প্রথম খন্ড - ১. শার্লক হোমস
[ ভূতপূর্ব মিলিটারি
ডাক্তার জন এইচ ওয়াটসন এম ডি-র স্মৃতিচারণ থেকে পুনর্মুদ্রিত ]
১. শার্লক হোমস
১৮৭৮ সালে লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে ডাক্তারির ডিগ্রি নিয়ে নেটলি গিয়েছিলাম আমি সার্জন
পাঠক্রম পড়বার জন্যে। সেখানকার পড়াশুনো চুকিয়ে সামরিক বাহিনীতে যোগদান করলাম অ্যাসিস্ট্যান্ট
সার্জন পদে। ইন্ডিয়ায় গিয়ে কাজ বুঝে নেওয়ার আগেই লাগল আফগান যুদ্ধ। বোম্বাই পৌছে
শুনলাম আমাদের বাহিনী গিরিসংকটের মধ্যে দিয়ে শত্রুদের এলাকায় ঢুকে পড়েছে। অন্যান্য
অফিসারদের সঙ্গে কোনোমতে আমিও পৌঁছোলাম কান্দাহারে। রেজিমেন্টের ডিউটি শুরু করে দিলাম
তৎক্ষণাৎ।
এই অভিযানে অনেকের বরাত খুলে গেছে— সম্মান পেয়েছে, পদোন্নতি ঘটেছে। আমার বরাতে জুটেছে
শুধুই দুর্ভোগ। ব্রিগেড থেকে আমাকে সরানো হয়েছে। বার্কশায়ারের সঙ্গে মেইওয়ান্দের
রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে গিয়েছি। কাঁধে লেগেছে জিজেল বুলেট। হাড় ভেঙেছে, সাবক্লেভিয়ান
ধমনী ছুঁয়ে গেছে। খুনে গাজীদের হাতে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছি আর্দালি মুরে-র
জন্যে। ঘোড়ার পিঠে ফেলে নক্ষত্ৰবেগে সে আমাকে নিয়ে এসেছে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর মধ্যে।
দারুণ যন্ত্রণা আর পরিশ্রমে আমি তখন ধুঁকছি। ওই অবস্থায় আমাকে আনা হল পেশোয়ারের সদর
হাসপাতালে। অনেকটা সামলে ওঠার পর বারান্দায় বেড়াতাম, হাসপাতালের অন্যান্য ওয়ার্ডে
ঘুর ঘুর করতাম। তারপরেই আক্রান্ত হলাম অভিশপ্ত ভারতীয় আন্ত্রিক জুরে। শরীর একেবারে
ভেঙে গেল। ভীষণ কাহিল হয়ে পড়লাম। মেডিক্যাল বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফিরে এলাম
ইংল্যান্ডে। ইন্ডিয়া থেকে সামরিক জাহাজ ওরোন্টেজ একমাস পরে নামিয়ে দিয়ে গেল পোর্টসমাউথ
বন্দরে। শরীরে তখন আমার আর কিছু নেই। সরকার ঠিক করলে আমাকে ন-মাস সম্পূর্ণ বিশ্রাম
দেওয়া হোক।
ইংল্যান্ডে আমার তিন কুলে কেউ নেই। পকেটে রেস্ত বলতে দৈনিক সাড়ে এগারো শিলিং বরাদ্দ।
তাই এলাম লন্ডনে— ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সব উড়নচণ্ডীরা শেষ পর্যন্ত যেখানে এসে জোটে।
উঠলাম একটা হোটেলে। কিন্তু দু-দিনেই বুঝলাম ওই টাকায় হোটেলে থাকা সম্ভব নয়। হয় আমাকে
লন্ডন ছেড়ে যেতে হবে— নয় জীবনযাপনের ধারা পালটাতে হবে। শেষেরটাই সহজ মনে হল। কারো
বাড়িতে সস্তায় থাকা-খাওয়ার জায়গা খুঁজতে লাগলাম।
যেদিন ঠিক বারে দেখা হয়ে গেল স্ট্যামফোর্ডের সঙ্গে। এককালে স্ট্যামফোর্ড ছিল ডাক্তারি
কাজে আমার সহযোগী— ড্রেসার। খুব একটা হৃদ্যতা অবশ্য ছিল না। কিন্তু সেদিন পেছন থেকে
আমার কাঁধে টোকা মারতেই ওকে দেখে কী ভালোই যে লাগল তা বলবার নয়। লন্ডনের ধু-ধু নিঃসঙ্গতার
মধ্যে সে যেন একটা মরূদ্যান। স্ট্যামফোর্ডও দেখলাম উল্লসিত হয়েছে আমাকে দেখে। আনন্দের
চোটে তক্ষুনি একটা ছাকড়াগাড়ি নিয়ে রওনা হলাম হলবর্ন অভিমুখে লাঞ্চ খাওয়ার জন্যে।
গাড়ির মধ্যেই স্ট্যামফোর্ড জিজ্ঞেস করল, ওয়াটসন, একী ছিরি হয়েছে তোমার? চেহারাটা
তো দেখছি তক্তার মতো পাতলা আর বাদামের মতো বাদামি করে ফেলেছ।
সংক্ষেপে আমার অ্যাডভেঞ্চার-ইতিবৃত্ত শোনালাম। গাড়ি পৌছে গেল হলবনে। খেতে বসে সহানুভূতির
সুরে বললে স্ট্যামফোর্ড, আহারে। এখন কী করবে ঠিক করেছ?
সস্তায় মাথা গোঁজার আস্তানা খুঁজছি!
অদ্ভুত ব্যাপার তো। আজকেই এই নিয়ে দু-বার হল শুনলাম একই ইচ্ছে।
প্রথম ইচ্ছেটা কার?
হাসপাতালের কেমিক্যাল ল্যাবরেটরিতে কাজ করে। ঘর পেয়েছে চমৎকার, কিন্তু আধাআধি বখরায়
থাকবার মতো সঙ্গী পাচ্ছে না। একা খরচ বওয়ার সাধ্যও নেই।
বলো কী! খরচ আর ঘর ভাগ করতে চাইছে! আরে আমিও তো তাই চাই। একা থাকতে ভাল্লাগে না। সঙ্গী
পেলে বর্তে যাব।
স্ট্যামফোর্ড মদের গেলাস হাতে নিয়ে অদ্ভুতভাবে চেয়ে রইল আমার দিকে। বললে, শার্লক
হোমসকে তুমি চেনো না। চিনলে তার সঙ্গে অষ্টপ্রহর এক জায়গায় থাকতে চাইতে না।
কেন বল তো? গোলমালটা কোথায়?
তার বিরুদ্ধে কিছু বলতে চাই না! লোক ভালো। বিজ্ঞানের কিছু কিছু ব্যাপার নিয়ে উৎসাহী!
মেডিক্যাল স্টুডেন্ট নিশ্চয়?
না। ও যে কী চায়, সেটাই একটা রহস্য। অ্যানাটমি ভালো জানে, কেমিস্ট্রিতে তুখোড়। কিন্তু
ধরাবাঁধা মেডিক্যাল ক্লাস কখনো করেনি। এলোমেলো উদ্ভট বিষয়বস্তু নিয়ে পড়াশুনা করেছে
বিস্তর। বাইরে জ্ঞান ওর এত বেশি যে অনেক প্রফেসরেরও মুণ্ডু ঘুরে যায় সেই বিদ্যের নমুনা
শুনলে।
লক্ষ্যটা কী জিজ্ঞেস করনি?
না; ও-লোকের পেট থেকে সহজে কথা বার করা যায় না! মুড এলে কিন্তু অন্য মানুষ— মুখে তখন
তুবড়ি ছোটে।
এইরকম লোককেই দোস্ত চাই, বললাম আমি।
ভাঙা শরীরে আওয়াজ উত্তেজনা আর ভালো লাগে না। আফগানিস্তানে ঢের সয়েছি— বাকি জীবনটা
তার ঠেলা সামলাই। আমি চাই এমন একজনের সঙ্গে থাকতে যার পড়াশুনার অভ্যেস আছে, কথাবার্তা
কম বলে, প্রকৃতি শান্ত! বন্ধুটির সঙ্গে কীভাবে দেখা করা যায় বলো।
ল্যাবরেটরি গেলেই পাবে। খেয়ালি লোক তো। কয়েক সপ্তাহ হয়তো ল্যাবরেটরির চৌকাঠ মাড়াল
না। তারপরেই দেখবে উদয়াস্ত পড়ে সেখানে। যদি একান্তই চাও লাঞ্চ খেয়ে যাওয়া যাবে’খন’।
অবশ্যই চাই, তারপর শুরু হল অন্য কথাবার্তা। হলবর্ন থেকে বেরিয়ে ছ্যাকড়াগাড়ি ডেকে
উঠে বসলাম। যেতে যেতে ভাবী বন্ধুটি সম্বন্ধে আরও অনেক কথা বললে স্ট্যামফোর্ড।
বললে, ওয়াটসন, শার্লক হোমসের সঙ্গে যদি তোমার বনিবনা না হয়, আমাকে কিন্তু দোষ দিয়ো
না। ল্যাবরেটরিতে মাঝে মাঝে ওকে দেখেছি— এর বেশি খবর আমি রাখি না। তুমি দেখা করতে চাইছ
বলেই যাচ্ছি— আমাকে পরে দুষো না।
বনিবনা না-হলে না হয় ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। জবাব দিলাম আমি। তারপর শক্ত চোখে তাকিয়ে
বললাম, স্ট্যামফোর্ড, ব্যাপার কী বল তো? তুমি মাঝে থাকতে চাইছ না কেন? খুব বদমেজাজি
লোক নাকি? খুলে বলো, ঢেকো না।
হেসে ফেলল স্ট্যামফোর্ড। বললে, অনেক জিনিস বলেও বোঝানো যায় না। হোমস যেন একটু বেশি
রকমের সায়েন্টিফিক— আমার ধাতে সহ্য হয় না। কীরকম যেন হিমশীতল— ঠান্ডা যুক্তিতে ঠাসা—
সঠিক জ্ঞানের পেছনে ধাওয়া করার উন্মত্ততা ওর শিরায় উপশিরায়। চামড়ার ওপর ওর নবতম
আবিষ্কারের প্রতিক্রিয়া কী জানবার জন্যে খুব ঠান্ডা মাথায় বন্ধুর গায়ে ভেজিটেবল
অ্যালক্যালয়েড চিমটি কেটে বসিয়ে দিতে পারে— মনের মধ্যে তিলমাত্র বিদ্বেষ না-রেখে—
নিজের চামড়ার ওপরেও এক্সপেরিমেন্ট করতে পারে অম্লান বদনে।
সে তো ভালোই।
বাড়াবাড়ি হলেই খারাপ। যেমন ধর না কেন, কাটাছেঁড়া করার ডিসেকটিং রুমে যদি যাদের নিয়ে
গবেষণা তাদেরকেই লাঠিপেটা করতে আরম্ভ করে, ব্যাপারটা কিন্তুতকিমাকার হয়ে দাঁড়ায়
না কি?
লাঠিপেটা করে?
তাহলে আর বলছি কী! মৃত্যুর পর আঘাত কতখানি ফুটে ওঠে যাচাই করার জন্যে অমন করে। আমার
নিজের চোখে দেখা!
এর পরেও বলবে সে ডাক্তারি ছাত্র নয়?
বলব বই কী। মেডিক্যাল স্টুডেন্ট তো নয়ই, সে যে কীসের স্টুডেন্ট ঈশ্বর জানেন। যাক গে
ভাই, এসে গেছি। শার্লক হোমস লোক কীরকম, আলাপ করে নিজেই বুঝে নাও।
সরু গলির মধ্যে গাড়ি এসে দাঁড়াল একটা খিড়কির দরজার সামনে। দরজার পরেই মস্ত হাসপাতাল।
চেনা জায়গা। পথ দেখানোর দরকার ছিল না। পাথুরে সিড়ি বেয়ে উঠে গেলাম টানা লম্বা করিডরে।
দু-দিকের চুনকাম করা সাদা দেওয়ালে সারি সারি দরজা। একপ্রান্তে খিলেন দেওয়া একটা গলিপথ
বেরিয়ে গিয়ে শেষ হয়েছে কেমিক্যাল ল্যাবরেটরির সামনে। বিরাট উঁচু ঘর। থরে থরে সাজানো
অসংখ্য শিশিবোতল। চওড়া নীচু বিস্তর টেবিলে বকযন্ত্র, টেস্টটিউব আর নীলাভ শিখাচঞ্চল
জ্বলন্ত বুনসেন বার্নার। ঘরের মধ্যে ছাত্র বলতে একজনই– দূরের টেবিলে হেট হয়ে কাজে
নিমগ্ন। আমাদের পায়ের আওয়াজে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। পরক্ষণেই চেঁচিয়ে উঠল সোল্লাসে।
এক হাতে একটা টেস্টটিউব তুলে ধরে চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়ে এল আমাদের দিকে, পেয়েছি। পেয়েছি।
হিমোগ্লোবিনের সংস্পর্শে এলেই থিতিয়ে যাওয়ার মতো একটাই কেমিক্যাল আমি পেয়েছি। সোনার
খনি আবিষ্কার করলেও বুঝি এর বেশি উল্লাস ওই মুখে ফুটত না।
আলাপ করিয়ে দিল স্ট্যামফোর্ড, ডক্টর ওয়াটসন, মি. শার্লক হোমস।
ভাবতেও পারিনি ওই চেহারায় এত জোর থাকতে পারে— আফগানিস্তানে ছিলেন দেখছি।
আপনি জানলেন কী করে? অবাক হয়ে বললাম আমি।
তা জেনে কী হবে? শুকনো নীরস হেসে বললে হোমস। প্রশ্ন এখন এই হিমোগ্লোবিনকে নিয়ে। আমার
আবিষ্কারটার গুরুত্ব নিশ্চয় অনুধাবন করেছেন?
রসায়নগতভাবে কৌতুহলোদ্দীপক আবিষ্কার সন্দেহ নেই। কিন্তু বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে—
বলেন কী মশায়! এ-রকম প্রাকটিক্যাল মেডিকো-লিগ্যাল আবিষ্কার কতদিন হয়নি জানেন? রক্তের
দাগ প্রমাণ করবার অকাট্য পদ্ধতি কি এর ফলে পাচ্ছেন না? আসুন! এসে দেখে যান!। সাগ্রহে
আমার কোটের হাতা খামচে ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল কাজের টেবিলের সামনে। টাটকা
রক্ত চাই, বলতে বলতে পাট করে নিজের আঙুলেই লম্বা বডকিন ও ফুটিয়ে রক্ত বার করে টেনে
নিল কেমিক্যাল পিপেটের মধ্যে। এবার দেখুন এক ফোটা রক্ত মিশিয়ে দিচ্ছি এক লিটার জলের
মধ্যে। দেখতেই পাচ্ছেন রক্ত-মিশোনো জলটাকে দেখতে এখন বিশুদ্ধ জলের মতোই। রক্তের অনুপাত
কিন্তু দশ লাখের এক ভাগ– তার বেশি নয়। তা সত্ত্বেও রিঅ্যাকশন আমরা দেখতে পাব। বলেই
কয়েক টুকরো সাদা ক্রিস্টাল ছুড়ে ফেলল জলের মধ্যে, তারপর ঢালল কয়েক ফোটা স্বচ্ছ তরল
পদার্থ। সঙ্গে সঙ্গে ম্যাটমেটে মেহগনি রং হয়ে গেল জলটার এবং খানিকটা বাদামি ধুলো থিতিয়ে
পড়ল কাচের জারের তলায়।
... হাঃ হাঃ হাঃ! কেমন, এবার কী বলবেন? নতুন খেলা পেয়ে বাচ্চা ছেলের হাততালি দেওয়ার
মতো হাততালি দিয়ে পরমোল্লাসে বলল হোমস।
আমি বললাম, দেখে তো মনে হচ্ছে টেস্টটা খুব সূক্ষ্ম।
বিউটিফুল! বিউটিফুল! মান্ধাতার আমলের গুয়াইকাম টেস্টটাই যেমন লটঘটে তেমনি অনিশ্চিত।
মাইক্রোস্কোপে রক্তকণিকা পরীক্ষাও তাই। রক্তের দাগ কয়েক ঘণ্টার বাসি হলে তা পরীক্ষার
আর প্রশ্নই ওঠে না। এই টেস্টে কিন্তু ধরা যাবে রক্তটা বাসি না টাটকা। টেস্টটা যদি আগে
কেউ আবিষ্কার করত, মারাত্মক অপরাধে অপরাধী বহু ব্যক্তিরই বহাল তবিয়তে ধরাধামে বিচরণ
বন্ধ হয়ে যেত— হাতেনাতে পেত পাপের সাজা!
তা ঠিক!’ স্বগতোক্তি করলাম আমি!
ক্রিমিন্যাল কেসের অনেক কিছুই নির্ভর করে একটা পয়েন্টের ওপর। খুন করার বেশ কয়েক মাস
পরে হয়তো সন্দেহ এসে পড়ল খুনির ওপর। জামাকাপড় পরীক্ষা করে বাদামি দাগও পাওয়া গেল।
কিন্তু সে-দাগ কাদার দাগ কী রক্তের, মরচের দাগ না ফলের কে বলবে? সমস্যাটা নিয়ে বহু
এক্সপার্টের মুণ্ডু ঘুরে গিয়েছে। এখন থেকে আর ঘুরবে না। পাওয়া গেছে শার্লক হোমস টেস্ট।
বলতে বলতে চোখ জ্বলজ্বল করতে লাগল অদ্ভুত মানুষটার। হাত রাখল বুকের ওপর এবং এমনভাবে
বাতাসে মাথা ঠুকে অভিবাদন করল শূন্যকে লক্ষ করে যেন তার সুদূর কল্পনায় উদবেলিত হয়ে
উঠেছে করতালিমুখর বিশাল জনতা।
উৎসাহ দেখে চমৎকৃত হয়ে মন্তব্য করলাম, আপনাকে অভিনন্দন জানানো উচিত।
গত বছর ফ্রাঙ্কফুর্টেণ্ড ভন বিসচফের কেস হয়েছিল। এই টেস্ট যদি তখন থাকত ফাঁসি হয়ে
যেত ভন বিসচফের। এ ছাড়াও রয়েছে ব্রাডফোর্ডের ম্যাসন, কুখ্যাত মুলার নিউ অলিয়েন্সের
স্যামসন আর ম'পেলিয়ারের লেফেভার। এক কুড়ি মামলা এখুনি বলতে পারি— প্রতিটি কেসেই অকাট্য
হতে পারত এই টেস্ট।
হেসে ফেলল স্ট্যামফোর্ড। বলল, তুমি যে দেখছি একটা চলন্ত ক্রাইম ক্যালেন্ডার। এই লাইনে
একটা কাগজ বার করে ফ্যালো। ‘পুলিশের অতীত সংবাদ।’ ভালো চলবে।
‘পড়ে ইন্টারেস্ট পাওয়া যাবে’, আঙুলের ক্ষততে স্টিকিং প্লাস্টার লাগাতে লাগাতে বললে
হোমস আমার দিকে চেয়ে একটু হেসে, একটু সাবধান হওয়া দরকার আমার। বিষ নিয়ে কাজ করি
তো। হাত বাড়িয়ে দিতে দেখি বিস্তর স্টিকিং প্লাস্টার লাগানো হাতের চারিদিকে— অ্যাসিডেও
বিবর্ণ হয়ে গেছে বেশ কয়েক জায়গা।
তিন পায়ার লম্বা টুলে বসল স্ট্যামফোর্ড আর একটা টুল পা দিয়ে ঠেলে দিলে আমার দিকে।
বললে, আমরা এসেছিলাম কাজ নিয়ে। ওয়াটসন বাসা খুঁজছে। তুমি বড়ো ঘ্যান ঘ্যান করছিলে
ঘর ভাগাভাগি করে থাকার মতো সঙ্গী পাচ্ছে না বলে! তাই ভাবলাম তোমাদের মিলিয়ে দিই।
আমার সঙ্গে ঘর ভাগ করে থাকার কথা শুনেই কিন্তু উল্লসিত হল শার্লক হোমস। বললে, বেকার
স্ট্রিটের একটা বাড়ির ওপর নজর আছে আমার। দু-জনের পক্ষে উপযুক্ত। কড়া তামাকের গন্ধ
কি আপনার অপছন্দ?
আমি নিজে “শিপ’ ব্র্যান্ড স্মোক করি।
চমৎকার। কেমিক্যাল নিয়ে থাকতে ভালোবাসি আমি— মাঝে মাঝে এক্সপেরিমেন্টও করি। বিরক্ত
হবেন না তো?
একেবারেই না।
ভেবে দেখি আর কী কী বদখেয়াল আছে আমার। মাঝে মাঝে গুম হয়ে বসে থাকি— দিন কয়েক হয়তো
মুখই খুলি না। ভাববেন না যেন মুখ ভারী করেছি। একলা থাকতে দেবেন— দেখবেন ঠিক হয়ে যাব।
এবার বলুন আপনার গলদ কী কী আছে! একসঙ্গে থাকতে যাওয়ার আগে দু-জনেরই খারাপ দিকগুলো
আগে জেনে নেওয়া দরকার।
জেরার বহর দেখে না-হেসে পারলাম না। বললাম, আমি একটা বুলডগের বাচ্চা পুষি। ঝগড়াঝাটি
চেঁচামেচি ভালোবাসি না। নার্ভ আমার অনেক ধাক্কায় কাহিল। মাঝরাতে উঠে বসে থাকি। আর
ভীষণ কুঁড়ে আমি। শরীর ভালো থাকলে আর এক ধরনের বদ স্বভাব মাথা চাড়া দেয় অবশ্য, তবে
এগুলোর চাইতে সেটা বড়ো নয়।
চেঁচামেচির মধ্যে বেহালা বাজানোও ধরেন নাকি? উদবিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে হোমস।
সেটা নির্ভর করছে বাজনাদারের ওপর। ভালো বেহালা বাজনায় দেবতাও তুষ্ট হন— আর যদি আনাড়ির
হাতে—
খুশিতে কলকলিয়ে উঠল হোমস, ব্যাস, ব্যাস, ওতেই হবে। একসঙ্গে থাকতে পারব বলেই বিশ্বাস—
যদি ঘরদেরি আপনার পছন্দ হয়।
কখন দেখা যায় বলুন।
কাল দুপুরে এখানেই চলে আসুন। দু-জনে মিলে গিয়ে দেখে শুনে একটা ব্যবস্থা করে ফেলা যাবে’খন।
করমর্দন করে বললাম, তাহলে সেই কথাই রইল— কাল দুপুরে।
কেমিক্যাল পরিবৃত অবস্থায় হোমসকে রেখে আমি আর স্ট্যামফোর্ড বেরিয়ে এলাম। হেঁটে চললাম
হোটেলের দিকে।
যেতে যেতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম স্ট্যামফোর্ডকে, আচ্ছা, আমি যে আফগানিস্তান
ঘুরে এসেছি, মি. হোমস তা বুঝলেন কী করে?
দুর্বোধ্য হাসি হেসে স্ট্যামফোর্ড বললে, ওর অনেক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে— এটা তার মধ্যে
ছোটোখাটো একটা। অনেকেই অবাক হয়েছে ওর এই ক্ষমতায়– অচেনা মানুষকে দেখেই হাঁড়ির খবর
পর্যন্ত বলে কী করে, সে এক রহস্য।
রহস্য তো বটেই! সোৎসাহে দু-হাত ঘষতে ঘষতে বললাম, তীব্র রহস্য। এ-রকম লোকের সঙ্গে আলাপ
করিয়ে দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞ রইলাম তোমার কাছে। জানো তো মনুষ্যত্বের প্রকৃত পর্যবেক্ষণ
যে করতে পারে, মানুষ তাকে বলা যায়।
তুমি ওকে যত না পর্যবেক্ষণ করবে, তার চাইতে অনেক বেশি ও করবে তোমাকে। তোমার কাছে শার্লক
হোমস একটি গ্রন্থিল বাঁধা হয়ে থাকবে চিরকাল— কিন্তু তোমার ভেতর পর্যন্ত স্পষ্ট হয়ে
যাবে ওর চোখে। চললাম।
এসো, বলে ফিরে এলাম হোটেলে। মন কিন্তু পড়ে রইল নতুন বন্ধুটির প্রতি।