ভৈরবের পুনঃপ্রবেশ
আমরা যখন গুরলার উপরে উঠে ওপাশের উতরাই দিয়ে নীচের দিকে নামছি, তখন চাঁদের আলো ধীরে ধীরে ঊষার আলোর সঙ্গে মিশিয়ে যাচ্ছে! কোনও অদৃশ্য চিত্রকর যেন দুরকম আলো-রং একসঙ্গে মিলিয়ে নতুন কোনও অপূর্ব ছবি আঁকবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছেন।
কুয়াশার ভিতর থেকে যেন রূপকাহিনীর মায়াজগৎ একটু-একটু করে আত্মপ্রকাশ করছে।
ক্রমে কুয়াশার স্বপ্ন-যবনিকা বিরাট কোনও রঙ্গালয়ের অর্ধ-স্বচ্ছ পাতলা পরদার মতো ধীরে ধীরে শূন্যে উপরে উঠতে লাগল দুলতে দুলতে, কাঁপতে কাপতে!
ওই সেই ভুবনবিখ্যাত কৈলাস পর্বত, নীলিমার কোলে যেন তুষারে-গড়া বিরাট এক শিবলিঙ্গ! গৌরী ঊষার অরুণ কিরণ-কুসুম প্রভাতী পূজার নিবেদনের মতো মহাতাপস শিবের তুষার-কান্তির উপরে এসে পড়ে তাকেও রাঙা করে তুললে?
নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলুম, এ কী! সরোবর, না সাগর? নীলাকাশের অসীমতার তলায় আর এক বিপুল নীলিমার সৃষ্টি করে রাবণ হ্রদ প্রভাতের প্রথম আলোকের আশীর্বাদ গ্রহণ করছে! ধু-ধু-ধু প্রস্তরমরুপ্রান্তরে মাইলের পর মাইল থইথই করছে অগাধ জলের রাশি! স্বপ্নাতীত মহাবিস্ময় যেন মূর্তি ধরেছে!
এমন মনোহর সরোবর, যেখানে এলে তপস্যা করতে সাধ যায়, সেখানে কিন্তু লোকালয়ের চিহ্ন পর্যন্ত দেখলুম না। মরুভূমিতেও লোকের বসতি থাকে, কিন্তু এ যেন অভিশপ্তের মুল্লুক! সেইজনেই কি একে রাবণ হ্রদ বা রাক্ষস তাল বলে ডাকা হয়? মনে পড়ল, পথে একজন লোক সাবধান করে দিয়েছিল যে, রাক্ষস তালের রূপ দেখে ভুলে যেন তার জলে নামতে না যাই! কেন, এখানে তো ভয়ের কিছুই দেখছি না! ... কিন্তু একটু পরেই আমরা ভয়ের কারণ বুঝতে পারলুম!
রামহরি শিবলিঙ্গরূপী আশ্চর্য কৈলাস-শিখর দেখেই উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘বোম মহাদেব! আজ আমার জন্ম সার্থক হল!'—বলেই সে পাহাড়ের উপরে দণ্ডবত হয়ে শুয়ে পড়ে প্রণামের পর প্রণাম ঠুকতে লাগল।
আমিও কৈলাসের সূর্যোদয় দেখতে দেখতে ভুলে গেলুম আর সব কথা! হঠাৎ কুমার বলে উঠল, দ্যাখো, দ্যাখো,—ও কী কাণ্ড!
চমকে ফিরে কুমারের দৃষ্টি অনুসরণ করে সবিস্ময়ে দেখলুম, রাবণ হ্রদের পাশ দিয়ে নানারঙা নুড়ি ছড়ানো পথে ছয়-সাতজন লোক ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসছে গুরলার দিকেই।
কে ওরা? দূর থেকে চেনা গেল না! কিন্তু অমন করে ছুটছে কেন? যেন ওদের বাঘে তাড়া করেছে!
তারা আরও কাছে এসে পড়ল। ... ক্রমে আরও কাছে!
এমন সময়ে তাদের কাছ থেকে দূরে--অনেক দূরে দেখা গেল পিঁপড়ের সারির মতো দলে দলে লোক! তারাও ছুটে আসছে! তাহলে প্রথম দল পালাচ্ছে ওদেরই ভয়ে?
বিমল উৎকট আনন্দপূর্ণ স্বরে বললে, কুমার, আমাদের প্রিয়বন্ধু ভৈরব আর তার স্যাঙাতদের চিনতে পারছ কি? পিছনে তিব্বতি পঙ্গপাল নিয়ে ওরা এইদিকেই আসছে!
ভৈরব, ভৈরব! আবার তাহলে ভৈরবের সঙ্গে দেখা হল, আমার পিতৃহত্যাকারী ভৈরব। হা, আজ আমি তার সঙ্গে শেষবার দেখা করতে চাই।
কুমার সবিস্ময়ে বললে, কিন্তু ওদের প্রত্যেকেরই হাতে বড়ো বড়ো এক-একটা বাক্স রয়েছে কেন?
বিমলের চক্ষু বিস্ফারিত হয়ে উঠল। সে উত্তেজিত কণ্ঠে বললে, ওগুলোকে বড়ো বাক্স বলে ছোটো সিন্দুক বলাই উচিত! ওগুলোর ভিতরে কী আছে?
রামহরি আমাদের সকলের মনের সন্দেহ ভাষায় প্রকাশ করে বললে, গুপ্তধন নয় তো?
বিমল বললে, তা ছাড়া আর কী হতে পারে? প্রাণের ভয়ে পালাবার সময়েও ওরা যখন সিন্দুকগুলো ছাড়েনি, তখন ওদের মধ্যে খুব দামি জিনিস ভিন্ন আর কিছু থাকতে পারে না!
রামহরি আশ্চর্য স্বরে বললে, ওরা যকের ধন নিয়ে এল, ভূত কিছু বললে না!
খেদে দুঃখে আমার হৃৎপিণ্ড ফেটে যাবার মতো হল! সাত ঘাটের জল খেয়ে এখানে এসে হাজির হলুম কি এই দেখবার জন্যে?
কুমার আমার চিন্তার প্রতিধ্বনি করে বললে, বিমল, বিমল! আমাদের চোখের সামনে ওরা গুপ্তধন নিয়ে পালাবে, আর আমরা কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই দেখব?
বিমল বললে, ওরা আর কোথায় পালাবে কুমার? ওদের পিছনে পঙ্গপালের মতো শত্ৰু, ওদের একপাশে পাহাড়, আর একপাশে হ্রদ, ওদের সুমুখে আছি আমরা,—আর ওরা এদিকেই আসছে সিন্দুকগুলো আমাদের হাতে তুলে দেবার জন্যে। আমাদের অনেক পরিশ্রম বেঁচে গেল! ... আমি এখন খালি এই কথাই ভাবছি যে, সিন্দুকগুলো ওদের হাত থেকে নিতে কত সময় লাগবে? তার মধ্যে তিব্বতি হনুমানগুলো কাছে এসে পড়বে না তো? আমাদেরও তো যথাসময়ে পালাতে হবে?
কুমার বললে, তিব্বতিরা এখনও অনেক তফাতে আছে, আমাদের কাছে আসতে হলে এখনও ওদের আধমাইল পথ পার হতে হবে!
আমি ব্যগ্রভাবে বললুম, কিন্তু ভৈরবরা যে এসে পড়ল! ওরাও আমাদের দেখে ভয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে?
বিমল বললে, “ওদের পালাবার আর কোনও পথ নেই। আবার ধরা বন্দুক! অগ্রসর হও। বন্দুক তুলে আমরা বেগে তাদের আক্রমণ করতে ছুটলুম!
প্রথমটা কয়েক মুহুর্তের জন্যে ভৈরবরা স্তম্ভিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল, আমাদের এখানে দেখবার জন্যে ওরা কেউই প্রস্তুত ছিল না! ভৈরব একবার পিছনপানে তাকালে, কিন্তু সেদিকের দৃশ্য আরও ভয়ঙ্কর! কাতারে কাতারে লোক ছুটে আসছে, জনতার যেন শেষ নেই! এ জনতাসাগর কাছে এসে পড়লে ভৈরবের সঙ্গে আমাদেরও কোথায় তলিয়ে যেতে হবে!
বিমল একবার বন্দুক ছুঁড়লে,—বোধহয় ভৈরবকে ভয় দেখাবার জন্যেই, কারণ গুলি কারুর গায়েই লাগল না।
ভৈরব মরিয়ার মতো চেঁচিয়ে বললে, ভাই-সব! জলে ঝাপিয়ে পড়ো! সাঁতার দাও! চোখের নিমেষে তারা সাতজনেই রাবণ হ্রদের দিকে ফিরল!
বহুদূর থেকে তিব্বতিদের কণ্ঠে আবার প্রায় সমুদ্রগর্জনের মতো গম্ভীর চিৎকার জেগে উঠল--তারাও ভৈরবদের উদ্দেশ্য বুঝতে পারলে! কিন্তু তারা চাচালে কেন? ওরা জলে ঝাপ দিলে গুপ্তধনের সিন্দুকগুলো ডুবে যাবে বলে?
বিমল অট্টহাস্য করে চেঁচিয়ে বললে, আর কোথায় যাবে তুমি ভৈরব? তুমি যদি জলে ঝাঁপ দাও, আমি পাতালে গিয়েও তোমাকে ধরব।
কুমার বললে, হয় বাক্সগুলো দাও, নইলে জলে পড়েও বাঁচবে না? কিন্তু তারা কেউ আমাদের কথায় কান পাতলে না—একবার ফিরেও তাকালে না! আমরা তাদের কাছে যাবার আগেই তারা অতি বেগে রাবণ হ্রদের মধ্যে গিয়ে পড়ল।
তারপরেই চোখের সুমুখে যে অভাবিত ও ভয়ানক দৃশ্য জেগে উঠল তা আমাদের সকলেরই দেহ প্ৰস্তুর-মূর্তির মতো আড়ষ্ট করে দিলে! সেই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে বুঝতে পারলুম, এই হ্রদের নাম রাক্ষস তাল হয়েছে কেন? আমি হলে এ হ্রদের নাম রাখতুম ‘মৃত্যু-সায়র’! সে দৃশ্যের কথা মনে হলে ভয়ে এখনও আমার সর্বাঙ্গ ঠান্ডা হয়ে যায়! কিন্তু হয়তো এটা বিধাতার দেওয়া শাস্তি!
ভৈরবের দলের ছয়জন লোক দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ঠিক পাগলের মতোই জলের ভিতরে গিয়ে পড়ল। কিন্তু হাঁটুজলে গিয়ে পৌঁছতে-না-পৌঁছতেই তাদের প্রত্যেকের দেহ কোমর পর্যন্ত হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল—সঙ্গে সঙ্গে তারা সভয়ে চেঁচিয়ে উঠল!
তারপর দেখতে দেখতে তাদের বুক পর্যন্ত ডুবে গেল যেন পাতাল তাদের পা ধরে সজোরে আকর্ষণ করছে!
রামহরি চেঁচিয়ে উঠল—চোরাবালি! চোরাবালি!
অভাগারা পরিত্রাহি ডাক ছেড়ে বললে, ‘বাঁচাও, বাঁচাও!’--কিন্তু জীবন যেতে বসেছে, তবু তারা সিন্দুকগুলো ছাড়লে না—বরং যেন আরও বেশি জোরে দুই হাতে বুকের উপরে আঁকড়ে ধরে রইল! আমার বিশ্বাস, ওই সিন্দুকগুলোর ভারেই তাদের দেহ বেশি-শীঘ্র চোরাবালির মধ্যে বসে যাচ্ছে!
রামহরি আবার চাচালে—লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ো! লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ো!
কিন্তু কে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়বে? তখন তাদের গাল পর্যন্ত বসে গেছে এবং মুখ খালি চিৎকার করছে ‘বাঁচাও, বাঁচাও' বলে!
বিমল একবার জলের ভিতরে পা বাড়াল—এবং সঙ্গে সঙ্গে তারও হাঁটু পর্যন্ত ডুবে গেল! রামহরি একলাফে এগিয়ে গিয়ে প্রচণ্ড টান মেরে তাকে সরিয়ে আনলে! বিমল বললে, এ কী ভয়ানক মৃত্যু! আমরা কি কোনও সাহায্যই করব না? কুমার বললে, নিজেদের প্রাণ দিয়ে? দুরাত্মাদের জন্যে আমি প্রাণদান করতে রাজি নই!
তখন কারুর দেহ একেবারে তলিয়ে গিয়েছে, কারুর কেবল মাথা দেখা যাচ্ছে এবং কোথাও বা একখানা হাতমাত্র জলের উপরে জেগে ছটফট করছে!
কিন্তু পালের গোদা ভৈরব ছিল সর্বশেষে, ঝাপ দেবার আগেই দলের লোকের অবস্থা দেখে সে আর জলে নামেনি।
এতক্ষণ সে আড়ষ্টের মতো সেইখানেই দাঁড়িয়ে ছিল, প্রবল উত্তেজনায় আচ্ছন্ন হয়ে পালাবার চেষ্টা পর্যন্ত করেনি!
আমরাও এতগুলো মানুষকে একসঙ্গে হঠাৎ অমন মৃত্যুফাদে পড়তে দেখে তার অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে ভুলে গিয়েছিলুম।
এখন আমার হুঁশ হল! তাড়াতাড়ি ফিরে দেখি ভৈরব যেখানে ছিল সেখানে আর নেই। সেও জলে ঝাপ দিলে নাকি? না, তাহলে এত শীঘ্র অদৃশ্য হয়ে যেত না!
অন্যদিকে তাকিয়ে দেখলুম, তিব্বতিরা চিৎকার করতে করতে অনেকটা কাছে এসে পড়েছে। সেদিকেও ভৈরব নেই!
চেঁচিয়ে বললুম, বিমল কুমার! ভৈরব কোথায় গেল?
তারা বিদ্যুৎবেগে ফিরে দাঁড়াল! এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে বিমল বললে, ভৈরব কী আবার ফাঁকি দিলে?
রামহরি বললে, ওই যে, শয়তান পাহাড়ে উঠছে! তাই তো! সিন্দুকটা কাঁধে করে ভৈরব দ্রুতপদে পাহাড়ে উঠে যাচ্ছে।
বিমল বললে, ভৈরব, যদি বাঁচতে চাও এখনও দাঁড়াও! ভৈরব দাঁড়াবার নামও করলে না? বিমল বললে, প্রাণ থাকতে তোমাকে পালাতে দেব না! বাঘা!
বাঘা ল্যাজ নাড়তে নাড়তে বিমলের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বিমল হাত দিয়ে ভৈরবকে দেখিয়ে ইশারা করে বললে, বাঘা! ধর ওকে!
বাঘা লাফাতে লাফাতে পাহাড়ের দিকে ছুটল এবং আমরাও তার অনুসরণ করলুম!