার স্বামীর ? ফারুক। হ্যা, তার বউ। আমার বউয়ের জামা পরিয়ে দিয়েছিলাম বলে অফিসার ব্যাটা টেরও পায়নি। তবে বউটা ছিল শয়তান। কিছুতেই বাগ মানল না। ভোরবেলায় গলায় দড়ি দিয়ে মরল ।

          
গ্রাম-প্রধান দেখলেন হায়দারের হাতে একটা কালো চকচকে অস্ত্র। সে সামনে এগিয়ে গেল, ‘শোর রে কুত্তা, দোজখে গিয়ে তুই বসে থাকবি যতদিন না সেই অফিসারটা সেখানে যায়। আমাকে চিনিস ? আমার মাকে যা করেছিস তার বদলা নেবার জন্যে এতকাল আমি অপেক্ষা করে এসেছি।' শব্দ হল। জমিদারবাবুর শরীরটা মুহুর্তেই ঢলে পড়ল। হায়দার ঘুরে দাড়িয়ে পথ দেখিয়ে আসা লোকটাকেও গুলি করল। তারপর মেয়ে দুটােকে বলল, তোমাদের কিছু বলব না। আজ থেকে তোমরা মুক্তি পেলে। তবে যদি পুলিশের কাছে আমার কথা ফাস করো-।"

          
ভয়ে কুঁকড়ে থাকা মেয়েদের একজন বলে উঠর, কক্ষনো না।’

           
গ্রাম-প্রধান পাথর হয়ে গিয়েছিলেন । তাকে টানতে টানতে হায়দার বাগানে নেমে এল। তার সঙ্গীরা তখন বাগানে চলে এসেছে। হায়দার জিজ্ঞাসা করল, ‘পাহারাদারটা ?

          
ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে।’

          
বাড়ির বাইরে পাকদন্ডির রাস্তায় পৌছে হায়দার গ্রাম-প্রধানকে বলেছিল, কেউ তোমাকে দ্যাখেনি। যারা দেখেছিল তারা কথা বলতে পারবে না। শক্রর সঙ্গে লড়াই করার আগে দালালদের সরিয়ে ফেলা দরকার। তাছাড়া এটা কর্তব্য ছিল । তুমি একা ফিরতে পারবে ?

          
গ্রাম-প্রধান কেঁদে ফেলেছিল, "তোর মতো যদি আমার একটা ছেলে থাকত!

 

 

           
পুলিশ অফিসারের ছদ্মবেশে রাস্তায় বের হলে হায়দারের একটাই ভয় হয়। তার দলেরই কেউ যদি ভুল বুঝে গুলি চালিয়ে দেয়। অবশ্য ভার্গিসের সেপাইগুলো যখন তাকে স্যালুট করে তখন বেশ মজা লাগে। মোটরবাইকটা পুলিশেরই। নাম্বারপ্লেট পাল্টে নেওয়া হয়েছে। হায়দার সেটা চালাচ্ছিল ধীরে ধীরে। এর মধ্যেই শহরের রাস্তার লোক জমে গেছে। কাল তো হাটাই মুশকিল হবে। আকাশলাল যে ফন্দি এঁটেছে তা শুনতে বেশ, কিন্তু একটু গোলামাল হলেই ওকে হারাতে হবে। আর এই মুহুর্তে আকাশ সঙ্গে না থাকলে তাদের এখান থেকে পালানো ছাড়া কোনও উপায় নেই।

              
টুলিস্টলজের কাছে পৌছে সে দেখল দুজন সেপাই দাড়িয়ে আছে। তাকে দেখামাত্রই স্যালুট কল তারা। হায়দার জিজ্ঞাসা করল, 'ভেতরে আছে ?

             
"হ্যা স্যার।’

              
ঠিক আছে। তোমরা যাও । আমি এখানে থাকব।

             
“আমরা যাব স্যার ?

             
‘হ্যা। বড় সাহেব আমাকে থাকতে বলেছেন।"

              
লোক দুটাে ছাড়া পেয়ে খুশি হল । এখানে পুতুলের মত না দাড়িয়ে থেকে শহুরের পথে ঘুরলেই পকেট ভর্তি হয়ে যাবে। হাজার হাজার গেয়ো মানুষ মুরগির মত ঢুকছে। লোক দুটো চলে গেলে হায়দার লজের ভেতর ঢুকল । সাত নম্বর ঘরে ওদের থাকার কথা। সে ওপরে উঠতেই এগিয়ে আসা একটি মানুষ কাষ্ঠহাসি হাসল, হুকুম করুন স্যার ?

             
‘করিম, আমি হায়দার।

             
আই বাপ! একদম চিনতে পারিনি। ওদের ঘর বদল করে দিয়েছি। আসুন।

           
 'একটা ট্যাক্সি ডাকো। এক্ষুনি ।

             
ঘর চিনিয়ে দিয়ে হোটেলের সেই লোকটি চলে গেলে দরজায় টোকা দিল হায়দার । তার পর ভেতরে ঢুকল । ওরা দুজন চুপচাপ দুটো চেয়ারে বসে ছিল । হায়দার বলল, আপনাদের এই হয়রানির জন্য দুঃখিত। কিন্তু কিছু করার নেই। সরকার আপনাদের এখান থেকে বহিস্কৃত করেছেন।

            
মানে ? স্বজন উঠে দাড়াল ।

           
‘এখনই এই শহর থেকে আপনাদের ফিরে যেতে হবে।'

           
ও ভগবান। বেঁচে গেলাম। পৃথা বলে উঠল।

          
 কিন্তু যারা আমাকে ডেকেছে— । স্বজনের তখনও দ্বিধা।

         
 ‘এখনই না গেলে দুজনকেই জেলে পচতে হবে। আসুন।

               
অতএব ওরা দুজন হায়দারের পেছন পেছন বেরিয়ে এল। বের হবার আগে স্বজন একটা সুটকেস তুলে নিল, পৃথা দ্বিতীয়টা। টুরিস্ট লজের সামনে তখন ট্যাক্সি এসে গেছে। পাশে করিম দাড়িয়ে। ওদের ট্যাক্সিতে তুলে দিয়ে করিম বলল, মুকবুল খুব ভাল ছেলে স্যার।

            
 হায়দার ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তে ছেলেটা হাসল ।

             
নিজের বাইকে স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে যেতে ট্যাক্সিটা তাকে অনুসরণ করল।

           
 উল্টোদিকের রাস্তায় ওষুধের দোকানে বসে থাকা একটা লোক দৃশ্যটা দেখে এমন হতভম্ব হয়ে পড়েচিল যে কি করবে বুঝতে পারছিল না ন তারপর খেয়ার হল একজন পুলিশ অফিসার ওদের নিয়ে গেলেও তার যখন ছায়ার মত লেগে থাকার কথা তখন ঘটনাটা হেডকোয়াটার্সে জানানো দরকার। সে ওয়াকি টকির সুইচ অন করল, ‘হ্যালো, হেডকোয়ার্টাস, হ্যালো-হ্যালো- এস বি ফাইভ বলছি- ।