পদ্মা নদীর মাঝি - Padma Nodir Majhi by মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় - Manik Bandhopadhya, chapter name পদ্মা নদীর মাঝি - ৭

পদ্মা নদীর মাঝি - ৭

ইলিশের মরশুম শেষ হইয়া গেল। ধনঞ্জয়ের তিনটি নৌকা ইলিশ মাছ ধরার কাজে লাগানো হইয়াছিল, একটিতে থাকিত সে নিজে, অন্য দুটিতে তার দুই ছেলে। আশ্বিনের ঝড়ে একটি নৌকা ভাঙিয়া গিয়াছে। এবার একটি নৌকা সে রাখিল মাছ ধরার জন্য, অন্যটি লাগানো হইল ভাড়া খাটিবার কাজে। ছেলেরা মাছ ধরিবে, নিজে সে একজন মাঝিকে লইযা নৌকা বাহিলে।

কুবেরকে ধনঞ্জয় পছন্দ কবে না। গণেশকে সে তার নৌকার মাঝি হইতে বলিল। কিন্তু গণেশ কিনা বোকা, সে গেল পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিতে কুবেরের কাছে!

কুবের রাগিয়া বলিল, যা যা, খাট গিয়া আজান খুড়ার নায়। আমারে জিগাস ক্যান। আজান খুড়া বেশি আপনার না তর?

কুবের অনুমোদন না করিলে তাহা হইবার নয়, গণেশ ধনঞ্জয়কে বলিয়া আসিল তার নৌকায় এক সে মাঝির কাজ করিবে না, কুবের যদি করে তবেই সে করিবে, নতুবা নয়। শুনিয়া ধনঞ্জয বলিল, যা, মর গিয়া তবে পঞ্চাশ জনা মাঝি রাখুম, কলের জাহাজ পাইছস, না?

গণেশ তাহা জানে না। চিরদিন সে কুবেরের কথায় নির্ভর করিয়া আসিয়াছে, কলের জাহাজ হোক আর ছোটো পানসি হোক কুবের যেখানে নাই গণেশও নাই সেখানে। কুবেরের দাওয়ায় বসিয়া সে নিশ্চিন্ত মনে তামাক টানিতে লাগিল, আর কুবের গভীর চিন্তিত মুখে ভাবিতে লাগিল, এবার কী করিবে। মাঝিগিরিই সে করিবে সন্দেহ নাই, তবু গম্ভীর চিন্তিত মুখে অন্য কিছু করা যায় কিনা ভাবিতে কুবের চিরদিন বড়ো ভালোবাসে।

কপিলা চলিয়া যাওয়ার পব ক্ৰমে ক্ৰমে কুবেরের অভাব বাড়িয়াছে। ঘরের লক্ষ্মী যেন চলিয়া গিয়াছে কপিলার সঙ্গে, পরিপূর্ণভাবে ক্ষুধার নিবৃত্তি আর হইতেছে না। সময়টা পর্যন্ত পড়িয়াছে খারাপ। জিনিসপত্রের দাম চড়িয়া গিয়াছে। বর্ষায় একটা ফসল নষ্ট হইয়াছিল, পাটের কল্যাণে আমন ধানের ফসলও হইয়াছে কম। চাষিদের ঘরে ধান নাই, টাকা নাই, আছে পাট – কুবেরের ঘরে কিছুই নাই। পাটের উপর চাষির অনিশ্চিত মরণ-বাঁচন, কুবেরের জীবনধারণ সুনিশ্চিত মাঝিগিরিতে—সেটা ভালোমতো জুটিতেছে না। একটা নৌকা যদি কুবেরের থাকিত! পদ্মার ঘাটে ঘাটে তবে সে কুড়াইয়া বেড়াইতে পারিত জীবিকা, পরের নৌকায় লগি ঠেলিতে পাইবার ভরসায় বসিয়া থাকিতে হইত না।

ভোরবেলা এখন নদীর বুক জুড়িয়া থাকে কার্তিকের কুয়াশা, যদিও অগ্রহায়ণ আসিয়া গিয়াছে। জলের তল হইতে মাঠঘাট মাথা তুলিয়াছে। কোথাও রবিশস্যের চারা উকি দিয়াছে, কোথাও সবে শস্য-বীজ বপন করা হইতেছে। রাত্রে অল্প অল্প শীত করে, কাপড় গাযে দিতে হয়।

কুবেরের মন বড়ো খাবাপ। কিছু ভালো লাগে না। গোপি হাসপাতাল হইতে ফিরিয়া আসিয়াছে, ভাঙা হাঁটুটি তাহার শক্ত হইয়া গিয়াছে, সে হাঁটিতে পারে না। ভবিষ্যতে আবার কোথায় হাড় ভাঙিয়া ঠিক করিয়া দিলে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া হয়তো সে হাঁটিতে পারিবে, চলন তাহার স্বাভাবিক হইবে না কোনোদিন। যুগলকে জামাই করাব আশা আর নাই। মেয়ের বিবাহ দিবার এবং সেই উপলক্ষে কিছু টাকা পাইবার ভরসাও লুপ্ত হইয়া গিয়াছে।

কী উপায় হইবে গোপির?

রাসু মাঝে মাঝে আসে, বেশ বুঝিতে পারা যায় গোপির অবস্থা দেখিয়া সে বড়োই দুঃখিত হইয়াছে। গোপির হাঁটুর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ডাক্তার কী বলিয়াছে রাসু খুঁটাইয়া খুঁটাইয়া জিজ্ঞাসা করে, এক একদিন টিপিয়া টুপিয়া নিজেই পরীক্ষা করিয়া দেখিতে যায়, কী সন্তর্পণে সে যে স্পর্শ করে গোপির হাঁটু!

মালা হঠাৎ রাসুকে বড়ো খাতির করিতে আবম্ভ করিয়াছে। যুগল অবস্থাপন্ন লোক, গোপির দিকে সে আর ফিরিয়াও চাহিবে না, চালচুলাহীন রাসু হয়তো গোপিকে গ্রহণ করিতে পারে।

বড়ো দোটানায় পড়িযাছে রাসু। আজ সে চাহিলেই গোপিকে পায়, এক পয়সা পণও তাহাকে দিতে হইবে না-কিন্তু সে কি এই গোপিকে চাহিয়াছিল, এই পঙ্গু মেযেটাকে? খোঁড়া মালাকে লইয়া কুরেব সংসার পাতিয়াছে, অসুখী কুবের নয়, দারিদ্র্যের পীড়নে সে কষ্ট পায় বটে কিন্তু পারিবারিক জীবনটি তাহার কামনা করিবার মতো—গোপিকে লইয়া হয়তো সে এমনি সুখের সংসারই পাতিয়া বসিতে পারিবে। তবু মনটা খুঁতখুঁত করে রাসুর! খোড়া বউ! হয়তো জীবনে কোনোদিন সে উঠিয়া দাঁড়াইতে পারিবে না—যদি পারেও, লাঠি ধরিয়া খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া হাঁটিবে, পায়ের জন্য দেহের হয়তো তার পুষ্টি হইবে না, চিরকাল কুৎসিত দেখাইবে তাহাকে।

শেষ পর্যন্ত গোপির পায়েব অবস্থাটা কী দাঁড়ায় দেখিয়া কর্তব্য নির্ণয় করাব জনা প্রতীক্ষা করাও বিপজ্জনক। হাসপাতালের ডাক্তার যদি পা-টিকে ঠিক আগের মতো করিয়া দেয়? মরা মানুষ বাঁচায় ডাক্তার, কত ওষুধ কত যন্ত্রপাতি ডাক্তারের, একটা ভাঙা পা ঠিক করিয়া দেওয়া তার পক্ষে কঠিন নয়। তখন রাসুকে কি আর কুবের জামাই করিতে চাহিবে? আপশোশ করিয়া মরিতে হইবে রাসুকে তখন।

সাইরা যাইব কয় নাই ডাক্তার? রাসু জিজ্ঞাসা করে।

হ। কুবের জবাব দেয়।

কিন্তু এ কথা রাসু বিশ্বাস করিতে পারে না। গোপির পা যে কিছুদিনের মধ্যে ঠিক হইয়া যাইবে রাসুকে তাহা বিশ্বাস করাইতে এত বেশি আগ্রহ দেখায় কুবের যে রাসু সন্দিগ্ধ হইয়া ওঠে।

হঠাৎ একদিন সে করে কী, চলিয়া যায় আমিনবাড়ি। হাসপাতালে গিয়া জিজ্ঞাসাবাদ করে, বলে যে সে গোপির আত্মীয়–কোনোমতেই কি গোপির পা-টি আগের মতো করিয়া দেওয়া যায় না? ডাক্তাবের সামনে হাতজোড় করিয়া সে দাঁড়াইয়া থাকে। কত ব্যাকুল, কত উৎকণ্ঠিত আত্মীয় সে গোপির!

না, গোপির দরদি আত্মীযকে ভরসা ডাক্তার দিতে পারেন না।

রাসু চিন্তিত মুখে গ্রামে ফিরিয়া আসে। আবার সে দেখিতে যায় গোপিকে। শীতের কুয়াশার মতো ফ্যাকাশে হইয়া গিয়াছে মেয়েটা, শীর্ণ রোগা মুখখানাতে জ্বলজ্বল করিতেছে দুটা চোখ, একটা খড়ের পুটুলির উপর ভাঙা পা-টি রাখিয়া এলাইয়া পড়িয়া আছে বিছানায়।

রাসু মমতা বোধ করে। ময়নাদ্বীপে একে একে স্ত্রীপুত্রকে হারাইয়া যে নিষ্ঠুর বেদনায় বুক তাহার দীর্ণ হইয়া গিয়াছিল, তেমন বেদনা লক্ষ স্ত্রীপুত্রকে হারাইয়াও আর সে কোনোদিন অনুভব করিবে না–গোপির ভাঙা পা-খানা দেখিলে মনটা শুধু কেমন করিয়া ওঠে।

 

একদিন সকালে হোসেন মিয়া কুবেরের বাড়ি আসিল।

মৃদু মৃদু হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কাম মিলে নাই কুবের বাই?

কুবের মাথা নাড়িয়া বলিল, না।

হোসেন বলিল, জান দিয়া তোমাগো দরদ করি, ক্যামনে ভালা করুম তোমাগো হুঁশ থুই কুবের বাই। কাম করবা, আমার লায়?

মনে মনে কুবের ভয় পাইল। কী মতলব করিয়াছে হোসেন মিয়া? যাচিয়া কাজ দিতে চায কেন? হোসেন মিয়ার উপকার গ্রহণ করিলে শেষ পর্যন্ত মঙ্গল নাই কুবের তাহা ভালো করিয়াই জানে, কোন স্বাৰ্থ সাধিবার জন্য কবে কাকে হোসেন মিয়ার প্রয়োজন হয় তাই শুধু কেহ জানিতে পাবে না। কুবের একবার ভাবিল, না, হোসেন মিয়ার নৌকায় সে কাজ করিবে না। কিন্তু এ কথা বলা যায় না। লোকটার মৃদু হাসি-ভরা মুখের দিকে চাহিয়া যত ভয় করে কুবেবের, সেই ভয়েব তাড়নাতে ওকেই যেন জড়াইয়া ধরিবার প্রয়োজন তত বাড়ে। তা ছাড়া, আজ পর্যন্ত ক্ষতি সে কিছুই তাহার করে নাই, বরং উপকার করিয়াছে অনেক।

কুবের জোর করিয়া আগ্রহ দেখাইয়া বলিল, হোসেন মিয়ার নৌকায় কাজ পাইলে সে বর্তিয়া যায়। সে যেন জানিত না কুবের রাজি হইবে, এমনিভাবে হোসেন খুশি হইয়া গেল-মানুষ বশ করার কত কাযদাই লোকটা জানে। কী কাজ করিতে হইবে কুবেরকে, কী সে পাইবে, এ সব কথা কিছুই উঠিল না। হোসেন শুধু বলিল, মাঝে মাঝে দশ পনেরো দিনের জন্য কুবেরকে বাড়িঘর ছাড়িয়া যাইতে হইবে, যাইতে হইবে পদ্মার দূরতম বন্দরে, যেখানে যেখানে হোসেন মিয়ার বাণিজ্য আছে। কীসেব বাণিজ্য হোসেন মিয়ার? কে তা জানে। কে সে প্রশ্ন করিবে। কুবের শুধু সায় দিয়া গেল— তার আপত্তি নাই। সপরিবারে ময়নাদ্বীপ যাওয়া ছাড়া যেখানে যাইতে বলুক কুবের সেইখানে যাইবে, যা করিতে বলুক তাই করিবে, প্রতিদানে জীবিকা পাইলেই হইল।

গণেশের কথাটা কুবেরের মনে পড়িতেছিল, তার জন্য ধনঞ্জয়ের নৌকায় একা সে কাজ নেয নাই। আজ গণেশকে ফেলিয়া হোসেন মিয়ার নৌকায় কাজ নেওয়া তার কি উচিত হইবে? কুবের উশখুশ করে। গণেশের কথাটা বলিতে গিয়া মুখে আটকাইয়া যায়। বন্ধুত্ব বজায় রাখিতে গিয়া যদি তার নিজের কাজটা ফসকাইয়া যায়? তা ছাড়া, তার সঙ্গে গণেশও হোসেন মিয়ার খপ্পরে আসিয়া পড়িবে এটা কুবেরের ভালো লাগিতেছিল না।

তবু, গণেশেরও একটা উপায় হওয়া চাই।

টোঁক গিলিয়া কুবের জিজ্ঞাসা করিল গণেশকে নিতে পাবে না হোসেন মিয়া? গণেশ বলবান, পাকা মাঝি গণেশ–বুদ্ধিটা একটু ভোঁতা বটে কিন্তু জেলেপাড়ায় ওর মতো লগি ঠেলিতে, দাঁড় টানিতে আর কেহ পারে না।

হোসেন বলিল, ডাইকা আনবা গণেশরে?

অখল?

হ, যাও, বাতচিত কইরা যাই।

কুবের অনিচ্ছার সঙ্গে উঠিয়া গেল। হোসেন মিয়াকে একা বাড়িতে রাখিয়া যাইতে তার ভরসা হয় না। গণেশকে নিয়া ফিরিয়া আসিয়া সে দেখিল, ইতিমধ্যে সংবাদ পাইয়া আমিনুদ্দি আসিয়া হোসেন মিয়ার কাছে বসিয়াছে। আমিনুদ্দিকে দেখিলে চিনিতে পারা যায় না। কয়েকদিন আগে জহরের ছেলের সঙ্গে মেয়েটার সে বিবাহ দিয়াছে, স্ত্রীপুত্রের অপমৃত্যুর পর এত তাড়াতাড়ি মেয়ের বিবাহ দিতে সকলে তাহাকে বারণ করিয়াছিল, কারও কথা সে শোনে নাই। যেটুকু বন্ধন ছিল তাও সে অধীর হইয়া চুকাইযা ফেলিয়াছে। এবার সে কী করিলে সেই জানে!

কুবেরকে দেখিয়া আমিনুদ্দি বলিল, ময়নাদ্বিপি যামু গিয়া কুবির, কাইজা মনে থুইয়ো না, কসুর মাপ কইরো বাই।

ময়নাদ্বিপি যাবা? ক্যান?

কই যামু, না ত?

কুবের ও গণেশ অভিভূত হইয়া আমিনুদ্দিল দিকে চাহিয়া বহিল। সকলকে হারাইযা রাসু একদিন ময়নাদ্বীপ হইতে ফিরিয়া আসিয়াছিল, এখানে সকলকে হারাইয়া আমিনুদ্দি আজ ময়নাদ্বীপে যাইতেছে। আমিনুদ্দিকে ওখানে নেওয়ার জন্য হোসেন অনেকদিন হইতে চেষ্টা করিতেছিল, এতদিনে তাহার মনস্কামনা পূর্ণ হইল—হোসেনের কোনো ইচ্ছা কি অপূর্ণ থাকিবার নয়? ভয়ে তাহারা হোসেন মিয়ার দিকে তাকাইতে পারে না। মনে হয আশ্বিনের ঝড় নয়, হোসেন মিয়াই আমগাছ ফেলিয়া আমিনুদ্দির কুটিরখানি চূর্ণ করিয়া দিয়াছিল। লোকে যে বলে কোনো কোনো মানুষের ভূতপ্রেতের উপর কর্তৃত্ব থাকে, হোসেনেরও তাই আছে কিনা কে জানে : একদিন রাত্রে সে যে হোসেন মিয়ার পকেট হইতে পয়সা চুরি করিয়াছিল সে কথা মনে করিয়া কুরেরেব বুকের মধ্যে চিপটিপ করিতে থাকে। এমন অলৌকিক শক্তি যার, সে কি টের পায় নাই চুরির কথা? ঘরের চালা হয়তো নয়। হয়তো হোসেনের পোষ-মানা অন্ধকারের অশরীরী শক্তি সেদিন গোপীর হাঁটু ভাঙিয়া দিয়াছিল, বাড়ি ছিল না বলিয়াই কুবের সেদিন বাঁচিয়া গিয়াছিল নিজে টু মেঘলা অমাবস্যার অন্ধকারের মতো অতল কুসংস্কার নাড়া খাইয়া কিছুক্ষণের জন্য কুবেবের মনকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখে।

খানিক পরে আমিনুদ্দি উঠিয়া গেল। তখন হোসেন কুবের ও গণেশকে বুঝাইবার চেষ্টা করিল, ময়নাদ্বীপে গিযা মঙ্গলই হইবে আমিনুদ্দির, এখানে শোকে দুঃখে কাতর হইয়া থাকিবে লোকটা, তার চেয়ে সেখানে গিয়া আবার বিবাহাদি করিয়া ঘর-সংসার করা কি ভালো হইবে না ওর পক্ষে? ময়নাদ্বীপ কি সে রকম আছে এখন, জঙ্গল সাফ হইয়া এখন সেখানে নগ্র বসিয়াছে।

হোসেন মিয়া চলিয়া গেলে গণেশ ও কুবের বসিয়া বসিয়া অনেকক্ষণ গল্প করিল। ভবিষ্যতের সব জল্পনা-কল্পনা। চাকরি পাইয়া দুজনেই খুশি হইয়াছে, দেনাপাওনা ব্যাপালে হোসেন মিয়া কৃপণ নয়, কোথায় কোথায় যাইতে হইবে, লগি ঠেলা ছাড়া আর কী তাদের দিয়া হোসেন মিয়া করাইয়া লইবে, এখন তাই শুধু তাদের ভাবনা।

 কয়েকদিন পরে হোসেন মিয়ার আহ্বান আসিল।

কুবের ও গণেশ সকাল সকাল খাইয়া নদীর ঘাটে গেল। ঘাটে হোসেন মিয়ার বড়ো একটি পানসি বাঁধা ছিল। নৌকায় আরও দুজন মাঝি আছে, তারাও হিন্দু। হোসেন মিয়ার ব্যবস্থা ভালো, একই নৌকায় হিন্দু-মুসলমান মাঝি থাকিলে তাদের রান্না-খাওযার অসুবিধা হয়, সে তাই তার তিনটি নৌকার দুটিতে শুধু মুসলমান মাঝিই রাখিয়াছে, আর এই নৌকাটিতে রাখিয়াছে হিন্দু মাঝি। অন্য মাঝি দুজনের নাম শম্ভু ও বগা।

তখন নদীতে কিছুকিছু কুয়াশা ছিল। সকলকে দাঁড় ধরিতে বলিয়া হোসেন নিজে হাল ধরিয়া বসিল। নৌকা চলিল দেবীগঞ্জের দিকে। দেবীগঞ্জে হোসেন নামিয়া গেল। ঘণ্টাখানেক পরে ফিরিয়া আসিয়া কুবেরকে সে ডাকিল কাছে। বলিল, কলিকাতা হইতে বিড়ি চালান আসিয়াছে, নৌকায় আমিনবাড়ি পৌঁছিয়া দিতে হইবে। সেখানে গিরিধারী সাহার গদিতে খবর দিলে তাহারা মাল নামাইয়া লইয়া যাইবে, তারপর কুবের নৌকা লইয়া ফিরিয়া আসিবে কেতুপুরে। দ্বিতীয় আদেশ পাওয়া পর্যন্ত নৌকা কেতুপুরেই বাঁধা থাকিবে।

সকলকে সঙ্গে করিয়া হোসেন রেলের মালগুদামে গেল। টাকা দিয়া মাল খালাস করিয়া আর সে কথা বলিল না, কুবেরের হাতে তিনটি টাকা দিয়া জেটিতে যে স্টিমারটি বাধা ছিল সোজাসুজি তাহাতে গিয়া উঠিল।

হোসেন মুখে বলিয়া যায় নাই, তবু কাহারও বুঝিতে বাকি থাকে নাই যে সমস্ত ভার সে দিয়া গিয়াছে কুবেরকে, কুবেরই সব ব্যবস্থা করিবে। কুবের প্রথমটা একেবারে অভিভূত হইয়া গেল। এ কী সম্মান তার, এ কী সৌভাগ্য! এতবড়ো একটা নৌকা, তিনজন জবরদস্ত মাঝি, তিনশো চারশো টাকার মাল-এ সমস্তের উপর কর্তৃত্বের অধিকার তাহার একার। সকলের রাহাখরচেব টাকা পর্যন্ত হোসেন মিয়া তাহার জিম্মী করিয়া দিয়া গিযাছে!

মাল তুলিতে গিয়া কুবেরের মুখে কথা আটকাইয়া গেল। ভয়ে ভয়ে সে একবার সকলের মুখের দিকে চাহিল। হোসেন মিয়ার পক্ষপাতিত্বে না জানি মনে মনে ওরা কত রাগিয়াছে।

তারপর কুবের নীরবে একটা প্যাকিং কেস তুলিয়া লইল। শম্ভু জিজ্ঞাস করিল, জলপানি দিবা না কুবির?

কুবের ক্ষীণকণ্ঠে বলিল, মাল নায় তুইলা দিলে চলব না?

তা চলিবে। ধীরে সুস্থে তাহারা বিড়ির কেসগুলি নৌকায় তুলিতে লাগিল। কাজে কারও যেন গা নাই। কাজের চেয়ে কথা বলিয়া কুবেরের সঙ্গে খাতির জমাইবার চেষ্টাই তাদের বেশি। একপ্রস্থ মাল রাখিয়া আসিয়াই বগা কুবেরের কাছে একটা বিড়ি দাবি করিয়া বসিল। ওদের দেখাদেখি গণেশও যেন গা ছাড়িয়া দিয়াছে। কুবের মনে মনে বিরক্ত হইয়া উঠিল কিন্তু মুখে কিছু বলিতে সাহস পাইল না।

মাল বোঝাই হইলে কুবের চিড়াগুড় কিনিয়া দিল সকলকে, বসিয়া বসিয়া এত আরামে তাহারা চিড়া চিবাইতে লাগিল যেন আজকের মতো কাজকর্ম সব শেষ হইয়া গিয়াছে। নৌকা খুলিবার পরেও তাদের শৈথিল্য ঘুচিল না। এমনভাবে দাঁড় টানিতে লাগিল যেন কত কাল আগে তারা মরিয়া গিয়াছে।

কুবের বলিল, গাও লাগাও বাই, জোরে খ্যাপ মার।

শম্ভু বলিল, ক্যান?

কুবের সাহস করিয়া বলিল, ক্যান কী? সারাদিন লাগাইবা আমিনবাড়ি যাওনে? হোসেন মিয়া শুইনা কইব কী?

শম্ভু বলিল, হোসেন মিয়া শুনব ক্যান? বলিয়া শম্ভু হাসিল। দাঁড় উঁচু করিয়া রাখিয়া বুক চিতাইয়া বলিল, ডরাও নাকি হোসেন মিয়ারে কুবির, আঁই?

কুবেরের পরিচয় এতক্ষণে ওরা পাইয়া গিয়াছে, সর্দার বলিয়া আর মানিবে না, বন্ধুর মতো সমানভাবে কথা কহিবে। কুবের বড়ো বিমর্ষ হইয়া যায়। কত বড়ো পদটা হোসেন মিয়া তাহাকে দিয়া গিয়াছে, ইতিমধ্যে সে তার পদমর্যাদা হারাইয়া বসিল! প্রথম প্রথম ওরা যখন খাতির করিয়া ভাব জমাইবার চেষ্টা করিয়াছিল তখন একটু দূরত্ব বজায় রাখিয়া চলিলে ভালো হইত। গণেশটা পর্যন্ত ওদের সঙ্গে মিলিয়া তার সঙ্গে ইয়ার্কি জুড়িয়া দিয়াছে।

কড়া কথা বলিবে নাকি? ভয় দেখাইবে? ওরা অবশ্য চটিয়া যাইবে, কিন্তু তাহাতে কী আসিয়া যায় তার! স্বয়ং হোসেন মিয়ার সে নির্বাচিত প্রতিনিধি! তবু জোর করিয়া কুবের কিছু বলিতে পারে না। যেটুকু সে বলে সকলে হাসিয়া উড়াইয়া দেয়, নৌকা অগ্রসর হয় মন্থরগতিতে।

আমিনবাড়ি পৌঁছিতে বিকাল হইয়া গেল। গিরিধারী সাহার দোকানো খবর দেওয়া হইল বটে কিন্তু সেদিন মাল খালাস করিতে কেহ আসিল না। রাত্রে হোটেলে খাইয়া কুবের নৌকায় শুইয়া রহিল, শম্ভু ও বগাব সঙ্গে শহরে গিয়া গণেশ যে কোথায রাত কাটাইয়া আসিল, সকালবেলা বারবার জিজ্ঞাসা করিয়াও কিছু জানা গেল না, রহস্য করিয়া তিনজনে তাহারা হাসিতে লাগিল। মনে মনে বড়ো রাগিয়া গেল কুবের। এ কী তামাশা জুডিয়াছে গণেশ তার সঙ্গে? আজীবন যে নির্ভরশীল বোকা লোকটা তাহার তোষামোদ করিয়া আসিয়াছে, সঙ্গদোষে একদিনে সে এমনভাবে বিগড়াইয়া গেল। একটু বেলায় দোকানের লোক আসিয়া মাল লইয়া গেল। কুবের অবিলম্বে নৌকা ছাড়িল। কেতুপুরের কাছাকাছি আসিয়া দূর হইতে দেখিতে পাওযা গেল, ঘাটে হোসেন মিয়ার সবচেযে বড়ো নৌকাটি বাঁধা রহিয়াছে। দেখিয়া কুবেরের মুখ শুকাইয়া গেল। এত দেরী করার জন্য না জানি হোসেন মিতা তাহাকে কী বলিবে। শম্ভু এবং বগাও হঠাৎ অত্যন্ত বাধ্য ও কর্মঠ হইয়া গেল, ঘাটের কাছে আসিয়া দাঁড় পড়িতে লাগিল ঋপাঝপ, গতি বাড়িয়া গেল নৌকার।

হোসেন মিয়া নৌকার সামনে বসিয়া তামাক টানিতেছিল, ছইয়ের মধ্যে জড়োসড়ো হইয়া বসিয়াছিল একটি নগ্নদেহ বছর চল্লিশ বয়সের পুরুষ, দুটি মাঝবয়সি রমণী ও তিনটি ছোটো ছোটো ছেলেমেযে। দেখিয়া মনে হয় একটি মুসলমান পরিবার। কুবের ওদের চিনিতে পারিল না। হোসেন মিয়ার আত্মীয়স্বজন যে নয় সহজেই টের পাওয়া যায় ময়লা ছেঁড়া কাপড় ওদের পরনে, শীর্ণদেহে শুষ্ক মুখে দাবিদ্র্যের সুপরিচিত ছাপ।

ভয়ে ভয়ে কুবের হোসেন মিয়াব মুখের দিকে তাকায, কিন্তু হোসেন মিয়া এতটুকু বিরক্তির লক্ষণ দেখায় না, দাডিতে হাত বুলাইয়া একবার শুধু জিজ্ঞাসা কবে, মাল খালাস দিছ?

কুবের রসিদটা তার হাতে দেয। তারপর এক টাকা দশ আনা পয়সা ফিরাইয়া দিয়া বলে যে রাহাখরচ বাবদ এক টাকা ছ আনা লাগিয়াছে। বলিয়া তাড়াতাড়ি হিসাবও দাখিল করিতে আরম্ভ করে। বেশি নয়, তিনটি টাকা হইতে দুআনা পয়সা মোটে সে চুরি করিয়াছে, তবু বুকের মধ্যে তাহার ঢিপঢিপ করিতে থাকে। হোসেন মৃদু মৃদু হাসে বলে, বও মিয়া, বও, হিসাব দিবানে পরে।

সেদিন ছুটি।

পরদিন আবার পাড়ি দিতে হইবে। এবার কাছাকাছি কোথাও নয, একেবারে সেই চাঁদপুর ছাড়া। মেঘনার মোহনার দিকে। গন্তব্য স্থানটি ঠিক কোথায হোসেন ভাঙিয়া বলিল না। কুবেবের প্রশ্নে মৃদু মৃদু হাসিয়া জবাব দিল, ব্যস্ততা কীসের? চাঁদপুর গিয়া কুবের নোঙর ফেলুক, ঠিক সময সেখানে হাজির হইয়া হোসেন স্বয়ং নৌকার ভার নিবে, বলিয়া দিবে কোন পথে চলিবে নৌকা, কোথায় গিযা শেষ হইবে যাত্রা।

এবার মাল নয, মানুষ যাত্রী। হোসেনের নৌকায় যে মুসলমান পবিবাবটি আসিয়াছে, তারা। কুবের ও গণেশ কতদিনে বাড়ি ফিরিতে পারিবে বলা যায় না। বাড়িতে খরচ দিয়া যাওযার জন্য হোসেন দুজনকে পাঁচটি করিয়া টাকা দিল।

বাড়ির পথে গণেশের সঙ্গে কুবের কথা বলিল না। রাগে সে চটিযাছে গণেশের উপর। গণেশ সঙ্গে সঙ্গে চলে, একথা সেকথা বলে, কুবের নীরব হইয়া থাকে, মুখ ফিরাইয়া চাহিয়াও দ্যাখে না। গণেশের কিনা মোটাবুদ্ধি, কুবের যে রাগিয়াছে এটা সে টের পাইল একেবারে বাড়ির কাছাকাছি গিয়া।

টের পাইবামাত্র সে বিবর্ণ হইয়া বলিল, গোসা করছ নাকি কুবিরদা?

কুবের বলিল, যা যা বাড়িত যা, বাজে বকস ক্যান?

বলিয়া সে হনহন করিয়া আগাইয়া গেল। গণেশ ক্ষুধার তাড়নায তখনকার মতো বাড়ি গেল বটে, ভাতটি খাইয়াই স আবার হাজির হইল কুবেরের বাড়িতে। কুবের কথা কয না, চাহিয়াও দ্যাখে না। গণেশ ভাবিয়া চিন্তিয়া তামাক সাজিয়া নিজে দুটো একটা টান দিয়াই কুবেরের দিকে বাড়াইয়া দিল, বলিল, ধর কুবিরদা।

কুবের হুঁকা গ্রহণ করিল। তবু সে কথা বলিল না!

বিপদে পড়িয়া গণেশ প্রায় কাঁদো কাঁদো হইয়া বলিল, কিবা কর কুবিরদা, আঁই? যামু গিয়া কইলাম, আর আমু না!

তখন তাহাকে ক্ষমা করিয়া কুবের জিজ্ঞাসা করিল, কাইল রাইতে ছিলি কই?

প্রশ্ন শুনিয়াই গণেশ হাসিয়া ফেলিল, ফিসফিস করিয়া বলিল, বাক্যা মাইয়া কুবিরদা, কিবা গীত কয়!

বলিয়া সে গুনগুন করিয়া গান ধরিল—

পিরিত কইরা জ্বইলা মলাম সই, আ লো সই!
আওন যাওন সমান সোনার, জউলা চুকা দই!
আ লো সই।
থাকলি ঘরে ছ্যাচন কেমন, টেঁকির তলে চিড়া যেমন,
বিদেশ গেলি মনের পোড়ন ভাইজা করে খই!
আ লো সই!

কুবের বলিল, দূর দূর লক্ষ্মীছাড়া! কুচরিত্তির হইছস, আঁই? ক্যান গেছিলি?

গণেশ প্রতিবাদ করিয়া বলিল, কুচরিত্তির কিবা? গীত শোননে দোষ নাই।

ঠিক বেড়ার আড়ালে মালা বুঝি শুনিতেছিল, ডাকিয়া বলিল, আবার কও গীতখান—শুনছ মাঝি? আবার কও।

কুবের ধমক দিয়া বলিল, চুপ থাক, গীত শুইনা কাম নাই।

খানিক পরে চাঁদপুর যাত্রার কথা উঠিল। আড়াল ছাড়িয়া হাতের ভরে ঘষিয়া ঘষিযা মালা এবার আসিল কাছে। মুসলমান পবিবারটিকে হোসেন মিয়া কোথায লইয়া যাইবে অনুমান করিতে কারও বাকি থাকে নাই, কে জানে কোন গ্রাম হইতে ওদের হোসেন সংগ্ৰহ করিয়া আনিয়াছে! কেহ কুপরামর্শ দিবে ভাবিয়া নৌকা হইতে ওদের সে গ্রামে নামিতে পর্যন্ত দেয় নাই। মানুষটি সহজ নয় হোসেন মিয়া! মরুক, তাদের কী? তারা মাঝি, পয়সা দিয়া যে লগি ঠেলিতে বলিবে তারই হুকুম মানিয়া নৌকা ভাসাইবে পদ্মায়, মানুষ না মাল কী আছে নৌকায় তাদের ভাবিবার প্রয়োজন নাই!

বিকালের দিকে গণেশের খোঁজে উলুপী আসিল, বলিল, যুগল আসিয়াছে। কী খবর যুগলের? সাতদিন পরে তাহার বিবাহ। চার কুড়ি টাকা পণ দিয়া সোনাখালির এক রূপসি কন্যাকে সে ঘরে আনিতেছে। ভালো কথা। আনুক! কুবেরের কী? আশ্বিনের ঝড়ে সব আশা-ভরসা তাহার উড়িয়া গিয়াছে। চার কুড়ি টাকা! চার কুড়ি টাকার ভাগ্যই যদি তার থাকিবে, পরের নৌকায় মাছ ধরিয়া লগি ঠেলিয়া সে মরিবে কেন আজীবন!

উলুপী আপশোশ করিয়া বলে, যে কপাল গোপির! একটা বছর সবুর সহিল না মেয়ের, ঠ্যাং ভাঙিয়া খোঁড়া হইয়া রহিল। কত পাপ করিয়াছিল আর জন্মে কে জানে!

কুবের বলিল, ক্যান, যুগাইলা বিনা মানুষ নাই দ্যাশে?

উলুপী একটা অদ্ভুত শব্দ করিয়া বলিল, কেডা নিব খোঁড়া মাইয়ারে?

কুবের ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে উলুপীর দিকে চাহিল, কিছু বলিল না।

রাত্রে সেদিন হঠাৎ আবার গোপির হাঁটু ব্যথা করিতে লাগিল। মেয়ে কী সহজে নিষ্কৃতি দিবে সকলকে। ওর যে কুক্ষণে জন্ম হইয়ছিল। ভোর ভোর কুবের যখন বাড়ির বাহির হইল, গোপি যাতনায় কাঁদিতেছে। বসিয়া থাকিবার উপায় কুবেরের ছিল না। বেলা হইলে তামাক পাতা নিয়া গোপির হাঁটুতে জড়াইয়া বাঁধিয়া দিতে বলিয়া, পথে গণেশকে হাঁক দিয়া, বিরস চিত্তে সে নদীতীরে গেল।

তখনও হোসেন ঘাটে আসে নাই। শম্ভু ও বগা সদা ঘুম হইতে উঠিয়া হাই তুলিতেছে। ছইয়ের মধ্যে মুসলমান পরিবারটি তেমনি জড়োসড়ো হইয়া বসিয়া আছে। রাত্রে কী ওরা ঘুমায় নাই? আগাগোড়া চাদর মুড়ি দিয়া আর একজন কে বসিয়া আছে নৌকায়, কাপড়ের পুটুলিটা রাখিতে নৌকায় উঠিয়া কুবের তাহাকে চিনিতে পারিল। আমিনুদ্দি।

আমাগো লগে যাইবা নাকি আমিনুদ্দি বাই? কুবের জিজ্ঞাসা করিল।

হ।

মাইয়া কান্দে না?

আমিনুদ্দি সায় দিল, হ। কান্দে।

দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হইবে, নৌকার দড়ি কাছি লগি ও দাঁড়গুলি কুবের পরীক্ষা করিয়া দেখিল, তক্তা তুলিয়া ভিতরে কতখানি জল উঠিয়াছে মাপিল। কিছু জ্বালানি কাঠ, তামাক ও নারিকেলের ছোবড়া, চাল, ডাল, তেল, লুন, পিতলের দুটা হাঁড়ি, দুটা লোহার কড়াই, কয়েকখানা কাঁসি কাল সংগ্ৰহ করিয়া রাখা হইয়াছিল, এ সমস্তের তদারকও কুবের করিল। কুবেবের দাযিত্ব কি কম। এত বড়ো অভিযানের সে পরিচালক!

তদারক শেষ করিয়া কুবের বসিয়া একটা বিড়ি ধরাইল, লক্ষ্য করিতে লাগিল ছইয়ের ভিতরের পবিবারটিকে। কী মনমরাই ওদের দেখাইতেছে সকালবেলার ম্লান আলোকে। কারও মুখে কথা নাই, কী যেন ভাবিতেছে সকলে, ভীত ও স্তব্ধ ছেলেমেয়েগুলির পর্যন্ত এতটুকু সাড়া নাই জীবনেব! গ্রাম ছাড়িয়া দেশ ছাড়িয়া নিরুদ্দেশ যাত্রার গভীর বিষাদ ওদের আচ্ছন্ন করিয়া দিয়াছে।

খানিক দেখিয়া কুবের পুরুষটিকে জিজ্ঞাসা করিল, নাম কী মিয়া?

সে মৃদুস্ববে বলিল, রসুল।

বাড়ি কই?

মালুর চর।

কথা বলিতে তাহার ভালো লাগিতেছে না বুঝিতে পারিয়া কুবে্র চুপ করিয়া গেল।

হোসেন মিয়া আসিতে আসিতে চারিদিক আলো হইয়া উঠিল। ততক্ষণে জেলেপাড়ার অনেকে ঘাটে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে উলুপী আসিয়াছে কলসি কাখে, স্বামীকে বিদায দিয়া সে কলসি ভরিয়া বাড়ি ফিরিবে। লখা ও চণ্ডী আসিয়াই কুবেরের কাছে একটা করিয়া পয়সা দাবি করিয়াছিল, না পাইয়া তাহারা মুখ গোঁজ করিয়া আছে, বিদায় নেওয়ার সময় বাপেব কাছে এতখানি নিষ্ঠুরতা তাহারা প্রত্যাশা করে নাই। রাসুও আসিয়া নৌকায় উঠিয়া বসিয়াছে। এমনিভাবে একদিন সকালবেলা সে ময়নাদ্বীপের উদ্দেশে রওনা হইয়াছিল। কিন্তু সে কথা রাসুর বুঝি আজ মনে নাই। নির্বিকার চিত্তে সে হোসেন মিয়ার নিকট বিড়ি চাহিয়া ধূমপান করে, যাচিযা কুবেরকে বারবাব শোনায় যে কুবেরের চিন্তার কারণ নাই, তাহার অনুপস্থিতির সময় সকলের দেখাশোনা সেই করিবে। কবে ফিরবা মাঝি? ঠিক নাই? তা হোক, রাসু যখন গ্রামে রহিল, বাড়ির জন্য কীসের ভাবনা কুবেরের?

এবার নৌকা খুলিলেই হয়। কুবেরকে পথখরচের জন্য টাকা দিয়া হোসেন নামিয়া গেল। টাকার পরিমাণটা কুবেরকে অবাক করিয়া দিল—কী দরাজ হাত হোসেন মিয়ার! ভয়ও কুবেরের হইল বইকী! এতগুলি টাকা সামলাইয়া রাখা, হিসাব করিয়া খরচ করা, সে বড়ো সহজ কর্মভোগ নয়। সবচেয়ে অস্বস্তির কথা, টাকাটা হাতে আসিবা মাত্র তাহার ভাবিতে ইচ্ছা হইতেছে তিন টাকায় যদি দুআনা বাঁচানো যায় নিজের জন্য, চেষ্টা করিলে এতগুলি টাকা হইতে না জানি কত বাঁচানো চলে! কাল হইতে এই কথাই সে থাকিয়া থাকিয়া ভাবিতেছিল বটে, ভাবিতেছিল কত টাকা হোসেন এবার তাহার হাতে দিবে,—পথখরচের টাকাটা অন্য কারও জিন্মায় হোসেন এবার দিবে কিনা এ আশঙ্কাও তাহার ছিল না এমন নয়। আজ টাকাটা পাইয়া সে খানিকক্ষণ অভিভূত হইয়া রহিল। এতখানি বিশ্বাস হোসেন তাহাকে করে? হোসেন মিয়াব মতো মানুষকেও ফাঁকি দিতে পারিয়াছে ভাবিয়া একটু গর্বও কুবেবের হয়, না লোকটা সৰ্বশক্তিমান নয।

কুবের তো জানিত না যে তিন টাকায় দুআনার বেশি ফাঁকি দিবাব সাহস তাহার নাই বলিয়াই হোসেন তাহাকে বিশ্বাস করে! পাঁচটা টাকা কুবের কোনোদিন চুরি করিতে পরিবে না। শুধু সাহসের অভাবে নয়, দুআনার বেলায় যে বিবেক তাহার চুপ করিয়া থাকে পাঁচ টাকার বেলায় তাহাই গর্জন করিয়া উঠিবে।

টাকাগুলি কোমরে বাঁধিয়া কুবের লখা ও চণ্ডীর দিকে চাহিল। তারপর দুটা পয়সা সে ছুড়িয়া দিল ছেলেদের দিকে। পয়সা দুটা কুড়াইয়া নিয়া দুজনে চোখের পলকে অদৃশ্য হইয়া গেল।

এমন সময়ে দেখা গেল আলুথালু বেশে একটি মেয়ে ঘাটের দিকে ছুটিয়া আসিতেছে। নৌকার উপর আমিনুদ্দি চঞ্চল হইয়া উঠিল। হোসেন বলিল, নাও খোলো কুবির।

খোঁটা হইতে নৌকার দড়ি খুলিয়া শম্ভু হাতে ধরিয়া রাখিয়ছিল, সে লাফাইয়া নৌকায় উঠিয়া পড়িল। আমিনুদ্দির মেয়ে যখন ঘাটে একেবারে জলের কিনারা পর্যন্ত আসিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল, নৌকা তফাতে সরিয়া গিয়াছে। বাপজান, বাপজান বলিয়া আকুল হইয়া মেযেটা কঁদিতে লাগিল, নদীতে বুঝি সে ঝাঁপই দিয়া বসে। উলুপী ছাড়া ঘাটে স্ত্রীলোক নাই যে ওকে ধরিবে। উলুপী কলসি কাখে জল নিতে আসিয়াছে, আমিনুদ্দির মেয়েকে তাহার ছুঁইবার উপায নাই। কিন্তু এখন সে কথা ভাবিবার সময় নয়। সে-ই মেয়েটাকে জড়াইয়া ধরিয়া রাথিল। আমিনুদ্দি হাঁকিয়া হাঁকিয়া মেয়েকে, বলিতে লাগিল, সে ফিরিয়া আসিবে, দুদিন পরে নিশ্চয় ফিরিয়া আসিবে।

মৃদু মৃদু বাতাস বহিতেছিল। শম্ভু ও বগা বাদাম তুলিয়া দিল। তারপর কেতুপুবের ঘাট দূর হইতে দূরে সরিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল। কুবের আমিনুদ্দির কাছে আসিয়া বলিল, মাইয়ারে কইয়া আস নাই?

আমিনুদ্দি মাথা নাড়িল।

দাঁড় বাহিবার প্রয়োজন ছিল না, আস্তে আস্তে বাতাসের জোর বাড়িয়াছে, বাদাম উঠিয়াছে ফুলিয়া। কুবের এবার নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়া নিজের রাজ্যপাট ও প্রজাপুঞ্জের দিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিল। রাজ্য প্রকাণ্ড, বসিবার শুইবার স্থানাভাব নাই, শুধু প্রজারা বড়ো অসুখী। মাঝবয়সি রমণীটি, পরিচয় নিয়া কুবের জানিতে পারিল রসুলের সে বোন, যাত্রার আগেই মৃদুস্বরে কঁদিতে আরম্ভ করিয়াছিল, কত গ্রাম তাহারা পার হইয়া আসিয়াছে, এখনও থাকিয়া থাকিয়া সে চোখ মুছিতেছে।

বেলা বাড়িতে লাগিল। কুবের সকলকে জলখাবার বণ্টন করিয়া দিল। বাড়ি হইতে বাহির হইবার সময় মনটা খারাপ হইয়াছিল, এখন মন্দ লাগিতেছে না কুবেরের। নদীকে সে বড়ো ভালোবাসে, নদীর বুকে ভাসিযা চলার মতো সুখ আর নাই। একে একে কতকগুলি লঞ্চ ও স্টিমার দুদিক হইতে ঢেউ তুলিয়া আসিয়া আগাইয়া যায়, সম্মুখের বোঝাই নৌকাগুলি পড়ে পিছনে। কোথাও নদীর একটি ছাড়া তটরেখা নাই, কোথাও অপর তীরের গাছপালা অস্পষ্ট চোখে পড়ে। কাউয়াচিলা পাখিগুলি ক্ৰমাগত জলে ঝাঁপাইয়া পড়িতেছে, বকেরা এখন একক শিকারী, সন্ধ্যায় ঝাঁক বাঁধিবে। স্টিমার, নৌকা, ভাসমান কচুরিপানা, আকাশের পাখি ও মেঘ সব ভাসিয়া চলিয়াছে–তীরের দিকে চাহিয়া মনে হয় জলের সীমায় মাটির তীরভূমিও বুঝি লঘু গতিতে চলিয়াছে পিছনে।

তবু নদী ছাড়া সবই বাহুল্য। আকাশের রঙিন মেঘ ও ভাসমান পাখি, ভাঙন-ধরা তীরে শুভ্র কাশ ও শ্যামল তরু, নদীর বুকে জীবনের সঞ্চালন, এ সব কিছুই যদি না থাকে, শুধু এই বিশাল একাভিমুখী জলস্রোতকে পদ্মার মাঝি ভালোবাসিবে সারাজীবন। মানবী প্রিয়ার যৌবন চলিয়া যায়, পদ্মা তো চিরযৌবনা। বৈচিত্র্য? কী তার প্রয়োজন? নূতন পৃথিবী কে খোঁজে, কে চায় পদ্মার রূপের পরিবর্তন, শুধু ভাসিয়া চলার অতিরিক্ত মোহ?

সকালবেলা সুবাতাস ছিল, তারপর বাতাস দিক পরিবর্তন করিল। বিশেষ কিছু অসুবিধা তাহাতে হইল না। দাঁড় টানিতে কোনো কষ্ট নাই। নদীর স্রোতই নৌকা ঠেলিয়া নিয়া চলিয়াছে, ফিরিবার সময় উজান ঠেলিয়া আসিতে প্রাণ বাহির হইয়া যাইবে বটে, এখন আরামের অন্ত নাই। মধ্যাহ্নে নৌকা ভিড়াইয়া রান্নার আযোজন করা হইল। দুটি উনান খুঁড়িয়া দুইটি হাঁড়িতে চাপানো হইল ভাত, কাছের এক গ্রামে তরিতরকারি মিলিল নিজেদের জন্য রাধিবার ভারটা কুবেরের উপরেই পড়িযাছিল, অদূরে রন্ধনরতা রসুলের বোন নছিবনকে দেখিতে দেখিতে কুবের মনে মনে একটু আপশোশ করিল। ভাবিল, কী ক্ষতি মুসলমানের রান্না খাইলে? ডাঙার গ্রামে যাহারা মাটি ছানিয়া জীবিকা অর্জন করে তাহাদের মধ্যে ধর্মের পার্থক্য থাক, পদ্মানদীর মাঝিরা সকলে একধর্মী। গণেশ, শম্ভু ও বগা সঙ্গে না থাকিলে কুবের তো নিজের জন্যে রাঁধিতে বসিত না।

খাওয়া-দাওয়ার পর আবার নৌকা চলিল। রাত্ৰি নটা দশটার সময় একেবারে নদীর কিনারায় সুষুপ্ত একখানি গ্রামের পাশে সেদিনকার মতো স্থগিত করা হয় যাত্রা।

তৃতীয় দিন অপরাহ্লে পাওযা গেল পদ্মা ও মেঘনার সঙ্গম। নদী এখানে সাগরের মতোই পারাপারহীন। সন্ধ্যার দেরি নাই দেখিয়া কুবের সেদিন নৌকা বাঁধিল, এদিকে সে আগেও আসিয়াছে বটে, কিন্তু নদী ভালো করিয়া চেনা নয়, সন্ধ্যাব পর নৌকা চালাইতে সে সাহস করিল না।

পরদিন চাঁদপুরে নৌকা ভিড়িল।

ভালোয় ভালোয এতখানি পথ আসিয়া কুবেবের মনে আনন্দ ধরে না। এবার হোসেন মিয়া আসিয়া পড়িলেই সে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হইতে পারে। জাহাজঘাটে স্টিমার ভিড়িলে কুবের গিয়া যাত্রীদের অবরোহণ পথটির মুখে দাঁড়াইযা থাকে, মোটঘাট লইয়া দেশবিদেশের কত নরনারী তাহার সামনে দিয়া রেল স্টেশনের দিকে চলিয়া যায়, কুবেবের উৎসুক দৃষ্টি অনুসন্ধান করে হোসেনকে। সমস্ত যাত্রী নামিয়া আসিবার পরেও সে অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকে।

হোসেন আসিল তিনদিন পরে রাত্রের স্টিমারে। প্রতীক্ষা করিতে করিতে কুবের চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল, হোসেনকে দেখিবামাত্র সমস্ত চাঞ্চল্য তাহার অন্তর্হিত হইয়া গেল। নির্ভয় নিশ্চিন্ত রহস্যময় সদানন্দ মানুষটির সাহচর্যে মুহূর্তে সকল উত্তেজনা জুড়াইয়া যায়,–কঠিন কর্তব্য সম্পন্ন করার গর্ব, আগাম কর্তব্য সম্পাদনের দুর্ভাবনা কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। তাই বটে। ভালোয় ভালোয় কুবের চাঁদপুর আসিয়া পৌঁছিতে না পারিলেও কিছুই আসিয়া যাইত না বটে হোসেনের!—মৃদু মৃদু হাসিয়া সে বলিত, দরিয়ায চুবাইয়া আইছ নাও? ভালা করছ কুবির বাই!

হোসেন নৌকায় আসিয়া বসিল। সকলে তাহাকে ঘিরিযা রহিল, ছইয়েব মধ্যে নছিবন ও রসুলের স্ত্রী ঘোমটার ভিতর হইতে চাহিতে লাগিল—হোসেনকে দেখিয়াই তাহারা ঘোমটা দিয়াছে। মৃদু মৃদু হাসে হোসেন, সকলের কুশল জিজ্ঞাসা করে; দাড়ি মুঠা করিয়া ধরিয়া সকৌতুকে রসুলের ছ বছরের মেয়েটাকে বিবিজান বলিয়া ডাকে। আমিনুদ্দি মেয়ের খবর জিজ্ঞাসা করিলে বলে তাহাকে সে বহাল তবিয়তে ঘরের কাজ করিতে দেখিয়া আসিয়াছে, দুশমন বলিয়া গাল দিয়া হোসেনকে সে নাকি কড়া কড়া কথা বলিয়াছে অনেক।

আমিনুদ্দির চোখ ছলছল করে। সে বলে, আল্লা জানে মিয়া, আর ফির‍্যা আমু না ভাবলি মনডা পোড়ায়।

হোসেন বলে, ফিরনের মন থাকলি কও মিয়া অখন, জাহাজে তুইলা দিই তোমারে কইল। খুশ না হলি ক্যান যাবা?

আমিনুদ্দি নীরবে মাথা নাড়ে।

হোসেন বলে, তবে কাইল তোমাগো নিকা সারি?

আমিনুদ্দি বিস্মিত হইয়া বলে, কাইল ক্যান? ময়নাদ্বীপি দিবা-দুইমাস বাদ।

হোসেন বলে, ময়নাদ্বীপি মোল্লা পামু কই? রাজবাড়ির আজীজ ছাহাব কন, ময়নাদ্বীপি শও জনা মানুষ হলি আর মসজিদ দিলি আর হিঁদুরে জমিন না দিলি গিয়া থাকতি পারেন। তা পারুম না মিয়া। হিঁদু না নিলি মানুষ পামু কই? হিঁদু নিলি মসজিদ দিমু না। ক্যামনে দিমু কও; মুসলমানে মসজিদ দিলি, হিঁদু দিব ঠাকুরঘর—না মিয়া, আমার দ্বীপির মদ্যি ও কাম চলব না।

সকলে অভিভূত হইয়া শোনে। হোসেনের মুখে ময়নাদ্বীপের কথা কুবের কখনও শোনে নাই, আজ হোসেন বলিতে থাকে ওই দ্বীপটির জন্য তার কত দরদ। নিলামে দ্বীপটি কিনিবার পর ওখানে জনপদ বসানোর স্বপ্ন দেখিতেছে সে, জীবনে আর তার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য নাই, কামনা নাই,—হাজার দেড়েক মানুষ ওখানে চলাফেরা করিতেছে, এক বিঘা জমিও দ্বীপের কোনোখানে আকৰ্ষিত নাই, মরিবার আগে এইটুকু শুধু সে দেখিয়া যাইতে চায়। কত অর্থ ও সময় সে ব্যয় করিয়াছে দ্বীপের পিছনে! ময়নাদ্বীপের নেশা পাইয়া না বসিলে আজ তো সে বড়োলোক—একসঙ্গে তাহার এতগুলি লাভরান ব্যাবসা দাঁড়াইয়া গিয়াছে যে ভাবিতে বসিলে আল্লার করুণার পরিচয়ে মাথা নত হইয়া আসে। হ, ময়নাদ্বীপ ব্যাপিয়া একদিন মানুষের জীবনের প্রবাহ বহিবে বলিয়া যে কাজে হোসেন হাত দেয় সেই কাজ খোদাতালা সফল করিয়া দেন। টাকা না থাকিলে সে পরিবে কেন এই কঠিন কাজ সম্পন্ন করিতে?

কী কও রসুল, নিকা সারি কাইল?

রসূল সায় দিয়া বলে, আমি কী কমু মিয়া, যা মন লয় করেন।

হোসেন বলে, বইন কী কয়, জিগাও।

রসুল ছইয়ের মধ্যে গিয়া খানিক পরামর্শ করিয়া আসে। নছিবনের মত আছে। আমিনুদ্দি নিঃশব্দে বসিয়া থাকে। আপন মনে কী যেন সে ভাবিতে থাকে বন্দরের আলোকমালার দিকে চাহিয়া! কুবের সবিস্ময়ে হোসেনের প্রত্যেকটি ভাবভঙ্গি লক্ষ করে। কী প্রতিভা লোকটার, কী মনের জোর : যেখানে যত ভাঙাচোরা মানুষ পায় কুড়াইয়া নিয়া জোড়াতালি দিয়া নিজের দ্বীপে রাজ্য স্থাপন করিতেছে—প্রজাবৃদ্ধির ব্যবস্থার দিকে তাহার সজাগ দৃষ্টি! হোসেনের উদ্দেশ্যই হয়তো তাই, আমিনুদ্দির মতো জীবনযুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত হতাশ ও নিরুৎসাহ মানুষগুলিকে আসলে তাহার প্রয়োজন নাই, ওরা তাহার দ্বীপটি যে নবীন নরনারীতে ভরিয়া দিবে, সে তাহাদেরই প্রতীক্ষা করিয়া আছে!

অনেক রাত্রে হোসেন বিদায় গ্রহণ করিল। নৌকায় তখন জল্পনা-কল্পনার অন্ত রহিল না। প্রথম বিস্ময়টা কাটিয়া যাওয়ার পর আমিনুদ্দির সঙ্গে সকলে হাস্য-পবিহাস জুড়িয়া দিল। ঠাট্টা করিতে বড়ো মজবুত শম্ভু। তার এক একটা কথায় নৌকায় হাসির কলরব উঠিতে লাগিল, ছইয়ের মধ্যে রমণী দুটি পর্যন্ত মাঝে মাঝে খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিয়া মুখে কাপড় চাপা দিতে লাগিল।

পরদিন আমিনুদ্দির সঙ্গে নছিবনের নিকা হইয়া গেল। তার পরের দিন কতকগুলি চাষের যন্ত্রপাতি, তিন চার বস্তা আলু, এক পিপা সরিষার তৈল, কাঠের একটা বাক্সো বোঝাই নুন, কতকগুলি সস্তা বিলাতি কম্বল, এক বস্তা কাপড় জামা এই সব অজস্র জিনিসপত্রে হোসেন নৌকা বোঝাই করিয়া ফেলিল।

রাত্রি প্রভাত হইলে বলিল, নাও খোলো কুবির বাই।

কোনদিক যামু মিয়া বাই?

হোসেন বলিল, সমুন্দুর।

সারাদিন এই তীর ঘেঁষিয়া নৌকা চলিল। কেতুপুরের পদ্মায় যে নৌকাকে অত্যন্ত বৃহৎ মনে হইয়াছিল, এখন সেটিকে কুবেরের মোচার খোলা বলিয়া মনে হইতে লাগিল। পরদিন অপরাহ্লে নোয়াখালি জেলার নারিকেল বৃক্ষপূর্ণ তীরভূমিতে নৌকা বাঁধা হইল। এদিকে কুবের কখনও আসে নাই, বিস্ময়ের সঙ্গে সে হোসেনকে জিজ্ঞাসা করিল, এই কি সমুন্দুর? হোসেন একখানা ম্যাপ বাহির করিল। আঙুল দিয়া সে কুবেরকে চিনাইয়া দিতে লাগিল মেঘনার মোহানার দ্বীপগুলি—সিদ্ধিদ্বীপ, বিদৌদ্বীপ, সন্দ্বীপ, হাতিয়া প্রভৃতি। আরও পশ্চিমে মানপুরদ্বীপ, দক্ষিণ-শারাজপুর, বন্দোরাদ্বীপ। আর ওই যে ছোটো ছোটো বিন্দুগুলি দেখা যায় বাইশ নম্বর মোটা লাইনটার উপরে, ওগুলি মানিক দ্বীপপুঞ্জ। চিনিতে পারিতেছে কুবের? আর ওই পুব-পশ্চিমের বাইশ নম্বর লাইন আর উত্তর-দক্ষিণের এই একানব্বই নম্বর লাইনটা যে বিন্দুতে পরস্পরকে অতিক্ৰম করিয়াছে, এই বিন্দুটির কিছু উত্তর-পূর্বে ওই যে একটি সবুজ বিন্দু দেখা যায় ওর নাম ময়নাদ্বীপ। জানে কুবের,—ওরই নাম ময়নাদ্বীপ! আব ঘণ্টা দশেক নৌকা বাহিয়া তাহারা নোয়াখালির তীরভূমিকে পিছনে ফেলিবে, তারপর হাতিয়া ডাইনে রাখিয়া ধনমানিক দ্বীপ ছুঁইয়া, ধনমানিক দ্বীপ আর রাবনাবাদ দ্বীপের যোগরেখার সঙ্গে বিয়াল্লিশ ডিগ্রি কোণ করিয়া পূর্ব-দক্ষিণে নৌকা বাহিলে একদিনে ময়নাদ্বীপে পৌঁছানো যাইবে।

কুবের ভালো বুঝিতে পারে না! হী করিয়া নকশার বেখা ও লেখাগুলির দিকে চাহিয়া থাকে। কে জানে ওর মধ্যে মধ্যে ডাঙা ও জলের পার্থক্য কী কৌশলে আঁকা আছে, সে তো কোনো প্রভেদ বুঝিতে পারে না!

হোসেন মিয়া যে কত বড়ো দক্ষ নাবিক, দিকচিহ্নহীন সমুদ্রের বুকে তাহার নৌকা পরিচালনা দেখিয়াই তাহা বোঝা গেল। সামনে একটা কম্পাস রাখিয়া সে হাল ধরিয়া বসিল, নৌকার ছযজন মাঝি টানিতে লাগিল দাঁড়। সারাদিন পরে রক্তিম সূর্য সমুদ্রের জলে ডুবিয়া গেল, পুবে বহুদূরে কালো বিন্দুল মতো একটি দ্বীপ ছাড়া সূর্য শুধু দেখাইয়া গেল আকাশ ও জলরাশি। রাত্রেও দাঁড় টানার বিবাম হইল না, পালা করিয়া দুজন দুজন মাঝিকে দুঘণ্টা করিয়া ঘুমানোব অবসর দিয়া চারজনকে হোসেন সবসময়ে বসাইয়া রাখিল দাঁড়ে, নিজে এক মিনিটেব জন্যও চোখ বুজিল না। নৌকার সকলে হয়রান হইয়া গেল, কুবেরের মনে হইতে লাগিল নৌকা বাহিয়া জীবনে সে আর কোনোদিন এত শ্রান্ত হইয়া পড়ে নাই।

সকালবেলা দেখা গেল চাবিদিক নিবিড় কুয়াশায় ঢাকিয়া গিয়াছে।

হোসেন বলিল, বইঠা থোও কুবির, নোঙর ফেলো।

এতখানি কাছি টানিয়া নোঙর সমুদ্রের তলে গিয়া ঠেকিল যে কুবেরের মনে হইল নোঙরটা পাতালে গিয়া পৌঁছিযাছে। কুযাশায় নৌকা চালাইবার উপায় নাই, ধনমানিক দ্বীপের কাছাকাছি তাহারা আসিয়া পড়িযাছে, কুয়াশায় দেখিতে না পাইয়া পাশ কাটাইয়া দূ্রে চলিয়া গেলে বিপদ হইবে; এই দ্বীপটির অবস্থান দেখিয়া তবে ঠিক করা যাইবে বাবনাবাদ দ্বীপের সঙ্গে ইহার যোগরেখা, তারপর সোজা আগানো চলিবে কম্পাসের উপর নির্ভর করিয়া একেবারে ময়নাদ্বীপের দিকে। সারাদিন নৌকার অবস্থান বুঝিতে পাবা যাইবে কি না সন্দেহ। অপেক্ষা করিতে হইবে রাত্রির জন্য। রাত্রে তারা উঠিলে ওই যে অদ্ভুত যন্ত্রটা আছে হোসেনের, ওই যন্ত্রের ভিতর দিয়া আকাশের দিকে চাহিয়া তবে হোসেন বলিতে পারিবে যে দিকে কতদূরে ধনমানিক দ্বীপ লুকাইয়া আছে।

কি জান মিয়া, কলের জাহাজ হলি, জানন যায় কত জোর চলতেছি, ঘণ্টায় কয় মাইল আলাম-সমুদ্দুরের কোনখানে রইছি হিসাব করলি মেলে। নাও চালাইয়া জানুম কিবা?—দাড়িতে হাত বুলায় হোসেন, সকলকে অভয় দিয়া আবার বলে, ডরাইও না, দশ বাজলি কুয়াশা থাকবে না। আইজ কাইল রোজ বিহানবেলা কুয়াশা হয়। অ্যাবে কি কুয়াশা কয় মাঝি?

বসিয়া বসিয়া হোসেন গল্প বলে, সকলে শোনে। এ যেন কেতুপুরেরই এক ভাঙা কুটিরে হোসেনের আড্ডা বসিয়াছে। এমনই কুয়াশার মধ্যে একবার সে সমুদ্রের বুকে হারাইয়া গিয়াছিল, তিনদিন নোঙর ফেলিয়া ছিল সমুদ্রে, জল ফুরাইয়া গিয়া শেষের দিন তৃষ্ণায় ছাতি তাহদের ফাটিয়া গিয়াছিল। তারপর হোসেন কম্পাস কিনিয়াছে, তারা দেখিয়া নৌকার অবস্থান নির্ণয়ের যন্ত্র কিনিয়াছে—চাঁটগায়ে হোসেন যখন জাহাজে কাজ করিত, খালাসির কাজ করিতে করিতে শেষ পর্যন্ত একটা মালবাহী স্টিমারের বো-সান পর্যন্ত সে হইয়াছিল, সেই সময় এক সাহেব কাপ্তেনের কাছে সে এ সব যন্ত্রের ব্যবহার শিখিয়াছে। বড়ো বড়ো জাহাজ চালাইয়া হোসেন এখন পৃথিবী ঘুরিয়া আসিতে পারে!

পৃথিবী সে কি ঘুরিয়া আসে নাই? হ, সে কাহিনি বলিবার মতো বটে! কুড়ি বছর বয়সে হোসেন বাড়ি ছাড়িয়া পালাইয়াছিল, তারপর অর্ধেক জীবন সে তো দেশ-বিদেশে ঘুরিয়াই কাটাইয়াছে—নদীর বুকে ও সমুদ্রে।

অনেক বেলায় আস্তে আস্তে কুয়াশা মিলাইয়া গেল। নোঙর তোলা হইল। দুঘণ্টা পরে দূরে দেখা গেল ধনমানিক দ্বীপ। কম্পাসটা সামনে রাখিয়া হোসেন হাল ধরিয়া বসিল, পরদিন ভোরবেলা তাহারা ময়নাদ্বীপে পৌঁছিয়া নোঙর ফেলিল।

এই ময়নাদ্বীপ? পাঁচ ছয় বৎসর ধরিয়া যে রহস্য-নিকেতনের কথা সে শুনিয়া আসিয়াছে? কুবের যেন একটিমাত্র দৃষ্টিপাতে সমস্ত দ্বীপটিকে দেখিয়া ফেলিতে চায়। দ্বীপের খানিকটা ডিম্বাকৃতি, খানিকটা ত্রিকোণ। দ্বীপের দীর্ঘতম পরিসর প্রায় এগাবো মাইল–হোসেন নিজে মাপিয়া দেখিয়াছে। দ্বীপের যেখানে নৌকা ভিড়িয়াছিল, সেদিকে খানিকটা অংশ পরিষ্কার করিয়া বসতি স্থাপিত হইয়াছে, চাষ হইতেছে, বাকি অংশ জঙ্গলে ঢাকা। পশ্চিম দিকে অসংখ্য নারিকেল গাছ, সমস্ত দ্বীপে ছড়াইয়া না পড়িয়া গাছগুলি একস্থানে ঘন হইয়া মাথা তুলিয়াছে কেন বোঝা যায় না।

জমি অত্যন্ত নিচু, এত নিচু যে আশঙ্কা হয় যেদিন খুশি হইবে সেইদিনই সমস্ত দ্বীপটিকে সমুদ্র গ্রাস করিয়া ফেলিবে। দ্বীপের মাঝখানে এক মাইল পরিমিত একটা লোনা জলা আছে, সমুদ্রের চেয়েও ওখানটা বুঝি নিচু, খাল কাটিয়া যোগ করিয়া দিলে সমুদ্রের জল আসিয়া ভরিয়া ফেলিবে। জলার ধারে খানিকটা ধানের জমি করা হইয়াছে, বিস্ময়কর ফসল ফলে। জলায় ও চারিদিকের জঙ্গলে অসংখ্য সাপ আছে, কিন্তু জন্তুজানোয়ার কিছু নাই, রাসু যে বাঘ সিংহের গল্প করিয়াছিল সেটা নিছক গল্পই।

হোসেন মিয়ার উপনিবেশে লোকসংখ্যা একশোর কম নয়, কিন্তু তার তিন ভাগই প্রায় ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে, যাদের অধিকাংশ এই দ্বীপে জন্মগ্রহণ করিয়াছে। ম্যালেবিয়া ও সাপের সঙ্গে লড়াই করিয়া এখনও হোসেন জয়লাভ করিতে পারে নাই, জঙ্গলের সঙ্গে অবিরত সংগ্রাম চলিয়াছে, অনেক খাদ্য এখানে উৎপন্ন করা যায় না, জীবনের অনেক প্রয়োজন মিটাইতে সমুদ্র পথে পাড়ি দিতে হয় সভ্য জগতের দিকে। অবিশ্রাম খাটুনি এখানে, অসংখ্য অসুবিধা এখানে, জীবন এখানে নির্মম ও নীরব। রাসুর মতো অনেকে তাই পালাইয়া গিয়াছে। হোসেনের পাঁচ বছরের চেষ্টায় দ্বীপে তাই ত্রিশটির বেশি পরিবার নীড় বাঁধে নাই। আমিনুদ্দি ও রসুলকে ধরিলে দ্বীপের গৃহস্থ পরিবারের সংখ্যা এবার বত্রিশ হইল মাত্র।

কী কঠিন কাজে হোসেন মিয়া যে আত্মনিয়োগ করিয়াছে, কী সীমাহীন যে তাহার ধৈর্য ও অধ্যবসায়, এবার কুবের তাহা ভালো করিয়া বুঝিতে পারে। এই নিচু, জলা ও জঙ্গলপূর্ণ মনুষ্যবাসের অযোগ্য দ্বীপ, ধান ছাড়া আর কোনো ফসল যে দ্বীপের লোনা মাটিতে জন্মে না, লাউ কুমড়াগুলি ফলে কুঁকড়ানো শশার মতো ছোটো ছোটো,—এখানে এই মুষ্টিমেয় নরনারীর বসতি স্থাপন করাও হোসেন মিয়া ছাড়া আর কারও দ্বারা সম্ভব হইত না। সন্দ্বীপ, হাতিয়া, ধনমানিক, রাবনাবাদ এইসব জনপূর্ণ দ্বীপের কথা কুবের শুনিয়াছে, ময়নাদ্বীপ যদি মানুষের বাসের যোগ্য হইত ওই সব দ্বীপের মতো কবে এখানে গড়িয়া উঠিত গ্রাম। এ কী কদর্য একটা দ্বীপ হোসেন বাছিয়া লইয়াছে?

হয়তো সস্তায় পাইয়াছিল বলিয়া। স্বাস্থ্যকর, উর্বর দ্বীপ কিনিয়া জমিদারি পত্তনের টাকা হোসেন কোথায় পাইত, ও রকম জনহীন দ্বীপই বা কোথায়।

দ্বীপ দেখিয়া আমিনুদ্দি ও বসুল বড়ো দমিয়া গিয়াছে। ফিরিয়া যাওয়ার কথাটাও তাদের মুখে শোনা গিয়াছে দু-একরাব। তবে হোসেনের সামনে তারা কিছু বলে নাই। বলা যায় না। কত উপকার যে হোসেন তাদের করিয়াছে তার হিসাব হয় না। আমিনুদ্দি অপরিশোধ্য আর্থিক ঋণেই শুধু আবদ্ধ নয়, হোসেন না দিলে এ জীবনে স্ত্রী কি আর তাহার জুটিত, নছিবনের মতো স্ত্রী? রসুলকে জেলের দুয়ার হইতে ছিনাইয়া নিয়া আসিয়াছে হোসেন, দেশে ফিরিলে জেলেই হয়তো তাহাকে ঢুকিতে হইবে। প্রতিদানে হোসেন আর কিছুই তাদের কাছে চায় না, তারা শুধু এখানে বাস করুক, স্বপ্ন সফল হোক হোসেনের। ইতিমধ্যে তাদের জন্য ঘর উঠিতে আরম্ভ হইয়াছে, দযা করিয়া ওই ঘরে তারা নীড় বাধিলে কৃতাৰ্থ হইয়া যাইবে হোসেন। জঙ্গল কাটিয়া যত জমি তারা চাষের উপযোগী করিতে পরিবে সব তাদের সম্পত্তি, খাজনা বা চাষের ফসল কিছুই হোসেন দাবি করিবে না। নিজেদের জীবিকা তাহারা যতদিন নিজেরাই অর্জন করিতে পরিবে না, জীবিকা পর্যন্ত জোগাইবে হোসেন। গৃহ ও নারী, অন্ন ও বস্ত্র, ভূমি ও স্বত্ব সবই তো পাইলে তুমি, এবার শুধু খাটিবে ও জন্ম দিলে সন্তানেব, এটুকু পরিবে না?

হোসেনের কাছে ফিরিয়া যাওয়াব কথা তাই কেহ মুখে আনিতে পারে না। ফিরিয়া যে যায়, সে যায় পালাইয়া, চুপিচুপি, চোরের মতো।

হোসেন তাদের ক্ষমা করে। দেখা হইলে রাসুর মতো হোসেন তাদের জঙ্গল সাফ করার মজুরি দেয়। জোর-জবরদস্তি হোসেনের নাই, অন্যায় সে কারও প্রতি করে না। শুধু তাকেই হোসেন শাস্তি দেয, ভীষণ ও মর্মান্তিক, যারা শত্ৰুতা করে হোসেনের, অকারণে ক্ষতি করিতে চায়, বিঘ্ন জন্মায় হোসেনের স্বপ্ন সফল হইবার পথে।

কদিন কুবের দ্বীপ দেখিয়া ও দ্বীপের মানুষগুলির সঙ্গে ভাব করিয়া কাটাইয়া দিল। খেতের ধান সব কাটা হইয়া গিয়াছে, কিছু সবিয়া, বুট ও মটর লাগানো হইয়াছে, মূলা, পালং, কপি প্রভৃতি শাকসবজি গত বছর বাঁচিয়া থাকিতে চাহে নাই, এ বছর কয়েক বিঘা জমিতে নূতন একপ্রকার সার দিয়া পবীক্ষাব জন্য কিছু কিছু চাষ হইয়াছে কী হইবে বলা যায় না।

আরও ভিতরের দিকে দ্বীপের মাটি রবিশস্যের উপযোগী কিনা দেখিবার জন্য জঙ্গলের মধ্যে এখন অল্প একটু স্থান পরিষ্কার করা হইতেছে। সকালবেলা দা কুড়াল লইযা একদল লোক জঙ্গলের মধ্যে মাইলথানেক হাঁটিয়া যায়, নির্বাচিত স্থানটিতে গাছপালা ঝোপঝাড় কাটিয়া সাফ কবে, শাবল দিয়া খুঁড়িয়া গাছের শিকড় তুলিয়া ফেলে, তারপর সারাদিন মশা ও পোকার কামড়ে শরীর ফুলাইযা সন্ধ্যার সময় ফিরিয়া আসে। কুবের একদিন দেখিতে গিযা শিহরিয়া ফিরিয়া আসিল। এই দ্বীপটির সৃষ্টির দিন হইতে যে বনভূমি কুমারী, তার বুকের এক খাবলা মাংস যেন সকলে ছিনাইয়া লইযাছে, চারিপাশে নিবিড় বনের মাঝখানে পরিষ্কৃত স্থানটুকু এমনই বীভৎস দেখায়!

কয়েকদিন আগে কী একটা গোলমাল হহয়ছিল দ্বীপে, হোসেন উপস্থিত না থাকিলে অনেকে একত্র হইয়া জটলা করে, ভাসা ভাসা দুটো একটা কথা কানে আসে কুবেরের। বিপিন নামে ষাট বছরের এক বৃদ্ধকে হোসেন এখানে মোড়ল করিয়াছে, তাকে ঘিরিয়াই জটলাটা জমাট বাঁধে বেশি, কুবের কাছে গেলেই কিন্তু সকলে চুপ করিয়া যায়। তারপর একদিন সন্ধ্যার সময় কাজকর্ম শেষ করিয়া সকলে যখন ঘরে ফিরিয়াছে, নিজের স্বতন্ত্র কুটিরের দাওয়ায় বসিয়া হোসেন প্রসন্ন মুখে টানিতেছে তামাক, বিপিন কথাটা ফাঁস করিল। বলিল, নালিশ আছে একটা। নালিশ? হোসেনের মুখ গম্ভীর হইয়া গেল।

বিপিন ধীরে ধীরে ব্যাপারটা খুলিয়া বলিল। নারীসংক্রান্ত লজ্জাকর ঘটনা। এনায়েত দ্বীপে আসিয়াছে মাত্র ছমাস আগে, ইতিমধ্যেই সে সকলকে বড়ো জ্বালাতন করিয়া তুলিয়াছে। প্রথম প্রথম এর সঙ্গে ওর সঙ্গে প্রায়ই তার কলহ বাধিত, একদিন নিরীহ দুর্বল গগন ঘোষকে মারিয়া সে জখম করিয়া দেয়, সকলে মিলিয়া তখন খুব শাসন করিয়া দেয় এনায়েতকে। তারপর হইতে সে বেশ শান্তশিষ্ট হইয়াই থাকে, ব্যাপারটা তাই হোসেনকে জানানো হয় নাই। কিন্তু কদিন আগে সে এক ভয়ানক অপরাধ করিয়া বসিয়াছে। বসির মিয়ার বউটি ছেলেমানুষ, কিছুদিন হইতে এনায়েত তাকে নাকি বিরক্ত করিতেছিল, ভয়ে বউটি কাহাকেও কিছু বলে নাই। তারপর একদিন দুপুরবেলা সকলে যখন কাজে গিয়াছে, এনায়েত বসিরের ঘরে প্রবেশ করে। বসিরের স্ত্রীর চেঁচামেচি শুনিয়া পাশের কুটিরের আকবরের স্ত্রী গিয়া পড়ায় বেচারি সেদিন ভালোয় ভালোয় রক্ষা পাইয়াছে।

হোসেন বলিল, হারামিব পোলারে কাইটা দরিয়ায় দিলা না ক্যান?

বিপিন স্বীকার করিল অতটা তাহারা করিতে পারে নাই, তবে মারধোর করা হইয়াছে যথেষ্ট! খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিযা সকলকে হোসেন ডাকিয়া আনিতে বলিল, এনায়েতও যেন আসে। অল্পক্ষণের মধ্যেই সকলে আসিয়া জুটিল, মেয়েরাও কেহ কেহ আসিয়া তফাতে দাঁড়াইয়া রহিল কৌতুহলের সঙ্গে। বিচার হইবে এনায়েতের। কে জানে তাহাকে শূলেই দিবে না সাগবে ডুবাইয়া মারিবে হোসেন!

এনায়েতের বয়স বেশি নয়, বলিষ্ঠ যুবক সে, ময়নাদ্বীপে এমন আর একটা মানুষও নাই। তেজের সঙ্গে সে আসিয়া হোসেনের সামনে বসিল, নির্ভয় নিশ্চিন্ত। হোসেন একে ওকে দুটো একটা কথা জিজ্ঞাসা করিল, রুষ্ট চোখে এনায়েতের দিকে চাহিতে লাগিল, বারবার বলিতে লাগিল, কী আপশোশ! কী আপশোশ!

তারপর সে কৈফিয়ত তলব করিল এনায়েতের।

এনায়েত বলিল, জবরদস্তি করি নাই মিয়া।

হোসেন বলিল, না করলা জবরদস্তি, বসিবের ঘরের মদ্যি যাবা ক্যান তুমি? কবিলারে নজর দিবা ক্যান?

আমারে দেইখা একরোজ স্যায় হাসিলো!

আরে বলদা তুমি! বাই বইলা হাসিলো, দ্যাশগাঁও ছাইড়া দ্বীপের মদ্যি আইসা রইছ, বাই বইন না মাইয়া মরদ অ্যানে? ভালা কাম কর নাই মিয়া। তিন রোজ বাইন্ধা থুমু তোমারে, খানাপিনা মিলব না।

তখন হোসেন মিয়ার হুকুমে সকলে মিলিয়া তাহাকে দাওয়ার খুঁটির সঙ্গে বাঁধিয়া দিল। আলগা করিয়াই বাঁধিল, হোসেন মিয়ার হুকুমের চেয়ে দড়ির বাঁধন তো এ দ্বীপে জোরালো নয়, বাঁধন খুলিয়া পালানোর সাহস এনায়েতের হইবে না। কোথায় পালাইবে?

হোসেনের ঘরের কাছেই একখানা ঘরে কুবের ও তাহার সঙ্গীদেল থাকিতে দেওয়া হইয়াছিল। সেদিন অনেক রাত্রে বাহিরে গিয়া জ্যোৎস্নালোকে কুবের দেখিতে পাইল, হোসেনের ঘরের দাওয়ায় বন্দী এনায়েত থালায় ভাত খাইতেছে, কাছে বসিয়া আছে একটি রমণী। চুপিচুপি কুবের ঘুরিয়া হোসেনের ঘরের পিছন দিকে গেল, জানালা দিয়া আস্তে আস্তে তাহাকে ডাকিয়া তুলিল।

খবর শুনিয়া হোসেন হাই তুলিয়া বলিল, হ? ঘুমাও গা কুবির।

আর শোনো মিয়া, কী দেখলা কী শুনলা আঁধার রাইতে মনে মনে থুইয়ো, কইয়া কাম নাই।

বলিয়া হোসেন পাশ ফিরিয়া শুইল।

এত বড়ো একটা ব্যাপারকে অবহেলা করিয়া হোসেনের পাশ ফিরিয়া শোয়া অবাক করিয়া দিল বটে কুবেরকে আজ, ব্যাপার সে বুঝিতে পারিল দ্বীপ ছাড়িয়া ফিরিবার দিন। বুড়া বসির নৌকায় আসিয়া উঠিল, তার ছেলেমানুষ বউ রহিয়া গেল দ্বীপে। বসির এ দ্বীপের আদি বাসিন্দা, প্রায় পাঁচ বছর এখানে সে সস্ত্রীক বাস করিতেছে। ছেলেমেয়ে হয় নাই বসিরের-একটিও নয়। পাঁচ বছরে যে একটিও মানুষ বাড়াইতে পারিল না দ্বীপের, কয়েক বছরের মধ্যে যে প্রবেশ করিবে কবরে, তাকে দিয়া আর কী প্রয়োজন আছে হোসেনের? বসির এবার তালাক দিবে তার বউকে। তারপর যথাসময়ে এনায়েতের সঙ্গে নিকা হইবে বউটির। একটি বউ আছে এনায়েতের, শীঘ্রই সে হোসেনকে উপহার দিবে একটি আনকোরা নতুন মানুষ—ময়নাদ্বীপের এক টুকরা ভবিষ্যৎ। তবুও আরও একটি বউ হোক এনায়েতের, সার্থক হোক দুজনের অন্যায় অসামাজিক প্রেম, পাঁচ বছর যে রমণী জননী হইতে পায় নাই তার কোল জুড়িয়া আসুক সন্তান, মানুষ ধাড়ক হোসেনের সাম্রাজ্যে।

গ্রাম ছাড়িবার তিন সপ্তাহ পরে কুবের ও গণেশ গ্রামে ফিরিয়া আসিল। চাঁদপুরে তাহাদের নামাইয়া দিয়া হোসেন নৌকা লইয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে। হোসেনের মুসলমান মাঝিরা চাঁদপুরে অপেক্ষা করিতেছিল।

গোপিকে নিয়া ইতিমধ্যে অনেক কাণ্ড হইয়া গিয়াছে। কুবের যেদিন চলিয়া গেল সেইদিনই গোপির পা ভয়ানক ফুলিয়া ওঠে। বাড়িতে পুরুষ কেহ নাই, কী করিবে ভাবিয়া না পাইয়া মালা কাঁদিয়া অস্থির হইছিল। তারপর রাসু আসিয়া সব ব্যবস্থা করিয়াছে। কত যে করিয়াছে রাসু গোপির জন্য, শত মুখেও মালা তাহা বলিয়া শেষ করিতে পারিবে না। সেইদিনই গোপিকে রাসু আমিনবাড়ির হাসপাতালে নিয়া গিযছিল, রাত্রেই গোপির হাঁটুতে আবার অস্ত্র করা হয়। সে এখনও হাসপাতালে আছে, প্রায়ই রাসু তাহাকে দেখিতে যায়। ডাক্তার আশ্বাস দিয়াছে হাড় ভাঙিয়া মাংসপেশির জট ছাড়াইয়া গোপির হাঁটু এবার ঠিক করিয়া দেওয়া হইয়াছে, একটু খোঁড়াইলেও সে হাঁটিতে পরিবে।

কুবের ফিরিয়াছে খবর পাইয়া রাসু আসে। কুবের দুটো একটা কৃতজ্ঞতার কথা বলিতেই সে একেবারে গলিয়া যায়। মাথাটা একবার চুলকাইয়া রাসু কযেকটা টোক গেলে। তারপর হঠাৎ বলিয়া বসে, গোপিবে দিবা মাঝি আমারে?

কুবের গম্ভীর হইয়া যায়। বলে যে বাস্ততা কীসের? গোপি তো পড়িয়া আছে হাসপাতালে, আগে সে ফিবিয়া আসুক? রাসু তবু পাড়াপীড়ি করিতে থাকে। গোপির পা ভালো হইয়া যাইবে শুনিয়া অবধি সে ব্যগ্র হইয়া উঠিয়াছে, এই সময় কুবেরের কাছে কথা আদায় করিয়া না রাখিলে পরে হয়তো সে মত বদলাইয়া ফেলিবে। গোপির পঙ্গুতা আরগ্য হওয়া যখন অনিশ্চিত ছিল তখন কথাটা পাকাপাকি করিয়া নেয় নাই বলিয়া বড়ো এখন অনুতাপ হইয়াছে রাসুর।

শেষে কুবের বলে, কাইল কমু রাসু।

রাত্রে সে পরামর্শ করিল মালার সঙ্গে। পরামর্শ করিয়া স্থির হইল যে, রাসূ যদি দেড়কুড়ি টাকা পণ দেয় আর দুকুড়ি টাকার গহনা দেয় গোপিকে তবে এ বিবাহ হইতে পারে। তার কমে হইবে না।

পরদিন রাসু আসিল। কুবেরের দাবি শুনিযা সে ভড়কাইয়া গেল। বলিল, অত টাকা কই পামু?

কুবের তার কী জানে? এই কটা টাকা যদি সে বিবাহে খরচ করিতে না পারে, বিবাহের পর বউকে তবে সে খাওয়াইবে কোথা হইতে?

রাসু মাথা নিচু করিয়া থাকে। মালা তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বুঝি মমতা বোধ কবে, কুবেরকে ইশারায় কাছে ডাকিয়া ফিসফিস করিয়া টাকার পরিমাণটা কিছু কমাইতে বলিয়া দেয়। কিন্তু মেয়েমানুষের পরামর্শে ভুলিবার পাত্র কুবের নয। গম্ভীর অবিচলিত মুখে সে বসিয়া থাকে বেড়ায ঠেস দিয়া, চক্ষু মুদিয়া যেন ঘুমাইয়া পড়ে।

অনেকক্ষণ পরে রাসু বলে, আইচ্ছা দিমু।

বলিয়া সে উঠিয়া যাইতে চায় কিন্তু এবার কুবের তাহাকে খাতির করিয়া বসায়, আগ্রহ সহকারে গল্প জুড়িয়া দেয় ময়নাদ্বীপের। রাসুর না জাগে উৎসাহ, না আসে মুখরতা। কী হইল রাসুর; এতদিনের স্বপ্ন তাহার সফল হইবে জানিয়া আহ্লাদ হইল না কেন? তামাক সাজিয়া খানিকক্ষণ টানিয়া হুঁকাটি নামাইয়া রাখিয়া কুবের আড়ালে যায়। কদিন আগেও তাহারা হুঁকা কাড়াকড়ি করিয়া তামাক টানিয়াছে কিন্তু এখন কিনা রাসু তাহার ভাবী জামাতা, ওর হাতে এখন আর হুঁকা দেওয়া যায় না, ওর তামাক খাওয়ার সময় সামনে থাকা যায় না।

দিন তিনেক পরে কুবের আমিনবাড়ি গিয়া গোপিকে দেখিয়া আসিল। হাসপাতালের খাবার খাইয়া বিছানায় শুইয়া শুইয়াই গোপি দিব্যি মোটাসোটা হইয়াছে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার জন্য রঙের যেন তাহার খোলতাই হইয়াছে বেশ। দিন সাতেক পরে সে ছুটি পাইবে।

রীতিমতো শীত পড়িয়াছে এখন। জেলেপাড়ার ছেলেবুড়ার শরীর রুক্ষ হইয়া খড়ি উঠিতে আরম্ভ করিয়াছে। মালার চামড়া কিন্তু চিরদিন মসৃণ, হাজার শীতেও কখনও তাহার গা ফাটে না। কপিলারও বুঝি ফাটে না। যে তেলটাই কপিলা খরচ করে শরীরের পিছনে! মাঠে পালং শাকের পাতাগুলিতে যে সরস লাবণ্য ফুটিয়া আছে, কপিলার দেহে হয়তো তার অভাব নাই। মালার বোন তো সে। মালার চেয়ে সে হাজার গুণে শৌখিন।

কাজকর্ম নাই, বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া কুবের সময় কাটায়। পীতম মাঝির অসুখ হইয়াছে, বুড়ে বয়সে তাহার সেবা করিবার কেহ নাই, যুগী তাই আসিয়া বাপের কাছে আছে। পীতম সেবা গ্রহণ করে মেয়ের কিন্তু দিবারাত্রি তাকে গাল দিয়া কিছু রাখে না। যুগীর হাতের জল খাইয়া চিরদিন নরকে পচিবার সাধ যে তাহার নাই, সব সময় এই কথাটা সে ঘোষণা করে এবং ঘোষণা করিতে করিতে গলা কাঠ হইয়া আসিলে যুগীব দেওয়া জল খাইয়াই তৃষ্ণা মেটায়। পীতমের টাকা আছে অনেক। বলে, টাকার লোভে যুগী তাহার সেবা করিতে আসিয়াছে কিন্তু একটি পয়সা সে যুগীকে দিয়া যাইবে না। যা কিছু তাহার আছে সব সে কালই বাবুদের জিম্মা করিয়া দিবে, তার পলাতক ছেলেটা ফিরিয়া আসিলে সব সে পাইবে। ছেলেটা পীতমের ফিরিয়া আসিল বলিয়া।

রাসু একবার পীতমকে দেখিতে আসিয়াছিল, পীতম তাহাকে দূর দূর করিয়া খেদাইয়া দিয়াছে। রাতারাতি খুন করিয়া ময়নাদ্বীপ ফেরত ডাকাতটা যে তার সর্বস্ব লুটিয়া লইবে অত বোকা পীতম নয়। রাসু কাছে আসিলে সে তার ঠাং খোঁড়া করিয়া দিবে। শীর্ণ হাত দুটি উঁচু করিতেও পীতমের কষ্ট হয়, রাসুর ঠ্যাং সে কেমন করিয়া খোঁড়া করিবে সেই জানে!

কুবেরের কাছে রাসু মনোবেদনা জানায়। একমাত্র ভাগনে সে পীতমের, তাকে পীতম ত্যাজ্য করিয়া দিল! কত দুঃখ-কষ্ট পাইয়া সে ফিরিয়া আসিল ময়নাদ্বীপ হইতে, দুদিন বাড়িতে ঠাঁই দিল না, অম্লান বদনে খেদাইয়া দিল রাস্তায়। মরিবার সময় এখন কাছে থাকিয়া একটু সেবা করার জন্য সে ব্যাকুল হইয়াছে, তাতেও বুড়া তাহাকে সন্দেহ করিবে, বাড়িতে ঢুকিতে দিবে না? তা ছাড়া, নিজের ভাগনে সে পীতমের, বুড়ার টাকাপয়সা বাড়িঘরের একটা অংশ কি তার পাওয়া উচিত নয়? কাকে ও সব দিয়া যাইবে বুড়া?

কুবের বলে, পোলার লাইগা থুইয়া যাইব কয়।

রাসু বলে, পোলা! বাঁইচা আছে নাকি স্যায়? গাঙে ডুইবা গেছে গা কবে।

আলস্যে সময় কাটায় কুবের, গ্রামের জোয়ান মানুষগুলি জীবিকা অর্জনের জন্য বাহির হইয়া যায়, গ্রামে থাকে শুধু বুড়া, শিশু ও নারীর দল, কুবের শুধু শুনিতে পায় পাকা মুখের আপশোশ আর নরম গলার কলহ। দেখা হইলেই হীরু জেলে অনন্তবাবুর নাম করিয়া কুবেরকে পরিহাস করে। কোনোদিন কুবের রাগে, কোনোদিন তাহার মন খারাপ হইয়া যায়। আজ কতকাল অনন্তবাবু গ্রামে নাই, কলিকাতার বাবু তিনি, জেলেপাড়ায় রাত্রে স্কুল খুলিবার মতলবে কবে তিনি দু-চারবার কুবেরের বাড়ি যাতায়াত করিয়াছিলেন, এখনও তাহা মনে করিয়া রাখা কী জন্য? শুধু কুবেরের বাড়ি তো নয়! কী পাগলামি মেজোবাবুর আসিয়াছিল কে জানে, জেলেপাড়ার মানুষগুলির সঙ্গে অন্তরঙ্গ হওয়ার জন্য সময নাই অসময় নাই আসিয়া হাজির হইতেন, বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া দেশের নাম করিয়া কী যেন সব বলিতেন দুর্বোধ্য কথা। কতদিন নির্জন দ্বিপ্রহরে কত বাড়ির ভিতর হইতে মেজোবাবুকে কুবের বাহি্র হইতে দেখিয়াছে। তাহার পঙ্গু অসহায় স্ত্রীব নামের সঙ্গেই শুধু মেজোবাবুর নামটা হীরু জড়ায় কেন?

হীরুকে একদিন কুবের মারিবে। বেদম মারিবে! বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া সময় কাটায় কুবের, মনটা তাহার ভালো নাই। জগা মাঝির বউ যেন কপিলার অনুকরণ করিয়া হাঁটিতে শিখিয়াছে, ভিজা কাপড়ে পথ চলিতে চলিতে চমকাইয়া উঠিয়া পিছনে কুবেরকে দেখিয়া তাহার চোখে সন্দেহ ঘনাইযা আসাব আগে কুবেবের তো অন্যমনস্কতা ঘোচে না। অপ্রতিভ হইতে হয় কুবেরকে। নকুলের বাড়ির সামনে কুলগাছটার তলে একদিন কপিলার পাযে কাঁটা বিঁধিয়াছিল। মিছে কথা, কাঁটা বিঁধে নাই। উঃ, বলিয়া কুবেরকে জড়াইয়া ধরিবার ছল সেটা কপিলার। কেতুপুরে দুর্গা-প্রতিমা দেখিয়া ফিরিবার সময় সেদিন কী ছলনাময়ীই কপিলা হইয়া উঠিয়াছিল।

গোপিকে আনিবার নাম করিয়া কুবের একদিন ভোর ভোর গ্রাম ছাড়িয়া বাহির হইয় পড়িল। শ্যামাদাসের বাড়ি আকুরটাকুর গ্রামে, হাঁটা পথে বারো তেরো মাইল। খেতের আল দিয়া আঁকিয়া বাঁকিয়া চলিতে কতবার যে কুবের ভাবিল ফিরিয়া আসে, আকুরটাকুরে পৌঁছিযা একটা পুকুরে মুখ হাত ধুইতে নামিয়া কতবাব সে যে পুকুবঘাট হইতেই সোজা আমিনবাড়ির দিকে হাঁটিতে আরম্ভ করা স্থির করিয়া ফেলিল তার হিসাব নাই!

তবু শেষ পর্যন্ত শ্যামাদাসের বাড়ির দরজাতেই পথ শেষ হইল তাহার।

শ্যামাদাস মাঠে গিযাছিল। কিন্তু শ্যামাদাসের মা বোন ঘর-বাড়ি জুড়িয়া আছে, কপিলা এখানে ঘোমটা-টানা বউ। কুটুম্বকে শ্যামাদাসের মা খাতির করিয়া বসিতে দিল, কুশল ও এদিকে আসিবাব প্রয়োজন জিজ্ঞাসা করিল। শ্যামাদাসের বাড়িঘর দেখিয়া কুবের মনে মনে পীড়িত হইয়া উঠিয়ছিল, ভালোরকম জবাব দিতে পারিল না। চার ভিটায চারখানা বড়ো বড়ো ঘর শ্যামাদাসের, চারিদিক লেপা-পোছা ঝকঝকে ঘরের মধ্যে উঁকি দিলে কত জিনিস চোখে পড়ে,—কাঠের সিন্দুক, বেতের ঝাঁপি, বাসনকোসন—কত কিছু। উঠানের একপাশে ধানের মরাই, অপর পাশে গোযাল ঘর। লক্ষ্মীশ্ৰী মাখানো সম্পন্ন গৃহস্থের ঘরসংসার, কুবেবের ভাঙা কুটিবের তুলনায বৈকুণ্ঠপুরী। বুকেব ভিতরে টাটায় কুবেরের। এই বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মী গিয়া তাহার ভাঙা ঘরে শাকান্ন খাইয়া কটা দিন কাটাইয়া আসিয়াছিল বলিয়া আজও সে আকাশকুসুম রচনা করে, ভাবে আজও লক্ষ্মীর মন পড়িয়া রহিয়াছে কেতুপুরে তাহার সেই নোংরা নীড়টিতে! কী বোকাই কুবের ছিল!

কপিলা জিজ্ঞাসা করে, খবর কী মাঝি? কী মনে কইবা আইলা? ভালা নি আছে

পোলাপানরা?

ডুরে শাড়ি পরিয়াছে কপিলা, চুলের তেলে কপাল তাহার ভিজিয়া গিয়াছে, দেহ যেন উথলিযা উঠিয়াছে কপিলার, বর্ষার পদ্মার মতো। কী ভীষণ খুশি মনে হইতেছে কপিলাকে। নিজের মলিন কাপড় ও চাদরটির লজ্জায় কুবেরের ছুটিয়া পলাইতে ইচ্ছা হইতে থাকে।

কয়েক মিনিট সাধারণ কথাবার্তা বলিয়া কপিলা আবার রাঁধিতে যায়। আরও খানিকক্ষণ আলাপ করিয়া কপিলার শাশুড়িও প্রস্থান করে। বাড়ির দু-একটি ছেলেমেয়ে শুধু ঘোরা-ফেরা কবে কুবেরের কাছে, তারপর তারাও চলিয়া যায়। কুবের বসিয়া থাকে একা। বোকা, নোংরা, অপদার্থ কুবের। ময়নাদ্বীপের এনায়েত ও বসিরের কথা কুবেরের মনে পড়ে—মনে পড়ে জ্যোৎস্নালোকে হোসেনের কুটিরের দাওয়ায় বন্দী এনায়েতের ভাত খাওয়া; যার জন্য দ্বীপের অধিবাসীদের কাছে করার সে মার খাইয়াছে, তারই আনিয়া দেওয়া ভাত! হোসেনের কল্যাণে কদিন পরে মিলনও তাদের হইবে—প্রকাশ্য, সামাজিক, আইনসঙ্গত মিলন। কী আশ্চর্য ভাগ্য লইয়াই এক একটা লোক জন্মায় জগতে! বসিয়া থাকিতে থাকিতে পথ চলার শ্রান্তিতে ঢুল আসে কুবেরের। আধ-জাগা আধ-ঘুমানো অবস্থায় সে স্বপ্ন দেখিতে থাকে, রচনা করিয়া চলে আকাশকুসুম। সর্বশক্তিমান হোসেনকে সে যেন বলিয়াছে কপিলাকে পাইলে সপরিবারে সে ময়নাদ্বীপে গিয়া বাস করিবে— গণেশকেও বলিয়া সে রাজি করিবে যাইতে। হোসেন তাহার চিরন্তন হাসি হাসিয়া যেন বলিয়াছে, তাই করুম কুবির বাই, তাই করুম—আইনা দিমু কপিলারে। তারপর যেন একদিন—

কপিলা আসিয়া বলে, থাকরা নাকি মাঝি?

কুবের বলে, না।

দুইদিন থাইকা যাও? আইছ ক্যান কও দেহি?

সুবচনীর হাটে যামু মন কইরা বাইরইছি কপিলা। তা ভাবলাম তরে দেইখা যাই।

কপিলা মুচকি হাসিয়া বলে, সুবচনীর হাট নাকি আইজ?

কুবের বিবর্ণ হইয়া বলে, না?

হাটে গিয়া ঘুমাইয়া থাকগা মাঝি, কাইল হাট কইরা বাড়িত যাইয়ো, বলিয়া কপিলা রান্নাঘরে চলিয়া যায়। কুবের উঠিয়া নামিয়া যায় উঠানে। লাউমাচার কাছে গিয়া সে দাঁড়ায়। লজ্জায় মুখখানাতে তাহার মাচার উপরকার উপুড় করা কালো হাঁড়িটার ছায়া পড়ে যেন। কপিলার সঙ্গে সে কেন পারিয়া উঠিবে? পদ্মানদীর বোকা মাঝি সে, এক হাটে কিনিয়া কপিলা তাহাকে আরেক হাটে বেঁচিয়া দিয়াছে। অনেকদিন আগে।

দুপুরবেলা বাড়ি ফিরিয়া কুবেরকে দেখিয়া শ্যামাদাস খুশি হইল। দুজনে পুকুরে স্নান করিয়া আসিয়া একসঙ্গে খাইতে বসিল, অতিথি আসিয়াছে বলিয়া কপিলা আজ অনেক রান্না করিয়াছে। কিন্তু খাদ্যে কুবেরের রুচি ছিল না। কুবেরের হঠাৎ আসিবার কারণটা শ্যামাদাসও জানিতে চাহিল। কুবের এবার এক আশ্চর্য মিথ্যা রচনা করিয়া বসিল। হোসেন মিয়ার ময়নাদ্বীপে গিয়া বাস করিতে চাহিবে এমন যদি কেহ জানা থাকে শ্যামাদাসের? অনেক সুবিধা সেখানে বাস করার। বাড়ি-ঘর অন্নবস্ত্র জমিজমা সব এখন বিনামূল্যে পাওয়া যাইবে, দশ-বিশবছব পরে দ্বীপে বসতির বিস্তার হইলে তখন নামে মাত্র খাজনা ধার্য হইবে জমির, পুরুষানুক্ৰমে স্বত্ব জন্মিবে জমিতে। শ্যামাদাস যদি দশজনকে এই সুবর্ণ সুযোগের সংবাদ জানায় আর কেহ ময়নাদ্বীপে যাইতে রাজি হইলে কুবেরকে যদি খবর দেয়, বড়ো ভালো হয় তবে।

শ্যামাদাস অবাক হইয়া বলিল, চা বাগানের ঠিকাদারি নিছ নাকি মাঝি, আঁই?

চা বাগান? কীসের চা বাগান? শ্যামাদাস চলুক না, ময়নাদ্বীপ দেখিয়া আসিবে? আজই চলুক।

তুমি যাওনা ক্যান ময়নাদ্বীপি? শ্যামাদাস জিজ্ঞাসা করিল। কুবের থতোমতো খাইয়া বলিল, যামু। আমিও যামু। আজ এখানে থাকিয়া যাওয়ার জন্য কুবেরকে অনেক অনুরোধ করিল শ্যামাদাস। কিন্তু থাকিবার উপায় কি আছে কুবেরের! গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া তাহাকে ময়নাদ্বীপের বারতা প্রচার করিতে হইবে।

সুবচনীর হাটের ভিতর দিয়া আমিনবাড়ির পথ। হাটের শূন্য চালাগুলি খাঁ খাঁ করিতেছিল, পথের ধারে স্থায়ী দোকান ও আড়তগুলি শুধু খোলা আছে। একটা খাবারের দোকানের সামনে নড়বড়ে বেঞ্চটাতে কুবের বসিয়া পড়িল। ভয়ানক শীত করিতেছিল কুবেরের, শরীরটা ছমছম করিতেছিল আর চোখ দুটো করিতেছিল জ্বালা। হুড়মুড় করিয়া জ্বর যে আসিতেছে অনেকক্ষণ আগেই সে তাহা টের পাইয়াছিল। বেঞ্চিটা রোদে সরাইয়া নিয়া চাদর মুড়ি দিয়া সে শুইয়া পড়িল। ক্ৰমে অপরাহু হইয়া আসিল, দোকানের ছায়া কুবেরকে অতিক্ৰম করিয়া হাটের চালাগুলির মাথায় উঠিয়া গেল, কুবের তেমনিভাবে পড়িয়া রহিল বেঞ্চিটাতে। শেষে ময়রা তাহাকে ডাকাডাকি আবম্ভ করিয়া দিল।

জ্বর আসিবার মুখে ভোজ খাইয়াছিল, অবস্থা বড়ো শোচনীয় হইয়া পড়িয়াছে কুবেরের। কপিলার স্বামী শ্যামাদাসের অবস্থা ভালো বলিয়া, গরিব সে, জ্বর গায়ে পথে নামিয়া আসিয়াছিল, এত জ্বর যে আসিবে কুবের তো ভাবিতে পারে নাই। মাথার মধ্যে যেন কুয়াশা নামিয়াছে আর শব্দ হইতেছে গমগম। কোথায় কী অবস্থায় সে পড়িয়া আছে তাও মাঝে মাঝে গোলমাল হইয়া যাইতেছে সব,–সমুদ্র তরঙ্গ, দুর্গাপূজার আলো, অন্ধকার একটা চাঁচেব বেড়ার বাহিরে সারিসারি ঘুমন্ত মানুষ, বারবার জাল নামানো উঠানো, ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা মাছের লাফালাফি সব একাকার হইয়া যাইতেছে। ময়রা মুখের চাদর সরাইয়া দিলে কুবের আরক্ত-চোখে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকে, বিড়বিড় করিয়া বলে, শ্যামাদাসেরে খবর দিবা, আকুরটাকুরের শ্যামাদাস?

সন্ধ্যার পর কুবের আবার ফিরিয়া গেল কপিলার কাছে, তাহাকে বিছানায় শোয়াইযা একটা মোটা কাঁথা তাহার গায়ে চাপাইয়া দিয়া কপিলা রাঁধিতে গেল। অন্ধকার ঘরে কুবের শুইয়া রহিল একা।

শেষরাত্রে ঘাম দিয়া কুবেরের জ্বর ছাড়িয়া গেল। সেই সঙ্গে ঘুমও ভাঙিয়া গেল তাহার, আর ঘুম আসিল না। একটা বিশ্রী বোটকা গন্ধে বড়ো অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিল। অল্প অল্প আলো হইলে সে উঠিয়া বসিল। ঘরখানা খুবই ছোটো, ঘরের অর্ধেক জুড়িয়া পাটের স্তুপ আব দরজার কাছে প্রকাণ্ড একটা পাঁঠা বাঁধা, শুইয়া শুইয়া দাড়ি নাড়িয়া জাবর কাটিতেছে।

শরীরটা বড়ো দুর্বল বোধ হইতেছিল কুবেবের। ধীরে ধীরে উঠিয়া সে বাহিরে গেল। কপিলা উঠানে গোবর লেপিতেছিল, বলিল, কিবা আছ মাঝি?

কুবের ক্ষীণস্বরে বলিল, জ্বর নাই। আমি অখন যামু কপিলা।

এখনই যাইবে কুবের, এই ভোরে? নাইবা গেল সে আজ দুর্বল শরীর লইয়া? একটু সুস্থ হইয়া কাল গেলে হয় না? অন্তত কিছু খাইয়া যাক সে। এখনই দুধ দুহিয়া কপিলা জ্বাল দিবে, একটু দুধ খাইয়া যাক।

না, কুবের কিছু খাইবে না। প্রয়োজন নাই। পাঠা ও পাটের সৌরভে তার পেট ভবিয়া গিয়াছে। বিষণ্ণ মুখে কুবের মাথা নাড়ে। পদ্মানদীর কূল ছাড়িয়া দশ মাইল তফাতে চলিয়া আসিয়াছে সে, মন কেমন করিতেছে তার। পদ্মার বাতাস গাযে না লাগিলে, কেতুপুরের মেছো গন্ধ না শুকিলে, সে সুস্থ হইবে না।

কপিলা গোবর লেপা স্থগিত করিয়া বলে, গোসা করছ মাঝি? গোসা কইরো না। ঘরভরা মাইনষের পাল, ঘর নি আছে আর তোমারে দিমু শোওনের লাইগা?

কুবের বলিল, হ রে কপিলা, হ! ব্যাজাল পারিস না, তর ব্যাজালে গাও জ্বলে।

গাও জ্বলে মাঝি? গাও জ্বলে?

হ, জ্বলে! গোবু ছাগল ভাবস আমারে তুই, খেলা করস আমার লগে। তরে চিনা গেলাম কপিলা, পরনাম কইরা গেলাম তরে।

কপিলা ফিসফিস করিয়া বলে, চুপ কর মাঝি, বেবাকে শুনবো। যাইবা যাও, কী আর কমু তোমারে? এউক্‌কা কথা কইয়া দিই মাঝি, মাথা খাও, দিদিরে কথাডা কইয়ো। কইয়ো, কপিলা পরের ঘরের বউ, পরের শাসনে কপিলার মুখে রাও নাই। অতিথ কই থাকবো, অতিথ কী খাইবো, কপিলারে কেডা তা জিগায়? দুষি কইরো মাঝি, শাইপো—কিন্তু এই কথাডা কইয়ো দিদিরে, মাথা খাও মাঝি, কইয়ো।

কার লগে কথা কস বউ?–ঘরের ভিতর হইতে শাশুড়ি জিজ্ঞাসা করে।

কপিলা চাপা সুরে বলে, যাও গা মাঝি। ক্যান আইছিলা তুমি?

 

আমিনবাড়ির হাসপাতাল হইতে গোপিকে সঙ্গে করিয়া জলপথে কুবের গ্রামে ফিরিল। তাহার শীর্ণ চেহারা দেখিয়া মালা বারবার জিজ্ঞাসা করিল, কী হইয়াছিল তাহার, ফিরিতে এত দেরি হইল কেন? প্রশ্নগুলিকে এড়াইয়া গেল কুবের। অল্প সময়ের মধ্যে অকস্মাৎ অনেকগুলি বিচিত্র অভিজ্ঞতা কুবেরকে যেন নতুন মানুষ করিয়া দিয়াছে, নদী ও নদীতীরের একটানা জীবনে তাহার গত কয়েকটি মাস চিরস্মরণীয়। কোথায় ছিল কপিলা, কোথায় ছিল আশ্বিনের ঝড়, কোথায ছিল ময়নাদ্বীপ! সব একসঙ্গে ভিড় করিয়া আসিয়াছে তাহার জীবনে।

গ্রামে ফিরিয়া কুবের দেখিল, রাসু ইতিমধ্যে পীতমের সঙ্গে ভাব করিয়া ফেলিয়াছে। যুগীর ছেলে হইয়াছে, পীতমকে কে আর দেখিবে, কাজটা তাই পাইয়াছে রাসু। যুগীর মতো রাসুকেও সে সর্বদা শাপান্ত করে, রাসু নীরবে সেবা করে বুড়ার, রাগও করে না, দুঃখিতও হয় না। রাসুর ধৈর্য দেখিয়া কুবের খুশি হয়, পীতম খুশি থাকিলে রাসু হয়তো কিছু পাইবে টাকা-কড়ি, গোপিরই ভালো হইবে তাহাতে। এমন কী, পীতমকে দেখিতে গিয়া তার কাছে রাসুর কিছু কিছু প্রশংসাও করিয়া আসে কুবের। বলে, মনটা ভালো রাসুর, দয়া-মায়া আছে রাসুর বুকে, নকুল-টকুলের মতো পাজি সে নয়। পীতম শোনে কিন্তু বিশ্বাস করে না। বলে, অরে তুই চিনস না কুবির, অ ডাকাইত। একদিন আমার বুকে চাকু মাইরা সর্বস্ব নিয়া পালাইবো হারামজাদা, তুই আছস কোন তালে!

কুবের প্রতিবাদ করে। না, রাসু সে রকম নয়। বড়ো ভালো রাসু।

কয়েকদিন পরে হোসেন মিয়া ফিরিয়া আসিলে কুবেরের অলস দিনগুলি শেষ হয়। রকমারি ব্যবসা হোসেনের, ধান, পাট, বিড়ির পাতা, তামাক, গুড়, চিনি, মশলাপাতি এক একরাব এক একরকম বোঝাই নিয়া কুবের বন্দর হইতে বন্দরে যাতায়াত করে। গোয়ালন্দের অপর তীরে একবার সাতশো ছাগল আসিয়া হাজির, সারাদিন ধরিয়া কুবের তাহাদের নদী পার করিল। ছাগলের গন্ধে বারবার তাহার মনে পড়িতে লাগিল কপিলার বাড়িতে এক কষ্টকর রাত্রিযাপনেব কথা। পরের বাড়িতে পরের শাসনে নিরুপায় নির্বাক বউ কপিলা যেখানে তাকে পাট-জমানো পাঁঠা-বাঁধা ভাঙা ঘরখানায় শুইতে দিয়াছিল।

তারপর একদিন চাঁদপুর যাওয়ার হুকুম পাওয়া গেল। তাড়াতাড়ি যাইতে হইবে, দিবারাত্রি নৌকা বাহিয়া যাওয়া চাই। গণেশ বিরক্ত হইয়া গজগজ করিতে লাগিল। শম্ভু ও বগা বহুদিন হোসেনের অধীনে কাজ করিয়াছে তারা কিছুই বলিল না, প্রাণপণে বইঠা বাহিয়া কুবেরকে অবাক করিয়া দিল। হোসেনকে কিছু কিছু কুবের এখন চিনিতে পারিয়াছে। সাধারণত সময়ের হিসাব হোসেনের একটু শিথিল, নৌকার খেপ দিতে মাঝিরা দেরি করিলে কিছু সে বলে না, শম্ভু ও বগা তাই গা ছাড়িযা দিয়া বইঠা ধরে, কুবেরের তাড়া গ্রাহ্য করে না। কিন্তু হোসেন যখন মুখ ফুটিয়া বলে যে দ্রুতগতির প্রয়োজন, শম্ভু ও বগার সমস্ত শৈথিল্য তখন অন্তর্হিত হয়। এমনভাবে বইঠা বাহিতে থাকে তাহারা যেন ভূতে পাইয়াছে তাহাদের। মনে মনে সায় দেয় কুবের। এমনিভাবেই কাজ নিতে হয় বটে মানুষের কাছে, এমনই কৌশলে। একটু দেরিতে যখন কিছুই আসিয়া যায় না, মাঝিদের সঙ্গে তখন বকবিকি না করিলে, তাড়াতাড়ির সময় দুবার বলিতে হয় না, এতটুকু ইঙ্গিত পাইলে আলস্য-পরিতৃপ্ত মাঝিরা সহসা অতিমাত্রায় কর্মঠ হইয়া ওঠে।

হোসেনের বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় কুবের প্রতিনিয়তই পায়। বিস্তৃত তাহার কর্মক্ষেত্র, এখানে ওখানে ছড়ানো তাহার জীবন, এলোমেলো তাহার চলাফেরা,—তবু চারিদিকে সামঞ্জস্য, সব নিয়মে বাঁধা। একটা জটিল বিশৃঙ্খলায় সে সব শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া দিয়াছে।

চাঁদপুরে হোসেন মিয়া নৌকায় যোগ দিল। ময়নাদ্বীপের পথেই এবারও নৌকা চলিল, নোয়াখালির উপকূলে ক্ষুদ্র একটি গ্রামের কাছে নৌকা বাঁধা হইল। নৌকায় বোঝাই দেওয়া হইল নারিকেল। বোঝাই শেষ হইল কিন্তু নৌকা খুলিবাব হুকুম হোসেন দিল না। দুদিন সেইখানে নিষ্কর্ম হইয়া তাহারা বসিয়া রহিল।

তৃতীয় দিন সন্ধ্যার সময় নদীর মোহনার দিক হইতে মুসুরি বোঝাই প্রকাণ্ড একটা সমুদ্রগামী বোট আসিয়া ভিড়িল পাশে, চট্টগ্রামবাসী এক বৃদ্ধ মুসলমান নামিয়া আসিয়া অনেকক্ষণ হোসেনের সঙ্গে করিল পরামর্শ। বোট হইতে তারপর ত্রিপল মোড়া কী যেন আসিল এই নৌকায়, ছইযের মধ্যে পাটাতনের তলে হোসেন তাহা লুকাইয়া ফেলিল। তারপর হোসেন ও বৃদ্ধ মুসলমানটি নামিয়া গেল তীরে, গুনিয়া গুনিয়া হোসেন কতকগুলি নোট তাহার হাতে দিল, নৌকায় ফিরিয়া আসিয়া বলিল, নাও খোলো কুবির বাই।

বড়ো কৌতুহল হইতেছিল কুবেরের। পাটাতনের নীচে কী লুকাইযা রাখিয়াছে হোসেন? হোসেনকে প্রশ্ন করিবার সাহস কুবেরের হইল না। অনেক রাত্রে নৌকা বাঁধিয়া রাঁধিবার আয়োজন করিবার সময শম্ভুকে সে চুপিচুপি জিজ্ঞাসা করিল।

শম্ভু বলিল, আপিম মিয়া, আপিম। চুপ যাও।

আপিম? চুপিচুপি আপিমের ব্যবসা করে হোসেন? এ তো ভালো কথা নয়! নানাদিকে কত উপার্জন হোসেনের, এইসব অসদুপায়ে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা কেন তার? তা ছাড়া, চোরাই আপিমের ব্যাবসা করা তো সহজ বিপদেব কথা নয়। ধরা পড়িলে কী উপায় হইবে তখন? কুবেরের ভয় করিতে লাগিল। হোসেন মিয়ার সঙ্গে যেদিন সে ভিড়িয়াছে, সেইদিন হইতে সে জানে একদিন অনিবার্য বিপদ আসিবে, একেবারে সর্বনাশ হইয়া যাইবে, আজ কুবের বিপদের স্বরূপটা বুঝিতে পারিল। আজ হোক, কাল হোক হাতে পড়িবে হাতকড়া, তারপর দু-দশবছর জেলের বাহিরে কুবেরকে আর খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।

ছইযের ভিতরটা হোসেন মিয়া দখল করিয়াছে, নৌকার উন্মুক্ত অংশে হোগলার ঢাকনি চাপাইয়া মাঝিরা শয়ন কবে। শুইয়া শুইয়া কুবের অনেক আবোল-তাবোল চিন্তা করিল। একবার ভাবিল, এবার গায়ে ফিরিয়া হোসেন মিয়ার নৌকায় আর সে কাজ করিবে না। জেলে যাওয়ার চেযে না খাইয়া মরাও ভালো। কিন্তু না খাইয়া মরার সঙ্গে কুবেরের পরিচয় আছে। হোসেন মিয়ার সঙ্গে ভিড়িয়া জীবনে সে প্রথম সচ্ছলতার সুখ জানিয়াছে, এই কাজ ছাড়িয়া দিলে যে অবস্থা তাহার হইবে খানিকক্ষণ সে বিষয়ে চিন্তা করিয়া কুবের বুঝিতে পারে জানিয়া শুনিয়া ইচ্ছা করিয়া দারিদ্র্যকে বরণ করিবার ক্ষমতা আর তাহার নাই। ক্ষোভে কুবেরের চোখে জল আসে। এ কী অন্যায় হোসেন মিয়ার। এই সব বিপজ্জনক কাজগুলি বাদ দিলেও তাহার তো কাজের অভাব নাই, সে সব কাজে ব্যাপৃত না রাখিয়া কুবেরকে কেন সে এই বিপদের মধ্যে টানিয়া আনিয়াছে? তারপর কুবের ভাবে, এই সব ভয়ংকর কাজের সহায়তা যদি তাকে করিতে হয়, বিপদের ভাগ যদি তাহার থাকে, লাভের অংশও তো তার পাওয়া উচিত? জেলে যাওয়ার ঝুঁকি যার সে কী শুধু বইঠা বাহিবার মজুরিই পাইবে?

মনে মনে কুবের কলহ করে হোসেনের সঙ্গে। কল্পনায় সে বারবার এই ঘটনাগুলি ঘটাইয়া যায় : হোসেনের অন্যায়টা বুঝাইয়া দিতে সে ভারী অনুতপ্ত হয়, তাড়াতাড়ি কোমরের কালো বেল্ট হইতে একতাড়া নোট নিয়া সে কুবেরকে দেয়। চার ভিটায় চারখানি বড়ো বড়ো ঘর তোলে কুবের, গোয়াল করে, ধানের মরাই করে, ঝাকার উপর লাউলতা তুলিয়া দেয়। তারপর একদিন কপিলাকে নিমন্ত্রণ করে। কপিলার পা দুটি জড়াইয়া ধরিয়া বলে যে তাকে ছাড়িয়া থাকিতে বুক ফাটিয়া গিয়াছে কুবেরের—ও কপিলা, আমারে ফেইলা আর যাইস না, যাইস না-আমি নি মইরা গেলাম কপিলা তরে না দেইখা?

কেতুপুরে ফিরিয়া কুবের এক আশ্চর্য সংবাদ শুনিল।

পীতমের বাড়িতে চুরি হইয়া গিয়াছে। গভীর রাত্রে সিঁদ কাটিয়াছে চোর। ঘরের কোণে কোথায় পীতম মস্ত একটি ঘটি ভরিয়া টাকা পুতিয়া রাখিয়াছিল, চোরের তাহা জানিবার কথা নয়। তবু সেইখানটা খুঁড়িয়াই ঘটিটা চোব নিয়া গিয়াছে।

টাকার শোকে বড়ো কাতর হইয়া পড়িয়াছে পীতম। চুরির ব্যাপারে রাসুকেই সে সন্দেহ করে। রাসু নিজে সিঁদ দিয়াছে এ কথা সে স্পষ্ট বলে না, তবে চোরের সঙ্গে রাসুর যে যোগ আছে তাতে পীতমের সন্দেহ নাই। ঘরের লোক বলিয়া না দিলে ঘটির সন্ধান চোর পাইত কোথায়? পীতমের গালাগালিতে রাসু কখনও রাগ করে নাই। কিন্তু এবার চুরির অপবাদ দেওয়ামাত্র পীতমকে আচ্ছা করিয়া কড়া কড়া কথা বলিয়া সে চলিয়া গিয়াছে। এটাও বড়ো সন্দেহজনক।

চুরির অপবাদের জন্য যেন নয়! টাকার সঙ্গেই যেন সে গিয়াছে, এতদিন গেল না কেন তবে, পীতমের যতদিন টাকা ছিল?

কুবের খবর নিতে গেলে পীতম কাঁদিয়া কাঁদিয়া চোর, রাসু ও বিশ্বসংসারের বিরুদ্ধে তার নালিশ জানাইতে লাগিল। হায়, তার সারা জীবনের সঞ্চয়, সাতকুড়ি তেরোটা টাকা! কোথায় আছে তার সেই পলাতক পুত্র, বুড়ো বাবাকে মনে করিয়া কবে সে ফিরিয়া আসিবে সেই আশায় পীতম যে টাকাগুলি জমাইয়া রাখিয়াছিল। সে কি চোরকে দিবার জন্য? লক্ষ্মীছাড়া রাসুর পেটে যাওয়ার জন্য?

কুবের বলে, রাসু জানল কিবা কই থুইছিলা ঘটি?

তা কি পীতম জানে? যে শয়তান মানুষ রাসু, কেমন করিয়া যেন টের পাইয়া গিয়াছে ঘটিটা কোথায় পোতা ছিল, রাসুর অসম্ভব কাজ নাই। ঘটির সন্ধান করিতেই হযতো সে আসিয়াছিল পীতমকে সেবা করিবার ছলে। সারাদিন ঘরের মধ্যে ঘুরিত রাসু—একোণ ওকোণ করিয়া বেড়াইত, আর তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মেঝের দিকে চাহিয়া কী যেন খুঁজিত। তখনই সন্দেহ হইয়াছিল পীতমের। হায়, তখন যদি সে সাবধান হইত!

কুবের বিশ্বাস করিল না রাসুর অপরাধ। ঘটি কোথায় পোতা ছিল তাই যদি রাসু জানিবে, চোরের সঙ্গে যোগ দিয়া টাকার সে ভাগিদার জুটাইবে কেন? নিজেই তো অনায়াসে চুপিচুপি ঘটিটা সরাইয়া ফেলিতে পারিত, তারপর গর্ত বুজাইয়া লেপিয়া মুছিয়া ঠিক করিয়া রাখিলে কতকাল পরে পীতম টাকা চুরির কথা টের পাইত ঠিক ছিল না। সিঁদ কাটিবার হাঙ্গামা রাসু করিতে যাইবে কেন?

চৌকিদার থানায় খবর দিয়াছিল। পুলিশ আসিয়া চুরির তদন্ত করিল। পুলিশ দেখিয়া কুবেরের বুকের মধ্যে কাঁপিতে আরম্ভ করিয়া দেয়, হোসেন মিয়ার সঙ্গে এবার নৌকাযাত্রা করিয়া আসিয়া পুলিশের জন্য চিরন্তন স্বাভাবিক ভীতিটা কুবেরের অস্বাভাবিক রকম প্রখর হইয়া উঠিয়াছে। পুলিশের কাছে পীতম অম্লান বদনে বলিয়া দিল রাসুকে সে সন্দেহ করে।

রাসুকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করা হইল, তার ঘরখানা খুঁজিয়া দেখা হইল, তারপর রাসুর হাতে হাতকড়া না দিয়াই পুলিশ চলিয়া গেল। না, রাসুর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নাই।

পুলিশ চলিয়া গেলে পীতমের বাড়ির সামনে দাঁড়াইয়া অনেকক্ষণ রাসু যা মুখে আসিল তাই বলিয়া পীতমকে অভিসম্পাত করিল। শুনিয়া কে বলিবে পীতম তার মামা!

তারপর একদিন সকালে কুবেরের কাছে আসিয়া রাসু জিজ্ঞাসা করিল, কবে বিয়া দিবা?

কুবের তৎক্ষণাৎ সন্দিগ্ধ হইয়া বলিল, গতিক কী রে রাসু? পীতম খুড়ার টাকা নি তুই নিছস?

রাসুর মুখখানা একটু বিবর্ণ হইয়া গেল বইকী!

সে বলিল, কী কও লখার বাপ, আঁই? টাকা নাই আমার? কাম করি না আমি?

কী কাম করস?

শেতলবাবু কাম দিছেন, বাবুগো নায়। মামা্র ঘরে চুরি করুম? অমন কথা কইয়ো না লখার বাপ!

তখন কুবের বলিল, পণের টাকা দিয়া থো না ক্যান তবে?

রাসু বলিল, দিমু। কবে বিয়া দিবা কও?

গোপি সারিয়া উঠিতেছিল। এখনও সে ভালো করিয়া হাঁটিতে পারে না বটে, তবে ক্রমেই পায়ে জোর পাইতেছে। মাসখানেক পরে বিবাহ তাহার দেওয়া যায়। কিন্তু বিবাহের আগে টাকা কুবেরের পাওয়া চাই, মেয়ের গায়ে ওঠা চাই গহনা। রাসুর মুখের কথায নির্ভর করিয়া থাকিবার পাত্র সে নয়।

যথাসময়ে টাকা ও গহনা দিবার প্রতিজ্ঞা করিয়া রাসু বিদায় লইল। প্রতিজ্ঞা করিল সে অবলীলাক্রমে, রাসুর যেন টাকার ভাবনা শেষ হইয়াছে বাবুদেব নৌকায় কাজ পাইয়া, সে যেন বড়োলোকই হইয়া গিয়াছে। টাকা ও গহনার কথা শুনিয়া একদিন মুখে তাহার কালিমা ঘনাইয়া আসিয়াছিল, আজ সে নির্ভয় নিশ্চিন্ত!

মালা বলে, রাসুরে য্যান কেমন কেমন দেহি, আমি ডরাই মাঝি।

কুবের বলে, ডরাইযা কাম নাই তর।

আঁই? বলিয়া মালা অবাক হইয়া থাকে।

কুবের গোপিকে ডাকে। লাঠি ধরিয়া হাঁটিতে বলে গোপিকে। গোপি কষ্টে উঠিয়া দাঁড়ায়, কষ্টে দু-এক পা হাঁটে। কুবের তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চাহিয়া দেখিয়া বলে, সারব গোপির মা, খাসা সারব পাওখান গোপির। রাসুর লগে ক্যান দিমু বিয়া?

কইলা যে রাসুরে?

কুবের একগাল হাসে। বলে, তুই নি মাইয়ালোক গোপির মা, বোঝস না। রাসুরে হাতে থুইছি, পাও যদি না সারে মাইয়ার, রাসুর লগেই দিমু। আর সাইরা যদি যায় গোপির মা, পাওখান যদি সাইরা যায় গোপির-—

মহোৎসাহে কুবের গোপির হাঁটুতে হাসপাতালের দেওয়া ওষুধ মালিশ করিতে থাকে। জোরে জোরে ঘষে কুবের, ব্যথায় গোপি কাতরায়। কুবের ধমক দিয়া বলে, চুপ থাক, চুপ থাক। জোর জোর না দিমু তো সারব ক্যান? মালিশ করিতে করিতে থামিয়া গিয়া হাঁটুটা সে টিপিয়া টিপিয়া পরীক্ষা করিয়া দ্যাখে। বলে, ফুলা কমে নাই গোপির মা?

হ। কম য্যান লাগে।

বলিয়া মালা উৎসুক চোখে গোপির পায়ের দিকে চাহিয়া থাকে। অনেকক্ষণ পরে সলজ্জভাবে বলে, মনে এউক্‌কা সাধ ছিল মাঝি। কমু?

হ, এমনইভাবে ভনিতা করে মালা। মালার তামাটে মুখখানা একটু রাঙা দেখায়। আস্তে আস্তে সে জিজ্ঞাসা করে কুবেরকে, হাসপাতালের যে ডাক্তার গোপির পা ভালো করিয়া দিয়াছে সে কি মালার পা-খানার কিছু করিতে পারে না? একবার গিয়া দেখাইয়া আসিলে হয় কিন্তু। কিছু যদি ডাক্তার না করিতে পারে নাই করিবে, মালার বড়ো সাধ একবার গিয়া দেখাইয়া আসে। কুবের কী বলে?

কুবের গম্ভীর হইয়া বলে, তর পায়ের কিছু হইবো না গোপির মা।

কেন? হইবে না কেন? মালা জিজ্ঞাসা করে। আহা, একবার দেখাইয়া আসিতে দোষ কী? ডাক্তার যদি বলে কিছু হইবে না, নিজের কানে শুনিয়া আসিয়া মালা নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিবে। একবার লইয়া চলুক কুবের তাহাকে। একফোঁটা যদি মায়া থাকে তার জন্য কুবেরের বুকে, একবার সে তাকে লইয়া চলুক সদরের হাসপাতালে। কুবের কী বুঝিবে খোঁড়া পায়ের জন্য সারাজীবন কী দুঃখ মালা পুষিয়া রাখিয়াছে মনে।

না? লইয়া যাইবে না কুবের? আঁই গো কুবেরের পাষাণ প্রাণ! মালার চোখে জল আসে। বিনাইয়া বিনাইয়া সে বলিতে থাকে যে মেয়ের জন্য কুবের দশবার হাসপাতাল যাইতে আসিতে পারে, মালাকে একবার, শুধু একটিবার লইতে তাহার আপত্তি! হ, অনেক পাপ করিয়াছিল আর জন্মে মালা, এবার তাই এমন কপাল লইয়া জন্মিয়াছে। কোলের ছেলেটাকে মালা মাই ছাড়াইয়া নীচে ফেলিয়া দেয়, ঘুরিয়া বসিয়া দরজার খুঁটিতে ঠকঠক করিয়া মাথা ঠোকে আর কাঁদিতে কাঁদিতে আহ্বান কবে মরণকে—যে মরণ এমনই নির্দয় যে মালার মতো পোড়াকপালির দিকে ফিরিয়াও তাকায় না।

চুপ যা গোপির মা, চুপ যা!

কেন চুপ যাইবে? কুবেরের দরদ আছে নাকি মালার জন্য? সে তো কপিলার মতো ভঙ্গি করিয়া হাঁটিতে পারে না যে তাকে লইয়া কুবের আমিনবাড়ির হাসপাতালে যাইবে, হোটেলে রাত কাটাইয়া আসিবে পরমানন্দে!

কুবের বিবর্ণ হইয়া বলে, কিবা কথা কস গোপির মা? মাইরা ফেলুম কইলাম। তারপর সে সুর বদলাইয়া বলে, হাসপাতালে যাওনের লাইগা কাঁদনের কাম কী আঁই! যাইবার চাস নিয়া যামুনে। যা মুখে লয় কইয়া রাগাইস না গোপির মা!

মালা ফোঁসফোঁস করিতে করিতে বলে, নিবা? নিয্যস? নিবা?

নিমু।

কিন্তু মালাকে আমিনবাড়ি নিয়া যাওয়ার সময় কুবেরের হয় না। হোসেন মিয়ার কাজের এখন অন্ত নাই, অবিরত চালান আসিতেছে, চালান যাইতেছে, এ বছর সতেজে ব্যাবসা আরম্ভ করিয়াছে হোসেন। মাঝখানে আবার একবার নৌকা লইয়া নারিকেলের ও চোরাই আপিমের চালান আনিতে কুবেরকে সেই নোয়াখালির উপকূলে যাইতে হইল। এবার আপিম পৌঁছাইয়া দিল একটি স্টিমলঞ্চ, লঞ্চে এক সাহেব আসিয়াছিল, হোসেন মিয়াকে কী তার খাতির! আপিমের পুঁটুলি নিয়া নৌকা চালাইতে এবারও কুবেরের বুকের মধ্যে সমস্ত পথ একটা আতঙ্ক জাগিয়া রহিল। গতবার ফিরিয়া গিয়া হোসেন প্রত্যেক মাঝিকে দশটা করিয়া টাকা—বখশিশ দিয়াছিল— এবারও দিবে সন্দেহ নাই, কিন্তু টাকার কথা ভাবিয়া কুবেরের একবিন্দু আনন্দ হইল না।

গণেশ জিজ্ঞাসা করে, কী ভাব কুবিরদা? ঝিমাও ক্যান? মিয়া বাই আপিম দিছে নাকি?

কুবের বলে, চুপ যা বলদ!

গণেশ বলে, কুকীর মা রূপার পইছা চায় কুবিরদা। ভাবি কী, ইবার মিয়াবাই টাহা দিলি দিমু পইছা গড়াইয়া কুকীর মারে—গণেশের খুশি ধরে না, কুবেরের গায়ে ঠেলা দিয়া বলে, হোসেন মিয়ার নায় কাম নিয়া বড়ো কাম করছ কুবিরদা! টাহার মুখ দেখিলাম।

কুবের তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সুদুর নদী বক্ষে চাহিয়া বলে, উটা কী রে গণশা? পুলিশের লন্‌চো নাকি?

হ।

কুবের শিহরিয়া বলে, কোন দিকে যায়?

আমাগো দিকে আহে দেহি কুবিরদা।

কুবের বিবর্ণ মুখে হোসেন মিয়ার কাছে যায়। ফিসফিস করিয়া বলে, পুলিশ লন্‌চো আহে মিয়াছাব।

হোসেন মৃদু মৃদু হাসে, বলে, বইঠা ধর গিয়া কুবির বাই। হোসেন মিয়া থাকতি কারে ডরাও? নদীর মধ্যি জাল ফেলাইয়া মাল উঠাইবো কোন হালার পুত?

হ? বিপদ ঘনাইয়া আসিলে আপিমের বান্ডিল নদীর জলে ফেলিয়া দিলেই চুকিয়া গেল? তাই হইবে বোধ হয়! সেই জনাই হয়তো হোসেন সর্বদা জলপথে আপিমের চালান নিয়া আসে, নতুবা নোয়াখালি হোক চট্টগ্রাম হোক রেলে স্টিমারে চাঁদপুর আসা ঢের সুবিধা। কুবেরের ভয় কিছু কমে। তবু, সুদূর পুলিশ লঞ্চের দিক হইতে দৃষ্টি সে ফিরাইতে পারে না। লঞ্চটি যখন ক্ৰমে ক্ৰমে কাছে আসিয়া পাশ দিয়া চলিয়া যায় কুবের শ্বাসরোধ করিয়া থাকে।

 

একদিন ভোরবেলা বাড়ি ফিরিয়া কুবের মালাকে দেখিতে পাইল না। গোপি বলিল, রাসুর সঙ্গে মালা আমিনাবাড়ির হাসপাতালে গিয়াছে।

কুবের রাগিয়া বলিল, কার নায?

বাবুগো নায়।

তিনদিন নদীর বুকে কাটাইয়া আসিয়াছে, মেজাজ গরম হইয়া ছিল কুবেরের। রাগে সে গুম খাইয়া রহিল। গোপি গড়গড় করিয়া ব্যাপারটা বিস্তারিত বলিয়া গেল। মালা কদিন হইতে রাসুকে তোষামোদ করিতেছিল, কাল মেজোবাবু মকদ্দমাব জন্য আমিনবাড়ি গিয়াছেন, সেই সুযোগে বাবুকে বলিয়া কহিয়া মালা ও রাসু সঙ্গে গিযাছে।

মেজোবাবু? মেজোবাবুব নৌকায় মালা আমিনবাড়ি গিয়াছে? মেয়ের দিকে কুবের কটমট করিয়া তাকায়। গোপিই যেন অপরাধিনী।

গোপি ভয়ে ভয়ে বলে, লখা লগে গেছে বাবা।

সারাদিন কুবের বাড়ি ছাড়িয়া নড়িল না। জীবনটা হঠাৎ তিতো হইয়া গিয়াছে কুবেরের কাছে। সমস্ত সকালবেলাটা সে রাগে আগুন হইয়া রহিল, নিধু মাঝি আলাপ করিতে আসিলে তাহাকে অকথ্য গালাগালি করিয়া ভাগাইযা দিল, বিনাদোষে মারিয়া চণ্ডীকে করিয়া দিল আধমরা। তারপর রাগ কমিয়া অপরাহ্নে আসিল বিষাদ। কেবলই মনে হইতে লাগিল কুবেরের, মালা প্রতিশোধ লইয়াছে। কপিলার সঙ্গে সে কিনা একদিন আমিনবাড়িতেই রাত কাটাইয়া আসিয়াছিল, মালা তাই মেজোবাবুর সঙ্গে সেই আমিনবাড়িতেই গিয়াছে, হাসপাতালে যাওয়ার সেই একই উপলক্ষের ছল করিয়া।

সন্ধ্যা হইল, মালা ফিরিল না। অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়া আসিল হোসেন। কুবের ছাড়া বড়ো ঘরখানা হইতে সকলকে সরাইয়া দিয়া ঘরের মাঝখানের খুঁটি বাহিয়া উঠিয়া নিজে সে চালের খড় ফাঁক করিয়া ছোটো ছোটো দুটি বান্ডিল লুকাইয়া ফেলিল। খুঁটি বাহিতেও জানে হোসেন, গুণের লোকটার অন্ত নাই।

কুবের নীরবে এই অদ্ভুত কাণ্ড চাহিয়া দেখিল, কিছু বলিল না। নামিয়া আসিয়া হোসেন বলিল, ডরাইয়ো না কুবির বাই, ডর নাই।

কুবের মুহ্যমানের মতো মাথা নাড়িল।

হোসেন বসিল। বলিল যে পুটলি দুটি যতদিন সে না লইয়া যায়, কুবেরের ছুটি। সারাদিন বাড়ি বসিয়া আরাম করিবে কুবের, কেমন? চালে গোঁজা জিনিস দুটিকে সে পাহারা দিবে বটে কিন্তু বারবার ওদিকে চাহিবার প্রয়োজন নাই কুবেরের। একেবারে না তাকানোই ভালো। না, ঘরের চালায় কিছুই গোজা নাই কুবেরের। অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়া আজ হোসেন তাহার বাড়ি আসে নাই, খুঁটি বাহিয়া উঠিয়া ঘরের চালে কিছুই সে গুঁজিয়া রাখে নাই।

কী কও কুবির বাই, তাই না? হোসেন মৃদু মৃদু হাসে।

হ, বলিয়া কুবের সায় দেয়।

সকলের চেয়ে বিশ্বাসী, সকলের চেয়ে নিরাপদ এই সরল পদ্মানদীর মাঝিটাকে হোসেন মিয়া যেন ভালোবাসে। কত টাকা হোসেন মিয়ার, দূরে দূরে ছড়ানো কত বড়ো তাহার ব্যাবসা, এগারো মাইল লম্বা একটা দ্বীপের সে মালিক, কুবের তো তাহার চাকর, তবু কুবেরের ঘরের ছেঁড়া চাটাইয়ে হোসেন আরাম করিয়া বসে, বন্ধুর মতো গল্প করে কুবেরের সঙ্গে। চেনাই যেন যায় না এখন হোসেনকে। হোসেনের নৌকায় কাজ নেওয়ার আগে কুবের তো তাকে শুধু সঙ্গতিপন্ন বলিয়া জানিত, অসংখ্য উৎস হইতে হোসেনের যে কত টাকা আসে এখন ভাবিতে গেলে কুবেরের মাথা ঘোরে! সে আর গণেশ শুধু জানিয়াছে, কেতুপুরের আর কেহ হোসেন মিয়ার রহস্য জানে না।

টাকাওলা মানুষের সঙ্গে মেশে না হোসেন, তাদের সঙ্গে সে শুধু ব্যাবসা করে, মাল দিয়া নেয় টাকা, টাকা দিয়া নেয় মাল। মাঝিরা তাহার বন্ধু। অবসর সময়টা সে পদ্মার দীন দরিদ্র মাঝিদের সঙ্গে গল্প করিয়া কাটাইয়া দেয়, টাকায় ফাঁপানো ব্যাগ পকেটে নিয়া বর্ষার রাত্রে জীর্ণ চালার তলে চাটাইয়া শুইয়া নির্বিবাদে ঘুমাইয়া পড়ে।

সেদিন রাত্রে মালা ফিরিল না।

পরদিন বেলা বারোটার সময় হাতের ভরে দুলিয়া দুলিয়া সে গৃহে প্রবেশ করিল, নদীর ঘাট হইতে এতটা পথ এমনিভাবে আসিতে কাপড়খানা তাহার কাদা মাখা হইয়া গিয়াছে। কুবের খাইতে বসিয়াছিল, একবার চাহিয়া দেখিয়া আবার খাওয়ায় মন দিল। ঘরে গিযা কাপড় বদলাইয়া মালা দাওয়ায় আসিয়া বসিল। কুবের চোখ তুলিয়া তাকায় না। চড়া গলায় পিসিকে আর দুটি ভাত আনিতে বলে।

মালা বলে, আগো শুনছ?

না, কুবের শুনিতে পায় না, সে বধির হইয়া গিয়াছে!

মালা বলে, তুমি ত নিলা না, রাসুর লগে তাই হাসপাতাল গেছিলাম। গোসা নি করছ?

জবাবের জন্য মালা খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে। তারপর সজল কণ্ঠে বলে, ডাক্‌তর কয়, পাও সারনের না আমার।

আরও কত কথা মালা বলে, কুবের সাড়া-শব্দ দেয় না। খাইয়া উঠিয়া নীরবে তামাক টানিতে থাকে। গোয়ার কী সহজ কুবের!

মালা শেষে রাগিয়া বলে, ক্যান মাঝি ক্যান, এত গোসা ক্যান? কবে কই নিছিলা আমারে, চিরডা কাল ঘরের মধ্যি থাইকা আইলাম, এউক্‌কা দিনের লাইগা বেড়াইবাব যাই যদি গোসা করবা ক্যান?

যা, বেড়া গিয়া মাইজ কত্তার লগে—হারামজাদি, বদ!

কী কইলা মাঝি, কী কইলা?

তারপর কী কলহই দুজনের বাধিয়া গেল! প্রতিবেশীরা ছুটিয়া আসিল, দাঁড়াইযা দেখিতে লাগিল মজা। শেষে রাগের মাথায় কুবের হঠাৎ কলিকাটা মালার গায়ে ছুঁড়িয়া মারিল। কলিকার আগুনে মালা ও তাহার কোলের শিশুটির গা স্থানে স্থানে পুড়িয়া গেল, কাপড়েও আগুন ধরিয়া গেল মালার। সিধুর বোন ছুটিয়া আসিয়া কাপড়খানা টানিয়া খুলিয়া লইল, নিজের কাপড়ের আঁচল দিয়া লজ্জা নিবারণ করিল মালার। দুঃখিনী সে, বড়ো ছেঁড়া তাহার কাপড়খানা।

স্ত্রী-পুরুষে ভিড় করিয়াছে অঙ্গনে, তাদের সামনে পঙ্গু অসহায়া স্ত্রীর এই দশা, মালার দুরবস্থায় আমোদ পাইয়া সকলে হাসিয়াছে, কে যেন হাততালি দিল। এতক্ষণে চমক ভাঙিল কুবেরের। লাফাইয়া দাওয়া হইতে নামিয়া গাল দিতে দিতে সকলকে সে বাড়ির বাহির করিয়া দিয়া আসিল। তারপর নিজের একখানা কাপড় আনিয়া দিল মালাকে।

ক্রমে ক্ৰমে শীত কমিয়া আসিল।

কেতুপুর গ্রাম ও জেলেপাড়ার মাঝামাঝি খালটা শুকাইয়া গিয়াছে। পদ্মার জলও কমিয়াছে অনেক। ক্ৰমে ক্ৰমে মাঠগুলি ফসল-শূন্য হইয়া খাঁ খাঁ করিতে লাগিল, পায়ে চলা পথগুলি স্পষ্ট ও মসৃণ হইয়া আসিয়াছে অনেকদিন আগে। আমগাছে কচিপাতা দেখা দিয়াছে। দেখিতে দেখিতে পাখির সংখ্যা বাড়িয়া গিয়াছে দেশে। ঝাক বাঁধিয়া বুনোহাঁসের দলকে উড়িতে দেখা যায়। উত্তরাভিমুখী নৌকাগুলি দক্ষিণের জোরালো সমগতি বাতাসে বাদাম তুলিয়া তরতর করিয়া ভাসিয়া যায়, দূরে গেলে অতিথি হাঁসগুলির মতোই রহস্যময় মনে হয় তাদের। মাছ দুধ সস্তা হইয়াছে, পদ্মার চর হইতে কলসিভরা দুধ আসিয়া বাজারে চার পয়সা সের বিকাইয়া যায়।

শীতে কুঁকড়ানো গ্রামগুলি গা মেলিয়াছে। সকাল সন্ধ্যায় মালা কাপড় ভাঁজ করিয়া লখা ও চণ্ডীর শরীর ঢাকিয়া গলায় বাঁধিয়া দেয় না, খালি গাযেই তালা শুকনো ডোবা পুকুরে কাদা ঘাঁটিয়া মাছ ধরিতে যায়। ফাটা চামড়া উঠিয়া গিযা ত্বক মসৃণ হইয়া। সিতেছে সকলেব, মালার রং যেন আরও ফরসা হইয়া আসিয়াছে, একমুষ্টি যৌবন যেন অতিবিক্ত আসিয়াছে মালার দেহে। মালাকে চাহিয়া রাত্রে কুবেরের ঘুম ভাঙে কোনোদিন গৃহে, কোনোদিন পদ্মার বুকে।

রাসুর সঙ্গে গোপির বিবাহের বন্দোবস্ত কিন্তু হইয়া গিয়াছে বাতিল। এ কীর্তিও হোসেন মিয়ার। সোনাখালির একটি পাত্র হোসেন ঠিক করিয়া দিয়াছে গোপির জন্য, নাম তার বঙ্কু, বয়স বেশি নয। এ জগতে বঙ্কুর আপনার কেহ নাই বটে কিন্তু হোসেন মিয়া আছে। হোসেন মিয়া যার মুরুব্বি, কীসের অভাব তার? বঙ্কু পাঁচকুড়ি টাকা পণ দিবে কুবেরকে, গোপিকে গহনা দিবে তিনকুড়ি টাকার, আর একদিন জেলেপাড়ার সকলকে দিবে ভোজ।

এ কথা জানিতে কুবেরের বাকি নাই যে বিবাহের পর নবদম্পতিকে হোসেন ময়নাদ্বীপে লইয়া যাইবে, কিন্তু জানিয়া কী লাভ? হোসেন মিয়ার অবাধ্য কুবের কেমন করিয়া হইবে? তা ছাড়া পাঁচকুড়ি টাকার মায়া ত্যাগ করিবাব সাধ্য কুবেবের নাই। বিবাহ দিলে মেয়ে পরের ঘরে যায়, কাছে অথবা দূরে। গোপি না হয় যাইবে দূরে–অনেক দূরের ময়নাদ্বীপে। হয়তো কখনও একটু মন কেমন করিবে কুবেরের, কিন্তু তার প্ৰতিকার কী? মন তো অনেক কারণেই কেমন করে মানুষের।

খবর শনিয়া রাসু গালাগালি করিয়া গিয়াছে। বলিয়াছে, কথা দিয়া কথা রাখিল না কুবের, কুবেরের সে সর্বনাশ করিয়া ছাড়িবে। যুগীকে গিয়া রাসু বুঝি ধরিয়াছে, তারপর একদিন শীতল আসিয়া রাসুর সপক্ষে খানিকক্ষণ ওকালতি করিয়া গিয়াছে কুবেরের কাছে। বলিয়াছে টাকা যদি বেশি চায় কুবের, সে তা বলে না কেন? সোনাখালির পাত্র যত টাকা দিতে চায তাই দিবে রাসু। গ্রামে রাসুর মতো পাত্র থাকিতে দূর দেশে মেযেকে কুবের পাঠাঁইবে কেন?

কেন? এ কেনর জবাব দিবার ক্ষমতা নাই কুবেরের! ময়নাদ্বীপে গিয়া গোপিকে বাস করিতে হইবে ভাবিলে জালে আবদ্ধ ইলিশ মাছের মতো মাঝে মাঝে তারও মনটা কি ছটফট করে না? তবু তাকে এ সব বলা মিছে।

একদিন গোয়ালন্দে অধরের সঙ্গে কুবেরের দেখা হইয়া গেল। অধর বলিল, কয়েকদিন আগে কপিলা চরডাঙায় আসিয়াছে, কিছুদিন থাকিবে। বাড়ি ফিরিয়া কুবের সেদিন মালাকে বড়ো দবদ দেখায়। বলে, মালা কতকাল বাপের বাড়ি যায় নাই, ইচ্ছা করে না যাইতে? ইচ্ছা যদি হয় তবে না হয় চলুক মালা কাল, দু-চারদিন থাকিয়া আসিবে। মালা বলে, না, বাপের বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা তাহার নাই। বাপ কি যাইতে বলিয়াছে তাকে? এতকাল সে যে যায় নাই, একবার কি দেখিতে আসিয়াছে তাকে? মালা কাঁদো কাঁদো হইয়া যায়। বলে, তার মনটা শুধু পোড়ায় বাপভাইয়ের কথা ভাবিয়া, তার জন্য ওদের কারও দরদ নাই। কেন সে যাইবে বাপের বাড়ি যাচিয়া? কুবের বিপন্ন হইয়া বলে, গেলে দোষই বা কী? বাপের বাড়ি তো বটে, যাচিয়া বাপের বাড়ি যাইতে কারও লজ্জা নাই। কালই চলুক মালা, দু-দিন একদিন পরেই ফিরিয়া আসিবে?

এবার মালা সন্দিগ্ধ হইয়া বলে, যাওনের লাইগা জিদ কর ক্যান মাঝি?

জিদ কিবা? দরদ কইরা কইলাম, জিদ!

মালার উপর রাগের সীমা থাকে না কুবেরের। চরডাঙা যাওয়ার আর তো কোনো ছুতা তাহার নাই! জামাই অকারণে শ্বশুরবাড়ি গেলে দোষ অবশ্য কিছুই হয় না, কিন্তু এখন কপিলা ওখানে আছে, হঠাৎ কুবেরের আবির্ভাব ঘটিলে কে জানে কে কী ভাবিয়া বসিবে। বসিয়া বসিয়া কুবের উপায় চিত্ত করে আর কুদ্ধ চোখে মালার দিকে থাকিয়া থাকিয়া তাকায়। হ, আজ বসন্তের আদর্শ আবহাওয়া আসিয়াছে কেতুপুপে, দোলের উৎসব হইবে কাল, লখা ও চণ্ডী আবিব কিনিয়া আনিয়া আজই অঙ্গনে খানিক ছড়াইয়াছে।

বিকালে পদ্মার ঘাটে নৌকার তদবির করিতে গিয়া কুবেরের আরও মন-কেমন করিতে থাকে। কাব্যের মসৃণ মার্জিত মন-কেমন করা নয়, তার ভীরু প্রকৃতির সঙ্গে যতখানি খাপ খায় ততখানি দুরন্ত মানসিক অস্থিরতা। পেট ভরিয়া খাইতে পাইয়া শরীরটা কুবেরের ভালো হইয়াছে—খাদ্য যতটুকু শক্তি দিত আগে ব্যয় করিতে হইত তার দশগুণ, এখন সেটা শুধু বন্ধ হয় নাই, বিশ্রামও জুটিয়াছে অনেক। মনেরও যেন তাতে ব্যাকুল হওয়ার ক্ষমতা বাড়িয়াছে এবং কমিয়া গিয়াছে দুর্বল অভিমান, সিদ্ধি বা আপিমের নেশার মতো আগে যা কুবেরের মনকে অনেকটা শান্ত করিয়া রাখিত। নৌকায় বসিয়া কুবের যেন ভুলিয়া যায় যত নিষ্ঠুরতা করিয়াছে কপিলা, যত দুর্বোধ্য নির্মম খেলা সে খেলিযাছে তার সঙ্গে। মনে পড়ে শুধু কপিলাকে, কপিলার লীলা-চাপলা, কপিলার হাসি ও ইঙ্গিত, তেলে ভেজা চুল ও কপাল আর বেগুনি রঙের শাড়িখানি। আর মনে পড়ে শ্যামাদাসের উঠানে ভোরবেলা গোবব লেপায় রত কপিলাকে, মালাকে বলিবার অনুরোধ মেশানো তার শেষ সকাতর কথাগুলি। ক্যান আইছিলা মাঝি, জিজ্ঞাসা করিয়াছিল না কপিলা? হ, ও জিজ্ঞাসার মানে কুবের বোঝে। আবার তাই যাইতে চায় কুবের কপিলার কাছে, এখনই যাইতে চায় শস্যহীন শুকনো মাঠগুলি ঊর্ধ্বশ্বাসে পার হইয়া চরডাঙ্গায়, কপিলা যেখানে চুল বাঁধিতেছে।—কুবেরকে দেখিয়া তার বোতলটি কাত করিয়া আরও খানিকটা তেল মাথায় ঢালিবে কপিলা : তার উত্তোলিত দুটি বাহু, মুখের ছলনাভরা হাসি, বসিবার দুর্বিনীত ভঙ্গি সব পাগল করিয়া দিবে কুবেরকে। ঘাটে আরও নৌকা আছে, মাঝি আছে। এখানে থাকিতে ভালো লাগে না কুবেরের, বাড়ি ফিরিতেও ইচ্ছা হয় না। নদীর ধারে ধারে সে হাঁটিতে আরম্ভ করে, ভাঙিয়া পড়ার জন্য প্রস্তুত তীরের ফাটলধরা অংশগুলির উপর দিয়া। চলিতে চলিতে এক সময় দশ-বারোহাত ডাঙা তাকে সঙ্গে করিয়া ধসিয়া পড়ে নীচে, শীতের পদ্মার জল যেখান হইতে হাত পনেরো পিছাইয়া গিয়াছে। মাটির একটা চাপড়াই বুঝি মাথায় ঘা দিয়া কুবেরকে অজ্ঞান করিয়া দেয়। মিনিট দশেক পরে চেতনা হয় কুবেরের। প্রথমে কুবেরের মনে হয় এ বুঝি কপিলারই এক কৌতুক। তারপর কষ্টে উঠিয়া বসিয়া সে নিঝুম হইয়া থাকে। শেষ বেলার সূর্য যেন পদ্মাকেও নিঝুম করিয়া দিয়াছে, দূরের নৌকাগুলি এবং আরও দূরের স্টিমারটি যেন হইয়া গিয়াছে গতিহারা। বাতাসের জোর নাই, নদীর ছলাৎ ছলাৎ শব্দ যেন ক্লান্ত। নিজের এলোমেলো চিন্তাগুলিকে কুবের ভালো বুঝিতে পারে না। মাথার মধ্যে একটা ভোঁতা বেদনা টিপটিপ করিতেছে। মাথার বা পাশটা দিয়া একটু রক্তও পড়িয়াছে। তাই বলিয়া কেবলই এখন মনে আসিতে থাকিবে কেন গণেশের সেই গান—পিরিত কইরা জ্বইলা মলাম সই, আলো সই? কার সঙ্গে পিরিত করিয়া জ্বলিয়া মরিতেছে কুবের? কপিলার সঙ্গে? হ, ভারী মেয়েমানুষ কপিলা। তার সঙ্গে আবার পিরিত। ছেলেমানুষ নাকি কুবের?

পদ্মায় স্নান করিয়া কুবের বাড়ি ফিরিল। ভাত খাইতে বসিয়া হঠাৎ কুবের বলিল, চরডাঙ্গা যাবি লখা?

যামু বাবা, যামু।

কাইল বিয়ানে মেলা দিমু, আঁই?

হ, এ ফন্দি মন্দ নয়। দোলের উৎসবে মামাবাড়ি যাইবে ছেলেবা। একা তো যাইতে পারিবে না তারা, কুবের তাই সঙ্গে যাইবে। কেহ টেরও পাইবে না কীসে কুবেরকে টানিয়া আনিয়াছে চরডাঙ্গাতে।

মালা বলিল, আগো, নিয়া যাইবা ত আমারেও নিয়া চল।

কুবের বলে, না তরে নিম্ না। যাবি না কইলি ক্যান?

কুবের বাঁচিযাছে। মালাকে লইয়া চরড়াঙ্গা যাওয়া কী সহজ কথা! রাজি না হইয়া ভালোই করিয়াছে মালা, যাতায়াতের ডুলিভাড়াটা কুবেরের বাঁচিয়া গেল।

মালা এখন যাইতে চায। ছেলেদের লইযা কুবের যদি সত্যসত্যই যায় চরডাঙ্গা তবে আব সে যাইবে না কেন? কুবের তার ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা তুলিয়াছিল বলিয়াই না প্রথমটা সে রাজি হয নাই? মালা স্বামীর তোষামোদ আরম্ভ করে। রাত্রে খানিক রাগারগি কাঁদাকাঁটি করিতেও ছাড়ে না। কিন্তু কুবের অটল। যাইবে না বলিল কেন মালা? কুবের যখন তোষামোদ আরম্ভ করিয়াছিল বাহাদুরি করিয়া তখন যাইতে অস্বীকার করিল কেন? মরিয়া গেলেও কুবের তো তাকে চরডাঙ্গায় লইবে না। হুঁ কুবেরের গো মালা জানে না। কী ভাবিয়াছে সে কুবেরকে?

রাত্রি থাকিতে উঠিয়া লখা ও চণ্ডীকে টানিয়া তুলিয়া কুবের রওনা হইয়া গেল। মাথা-কপাল কুটিয়া যাওয়ার জন্য কাঁদিতে লাগিল মালা, কুবের ফিরিয়াও তাকাইল না। সকাল সকাল তাহারা পৌঁছিল চরডাঙ্গায়। হাঁটিতে হাঁটিতে ছেলে দুটার পা ব্যথা হইয়া গিয়াছে। চণ্ডীকে মাঝে মাঝে কোলে করিয়া চলিতে হওযায় কুবেরের ধরিয়া গিয়াছে হাঁপ। শ্বশুরবাড়ির দাওযায় বসিয়া গামছা দিয়া সে ঘাম মুছিতে লাগিল। একটু পরে কপিলা একখানা পাখা আনিয়া দিল। কুবের খুশি হইয়া বলিল, আছস কিবা কপিলা?

কিবা দ্যাখ?

কাহিল য্যান লাগে তরে।

হ, কহিল হইছি।

কুবের ব্যগ্রকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে, ক্যান রে কপিলা, অসুখ নি করছে তর?

মনডার অসুখ মাঝি, তোমার লাইগা ভাইবা ভাইবা কাহিল হইছি।

বলিতে বলিতে আঁচলের আড়াল হইতে হাত বাহির করিয়া এক ভাড় চুন-হলুদ কপিলা কুবেরের গায়ে ঢালিয়া দেয়। হাসিয়া গলিয়া পড়ে কপিলা। কুবের মূঢ়ের মতো চাহিয়া থাকে। আনন্দ অথবা দুঃখ কীসে তাহার রোমাঞ্চ হয় সে বুঝিতে পারে না। কেতুপুরে থাকিবাব সময় এমনিভাবে হাসিত কপিলা। আকুরটাকুরে শ্যামাদাসের বাড়িতে এ হাসির আভাসও কপিলার মুখে সে দেখিতে পায় নাই।

কপিলার হাসির শব্দে বৈকুণ্ঠ বাহিরে আসে। লখা ও চণ্ডীকে সঙ্গে করিয়া কপিলা চলিয়া যায় ভিতরে।

শ্যামাদাসের কাছে বৈকুণ্ঠ ময়নাদ্বীপের কথা শুনিয়াছে। সে সেই কথা আরম্ভ করিল। কথায় কুবেরের মন ছিল না, সে অন্যমনে বৈকুণ্ঠের কথাব জবাব দিয়া গেল।

রং ও কাদা নিয়া গ্রামে দোলের উৎসব চলিয়াছে রঙের চেয়ে কাদার পরিমাণটাই এ পাড়ায় বেশি। চাষাভূষা জেলে-মাঝির পাড়া এটা, এখানে রঙের বড়ো অনটন। অনেক বেলায় কাদামাখা মূর্তিসমূহের একটা শোভাযাত্রা পাড়া হইতে গ্রাম প্রদক্ষিণ করিতে বাহির হইল। গাধার মতো ক্ষুদ্রকায় একটা ঘোড়ার উপরে বিচিত্র সাজে দোলের রাজা অতি কষ্টে বসিয়া আছে, গলায় তাহার ছেঁড়া জুতোর মালা, গায়ে গোটা দশেক ছিন্নভিন্ন জামা, চারিদিকে লড়বড় করিয়া ঝুলিতেছে অনেকগুলি ছেঁড়া ন্যাকড়া। সামনে দিয়া যাওয়ার সময় শোভাযাত্রার লোকেরা কুবের, বৈকুণ্ঠ ও অধরকে কাদা মাখাইয়া দিয়া গেল, অধর ভিড়িয়া গেল দলে। তাথৈ তাথৈ নাচ, ছুটাছুটি, হইচই, ডোবা পুকুরের পাঁক তুলিয়া যাকে খুশি ছুঁড়িয়া মারা—আনন্দ বটে দোলের। খানিক ইতস্তত করিয়া লখা ও চণ্ডী অধরের সঙ্গে যোগ দিবার জন্য ছুটিয়া গেল, কুবেরের বারণ কানেও তুলিল না।

কাদা ধুইয়া স্নান করিয়া আসিবাব উদ্দেশ্যে কুবের গেল পুকুরে। কপিলা বুঝি টের পাইয়াছিল। খানিক পরে সেও পুকুর ঘাটে আসিয়া হাজির।

আমারে রং দিলা না মাঝি?

পাঁক দিমু কপিলা? রং ত নাই!

দূর অ! রং নাই, পাক দিবার চায়! দিয়ো না মাঝি পাঁক, দিয়ে না কইলাম!

পাঁক দিতে বারণ করে কপিলা কিন্তু পা পিছলাইয়া কাদা মাখিয়া জলে সে গড়াইয়া পড়ে। হাতের ঠেলায কলসি ভাসিয়া যায় কুবেবের দিকে। কপিলা বলে, ধরে মাঝি, কলস ধরে।

বলে, আমারে ধর ক্যান? কলস ধরো।

হ, ভীত চোখে চারিদিকে চাহিয়া কলসির মতোই আলগোছে কপিলা ভাসিয়া থাকে, তেমনই ত্রাসের ভঙ্গিতে—স্তন দুটি ভাসে আর ডোবে। চোখের পলকে বুকে কাপড় টানিয়া হাসিবার ভান করিয়া কপিলা বলে, কথা যে কও না মাঝি?

কুবের বলে, তর লাইগা দিবারাত্র পরানডা পোড়ায় কপিলা।

কপিলা চোখ বুজিয়া বলে, ক্যান মাঝি, ক্যান? আমারে ভাব ক্যান? সোয়ামির ঘরে না গেছি আমি? আমারে ভুইলো মাঝি—পুরুষের পরান পোড়ে কয়দিন? গাঙের জলে নাও ভাসাইযা দূর দ্যাশে যাইয়ো মাঝি, ভুইলো আমারে। ছাড়, মানুষ আহে।

সাঁতার দিয়া কপিলা কলসি ধরিয়া আনে। কাপড় ঠিক করিয়া ভরা কলসি কাঁখে তুলিয়া পিছল ঢালু পাড় বাহিয়া উপরে উঠিয়া যায়। হ, ফিরিয়া একবার তাকায় কপিলা। ভরা কলসির জল খানিকটা উছলাইয়া পড়ে।

দুপুরে খাইয়া উঠিয়া কুবের বলে, লখা, চণ্ডী, ল মেলা কবি। দিনে দিনে গাঁয় ফিরুম।

 

মালা বিস্মিত হইয়া বলিল, আইজ ফিবা আইলা যে?

মাইনষে থাকে তর বাপের বাড়ি?

পথ হাঁটিয়া হঁটিযা লখা ও চণ্ডী আধমরা হইয়া গিয়াছিল। কুবেরও কম শ্রান্ত হয় নাই। জিরাইয়া জিরাইয়া গ্রামে পৌঁছিতে তাহদের সন্ধ্যা পার হইয়া গিয়াছিল। লখা ও চণ্ডী দুটি দুটি ভাত খাইয়া শুইয়া পড়িল। কপিলা চরডাঙ্গায় আসিয়াছে তাদের মুখে এ খবর শুনিয়া মালা গম্ভীর হইয়া গেল। কুবেরকে আর সে কিছুই জিজ্ঞাসা করিল না। খোঁড়া পা-টি টান কবিবার চেষ্টাতেই বোধ হয় একবার তাহার মুখখানা হইয়া গেল বিকৃত। কপিলা চলিয়া যাওয়ার পর হইতে নিজের পঙ্গুতা সম্বন্ধে মালা সচেতন হইয়া উঠিয়াছে। কুঁকড়ানো শীর্ণ পা-টিকে সে মাঝে মাঝে সিধা করিবার চেষ্টা করে, দুহাতে মাঝে মাঝে পা-টিকে ঘষিতে থাকে সজোরে। জন্ম হইতে অভ্যস্ত বিকলাঙ্গটি এতকাল পরে মালাকে বিশেষভাবে কাতর করিয়াছে।

বাড়ির দক্ষিণে খানিকটা ফাঁকা জমি ছিল। গোপির বিবাহের আগে ওখানে একখানা ঘর তুলিবার কথা ভাবিতেছিল কুবের। এতকাল সময় ছিল না, হোসেনের চালানি কারবারে এখন একটু মন্দা পড়িয়াছে। বাড়িতে থাকিবার সময় পায় কুবের। চরডাঙ্গা হইতে ফিরিবার পরদিন সে ঘর তুলিবার জন্য বাবুদের অনুমতি আনিতে গেল।

কুবের কি জানিত অনুমতির জন্য মেজোবাবুর কাছেই তাহাকে দরবার করিতে হইবে। নিচু হইয়া প্রণাম করিয়া জোড় হাতে মেজোবাবুর সামনে দাঁড়াইতে হইল কুবেরকে। করুণ কণ্ঠে জানাইতে হইল আবেদন। ঘর তুলিবে কুবের? খুব টাকা হইয়াছে নাকি কুবেরের? মেজোবাবু হাসিয়া কথা বলেন। ফরাসের সামনে মেঝেতে উবু হইয়া বসিবার অনুমতি কুবের পায়, কিন্তু যুক্তকর মুক্ত করিবার নিয়ম নাই। জেলেপাড়ার খবর জিজ্ঞাসা করেন মেজোবাবু; কে কেমন আছে, কার কেমন অবস্থা, কী রকম মাছ পড়িতেছে এ বছর। জেলেপাড়ার ঘরে ঘরে একদিন মেজোবাবুর যাতায়াত ছিল, শিক্ষা ও স্বাস্থানীতির জ্ঞান বিতরণ করিয়া মাঝিদের জীবনগুলি উন্নততর করিবার ঝোকে তিনি আভিজাত্য ভুলিয়াছিলেন। শিক্ষা মাঝিরা পায় নাই, মাঝিদের বউ-ঝিরা শুধু পাইয়াছিল দুর্নাম, গ্রামে গ্রামে খবর বটিয়াছিল যে কেতুপুরেব মেজোকর্তা জেলেপাড়ার ঘরে ঘরে রমণী চাখিয়া বেড়াইতেছেন—জেলেপাড়া মেজোবাবুর প্রণয়িনীর উপনিবেশ। আজ আর জেলেপাড়ার দিকে যাওয়ার সময় মেজোবাবু পান না। মাঝিদের কারও সঙ্গে দেখা হইলে খবর জিজ্ঞাসা করেন। সকালে দুপুরে জেলেপাড়ার ভাঙা কুটিরে গিয়া সময় যাপন করিবার সময়েও যে দুস্তর ব্যবধান মাঝিদের সঙ্গে মেজোবাবুর থাকিয়া গিয়াছিল, কোনো মস্ত্রে তাহা ঘুচিবার নয়। মাঝিরা বিব্রত সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিয়াছিল, ভালো করিবাব খেয়ালে বড়োলোক কবে গরিবের হূদয় জয় করিতে পারিয়াছে? মেজোবাবু তো হোসেন মিয়া নয়। দুর্নীতি, দারিদ্র্য, অন্তহীন সবলতার সঙ্গে নিচু স্তরের চালাকি, অবিশ্বাস ও সন্দেহের সঙ্গে একান্ত নির্ভর, অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে অধর্মকে অনায়াসে সহিয়া চলা—এ সব যাদের জীবনে একাকার হইয়া আছে, পদ্মার বুকে নৌকা ভাসাইয়া যারা ভাবুক কবি, ডাঙায় যারা গরিব ছোটোলোক, মেজোবাবু কেন তাদের পাত্তা পাইবেন? ও কাজ হোসেন মিয়ার মতো মানুষের পক্ষে সম্ভব, মেজোবাবুর চেয়ে বেশি টাকা উপার্জন করিয়াও যার মাঝিত্ব খসিয়া যায় নাই।

মালা? মালার কথাও মেজোবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন। মালার পাযের যে চিকিৎসা চলিতেছিল, কী হইল তার? তারপর ফাঁকা জমিটুকুতে ঘর তুলিবার অনুমতি দিয়া কুবেরকে মেজোবাবু বিদায় দিলেন।

মালা আজও মুখ ভাব করিয়া ছিল। কিন্তু কৌতুহল দমন করা যায় না।

কী কইল মাইজা কত্তা?

কী কইব? তব কথা জিগাইল।

হ?

নায় তুইলা আবার তরে হাসপাতাল নিয়া যাইব কইল গোপির মা।

গোঁয়ার কি সহজ কুবের! গো ধরিলে আর তো সে তাহা ছাড়িবে না! মেজোবাবুব নৌকায় মালা যে আমিনবাড়ি গিয়াছিল, কতকাল সে এ কথা মনের মধ্যে পুষিয়া রাখিবে সেই জানে, হয়তো মালা যখন বুড়ি হইয়া যাইবে, বিকল পা-টির মতো সর্বাঙ্গ শীর্ণ হইয়া আসিবে তাহার, তখনও এ কথা ভুলিবে না কুবের। কলহ করিয়া মালা কাঁদে। মৃত্যু কামনা করে নিজের। কিন্তু এ বিষযে কুবের কঠোর, নির্মম। অন্য বিষয়ে মালার সঙ্গে তাহার ব্যবহার বদলায় না, পঙ্গু অসহায় স্ত্রীর জীবন তারই বক্ষের আশ্রয়ে আজও উথলিয়া ওঠে, কিন্তু আমিনবাড়ি যাওয়ার জন্য অম্লান বদনে মালাকে সে পীড়ন করে। আজ রাত্রেই হয়তো কুবের মালাকে বুকে জড়াইয়া মিঠা মিঠা কথা বলিবে, পদ্মার ঠাণ্ডা বাতাসে জুড়াইয়া জুড়াইয়া কী যে মধুর হইয়া উঠিবে কুবেরের ব্যবহার! কাল হয়তো আবার সে কাঁদাইবে মালাকে মেজোবাবুর কথা তুলিয়া। এমনই প্রকৃতি পদ্মানদীর মাঝির, ভদ্রলোকের মতো একটানা সংকীর্ণতা নয়, বিরাট বিস্তারিত সংমিশ্রণ।

ঘর তোলা শেষ হইতে দিন দশেক সময় লাগিল। তারপর একদিন বঙ্কুব সঙ্গে বিবাহ হইয়া গেল গোপির।

কপিলা আসিল বিবাহে। সে না আসিলে বিবাহের কাজ করিবে কে? মালা তো পঙ্গু। কুবের খুশি হইয়া বলিতে লাগিল, আইছস কপিলা, আইছস? কুবের যেন ভুলিয়া গিযাছে চরডাঙ্গার পুকুরের জলে কী কথা তাহার হইয়াছিল কপিলার সঙ্গে। কিন্তু কপিলা সব মনে পড়াইয়া দেয়। সরিয়া সরিয়া পালাইয়া বেড়ায় কপিলা, টেঁকিঘরের ভিতরে দাঁড়াইয়া কুবের ইশারা করিয়া কাছে ডাকিলে মুখ ঘুরাইয়া থাকে। এ তো ছলনা নয়, খেলা নয় কপিলার। কী যেন ভাবিয়া আসিয়াছে কপিলা এবার, বড়ো সে গম্ভীর। একটু হাসি, দুটি কথাব কাঙাল কুবের, কপিলার হাসি কই, কথা কই কপিলার মুখে?

হলুদ মাখিতে মাখিতে হলদে হইয়া বিবাহ হইয়া গেল গোপির। বর-কনেকে কুবের পদ্মার নৌকায় তুলিয়া দিল। গোপি আবার ফিরিয়া আসিবে। হোসেন মিয়ার তাড়াতাড়ি নাই। বঙ্কু ও গোপি দুমাস দেশে থাক, তাতে সে আপত্তি করিবে না।

বিবাহের পরই কপিলার ফিরিয়া যাওয়ার কথা ছিল, কী ভাবিয়া সে রহিয়া গেল। কদিন পরে শ্যামাদাস আসিয়া তাকে আকুরটাকুর লইয়া যাইবে। দিন দুই পরে কুবেরকে হোসেন মিয়ার একটা চালান আনিতে যাইতে হইল। মাইল দশেক উজানে একটা গ্রামের ঘাটে নৌকা বাঁধিয়া সে পাট বোঝাই করিল নৌকায়। তারপর দেবীগঞ্জ ফিরিয়া আসিল অনেক রাত্রে।

সকলে শ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছিল। অত রাত্রে কেতুপুরে ফিরিতে রাজি হইল না। কুবেরের মন পড়িয়াছিল বাড়িতে। নদীর ধারে ধারে সে হাঁটিতে আরম্ভ করিল গ্রামের দিকে। নদীতে জেলে নৌকার আলোগুলি ইতস্তত সঞ্চালিত হইতেছে, মাছ ধরিবাব কামাই নাই পদ্মায়। চলিতে চলিতে কত কী ভাবে কুবের। কারও ঘুম না ভাঙাইয়া কপিলাকে কি তোলা যাইবে না? আর কিছু চায় না কুবের কপিলার কাছে, গোপনে শুধু দুটা সুখ-দুঃখের কথা বলিবে। একটু রহস্য করিবে কপিলার সঙ্গে। বাঁশের কঞ্চির মতো অবাধ্য ভঙ্গিতে সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া কপিলা টিটকারি দিবে তাকে, ধরিয়া নোয়াইযা দিতে গেলে বসিয়া পড়িবে কাঁদায়, চাপা হাসিতে নির্জন নদীতীরে তুলিয়া দিবে রোমাঞ্চ।

আর কিছুই কুবের চায় না।

কেতুপুরের ঘাটে পৌঁছাইয়া কুবেরের বুকের মধ্যে হঠাৎ কাঁপুনি ধরিয়া গেল, গলা শুকাইয়া গেল কুবেরের। স্পষ্ট সে দেখিতে পাইল সাদা কাপড় পরিয়া এতরাত্রে একটি রমণী ঘাটে দাঁড়াইয়া আছে। কোনো দিকে মানুষের সাড়া নাই, পদ্মার জল শুধু ছলাৎ ছলাৎ করিয়া আছড়াইযা ভাঙা তীরকে ভাঙিবার চেষ্টা করিতেছে, নদীর জোরবাতাসে সাদা কাপড় উড়িতেছে একাকিনী রমণীর।

ভীত কর্কশ কণ্ঠে কুবের বলিল, কেডা খাড়াইয়া আছ গো, কেডা?

নদীর দিকে মুখ করিয়া রমণী দাঁড়াইয়া ছিল, কুবেরের গলার আওয়াজে চমকাইয়া অস্ফুট শব্দ করিয়া উঠিল। তারপর ব্যগ্ৰকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, কেডা? মাঝি আইলা?

কুবের অবাক হইয়া বলিল, কপিলা? দুপুর রাইতে ঘাটে কী করস কপিলা?

কপিলা কাছে আসিল, বলিল, ডরাইছিলাম মাঝি!

তারপর আরও কাছে আসিল কপিলা, কুবেরের বক্ষের আশ্রয়ে সে কাঁদিতে লাগিল। কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, বড়ো বিপদ হইয়াছে আজ। আজ বিকালে হঠাৎ পুলিশ আসিয়া বাড়ি তল্লাশ করিয়াছে কুবেরের, টেঁকিঘরের পাটখড়ির বোঝার তলে পীতম মাঝির চুরি যাওয়া ঘটিটা পাওয়া গিয়াছে। বাড়ি ফিরিলেই চৌকিদার ধরিবে কুবেরকে। সন্ধ্যার পর চুপিচুপি কপিলা তাই ঘাটে আসিয়া বসিয়া আছে। কুবের ফিরিলে সতর্ক করিয়া দিবে।

কুবেরের মুখে কথা সরিল না।

অনেকক্ষণ পরে সে বলিল, রাসুর কাম। সব্বোনাশ করব কইছিল না রাসু—-রাসুর কাম।

কী করবা মাঝি? কে জানে কী করিবে! বিপদে-আপদে মুখ চাহিবার একজন আছে কুবেরের, তার কাছে গিয়া দাঁড়াইবে। ঘাটে হোসেনের নৌকা বাধা আছে দেখিয়া কুবের একটু আশ্বস্ত হইল।

কপিলার চোখ মুছাইয়া দিল কুবের, বলিল, বাড়িত্ যা কপিলা।

তুমি কী করব?

হোসেন মিয়ারে বিত্তান্ত কই গিয়া, দেখি স্যায় কী কয়।

আমি লগে যামু মাঝি।

হ, বাঁশের কঞ্চির মতো অবাধ্য কপিলা। কোনোমতেই কুবের তাহাকে বাড়ি পাঠাইতে পারিল না। কুবেবের সঙ্গে সে হোসেন মিয়ার বাড়ি গেল। হোসেনকে কিছু বলিতে হইল না, খবর সে আগেই শুনিয়াছে। লালচে দাড়ি মুঠা করিয়া ধরিয়া সে ভাবিতে ভাবিতে বলিল, ময়নাদ্বীপি যাবা কুবির? চুরি আমি সামাল দিমু।

আমি চুরি কবি নাই মিয়া!

তা কি হোসেন মিয়া জানে না? কিন্তু চোরাই মাল যখন বাহির হইয়াছে কুবেরের ঘরে, চোরকে সেখানে মাল বাখিয়া আসিতে কেহ যখন দেখে নাই, কে বিশ্বাস করিবে কুবেবের কথা? বাহিরের কেহ শত্ৰুতা করিয়া রাখিয়া যাইতে পারে এমন কোনো স্থানে মাল বাহির হয় নাই, একেবারে ঘরের মধ্যে লুকানো অবস্থায মাল পাওযা গিয়াছে। তা ছাড়া গরিব নয় কুবের?

বিবর্ণ মুখে কুবের মাথা হেঁট করিয়া থাকে। ঘোমটার ভিতর হইতে সজল চোখে কপিলা তার দিকে তাকায়। একজন মুনিষ তামাক সাজিয়া দিয়া যায় হোসেনকে। তামাক টানিতে টানিতে হোসেন জিজ্ঞাসা করে, যারা ময়নাদ্বীপি?

ঘাড় নাডিয়া কুবের সায় দেয়।

চোখ বুজিযা হোসেন ব্যবস্থার কথা বলিয়া চলে। আজ এই রাত্রেই রওনা হইয়া যাক কুবের। স্ত্রী-পুত্রের জন্য ভাবনা নাই কুবেরের, হোসেন রহিল। পরে গোপি আর বঙ্কুর সঙ্গে ওদের সকলকে হোসেন ময়নাদ্বীপে পৌঁছাইয়া দিবে। কেন, কাঁদে কেন কুবের? ময়নাদ্বীপ তো নিজেব চোখে সে দেখিয়া আসিয়াছে, সেখানে গিয়া বাস করিতে হইবে বলিয়া কান্নার কী আছে?

তামাক শেয করিয়া হোসেন উঠিল। বাহিরের একটা ঘরে সাতজন মুসলমান মাঝি ঘুমাইয়া ছিল, তাদের মধ্যে পাঁচজনকে সঙ্গে করিয়া সকলে নদীর ঘাটের দিকে চলিল। কুবের ও কপিলা চলিতে লাগিল সকলের পিছনে।

কপিলা চুপিচুপি বলে, না গেলা মাঝি, জেল খাট। কুবের বলে, হোসেন মিয়া দ্বীপি আমাকে নিবই কপিলা। একবার জেল খাইটা পার পামু না। ফিরা আবার জেল খাটাইব।

কপিলা আর কথা বলে না। ঘাটের খানিক তফাতে হোসেনের প্রকাণ্ড নৌকাটি নোঙর করা ছিল। একজন মাঝি ঘুমাইয়া ছিল নৌকায়। তাকে ডাকিয়া তুলিলে সে নৌকা তীরে ভিড়াইল। কুবের নীরবে নৌকায় উঠিয়া গেল। সঙ্গে গেল কপিলা।

ছইয়ের মধ্যে গিয়া সে বসিল। কুবেরকে ডাকিয়া বলিল, আমারে নিবা মাঝি লগে? হ, কপিলা চলুক সঙ্গে। এক অতদূরে কুবের পাড়ি দিতে পারবে না।