কুবের পুরীর রহস্য Kuber purir Rohoshyo by হেমেন্দ্রকুমার রায় Hemendra Kumar Roy, chapter name যবনিকা পতনের আগে

যবনিকা পতনের আগে

মেঘলোকবাসী পবিত্র কৈলাস-শিখর এবং হিমাচলবাসী আরক্ত প্রভাতসূর্য নীলপদ্মনীল রাবণ হ্রদকে দেখে আসছে না জানি কত হাজার হাজার শতাব্দী ধরে; এই নির্জন তটভূমিতে গীতকারী পাখির তান বা হরিৎ অরণ্যের গান পর্যন্ত জাগে না, মাঝে মাঝে এখানকার ধ্যানমৌন বিজনতা ভঙ্গ করে শ্রান্তদেহে পথ পেরিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যায় কেবল মানস সরোবর ও কৈলাসের যাত্রীরা! কিন্তু এখানে আজ অকস্মাৎ যে মৃত্যু-দৃশ্যের অভিনয় চলছে, সৈন্যদল চলাচল করছে, আগ্নেয়াস্ত্র গর্জন করছে, মহাদেব ও সূর্যদেব তা দেখে কি বিস্মিত হচ্ছেন না?

এখনও বুঝতে পারছি না এই সাংঘাতিক নাটকের সমাপ্তি কোথায়? একটা ঘটনা শেষ হতে না হতেই নূতন ঘটনার আবির্ভাব হচ্ছে, একটা বিপদের পিছনে ছুটে আসছে আর-একটা বিপদ, যেন বায়োস্কোপের এক অনন্ত সিরিয়াল’ ছবি! কিন্তু ভৈরবের মতন পিচ্ছল দুরাত্মা আমি কোনও চলচ্চিত্রেও দেখিনি! আজ ভাবলুম সব লুকোচুরি শেষ হল--কিন্তু আবার সে পালিয়ে গেল আমাদের হাত পিছলে!

পাহাড়ের অপথ-বিপথ দিয়ে একটা সিন্দুক ঘাড়ে করে মানুষ যে এত তাড়াতাড়ি উপরে উঠতে পারে, আজ স্বচক্ষে ভৈরবের পলায়ন না দেখলে কখনও আমি বিশ্বাস করতুম না! প্রতি মুহূর্তেই মনে হয়, এই বুঝি সে পা হড়কে আছাড় খেয়ে গড়াতে গড়াতে নীচে এসে পড়ে, কিন্তু তার পরেই দেখি, সে নিজেকে আশ্চর্য ভাবে সামলে নিয়ে এক পাথর থেকে আর এক পাথরে লাফ মারছে! মানুষ এমন মরিয়াও হতে পারে!

বাঘা যদি সমতল ক্ষেত্রে থাকত, তাহলে ভৈরবকে খুব সহজেই ধরে ফেলতে পারত। কিন্তু এই দুরারোহ পাহাড়ের উপরে উঠে ভৈরবকে ধরা তার পক্ষেও কঠিন হয়ে উঠল। শেষ পর্যন্ত সে হয়তো ভৈরবকে ধরতেই পারবে না!

আমরাও প্রাণপণে পাহাড়ে উঠছি। উঠতে উঠতে আমি বললুম, বিমল, ভৈরবকে ধরবার বেঁকে নিজেদের বিপদের কথা যেন ভুলে যেয়ো না! পিছনে তিব্বতি সেপাইরা আছে, তারা আর মিনিট ছয়-সাতের মধ্যেই পাহাড়ের তলায় এসে পড়বে!

বিমল প্রায় ডিগবাজি খেয়ে নীচে থেকে উপরের একখানা পাথরে উঠে বললে, আমি তাদের কথা ভুলে যাইনি। কিন্তু তারা বোধহয় অনেকক্ষণের জন্যেই আমাদের কথা ভুলে যাবে!

কুমার হামাগুড়ি দিয়ে একটা ঢালু জায়গা পার হয়ে বললে, কেন?

গুপ্তধন যে কারা চুরি করেছে সেটা তারা স্বচক্ষেই দেখেছে। আর এটাও তাদের চোখ এড়ায়নি যে, চোরেরা সিন্দুক জড়িয়ে দের চোরাবালির তলায় আশ্রয় নিয়েছে। তখন তারা অত চ্যাঁচাচ্ছিল কেন জানো? হ্রদ যে বিপজ্জনক, নিশ্চয়ই সে-সম্বন্ধে চোরদের সাবধান করবার জন্যে! চোরদের প্রাণের চেয়ে তাদের কাছে ঢের বেশি মূল্যবান হচ্ছে ওই সিন্দুকগুলো! আমার বিশ্বাস এখন তারা চোরাবালির ভিতর থেকে রত্নেদ্ধার করতেই ব্যস্ত থাকবে। সে বড়ো অল্প

সময়ের কাজ নয়—ততক্ষণে আমরা অনেক দূরে সরে পড়তে পারব!

আমি বললুম, কিন্তু একটা চোর যে সিন্দুক নিয়ে পাহাড়ের উপরে উঠেছে!

গোলমালে আমরাই যা প্রথমে দেখতে পাইনি, অতদূর থেকে তিব্বতিরা কি সেটা লক্ষ করতে পেরেছে?

এখন ভৈরব বা বাঘা কারুকেই দেখা যাচ্ছে না, কেবল পাহাড়ের আড়াল থেকে শোনা যাচ্ছে বাঘার চিৎকার! সেই চিৎকার শুনেই বুঝতে পারছি কোন দিকে যেতে হবে!

কুমার কুদ্ধ স্বরে হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, রাস্কেল ভৈরব! আমার যে দম ছুটে গেল! এখনও সে কতদূরে আছে?

বিমল বললে, বোধহয় আর বেশি দূরে নেই! খুব কাছেই বাঘার চিৎকার শোনা যাচ্ছে!

লোকটার গায়ে শক্তি তো কম নয়! অত বড়ো একটা বোঝা নিয়ে এখনও এই পথ দিয়ে উঠতে পারছে।

বিমল গম্ভীর স্বরে বললে, হুঁ। বলবান বটে!

এমন সময়ে একটা উঁচু পাথরের উপরে লাফিয়ে উঠেই দেখি, সামনেই খানিকটা সমতল জায়গা এবং তার উপর দিয়ে প্রথমে ভৈরব ও তার পিছনে বাঘা বেগে দৌড়াদৌড়ি করছে।

আমি মহা আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলুম, বিমল! কুমার! এই যে ভৈরব! তারাও এক এক লাফে আমার পাশে এসে দাঁড়াল।

ভৈরব বাঘাকে এড়াবার জন্যে শেষে সিন্দুকটা ছুড়ে ফেলে দিয়েই ছুটতে শুরু করলে কিন্তু বাঘা এখন সমতল জমি পেয়েছে, তার সঙ্গে ভৈরব পারবে কেন?

বাঘাকে তখন দেখলে সত্যই ভয় হয়। তার বাঘের মতন ছোপ-ধরা প্রকাণ্ড দেহ ক্রোধে ফুলে যেন আরও বড়ো হয়ে উঠেছে, রাঙা-টকটকে জিভখানা বাইরে বেরিয়ে পড়েছে, পথশ্রমে মুখের দুপাশ দিয়ে ফেনা ঝরছে, বড়ো বড়ো ধারালো দাঁতগুলো শিকার ধরবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে আছে এবং তীক্ষ্ণ দুটো চক্ষুতে ফুটেছে ক্ষুধিত হিংসার বিদ্যুৎ! সে একবার মস্ত লাফ মেরে ভৈরবের বুক পর্যন্ত উঠে তার গলা কামড়ে ধরবার চেষ্টা করলে কিন্তু পারলে না, ভৈরব তাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে অন্যদিকে ছুটে গেল।

কুমার উৎসাহে চেঁচিয়ে বলে উঠল, বাহবা বাঘা! বাহাদুর বাঘা! ধর ওর টুটি কামড়ে! ভৈরব ছুটতে ছুটতে বিষম চেঁচিয়ে বললে, রক্ষা করো! আমি ধরা দিচ্ছি! কুমার বললে, বাঘা, থাম! বাঘা অমনি দাঁড়িয়ে পড়ল। যেন নিশ্চল মূর্তি! আশ্চর্য শিক্ষিত কুকুর!

আমরা সকলে যখন ভৈরবের চারপাশে গিয়ে দাঁড়ালুম, সে তখন দুই হাতে ভর রেখে মাটিতে বসে পড়ে হেটমুখে ভয়ানক হাঁপাচ্ছে।

খানিকক্ষণ নীরবে তার দিকে তাকিয়ে রইলুম—এমন ভয়ানক মানুষ দ্রষ্টব্য জীবই বটে! আমাদেরই মতন দেখতে তার দেহ, কিন্তু তার মন যে কোনও পশুর চেয়েও হীন! এক-একজন মানুষকে সৃষ্টিকর্তা এমন করে গড়েন কেন?

বিমল তার সামনে বসে পড়ে বললে, তারপর ভৈরব! এখন কী করা যেতে পারে তোমাকে নিয়ে?

ভৈরব তার তীক্ষ্ণ চক্ষু দুটো তুলে হেসে বললে, আমাকে নিয়ে? কী করতে চাও তুমি?

বিমল বললে, আমি কী করতে চাই? আচ্ছা, আগে তোমার কীর্তিকলাপের ফদটা একটু নাড়াচাড়া করে দেখি। প্রথমত, তুমি দিলীপের বাবাকে হত্যা করেছ। দ্বিতীয়ত, তুমি কিষণ সিংকে হত্যা করেছ। তৃতীয়ত, তুমি আমাদের যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করবার চেষ্টা করেছ। বার বার গুপ্তধনের ম্যাপ চুরি, আমাদের পিছনে তিব্বতিদের লেলিয়ে দেওয়া, তোমার এ-সব কীর্তির কথা না হয় ছেড়েই দিলুম। এখন তুমিই বলো দেখি, আমাদের কাছ থেকে কতটুকু দয়া তোমার প্রত্যাশা করা উচিত?

ঘৃণায় ওষ্ঠাধর বেঁকিয়ে ভৈরব আঁঝালো গলায় বললে, দয়া? দয়া আমি কারুর কাছেই প্রত্যাশা করিনি। আমি আমার কর্তব্যপালন করেছি। দিলীপের ঠাকুরদা আমার বাবাকে খুন করেছিল। আমি তারই প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করেছি মাত্র।

আমি বললুম, মিথ্যা কথা!

মিথ্যা কথা? জানো তুমি দিলীপ, গুপ্তধনের গুহায় গিয়ে আমি আমার বাবার কঙ্কাল আবিষ্কার করেছি? সেই কঙ্কালের পাশে এখনও একখানা ছোরা পড়ে আছে! তিব্বতিদের ভয়ে তোমার ঠাকুরদা আমার বাবাকে মেরেও গুপ্তধন আনতে পারেনি। এ-সব কথা আমি আমার মায়ের মুখে শুনেছি।

বিমল বললে, তোমার বাবা হয়তো তোমার মতোই সাধু ছিলেন। হয়তো তাকে মেরে দিলীপের ঠাকুরদা কোনও অন্যায়ই করেননি—যেমন আজ তোমাকে বধ করলে আমাদেরও কোনও অন্যায় হবে না।

ভৈরব অল্পক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বললে, তোমাদের সঙ্গে আমি আর কথাকাটাকাটি করতে চাই না। তোমরা জিতেছ, আমি হেরেছি। যদিও আসলে জয়ী হয়েছি আমিই। কারণ গুপ্তধনের গুহায় তোমরা ঢুকতে পারেনি, কিন্তু পথ থেকে সমস্ত বাধা সরিয়ে আমিই সেই বিশাল গুহা আবিষ্কার করেছি, তার ভিতরে ঢুকেছি, সেখানকার কুবেরের ঐশ্বর্য স্বচক্ষে দেখেছি। যে অফুরন্ত ধনরত্ন সেখানে থরে থরে সাজানো আছে, তোমরা কেউ তা কল্পনাও করতে পারবে না। আমরা নিয়ে আসতে পেরেছি তার কয়েকটি কণা মাত্র! আমার দলের লোকরা যদি নিরেট বোকার মতো আচ্ছন্ন আর অবাক হয়ে, আমার নিষেধ অমান্য করে গুহার ভিতরে অতক্ষণ বসে না থাকত, বিহ্বল হয়ে গোলমাল না করত, যথাসময়ে চুপি চুপি বেরিয়ে আসতে পারত, তাহলে তিব্বতি বানরগুলো কিছুই টের পেত না, তোমরাও আমাদের ধরতে পারতে না, আর আমার সঙ্গীদেরও পাতাল প্রবেশ করতে হত না। এই সিন্দুকগুলো পাহাড়ের অন্য কোনও গুহায় লুকিয়ে রেখে, আমরা আবার সেখানে যেতুম, আবার আরও ধনরত্ন নিয়ে আসতুম! কিন্তু সেখানে যাবার পথ এখন একেবারে বন্ধ, তিব্বতিরা সাবধান হয়ে গেছে, তোমরাও তাদের চোখে আর ধুলো দিতে পারবে না। এখন এই ভেবেই আমার আনন্দ হচ্ছে যে, নিয়তির চক্রান্তে সফল হয়েও আমি বিফল হয়েছি বটে, কিন্তু সেইসঙ্গে তোমাদেরও সব আশা নির্মূল হয়েছে!'—এই বলে সে পাগলের মতো অট্টহাস্য করে উঠল।

বিমল গম্ভীর ভাবে বললে, ভৈরব, তোমার বক্তৃতা এতক্ষণ ধরে শুনলুম। এখন আবার জিজ্ঞাসা করি, অতঃপর তোমাকে নিয়ে কী করা যেতে পারে?

ভৈরব সগর্বে বললে, তোমরা আমাকে নিয়ে যা-খুশি করতে পারো, আমার কিছুতেই আপত্তি নেই। তোমরা চারজন, আমি একলা। তোমাদের অস্ত্র আছে, আমি নিরস্ত্র-গুহা থেকে তাড়াতাড়ি পালাবার সময়ে আমার বন্দুকটা পর্যন্ত ফেলে এসেছি। কাজেই তোমাদের বাধা দেবার কোনও শক্তিই আমার নেই।

বিমল মৃদু হেসে হাতের বন্দুকটা আমাদের দিকে নিক্ষেপ করলে। কোমরবন্ধ থেকে রিভলভারটাও বার করে রামহরির হাতে দিলে। তারপর ধীর স্বরে বললে, আমিও এখন তোমার মতোই নিরস্ত্র।

আর তোমার দলের লোকরা?

আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমার দলের কেউ তোমার গায়ে হাত দেবে না।

ভৈরব বিস্মিত কণ্ঠে বললে, তোমার উদ্দেশ্য কী?

বিমল শান্ত স্বরে বললে, আমি আগে ন্যায়যুদ্ধে একলা তোমার দর্পচূর্ণ করতে চাই। তারপর ভেবে দেখব, কোন শাস্তি তোমার উপযুক্ত।

তুমি আমার সঙ্গে হাতাহাতি লড়বে?

হ্যাঁ।

যদি আমি জিতি?

তাহলে তুমি স্বাধীন। ওই সিন্দুকটা নিয়ে তুমি যেখানে খুশি চলে যেতে পারো! মহা আনন্দে ভৈরবের দুই চক্ষু জুলজুল করতে লাগল! সে উঠে দাঁড়িয়ে উৎফুল্ল স্বরে বললে, ‘তাহলে ধরে নাও, আমি এখনই স্বাধীন হয়েছি। আমার এই হাত দুখানা দেখছ তো?

 

এই দুখানা হাত অনেক বড়ো বড়ো পালোয়ানকেও মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। খালি হাতে তোমরা চারজনও আমার বিরুদ্ধে দাঁড়ালে আমি হাসতে হাসতে লড়তে রাজি আছি!

বিমল হেসে বললে, তোমাকে আর অতটা বাহাদুরি দেখাতে হবে না। তুমি কেবল আমার সঙ্গেই লড়ো!

ভৈরব যখন তার বিপুল দেহ আরও ফুলিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল, তখন বিমলের জন্যে আমারও ভয় লাগল! বিমলের চেয়ে তার চেহারা কেবল বড়োই নয়, জোয়ানও বটে!

রামহরি উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললে, খোকাবাবু, ও-পাপিষ্ঠের সঙ্গে তোমার আর লড়ে কাজ নেই! বিমল ক্রুদ্ধ স্বরে বললে, তুমি থামো রামহরি!

কুমারের দিকে তাকালুম, সে কিন্তু দিব্য নিশ্চিন্তের মতো দুই পা ছড়িয়ে বসে বাঘার গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে--তার মুখে মৃদু মৃদু হাসি! যেন যুদ্ধের ফল কী হবে সেটা সে এখন থেকেই জানে!

বিমল প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে বললে, ভৈরব, তুমি কী লড়বে? কুস্তি, ঘুসি, না যুযুৎসু?

কুস্তি!

কুমার বললে, কিন্তু সাবধান ভৈরব! অন্যায় যুদ্ধ করলে আমাদের কাছ থেকে তুমি একতিল দয়াও পাবে না!

ভৈরব নির্দয় হাস্য করে বললে, একটা তুচ্ছ লোককে হারাবার জন্যে অনায় যুদ্ধের দরকার হবে না! তোমার বন্ধুকে আমি ধরব, আর আছাড় মারব! হুঁশিয়ার!

বুননা মোষের মতো সে তেড়ে এসে বিমলকে চেপে ধরবার চেষ্টা করলে, কিন্তু বিমল সাঁৎ করে তার নাগালের বাইরে গিয়ে দাঁড়াল! ভৈরব আবার সেই চেষ্টা করলে, কিন্তু সেবারেও কোনও সুবিধা করতে পারলে না!

আমি বিমলের শক্তির কথা ঠিক জানি না, কিন্তু গোড়াতেই এটা বুঝতে পারলুম যে, ভৈরবের চেয়ে তার গতি বেশি ক্ষিপ্র।

ভৈরব আবার আক্রমণ করলে, কিন্তু এবারে বিমল আর সরে গেল না, দুজনেই দুজনের কঠিন আলিঙ্গনে আবদ্ধ হল এবং দুজনেই দুজনকে মাটিতে পেড়ে ফেলবার জন্যে প্রাণপণ শক্তি প্রয়োগ করতে লাগল!

উত্তেজনায় আমার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে এল—এইবারেই আসল পরীক্ষা!

বিমলের মুখ দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু ভৈরবের মুখ দেখলুম রাঙা-টকটকে হয়ে উঠেছে। নিশ্চয়ই দেহের সমস্ত শক্তি সে ব্যবহার করছে!

কিন্তু বিমল ভূমিসাৎ হল না, হঠাৎ নিজেকে মুক্ত করে নিলে। বুঝলুম, ভৈরবের চেয়ে সে বেশি-কৌশলী!

আবার দুজনে খানিকক্ষণ জড়াজড়ি হল, আবার ভৈরবের পেশিস্ফীত বাহু ছাড়িয়ে বিমল সরে এল।

ভৈরব হাঁপাতে শুরু করলে, কিন্তু বিমলের শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক। বুঝলুম, বিমলের দম বেশি! আমার মনে আশার উদয় হল।

ভৈরব এতক্ষণ লড়ছিল হাসতে হাসতে। কিন্তু তার মুখ এখন গম্ভীর। সে বুঝে নিয়েছে, কেবল গায়ের জোরে বিমলকে সহজে কাবু করা যাবে না, এবং তাকে তাড়াতাড়ি কাবু করতে না পারলে শেষটা হয়তো দমের জোরেই বিমল তাকে কাবু করে ফেলবে।

এতক্ষণ বিমল শুধু আত্মরক্ষাই করছিল, এইবারে হঠাৎ বেগে আক্রমণ করলে, বোধ হয় সে ভৈরবের শক্তির মাত্রা বুঝে নিয়েছে!

ভৈরব তার আক্রমণ ঠেকাতে চেষ্টা করলে, কিন্তু পারলে না--বিমল তাকে মাটি থেকে দুই হাত উঁচুতে তুলে হাত-চারেক দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলে।

তার শক্তি সম্বন্ধেও আমার আর কোনও সন্দেহ রইল না, সানন্দে আমি কুমারের দিকে একবার মুখ ফিরিয়ে দেখি, সে তখনও সেই ভাবে বসেই বাঘার গায়ে সাদরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এতক্ষণে তার নিশ্চিন্ততার কারণ বুঝলুম! বিমলের ক্ষমতা সে জানে!

ভৈরবের মুখের ভাব তখন ভয়ানক! মাটির উপরে তাড়াতাড়ি উঠে বসে সে রাগে অজ্ঞানের মতো বেগে ছুটে এল, কিন্তু এবারে বিমল আর তাকে এড়াবার চেষ্টা করলে না, সে কাছে আসতেই কী-এক কৌশলে তার দেহকে চোখের নিমেষে আবার শূন্যে তুলে ভূতলে নিক্ষেপ করলে।

ভৈরব বেজায় হাঁপাতে হাঁপাতে আবার উঠে দাঁড়াল, তার গায়ের জোরের গর্ব আর রইল না!

কুমার অবহেলা ভরে বললে, বিমল, ওকে চিত করে এবারে এই বেলে-খেলা সাঙ্গ করে দাও!

‘হ্যাঁ, তাই দিচ্ছি’ বলেই বিমল আবার বেগে অগ্রসর হল, কিন্তু হঠাৎ একখানা বড়ো পাথরে হোঁচট খেয়ে ভূমিতলে পড়ে গেল!

চোখের পলক না পড়তেই ভৈরব প্রকাণ্ড একখানা প্রস্তর তুলে নিয়ে বিমলের মাথার উপরে নিক্ষেপ করতে উদ্যত হল—

এবং সেই মুহূর্তেই অতি-সতর্ক রামহরির হাতের রিভলভার গর্জন করে উঠল। ...বিমল যখন উঠে দাঁড়াল, দুরাত্মা ভৈরবের দেহ তখন মাটির উপরে স্থির হয়ে পড়ে আছে!

বিমল এগিয়ে গিয়ে তার দেহটাকে নেড়েচেড়ে বললে, পৃথিবীকে আর এর ভার সইতে হবে না। গুলি মস্তিষ্ক ভেদ করেছে।

বিমল সিন্দুকের ডালা খুলে ফেললে।

তার ভিতরে তাকিয়ে আমাদের চক্ষু স্থির হয়ে গেল! হিরে, চুনি, পান্নার ছড়াছড়ি! পায়রার ডিমের মতো বড়ো বড়ো মুক্তো! এ কী অসম্ভব দৃশ্য! আমার মাথা ঘুরতে লাগল!

বিমল সহাস্যে বললে, দিলীপ, এখানে যা আছে তাই দিয়েই তুমি একটা রাজ্য কিনতে পারো। এ সব এখন তোমার!

আমি বললুম, না, না, এ ধনরত্ন আমরা সবাই সমান ভাগ করে নেব!

কুমার মাথা নেড়ে কঠোর কণ্ঠে বললে, আমরা এখানে এসেছি তোমাকে সাহায্য করতে, তোমার দান গ্রহণ করতে নয়!

বিমল বললে, আমারও ওই মত। কিন্তু আপাতত রত্নগুলো ওর ভিতর থেকে বার করে নিয়ে প্রত্যেকে নিজের সঙ্গে কিছু কিছু লুকিয়ে রাখো। ও সিন্দুক ঘাড়ে নিয়ে যেতে গেলে আমরা নিশ্চয়ই ধরা পড়ব।

তাড়াতাড়ি সিন্দুক খালি করে ফেলে আমরা দ্রুতপদে সেখান থেকে চলে এলুম।

রত্নশূন্য সিন্দুক ও জীবনশূন্য ভৈরবের দেহের দিকে কৈলাসের রক্তমুখ দীপ্ত সূর্য তাকিয়ে রইল নিষ্পলকনেত্রে।