দ্বিতীয় খণ্ড - ১২। অ্যাভেঞ্জিং অ্যাঞ্জেলস
১২। অ্যাভেঞ্জিং অ্যাঞ্জেলস
দীর্ঘ, সংকীর্ণ গিরিসংকটে সারি দিয়ে পথ চলতেই গেল সারারাত। পথ কোথাও নেই, কোথাও আলগা
পাথর সমাকীর্ণ থাকায় অত্যন্ত বিপজ্জনক! দিকভ্রম ঘটল কয়েকবার, রাস্তা গেল গুলিয়ে।
কিন্তু পাহাড়ি পথের অলিগলি মুখস্থ থাকায় পথ আবার বের করে নিল জেফারসন হোপ। ভোর হল।
চোখের সামনে ভেসে উঠল আশ্চর্য কিন্তু বন্য সৌন্দৰ্য-দৃশ্য। যেদিকে দৃষ্টি যায়, কেবল
পাহাড় আর পাহাড়। বরফ-ছাওয়া চুড়োর মালা বেঁধে রাখতে চাইছে যেন সব দিক দিয়ে— গা
দিয়ে, কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে বিলীন হয়েছে দূর দিগন্তে। গা এত খাড়া যে অনেক উঁচুতে
পাইন আর লার্চ গাছগুলো যেন ঝুলছে মাথার ওপর— একটু হাওয়া দিলেই বুঝি খসে পড়বে ঘাড়ে।
ভয়টা অমূলক নয়। দৃষ্টিভ্রমও নয়। কেননা অনুর্বর উপত্যকার সর্বত্র ছড়ানো ঝড়ে-খসে-পড়া
বিরাট বিরাট গাছ আর পাথরের চাই। পথ চলা দায়। কয়েক কদম যেতে-না-যেতেই সত্যি একটা প্রকাণ্ড
গোলাকার পাথর বিষম শব্দের ঢেউ তুলে হুড়মুড়িয়ে নেমে এল পাহাড়ের গা বেয়ে— নিস্তব্ধ
গিরিপথে সে-আওয়াজ যেন বজ্রনাদ হয়ে ফেটে পড়ল সহস্র প্রতিধ্বনির আকারে— ক্লান্ত-চরণ
ঘোড়াগুলো লাফিয়ে উঠল গুরু-গুরু-গুম দমাস শব্দে।
সূর্য যখন উঁকি দিল পুবের আকাশে, অরুণ আভায় একে একে উৎসবে প্রজ্বলিত মোমবাতির লালচে
আভায় ঝিলমিল করে উঠল সুউন্নত পর্বতশীর্ষগুলো। আশ্চর্য সুন্দর মহান এই দৃশ্য নিমেষে
সব ক্লাস্তি হরণ করে নিয়ে গেল তিন পলাতকের অন্তর থেকে— নব বলে বলীয়ান হয়ে এগিয়ে
চলল আরও সামনে। একটু পরে পৌঁছোল একটা খরস্রোতা নদীর পাড়ে। পাহাড়ের ফাক দিয়ে বইছে
জলের ধারা। ঘোড়াগুলোকে জল খেতে দিয়ে নিজেরাও চটপট প্রাতরাশ সেরে নিলে। লুসি আর ফেরিয়ারের
ইচ্ছে ছিল আরও একটু জিরোনার— কিন্তু ক্লান্তি নেই জেফারসনের। এখানে নয়, এখানে নয়,
ওরা এসে পড়তে পারে। তাড়াতাড়ি যেতে না-পারলে প্রাণে বাঁচব না খেয়াল রাখবেন। কার্সনে
ঢুকে যত খুশি জিরোবেন— সারাজীবন জিরোবেন। কেউ আর ছুতে পারবে না। এ ছাড়া আর কথা নেই
ওর মুখে।
কাজেই সারাদিন দীর্ঘ, সংকীর্ণ গিরিসংকট বেয়ে এগিয়ে চলল তিন মূর্তি। রাত হল। হিসেব
করে দেখা গেল, শত্রুরা এখন কম করেও তিরিশ মাইল পেছনে। খাড়াই পাথরের গা থেকে প্রকাণ্ড
পাথর কার্নিশের মতো ঝুলছিল পথের ওপর। ঠান্ডা কনকনে বাতাসের ঝাপটা সেখানে কম। নিরাপদ
সেই জায়গাটিতে রাত কাটাল প্রাণের ভয়ে পলাতক তিন অভিযাত্রী— গা ঘেষে গুটিসুটি মেরে
শুয়ে পরস্পরের গায়ের গরমে শীত নিবারণ করল কোনোমতে। কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে ভোরের আলো
ফোটবার আগেই ফের শুরু হল যাত্রা। পেছনে এখনও কাউকে দেখা যায়নি। একটু একটু করে আশা
জাগতে লাগল জেফারসনের অন্তরে। আর বোধ হয় পেছনকার ওই ভয়ংকর সংগঠন ওদের নাগাল ধরতে
পারবে না। বেচারা! শত্রুর স্বরূপ ও আঁচ করতে পারেনি। ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেনি
ভয়াবহ ওই সংগঠনের লৌহমুষ্টি কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে এবং কত সহজে ওদের কবজায়
এনে পিষে শেষ করে দিতে পারে।
পলায়নের দ্বিতীয় দিবস। সূর্য যখন মধ্য গগনে, দেখা গেল সামান্য ভাড়ার প্রায় নিঃশেষিত।
তাতে ঘাবড়াল না শিকারি জেফারসন। কেননা পাহাড়ে শিকার করার মতো জস্তুর অভাব নেই। এর
আগেও এইভাবেই সে ক্ষুন্নিবৃত্তি করেছে রাইফেলের দৌলতে। পাহাড়ের খাঁজে শুকনো ডালপালা
জড়ো করে জ্বালাল একটা ধুনি। গা গরম করা দরকার আগুনের তাতে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায়
পাঁচ হাজার ফুট উঁচু এই অঞ্চল। কনকনে হাওয়ায় যেন ছুরির ধার। ঘোড়াদের দড়ি দিয়ে
বাঁধল, লুসির কাছে বিদায় নিল, কাঁধে রাইফেল বুলিয়ে বেরিয়ে পড়ল শিকারের সন্ধানে।
পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে উঠতে পেছন ফিরে দেখলে দাউ দাউ করে জুলছে আগুন, বাপ বেটিতে উবু
হয়ে বসে আছে আগুনের পাশে, নিস্পন্দদেহে দাঁড়িয়ে আছে ঘোড়া আর অশ্বতর। তারপর পাহাড়ের
আড়ালে যেতে যেতে এ-দৃশ্য হারিয়ে গেল চোখের সামনে থেকে ।
মাইল দুয়েক পাহাড়ের গা বেয়ে এগিয়ে গেল হোপ। পেরিয়ে এল গভীর সংকীর্ণ গিরিসংকটের
পর গিরিসংকট। বধ করার মতো শিকার পেল না। অথচ গাছের ছালে আঁচড়ের চিহ্ন, আর রাস্তায়
অন্যান্য বহু লক্ষণ দেখে বুঝল জায়গাটাকে ভালুকের রাজ্য বললেই চলে। ঘণ্টা দু-তিন বৃথা
অন্বেষণের পর ভাবছে এবার ফেরা যাক, এমন সময় বুকটা নেচে উঠল ওপরে দৃষ্টি যাওয়ায়।
তিন চারশো ফুট ওপরে একটা উদগত শিখরের কিনারায় ভেড়ার মতো দেখতে একটা জন্তু দাঁড়িয়ে—
দু-দুটো ধারালো অস্ত্রের মতো প্রকাণ্ড এক জোড়া শিং উঁচিয়ে রয়েছে মাথার ওপর। ভেড়ার
পাল চলেছে হয়তো ওই শিংয়ের পেছন পেছন— শিকারির চোখে এখনও তা অদৃশ্য। চলেছে অবশ্য উলটো
দিকে— হোপকে দেখতে পায়নি। পাহাড়ে গা মিলিয়ে শুয়ে পড়ল হোপ, অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্যস্থির
করল, তারপর টিপল ট্রিগার। শূন্যে ছিটকে গেল চতুষ্পদ— ঢালু পাহাড়ের গা বেয়ে দুমদাম
শব্দে গড়িয়ে গেল নীচের উপত্যকায়। এত বড়ো জানোয়ারকে তো আর ঘাড়ে করে নিয়ে যাওয়া
যায় না! তাই নিতম্ব কোমর আর পাজরা থেকে বেশ খানিকটা মাংস কেটে নিল জেফারসন। দ্রুত
পা চালাল আস্তানার দিকে— সন্ধের আর দেরি নেই। গোধূলি শুরু হয়ে গিয়েছে। কয়েক পা যেতে-না-যেতেই
বুঝলে অসুবিধেটা কোথায়। শিকারের নেশায় হন্যে হয়ে ঘুরতে ঘুরতে চেনাজানা গিরিসংকট
পেরিয়ে এমন জায়গায় এসে পড়েছে যে এখান থেকে রাস্তা চিনে নেওয়া মুখের কথা নয়। উপত্যকাটা
থেকে অনেকগুলো গিরিসংকট বেরিয়ে গিয়েছে চারিদিকে, প্রত্যেকটাই দেখতে প্রায় একইরকম,
আলাদা করে বিশেষ একটিকে মনে রাখা যায় না। কী আর করা যায়; একটা গিরিসংকট ধরে ধরে মাইলখানেক
যাওয়ার পর এমন একটা খরস্রোতা পাহাড়ি নদীর ধারে এসে পৌছলো যা সে আগে দেখেনি। পথ গুলিয়েছে
বুঝতে পেরে ফিরে এসে এগোল আর একটা গিরিসংকট ধরে— পরিণাম সেই একই। এদিকে দ্রুত রাত বাড়ছে।
চারদিক একেবারে অন্ধকার হয়ে যাওয়ার আগেই পৌছল একটা পরিচিত গিরিবর্ত্মে। চেনা হলেও
কালঘাম ছুটে গেল এগোতে গিয়ে। চাদ এখনও ওঠেনি, অথচ দু-পাশের ঘোর অন্ধকারে সব কিছুই
অস্পষ্ট। কোথায় চলেছে কিছুই বুঝছে না জেফারসন। কাধে মাংসের বোঝা, চরণে অসীম ক্লাস্তি;
তা সত্ত্বেও অদম্য প্রাণশক্তি নিয়ে এগিয়ে চলেছে লুসির জন্য— অনেক খাবার— বাকি যাত্রাপথ
আহার্যর অভাব আর হবে না— প্রতিটি অবসন্ন পদক্ষেপে দূরত্ব কমিয়ে আনছে তার আর লুসির
মধ্যে।
এসে গেছে আর একটা গিরিসংকটের প্রবেশমুখ। এই গিরিসংকটেই বাপবেটিকে ধুনি জ্বলিয়ে বসিয়ে
রেখে গিয়েছিল সে। অন্ধকারেও খাড়াই পাহাড়ে শিখরদেশ চেনা গেল। পাঁচ ঘণ্টা হল বেরিয়েছে
জেফারসন। নিশ্চয় উদবেগে ছটফট করছে। আনন্দের চোটে দু-হাত মুখের ওপর জড়ো করে খুশির
ডাক ছাড়ল জেফারসন— পাহাড়ে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে সেই ডাক ঘুরতে লাগল গিরিবর্ত্মে—
সে যে ফিরে এসেছে এই তার সংকেত। একটু বিরতি দিল পালটা ডাক শোনার আশায়। কিন্তু কেউ
সাড়া দিল না। নিজের ডাকই অসংখ্য প্রতিধ্বনি হয়ে বার বার আছড়ে পড়ল কর্ণকুহরে। নিস্তব্ধ,
বিজন গিরিসংকটের বুক যেন বিদীর্ণ হয়ে গেল একই চিৎকারের সহস্র প্রতিধ্বনিতে। আবার চেচায়
জেফারসন, এবার আরও জোরে, আবার নিজের ডাকই ছোটোবড়ো সরু মোটা কর্কশ কোমল প্রতিধ্বনি
হয়ে ফিরে আসে— ফেলে-যাওয়া সঙ্গীদের ফিসফিসানিও শোনা যায় না ধারেকাছে দূরে নিকটে।
একটা নামহীন আতঙ্কে পঙ্গু করে তোলে জেফারসনের সমস্ত সত্তা। কাঁধের বোঝা ছুড়ে ফেলে
দিয়ে ক্ষিপ্তের মতো ছুটে চলে সামনে।
মোড় ঘুরেই দেখা যায় জায়গাটা। পাঁচ ঘণ্টা আগে আগুন জ্বলছিল সেখানে দাউ দাউ করে। ছাইচাপা
আগুন এখনও দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু ওর যাওয়ার পর থেকে আগুনে আর নতুন কাঠ পড়েনি। শ্মশান
নৈঃশব্দ্যে নিশ্চপ চারিদিক— হাওয়া পর্যন্ত রুদ্ধকণ্ঠ। যা ভয় করেছিল জেফারসন, শেষকালে
তাই সত্যি হল। উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োতে দৌড়োতে নেমে এসে দেখল পুরুষ, নারী, পশু— সব উধাও,
অগ্নিকুণ্ডের পাশে জীবিত কোনো প্রাণী নেই। সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটছে জেফারসন না-থাকার
সময়ে ভয়ংকর সেই বিপর্যয় একাধারে গ্রাস করেছে ওদের সবাইকে— রেখে যায়নি কোনো চিহ্ন।
আঘাতটা আকস্মিক। স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল জেফারসন হোপ— কিংকর্তব্যবিমূঢ়, হতচকিত।
রাইফেলে ভর দিয়ে না-থাকলে মাথা ঘুরে পড়েও যেত। তবে নিস্ক্রিয় বসে থাকার পাত্র সে
নয়— যার প্রতিটি অণু-পরমাণুতে বিচ্ছুরিত কর্মচাঞ্চল্য এভাবে হাবাগোবার মতো দাড়িয়ে
থাকা তাকে সাজে না। অচিরে সাময়িক অসহায়তা কাটিয়ে উঠল জেফারসন। আধপোড়া একটা কাঠ
তুলে নিয়ে নিক্ষেপ করলে ধূমায়িত অগ্নিকুণ্ডে ফুঁ দিয়ে বাড়িয়ে দিল আগুন। লকলকে
শিখার আলোয় শুরু করল ছোট্ট শিবির পর্যবেক্ষণ। অনেকগুলো ঘোড়ার পায়ের ছাপ রয়েছে জমিতে।
যেন অশ্বারোহীদের বিরাট একটা দল পলাতকদের ওপর অতর্কিতে ঝাপিয়ে পড়েছিল। সল্টলেক সিটির
দিকে অশ্বারোহীরা ফিরে গিয়েছে। পলাতকদের কাবু করে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে কি? নিশ্চয়
তাই হয়েছে। মনে মনে প্রায় এই বিশ্বাসই এনে ফেলেছে জেফারসন হোপ, এমন সময়ে শরীরের
প্রতিটি স্নায়ু চনমন করে উঠল একটা জিনিস দেখে। একটু দূরেই ছোট্ট একটা টিবি দেখা যাচ্ছে।
লালচে রঙের মাটির টিবি। এ-টিবি কিন্তু আগে ছিল না। সদ্য খোড়া কবর— দেখেই বোঝা যায়!
কাছে যেতে দেখা গেল একটা লাঠি পোতা রয়েছে— লাঠির ডগাটা ছুরি দিয়ে চিরে ফাক করে এক
টুকরো কাগজে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে সেখানে। কাগজের বয়ান অতি সংক্ষিপ্ত! কিন্তু সুস্পষ্ট
:
------------------------------------------
জন ফেরিয়ার
সল্টলেক সিটির পূর্বতন
বাসিন্দা
মৃত্যু ৪ অগাস্ট,
১৮৬০
-------------------------------------------
এই তো কিছুক্ষণ আগে দুর্মদ বুড়োকে আগুনের ধারে বসিয়ে মাংসের খোঁজে বেরিয়েছিল জেফারসন।
বৃদ্ধ আর নেই– আছে কেবল কবরের ওপর ঝোলানো এই কাগজটুকু। পাগলের মতো আশপাশ খুঁজল হোপ
আর একটা কবর দেখবার আশায়— কিন্তু পেল না। লুসিকে তাহলে শয়তানরা ঘোড়ায় চাপিয়ে নিয়ে
গেছে। এতটা পথ পেছন পেছন এসেছিল ওকে বিয়ের যুপকাষ্ঠে বলি দেওয়ার জন্যে নিয়েও গেছে
ভয়ংকরের দল সেই উদ্দেশ্যে— বয়স্ক-পুত্রদের হারেমে ঢোকানোর জন্যে। নিয়তিকে ঠেকানোর
ক্ষমতা নেই জেফারসনের। অসহায় সে— বড়ো অসহায়। আর কেন বৃদ্ধ ফেরিয়ারের পাশে তারও
যদি একটা কবর খোঁড়া থাকত— শান্তি মিলত এই দুঃখেও।
মানুষ হতাশ হলেই রাজ্যের কুঁড়েমিতে তাকে পেয়ে বসে। কিন্তু জেফারসনের রক্তে নাচছে
অদম্য কর্মস্পৃহা— হাত পা গুটিয়ে থাকা তার ধাতে নেই। তাই গা-ঝাড়া দিয়ে আলসেমি আর
নৈরাশ্যকে বিদেয় করল ত্রিসীমানা থেকে। কিছু আর না-করার থাকলেও একটা পথ এখনও খোলা আছে—
প্রতিহিংসা। রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যেই জীবন কেটেছে তার। রেড ইন্ডিয়ানদের মতোই দুর্জয়
মনোবলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়েছে অনমনীয় প্রতিশোধস্পৃহা। ধৈর্য তার অসীম, সহিষ্ণুতা
অতুলনীয়, প্রতিহিংসা কামনাকে জিইয়ে রাখার ক্ষমতাও অপরিসীম। লেলিহান অগ্নিশিখার পাশে
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সমগ্র সত্তা দিয়ে উপলব্ধি করলে এই মহাশোককে সে সেইদিনই ভুলতে
পারবে যেদিন স্বহস্তে নিধন করবে শক্ৰদের— দেবে কুকর্মের চরম শাস্তি। আজ থেকে ওর অটল
সংকল্প আর অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়োজিত হোক সেই অভিলক্ষে। রক্তশূন্য কঠোর মুখে ফিরে
গেল মাংসের বোঝা যেখানে ফেলে এসেছিল সেইখানে, আগুনে কাঠ গুজে রান্না করল সেই মাংস যাতে
বেশ কয়েকদিন চলে যায়। পুটলিতে রান্না মাংস নিয়ে চরম ক্লাস্তিকে তুচ্ছ করে সেই মুহুর্তে
রওনা হল ফেলে-আসা পাহাড়ি পথে অ্যাভেঞ্জিং অ্যাঞ্জেলসের সন্ধানে।
ঘোড়ায় চড়ে যে-গিরিসংকট পেরিয়ে এসেছিল হোপ, পায়ে হেঁটে পাঁচদিন ধরে অতিকষ্টে সেই
পথেই ফিরে এল সে। পা কেটে রক্ত পড়তে লাগল পাথরের খোচায়– তবুও থামল না। রাত হলে পাহাড়ের
খাঁজে যেখান-সেখানে শুয়ে ঘুমিয়ে নিত কয়েক ঘণ্টা— ভোরের পাখি ডাকার সঙ্গেসঙ্গে শুরু
করত পদ অভিযান। ষষ্ঠ দিনে এসে পৌছাল ঈগল গিরিসংকটে— এখন থেকেই শুরু হয়েছিল ভাঙা কপালে
অভিযান। সাধুদের শহর এখান থেকে দেখা যায় অনেক নীচে। শরীর আর বইছে না; দাঁড়িয়ে থাকতেও
পারছে না। নিঃসীম অবসাদ সত্ত্বেও রাইফেলে ভর দিয়ে খাড়া রইল জেফারসন— দীর্ঘ শীর্ণ
হাতে ঘুসি নিক্ষেপ করল পায়ের তলায় দিগন্ত বিস্তৃত নিস্তব্ধ শহরের উদ্দেশে। দেখল কয়েকটা
মূল সড়কে পতাকা উড়ছে, উৎসবের আরও অনেক চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ এত উৎসব কীসের দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে ভাবছে হোপ, এমন সময় কানে ভেসে এল অশ্বখুরধ্বনি। সটান ওর দিকেই আসছে একজন
অশ্বারোহী। কাছে আসতেই চিনতে পারল মুখটা। নামটা কুপার— মর্মোন। অতীতে এর অনেক কাজ করে
দিয়েছে হোপ। তাই ঠিক করল লুসি ফেরিয়ারের মন্দ কপালে শেষপর্যন্ত কী সর্বনাশ ঘটেছে
তা জানতে হবে কুপারের মুখে। এগিয়ে গেল সামনে।
বললে, আমি জেফারসন হোপ। মনে পড়ে?
শিকারির এই হাল হয়েছে? মুখ সাদা, ভীষণ। চোখ দুটি উদ্রান্ত। জামাকাপড় তো নয়, যেন
ছেড়া ন্যাকড়া। চুল উশকোখুশকো। আপাদমস্তক কালিমাময়। সব মিলিয়ে ভয়ংকর দর্শন। চিনতে
কষ্ট হলেও সেই জেফারসন হোপই বটে। চেনবার পর কিন্তু বিস্ময় তিরোহিত হল কুপারের মুখচ্ছবি
থেকে— বিষম আতঙ্ক প্রকটিত হল চোখে-মুখে।
বললে চাপা স্বরে, তোমার মাথা কি খারাপ হয়েছে? এখানে এসেছ কেন? পরোয়ানা বেরিয়ে গেছে
তোমার নামে। ফেরিয়ারদের ভাগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলে কেন? রেহাই নেই তোমার। চার বয়স্ক
খুঁজছে তোমাকে। তোমার সঙ্গে এখন আমার কথা বলাও বিপদ— আমার প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়বে।
কারো তোয়াক্কা করি না আমি— পরোয়ানার ভয় আমাকে দেখিয়ো না। কুপার, বন্ধুত্ব আমাদের
অনেকদিনের। ঈশ্বরের নামে বলছি, যা জান, সব বল। নিশ্চয় তুমি অনেক খবর রাখ। আমার কথা
রাখ, আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাও। না বোলো না।
বিড়ম্বিত স্বরে মর্মোন বললে, বল কী বলবে। তাড়াতাড়ি করো। এখানে পাথরের কান আছে, গাছের
চোখ আছে।
ড্রেবার ছোকরার হারেমে— বিয়ে হয়ে গেল কালকে। আরে, আরে, পড়ে যাবে যে! শরীরের আর কিছুই
রাখোনি দেখছি।
ক্ষীণ স্বরে হোপ বললে, ঠিক আছি আমি, বলতে বলতে বসে পড়ল পাথরের ওপর। বিয়ে হয়ে গেছে?
গতকাল হয়ে গেল। এনডোমেন্ট হাউসে ফ্ল্যাগ উড়ছে ওই কারণেই। কার বউ হবে লুসি ফেরিয়ার,
এই নিয়ে টক্কর লেগেছিল ড্রেবার আর স্ট্যানজারসনের দুই ছেলের মধ্যে। তোমাদের পেছনে
যারা ছুটছিল, ওরা দু-জনেই ছিল সেই দলে। লুসির বাবাকে গুলি করে মারে স্ট্যানজারসন, তাই
তার দাবি বেশি, কিন্তু মিটিং-এ শেষ পর্যন্ত ড্রেবারের দল ভারী দেখা গেল; অবতার তাই
ওকেই দিয়েছে লুসিকে। তবে বেশিদিন ভোগ করতে পারবে না কেউই। মৃত্যুর ছবি দেখে এসেছি
মেয়েটার মুখে। মেয়ে বলে আর মনেই হয় না— যেন প্রেতিনি। চললে নাকি?
উঠে দাঁড়িয়েছিল জেফারসন। মার্বেলে খোদাই মুখে দুই চোখে নরকের আগুন জ্বালিয়ে বজ্রকঠিন
স্বরে বললে, হ্যাঁ চললাম। মুখের পরতে পরতে ফুটে উঠল দুর্জয় সংকল্প।
যাচ্ছ কোথায়?
কী হবে জেনে?
কাঁধে রাইফেল বুলিয়ে নিয়ে বন্য জন্তু অধ্যুষিত ভয়ংকর পাহাড়ের মধ্যে ফিরে গেল জেফারসন
হোপ— সেই মুহুর্তে ওর চাইতে হিংস্র, বিপজ্জনক কোনো প্রাণী অবশ্য ও-তল্লাটে আর ছিল কিনা
সন্দেহ।
কুপারের ভবিষ্যদবাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। বাপের ভয়ংকর মৃত্যুর জন্যই হোক, কি নিজের
ঘৃণিত বিয়ের জন্যই হোক, বিছানা ছেড়ে আর মাথা তুলতে পারল না লুসি। মারা গেল এক মাসের
মধ্যেই। পানোন্মত্ত স্বামীরত্বের বিন্দুমাত্র বিকার দেখা গেল না সেজন্যে। বিয়েটা করেছিল
স্রেফ জন ফেরিয়ারের সম্পত্তির লোভে। সেটা তো হাতে এসে গেল। কিন্তু অন্য বউরা মড়া
নিয়ে বসে রইল সারারাত— কবর দেওয়ার আগের রাত এইভাবেই কাটাতে হয় মর্মোন প্রথা অনুযায়ী।
কফিন ঘিরে বসে থাকার সময়ে শেষরাতে একটা আশ্চর্য কাণ্ড ঘটল! আচমকা দড়াম করে খুলে গেল
ঘরের দরজা। ছেড়া ন্যাকড়ার মতো পোশাক পরা রোদে-পোড়া বর্বর চেহারার একটা পুরুষ মূর্তি
ধেয়ে এল ঘরের মধ্যে। বিষম ভয়ে কাঠ হয়ে গেল মেয়েরা। প্রেতচ্ছায়ার মতো সেই বিকট
পুরুষ আতঙ্ক-স্তম্ভিত মেয়েদের দিকে তাকিয়ে হনহন করে হেঁটে গেল কফিনে শোয়ানো লুসি
ফেরিয়ারের পাশে। শ্বেতশুভ্র নিথর নিস্তব্ধ যে-দেহে একদা লুসি নামে একটি মেয়ে বাস
করত, সেই দেহের তুহিন শীতল ললাটে ঠোঁট ছুঁইয়ে এক ঝটকায় আঙুল থেকে টেনে নিলে বিয়ের
আংটিটা। দংষ্ট্রা-বিকশিত বীভৎস কণ্ঠে বললে. কবরে যাবে না এ-আংটি বলেই জ্যামুক্ত তিরের
মতো ছিটকে বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে বাইরে— সেখান থেকে সিড়ি দিয়ে নীচে– চেচানোর সময়
পর্যন্ত পেল না মেয়েরা! আঙুল থেকে আংটিটা অদৃশ্য হয়েছে বলেই নিজের চোখকে বিশ্বাস
করতে পারল মেয়েরা— বিশ্বাসও করাতে পারল সবাইকে। এত কম সময়ে এমন অদ্ভুত ব্যাপার যে
ঘটতে পারে, স্বচক্ষে দেখেও বিশ্বাস করা কঠিন হত আংটি উধাও না-হলে।
বুকের মধ্যে প্রতিহিংসার লেলিহান অনল নিয়ে কয়েকমাস পাহাড়ে পাহাড়ে বন্য জীবনযাপন
করল জেফারসন। অনেকরকম কাহিনি ছড়িয়ে পড়ল শহরে। নগরীর উপকণ্ঠে আর নিরালা গিরিসংকটে
নাকি একটা বিচিত্র ভৌতিক মূর্তিকে আজকাল প্রায়ই দেখা যাচ্ছে। জানালায় দাঁড়িয়ে থাকার
সময়ে একদিন নাকি স্ট্যানজারসনের দিকে একটা বন্দুকের গুলি উড়ে এসেছিল শনশন করে. কপাল
ভালো তাই মাথায় না-লেগে একফুট তফাতে দেওয়ালে লেগে চিড়ে চ্যাপটা হয়ে যায় বুলেটটা।
আর একবার নাকি পাহাড়ে পাহাড়ে টহল দেওয়ার সময়ে আচমকা একটা বিশাল আলগা পাথর গড়িয়ে
পড়ে ড্রেবারের মাথার ওপর— পাশের দিকে শেষ মুহুর্তে মুখ থুবড়ে পড়ায় একচুলের জন্যে
পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায় সাংঘাতিক মৃত্যু। তরুণ মর্মোন দু-জন নির্বোধ নয়। অচিরেই তারা
আঁচ করে নিলে ব্যাপারটা, প্রাণ হরণের জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে কেউ। সদলবলে অভিযান চালানো
হল পাহাড়ের মধ্যে। কিন্তু বৃথাই। টিকি দেখা গেল না জেফারসন হোপের। বার বার অভিযান
চালিয়ে অদৃশ্য আততায়ীকে দেখা গেল না হত্যা করা তো দূরের কথা। তখন থেকে ঠিক হল বাড়ির
বাইরে কখনো বেরোবে না। একলা কখনো রাস্তায় যাবে না। বাড়িতেও সবসময়ে সান্ত্রি পাহারাদার
মোতায়েন থাকবে। কিছুদিন পরে একটু নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। নতুন কোনো ঘটনা আর ঘটেনি। বিচিত্র
শত্রুর ছায়াও নাকি আর কারো চোখে পড়েনি। সময়ে মহাশোকও বিস্মৃত হয় মানুষ— সুতরাং
প্রতিহিংসার আগুনও নিশ্চয় নিভে গিয়েছে জেফারসনের মধ্যে— এই ধারণা নিয়ে হাঁফ ছেড়ে
বাঁচল দুই পাষণ্ড মর্মোন।
কিন্তু হয়েছে ঠিক তার উলটো। নেভার বদলে প্রতিহিংসার আগুন আরও বেড়েছে। অত্যন্ত কঠিন
ধাতুতে তৈরি তরুণ শিকারির ভেতরটা। এ-মন ধরা দিতে জানে না, বশ মানতে পারে না, কিছুই
মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না। প্রতিহিংসা নিতে বদ্ধপরিকর হয়েছে বলেই দিনে দিনে মনের
দিগদিগন্ত ছেয়ে ফেলেছে ওই একটিমাত্র স্পৃহা— প্রতিহিংসা চাই, প্রতিহিংসা। মনের মধ্যে
আর কিছুরই ঠাঁই নেই— প্রতিহিংসা স্পৃহা ছাড়া। প্রতিহিংসা পাগল হলেও কিন্তু সে অবোধ
উজবুক নয়— অত্যন্ত প্র্যাকটিক্যাল— ব্যবহারিক বুদ্ধি অতিশয় টনটনে। দু-দিনেই উপলব্ধি
করল শরীরের ওপর অহৰ্নিশ এই অত্যাচার করাটা ঠিক হচ্ছে না। লৌহ কাঠামোও একদিন ভেঙে পড়বে।
পুষ্টিকর খাবারের অভাবে আর চব্বিশ ঘণ্টা রোদে জলে পড়ে থাকার ফলে শরীর কাহিল হচ্ছে
একটু একটু করে। পাগলা কুত্তার মতো পাহাড়ের খাঁজে মরে পড়ে থাকলে প্রতিহিংসাটা নেবে
কে? শত্রুপক্ষ তো তাই চায়— এইভাবেই হন্যে হয়ে ঘুরতে ঘুরতে অক্কা পাক জেফারসন হোপ।
তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্রেফ শরীরটাকে সুস্থ সবল করার জন্যে আর অনেক টাকা জমিয়ে নতুন
করে প্রতিহিংসা অভিযানে নামার জন্যে নেভাদা খনি অঞ্চলে ফেরে সে অনির্বাণ আগুন নিয়ে।
ভেবেছিল বছর খানেক থাকবে নেভাদায়। কিন্তু অপ্রত্যাশিত অনেক পরিস্থিতির ফলে থাকতে হল
পাঁচ বছর। পাঁচ বছর পরেও কিন্তু মন থেকে প্রতিহিংসার আগুন যায়নি— স্মৃতি এতটুকু ফিকে
হয়নি। জন ফেরিয়ারের কবরের পাশে সেই স্মরণীয় রাতের তীব্র আবেগ সমানভাবেই তীব্র ছিল,
তীক্ষ্ণ ছিল মনের মধ্যে— মৌনী থেকেছে বাইরে, ভেতরে অহর্নিশ দাউ দাউ করে জুলছে প্রতিহিংসার
দাবানল। ছদ্মবেশ ধারণ করে নাম পালটে ফিরে এল সল্টলেক সিটিতে— ধরা পড়লে কী হবে সে-ভাবনা
একবারও ভাবল না— চরম শাস্তি দিতে পারলেই হল। এসে দেখল হাওয়া ঘুরে গেছে। আবার ওর কপাল
পুড়েছে। মাস কয়েক আগে ধর্ম নিয়ে মতভেদ দেখা যায় গির্জের মধ্যে। মাথা চাড়া দেয়
কিছু নবীন সদস্য– বিদ্রোহ করে বয়স্কদের খবরদারির বিরুদ্ধে। ফলে যা হবার তাই হয়েছে।
অসন্তুষ্ট কিছু ব্যক্তির অপসারণ ঘটেছে উটা থেকে— এখন তারা বিধর্মীত। এদের মধ্যে আছে
স্ট্যানজারসন আর ড্রেবার! কোথায় গিয়েছে তারা কেউ জানে না। গুজব, ড্রেবার বিষয়সম্পত্তি
বেচে বেশ কিছু নগদ টাকা নিয়ে যেতে পেরেছে। সে তুলনায় স্ট্যানজারসন বেচারিকে প্রায়
ফকির হয়েই রাস্তায় নামতে হয়েছে। কেউ জানে না দুই মূর্তিমান এখন কোন চুলোয়।
ঘটনা যখন এইরকম মোড় নেয় এবং এহেন প্রতিকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, তখন বেশির ভাগ লোকই
হাল ছেড়ে দেয়— প্রতিহিংসা নেওয়ার আশা ত্যাগ করে। কিন্তু জেফারসন হোপ সে-ধাতু দিয়ে
গড়া নয়। মুহুর্তের জন্যেও সে ভেঙে পড়ল না বা দ্বিধাগ্রস্ত হল না। চাকরি করার মতো
যোগ্যতা তার খুবই কম। কিন্তু এই স্বল্প পুঁজি নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের এক শহর থেকে আরেক
শহরে গিয়ে নানান রকমের জীবিকা জুটিয়ে নিয়ে অহৰ্নিশ খুঁজতে লাগল দুই শক্রকে। বছর
ঘুরে গেল। কালো চুল পেকে সাদা হয়ে গেল, তবুও মানুষ কুত্তার মতো নরশোণিত পিপাসা নিয়ে
বিরামবিহীনভাবে অন্বেষণ করে চলল দুটি মাত্র পুরুষকে যাদের রুধিরে হাত না-ধোয়া পর্যন্ত
জীবনে তার শান্তি নেই। অবশেষে পুরস্কার এল আশ্চর্য এই অধ্যবসায়ের। ওহিয়োর ক্লিভল্যান্ডে
এক ঝলকের জন্যে একটা জানলায় দেখা গেল একটা মুখ। সাঁ করে মুখটা সরে গেলেও চিনে নিয়েছিল
হোপ। এই মুখের খোজেই জীবন পণ করেছে সে! প্রতিহিংসার প্ল্যান মনের মধ্যে ছকে নিয়ে ফিরে
এল দীনহীন আস্তানায়। জানলায় দাঁড়িয়ে ড়েবারও চকিতের জন্যে রাস্তায় দেখেছিল একটা
ছন্নছাড়া লোককে। চোখে তার খুনের সংকল্প। দেখেই চিনেছিল। ড্রেবার তখন রীতিমতো ধনবান,
স্ট্যানজারসন তার সেক্রেটারি। দু-জনে সেই মুহুর্তে গেল পুলিশ ফাঁড়িতে। ইনিয়েবিনিয়ে
জানাল, একজন পুরোনো প্রতিদ্বন্দী ওদের দু-জনকেই খুন করবে বলে পেছন পেছন ঘুরছে। সেই
রাতেই হাজতে পোরা হল জেফারসন হোপকে! জামিনের টাকা না-দিতে পারায় কয়েক সপ্তাহ হাজত
বাসও করতে হল। বেরিয়ে এসে দেখলে ড্রেবারের বাড়ি শূন্য— সেক্রেটারিকে নিয়ে সে ভেগেছে
ইউরোপ অভিমুখে।
নতুন করে প্রতিহিংসা-পর্বে বাগড়া পড়ল বটে, কিন্তু জেফারসন হোপকে থামানো গেল না। ঘনীভূত
প্রতিহিংসা-স্পৃহা এবার ওকে তাড়িয়ে নিয়ে চলল, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে। টাকার
অভাবে বাধ্য হয়ে কিছুদিন গায়ে-গতরে খেটে একটি একটি ডলার জমিয়ে চলল পাথেয়-স্বরূপ।
কষ্টেসৃষ্টে জীবন চলে যাওয়ার মতো টাকাকড়ি জমবার পর রওনা হল ইউরোপ অভিমুখে। দুই শত্রুর
পেছন পেছন ধাওয়া করে চলল এক শহর থেকে আরেক শহরে, হাতের টাকা ফুরিয়ে গেলে কুলিমজুরের
কাজ করতেও দ্বিধা করেনি দু-বেলা গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে, কিন্তু একবারের জন্যেও শক্রদের
ছাড়িয়ে এগিয়ে যায়নি। সেন্ট পিটার্সবার্গে গিয়ে শুনল প্যারিস গিয়েছে দুই মহাপাপিষ্ঠ,
প্যারিস পৌছে শুনল এইমাত্র রওনা হয়েছে কোপেনহাগেনের দিকে। ড্যানিশ রাজধানীতে পৌছোতে
একটু দেরি করে ফেলেছিল হোপ। দু-দিন আগেই লন্ডনে চলে গিয়েছে দুই শত্রু। লন্ডনে এসে
পাওয়া গেল পাষণ্ডদের। তারপর কী ঘটেছিল, বৃদ্ধ শিকারীর নিজের জবানিতেই তা শোনা যাক।
ডক্টর ওয়াটসনের খাতায় তা আনুপূর্বিক লেখা আছে, সে-খাতা থেকে শোনানো হচ্ছে এই কাহিনি।