কুবের পুরীর রহস্য Kuber purir Rohoshyo by হেমেন্দ্রকুমার রায় Hemendra Kumar Roy, chapter name বাবা কৈলাসের মহাদেব

বাবা কৈলাসের মহাদেব

সেই বিরাট জনতার বিপুল চিৎকার যখন নিরবচ্ছিন্ন নিস্তব্ধতাকে নির্বাসিত করে আকাশ বাতাস ও হিমাচলকেও কাপিয়ে তুলছে, বিমল তখন অত্যন্ত নিশ্চিন্ত ভাবে টর্চের আলোকে গুহার ভিতরটা পরীক্ষা করতে লাগল। তার ভাব দেখলে মনে হয়, ও-চিৎকারে যেন ভয় পাবার কিছুই নেই, ও যেন বৈঠকখানার পাশের রাস্তায় আনন্দমেলায় সমবেত নিরীহ জনতার নিরাপদ কোলাহল।

কুমার বললে, “গহাটা ছোটো হলেও আপাতত আমাদের আশ্রয়ের পক্ষে যথেষ্ট!

আমি কিন্তু অতটা নিশ্চিত হতে পারলুম না! বললুম, কিন্তু আমরা হচ্ছি চারজন আর ওরা বোধহয় আড়াইশোর কম হবে না!

কুমার আমার পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে বললে, আজ এই গুরলা গিরিসঙ্কটে থার্মাপলির পুনরভিনয় হবে! কিন্তু হায়, আমাদের সঙ্গে কোনও কবি নেই, এই বীরত্ব-কাহিনি পৃথিবীকে শোনাবে কে? দিলীপ, তুমি পদ্য লিখতে পারো?

এই কি কৌতুকের সময়? আমি রেগেমেগে মাথা নেড়ে বললুম, না! লিখতে পারলেও এখন পদ্য নিয়ে আমি মাথা ঘামাতুম না!

তবে কী করতে? -কী উপায়ে প্রাণ বাঁচানো যায়, সেই চেষ্টাই করতুম।

কেবল চেষ্টা করেই যদি প্রাণ বাঁচানো যেত, তাহলে পৃথিবীতে আজ কোনও জীবজন্তুই মরত না। না-মরবার জন্যে সবাই চেষ্টা করে, তবু তো সবাই মরে! সুতরাং ও-চেষ্টা ছেড়ে ভবিষ্যতে তুমি পদ্য লেখবার চেষ্টা কোরো, তবু কবি বলে নাম কিনতে পারবে।

আমি বললুম, পৃথিবীতে এমন কোনও কবি আছেন বলে মানি না, যিনি এখন কবিতা লিখতে পারেন।

আমি কবি হলে লিখতে পারতুম দিলীপ! জীবন কী? মৃত্যু কী? দীপশিখা জ্বালা আর নেবার মতোই সহজ! আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো কবি তাই বলেছেন—জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’!

তারপর একটু থেমে বিমল ডাকলে, কুমার!

বলো।

তিব্বতি হনুমানগুলো প্রায় আমাদের সামনে এসে পড়েছে। ওরা খুব জয়ধ্বনি করছে! ভাবছে আমরা ফাঁদে পড়েছি, এখন একে একে ধরে টিপে মেরে ফেললেই হয়! কিন্তু ওদের ধারণা যে ভুল, সেটা কী ভাবে বুঝিয়ে দেওয়া যায় বলো দেখি?

কুমার একবার মুখ বাড়িয়ে বাইরেটা দেখে নিয়ে বললে, ওদের কাছেও বন্দুক আছে।

কিন্তু সেকেলে গাদা বন্দুক। ইংরেজদের তিব্বত-অভিযানের সময়ে ওই বন্দুক নিয়েই ওরা বীর-দন্তে লড়াই করতে এসেছিল, আর তার ফল কী হয়েছিল তা জানো তো? আজও দেখছি ওরা ও-বন্দুক ছাড়েনি! ও-সব বন্দুক প্রত্যেকবার মাটিতে রেখে বারুদ ঠেসে তারপর টিপ করে গুলি ছুঁড়তে কত সময় লাগবে বুঝেছ?

হ্যাঁ, তার আগেই আমরা শত্রুদের ঝড়ে কলাগাছের মতো মাটিতে পেড়ে ফেলতে পারব। ওরা অবশ্য এই শুড়িপথে ঢুকে হাতাহাতি যুদ্ধে আমাদের কাবু করবার চেষ্টা করবে।

যা, ওরা কাছে আসতে পারলে আমরা আর বাঁচব না। কিন্তু ওরা কাছে আসতে পারবে না!

এই শুড়িপথে একসঙ্গে দুজন লোকের পক্ষে পাশাপাশি চলা অসম্ভব। এ পথে ঢুকলে কেউ আর জীবন নিয়ে বেরুতে পারবে না। বেঁচে থাকুক আমাদের হাতের একেলে বন্দুক!

কিন্তু ওরা যদি এই গুহা অবরোধ করে?

তাহলে দু-চারদিন পরেই অনাহারে আমাদের আত্মসমর্পণ করতে হবে। কিন্তু সে আজকের কথা নয়। আজকের কথা হচ্ছে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায়—‘মারো মারো, শত্রু মারা’!

ওই ওরা এসে পড়েছে। কুমার, তুমি আমার পাশে এসে দাঁড়াও! রামহরি, দিলীপ! তোমরা আমাদের পিছনে থাকো! এখন আমাদের দরকার, খুব-তাড়াতাড়ি বন্দুক ছোড়া! আমি আর কুমার বন্দুকের নলগুলো খালি করেই দিলীপ আর রামহরিকে দেব, তারা তাদের বন্দুক আমাদের হাতে দিয়ে আবার আমাদের বন্দুকে টোটা ভরতে থাকবে। এ ব্যবস্থায় দিলীপ আর রামহরি বন্দুক ছুড়তে পারবে না বটে, কিন্তু আমরা শত্রুদের উপরে গুলিবৃষ্টি করতে পারর অশ্রান্ত ভাবেই!

তখন পাহাড়ের উপরকার ও নীচেকার দল একসঙ্গে মিলে গুহার শুড়িপথের সামনে দাঁড়িয়ে পরামর্শ করছে! এরা সবাই তিব্বতি, আজ দুপুরে আমাদের তাবুর ভিতরে হঠাৎ যে বেয়াড়া মূর্তির আবির্ভাব হয়েছিল, এদের সকলকেও দেখতে প্রায় সেই-রকম। এদের অনেকের পিঠে বন্দুকের বদলে তিরধনুকও দেখা গেল।

প্রথমে আমি ভেবেছিলুম, ভৈরবই বোধহয় লোকজন সংগ্রহ করে পথের কাঁটা সরাবার জন্যে আমাদের আক্রমণ করতে আসছে! কিন্তু এখন দেখছি তা নয়। এরা নতুন লোক। কিন্তু কারা এরা? ডাকাত, না গুপ্তধনের রক্ষক? যদিও এখনও এরা আক্রমণ করেনি, তবু এরা যে আমাদের বন্ধু নয় সেটা বেশ ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে!

বিমল ও কুমার গুহার অন্ধকারে সরে এসে হুমড়ি খেয়ে বসে বন্দুক নিয়ে অপেক্ষা করছে, বোধহয় এদের উদ্দেশ্য কী, বুঝবার জনেই। যদি এরা ঠিক শত্রু না হয়!

কিন্তু উদ্দেশ্য বুঝতে আর বিলম্ব হল না। হঠাৎ কয়েকটা বন্দুকের গর্জন শোনা গেল এবং তারপরেই কয়েকজন লোক বিকট চিৎকার করে শুডিপথের দিকে ছুটে এল। নির্বোধ।

বিমল বললে, ব্যস, আর দয়া নয়—আগে শুড়িপথ সাফ করো, তারপর চড়াইয়ের পথে যারা আছে তাদের মারো! চালাও গুলি!

এবং বিমল ও কুমারের বন্দুকরা স্বভাষায় অনর্গল কথা কইতে শুরু করল! তাদের বন্দুক শূন্য হলেই আমাদের হাতে আসে এবং আমাদের বন্দুক যায় পূর্ণোদরে তাদের হাতে!

দুইপক্ষের বন্দুকের শব্দে, জনতার চিৎকারে, আহতদের আর্তনাদে কান আমার কালা হয়ে যাবার মতো হল, শিকল-বাঁধা বাঘাও আর কিছু সুবিধা করতে না পেরে কেবল গলাবাজির দ্বারাই আসর মাত করে তুললে!

দেখতে দেখতে শুড়িপথ সাফ হয়ে গেল, সেখানে পড়ে রইল কেবল হত ও আহতদের দেহগুলো! তারপর চড়াইয়ের পথে যারা ছিল গরমাগরম গুলির আস্বাদ পেয়ে তাদেরও সাহস উবে গেল, তারাও তাড়াতাড়ি পাহাড়ের আরও উপরদিকে উঠে বন্দুকের নাগালের বাইরে গিয়ে দাঁড়াল এবং সেখান থেকে কেবল চেঁচিয়ে ও লাফিয়ে আমাদের ভয় দেখাবার চেষ্টা করতে লাগল! এত বিপদেও তাদের বাঁদুরে ভাবভঙ্গি দেখে আমি না হেসে পারলুম না!

বাঙালির ছেলে আমি, চিরদিন আদুরে-গোপালের মতো বাপ-মায়ের কোলেই মানুষ হয়ে এসেছি, আজকের এই আশ্চর্য দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে হতে লাগল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমি রূপকথার রাজ্যে গিয়ে স্বপ্ন দেখছি!

এই হিমালয়ের জ্যোৎস্নাময় তুষারসাম্রাজ্য, এই দলবদ্ধ শত্রুবাহিনীর আক্রমণ ও যুদ্ধহুঙ্কার, এই বন্দুকের ঘন ঘন বজ্রগর্জন, এই চোখের সামনে এতগুলো নরবলি, এই মৃত্যুভয়ের মূর্তিমান লীলা, এ-সমস্তই আমার কাছে নূতন—একেবারে অভিনব! গল্পে এ-রকম ঘটনা পড়া বা শোনা, আর স্বচক্ষে তা দেখা এককথা নয়। আমি অভিভূতের মতো হয়ে গেলুম।

শুড়িপথ দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে আহতরা পালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে এবং চড়াইয়ের উপরে দশ-বারোটা দেহ একেবারে স্থির হয়ে পড়ে আছে—সে-হতভাগ্যরা আর কখনও পালাতে পারবে না।

বিমল বললে, দেখেছ কুমার, ওই জংলি-বাঁদরগুলো বন্দুকের ব্যবহারও ভুলে গেছে? এতগুলো বন্দুকের শব্দ শুনলুম, কিন্তু একটাও গুলি গুহার ভিতরে এল না!

আমি বললুম, কিন্তু দুটো তির গুহার ভিতরে এসেছে।

বিমল বললে, হা, বন্দুকের চেয়ে ধনুকে ওদের হাত ভালো। কিন্তু এখন ওরা যেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখান থেকে তির ছুড়লেও আমাদের কোনও ভয় নেই। ওদের তির এতদূর আসবে না।

ওরা দূরে দাঁড়িয়ে সমানে চিৎকার করতে লাগল। আমাদের বন্দুকের প্রতাপ দেখে ওদের মন থেকে যুদ্ধ-সাধ বোধহয় একেবারেই লুপ্ত হয়ে গেছে।

কিন্তু ঘণ্টাখানেক কেটে গেল, তবু তারা ওখান থেকে নড়ল না। ওদের উদ্দেশ্য কী?

বিমল বললে, বোধহয় যা ভেবেছিলুম তাই। আক্রমণ করে ফল নেই বলে হয়তো ওরা আমাদের এইখানেই বন্ধ করে রাখতে চায়।

তাহলে উপায়? আমাদের সঙ্গে চামড়ার বোতলে সামান্য জল আছে বটে, কিন্তু তা ফুরিয়ে যেতে কতক্ষণ? বিশ্বাসঘাতক কুলিরা আমাদের মালপত্তর নিয়ে পালিয়েছে, খাবার পাব কোথায়?

অনাহারে কতদিন আত্মরক্ষা করতে পারব?

আচম্বিতে ও আবার কী ব্যাপার? আমাদের গুহার উপরে গড়গড় করে কী-একটা শব্দ উঠল। এবং তারপরেই গুহার ঠিক মুখেই ভীষণ শব্দে বড়ো বড়ো কতকগুলো পাথর এসে পড়ল। ওরা কি পাথর ছুড়ে আমাদের মারতে চায়? গুলি গেল, পাথর? কিন্তু কোথা থেকে চূড়ছে?

তারপর লক্ষ করে দেখলুম, এমন সব প্রকাণ্ড পাথর কোনও-একজন-মানুষের পক্ষেই ছোড়া সম্ভবপর নয়! এ-সব পাথরের এক-একখানা শূন্যে তুলতেই তিন-চারজন লোকের দরকার!

আবার গুহার গড়ানে ছাদে তেমনি গড়গড় শব্দ, আবার তেমনি কতকগুলো পাথর গুহার মুখে এসে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে শুনলুম শত্রুদের কণ্ঠে দ্বিগুণ উৎসাহে উল্লাসের চিৎকার! তখন আন্দাজ করলুম, শত্রুদের ভিতর থেকে বোধহয় একদল লোেক অন্য কোনও পথ দিয়ে আমাদের গুহার ছাদে এসে উঠেছে এবং সেইখান থেকেই এই পাথরগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে নীচে ফেলে দিচ্ছে! ক্রমাগত পাথর পড়ছে, গুহা থেকে বেরিয়ে ছাদের শত্রুদের মারবারও উপায় নেই!

বিমলও ব্যাপার বুঝে বললে, কুমার, এইবারে আমাকে ভাবালে দেখছি! ওরা গুহার ছাদ থেকে পাথর ফেলে গুহার মুখ বন্ধ করে দিতে চায়!

কুমার দমে গিয়ে বললে, সে যে জ্যান্ত কবর।

কিন্তু এখন গুহা থেকে বেরিয়ে খোলা জায়গায় গেলে হয়তো অনেক শত্রু মারতে পারব, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওদের হাতেই তাহলে আমাদের মরতে হবে!

কুমার চুপ করে রইল।

রামহরি বললে, হে বাবা কৈলাসের মহাদেব! আমরা তোমার রাজ্যে এসেছি, আমাদের রক্ষা করো!

বিমল বললে, কিন্তু রামহরি, মহাদেব যে প্রলয়কর্তা, সে কথা কি তুমি ভুলে গিয়েছ?

রামহরি খাপ্পা হয়ে বললৈ, থামো থামো, তোমায় আর অত ব্যাখ্যান করতে হবে না, তুমি ভারী পণ্ডিত! দুনিয়াসুদ্ধ লোক যে শিবপুজো করছে তা কি মরবে বলেই করছে?... হে বাবা কৈলাসের মহাদেব! খোকাবাবু ছেলেমানুষ, তার কথায় তুমি রাগ কোরো না, তুমি আমাদের রক্ষা করো—এই পাথর পড়া বন্ধ করে দাও!

গড়গড় আওয়াজ হচ্ছে তো হচ্ছেই, পাথরের পর পাথর পড়ছে তো পড়ছেই এবং সেইসঙ্গে বারংবার জেগে জেগে উঠছে শত শত নির্মম কণ্ঠে পৈশাচিক অট্টহাস্য! গুহার আধখানা মুখ তখন বন্ধ হয়ে গেছে, বাকি আধখানা বন্ধ হলেই জীবন্ত জগতের সঙ্গে আমাদের সকল সম্পর্কের অবসান!

অধরুদ্ধ গুহাপথ দিয়ে চন্দ্রকিরণ ভিতরে ঢুকে তখন নীরব ভাষায় যেন ডাক দিয়ে বলছিল, ‘বন্ধু, এখন কি আমায় আরও সুন্দর দেখাচ্ছে না?

কুমার বললে, রামহরি, এত রাতে আর এই শীতে শিব কৈলাসপুরীতে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। তোমার প্রার্থনা তিনি শুনতে পাননি!

রামহরি বিরক্ত কণ্ঠে বললে, ও হচ্ছে ক্রিশ্চানের কথা! ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর কি তোমার-আমার মতো? পৃথিবী তাদের মুখ চেয়ে আছে, তারাও পৃথিবীর শিয়রে দিন-রাত জেগে বসে আছেন! তারা যদি আমাদের দয়া না করেন তাহলে বুঝব আমরাই মহাপাপী, দয়ার যোগ্য নই!

অশিক্ষিত রামহরির সরল বিশ্বাসের কথা শুনে আমার চোখে জল এল। বিমল বললে, কুমার, আমি এই অন্ধকূপের মধ্যে দিনে দিনে তিলে তিলে মরতে পারব?

কী করবে?

এখনও বাইরে যাবার পথ আছে। আমি বাইরে যাব!

তারপর?

তারপর শত্রু মারতে মারতে বীরের মতো হাসতে হাসতে মরব।

আমারও ওই মত। দিলীপ, কী বলে? কোনওরকমে মনের আবেগ সামলে বললুম, আমার কোনও মত নেই। তোমরা যা বলবে তাই করব।

আচম্বিতে বাইরের সমস্ত চিৎকার একসঙ্গে থেমে গেল এবং সেই স্তব্ধতার মধ্যে শোনা গেল, বহু বহু দূরে অনেকগুলো জয়ঢাক ও তুরী-ভেরি বেজে উঠেছে! হিমারণ্যের এই অপরিসীম নিস্তব্ধতায় বহুদূরের শব্দকেও মনে হয় যেন কাছের শব্দ বলে। তাই কত দূর থেকে সেই তুরী-ভেরি ও ঢাকের শব্দ আসছে, ভালো করে সেটা বোঝা গেল না।

রামহরি খুশি কণ্ঠে বললে, খোকাবাবু, খোকাবাবু, পাথর আর পড়ছে না! আমি সাগ্রহে বললুম, ব্যাপার কী বিমল?

বিমল বললে, “কিছু তো আমিও বুঝতে পারছি না। তবে কৈলাসের মহাদেব এসে যে ওদের পাথর ছুড়তে বারণ করেননি, এ-বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই। কিন্তু ওই ঢাক আর ভেরী বাজছে কেন? ও কি কোনও সঙ্কেতধ্বনি?

গুহামুখে যে পাথরগুলো জড়ো হয়েছে তার উপর দিয়ে দেহের আধখানা বাড়িয়ে কুমার বললে, বিমল, বিমল! ওরা চলে যাচ্ছে।

চলে যাচ্ছে!

হ্যাঁ, খুব তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছে! দৌড়চ্ছে! যেখানে ওরা এতক্ষণ ছিল, সে-জায়গাটা প্রায় খালি হয়ে গেছে!

রামহরি গদগদ কণ্ঠে বার বার বলতে লাগল, হে বাবা কৈলাসের মহাদেব, ওদের সুমতি দাও বাবা, ওদের সুমতি দাও! কলকাতায় গিয়ে খুব ঘটা করে আমি তোমাকে পুজো দেব!

কুমার বললে, ব্যস, পাহাড়ের উপরে আর কেউ নেই! পথ সাফ!

বিমল বললে, কিন্তু এটা হতভাগাদের নতুন কোনও চাল নয় তো? হয়তো আমাদের বাইরে বার করবার আর একটা ফিকির!

প্রায় ঘণ্টাখানেক আমরা গুহার ভিতরে বসে রইলুম, কিন্তু বাইরে আর কারুর সাড়া পাওয়া গেল না।

বিমল ফিরে হাসতে হাসতে বললে, রামহরি, মহাদেব সত্যিই ঘুমোন না। তিনি তোমার কথা শুনতে পেয়েছেন!

রামহরি বললে, কলকাতায় গিয়ে আমাকে দশটা টাকা দিয়ে। আমি ঠাকুরকে পুজো দেব বলে মানত করেছি।

কুমার বললে, কিন্তু বিমল, সমস্ত ব্যাপারটাই যে রহস্যময় আর অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে!

চলো, বাইরে গেলে হয়তো একটা হদিশ পাওয়া যেতে পারে। আমরা পাথরের স্তুপ টপকে একে একে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালুম। চাঁদ তখন পশ্চিম আকাশে, যে-সব পাহাড়ের শিখর এতক্ষণ জ্যোৎস্নাময় হয়েছিল, এখন তারা হয়েছে ছায়াময়। এবং যেখানে ছিল ছায়া, সেখানে এসেছে আলো।

শুড়িপথে জন-পাঁচেক তিব্বতি মরে কাঠ হয়ে পড়ে আছে। আমাদের প্রাণবধ করতে এসে এরা নিজেদের প্রাণই রক্ষা করতে পারলে না। পৃথিবীতে মানুষের যদি ভবিষ্যৎ-দৃষ্টি থাকত, তাহলে জগতে অনেক যুদ্ধবিগ্রহই ঘটত না! অনেক পাপীও সাবধান হত।

মৃতদেহগুলোর বিকৃত ভয়ানক মুখ দেখে শিউরে উঠলুম। কোনওরকমে পাশ কাটিয়ে আবার চড়াইয়ে গিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম।

হঠাৎ আমার পায়ের তলায় কে কাদো-কাঁদো গলায় বলে উঠল, 'বাবুজি, পানি! চমকে চেয়ে দেখি, সেখানে একজন আহত তিব্বতি পড়ে রয়েছে।

বিমল তখনই নিজের বোতল থেকে তার মখে জল ঢেলে দিলে। বন্দকের গুলি তার বুকে লেগেছে। সে এত হাঁপাচ্ছে যে বেশ বোঝা গেল, তার মৃত্যুর আর দেরি নেই।

বিমল হিন্দিতে শুধোলে, তোমাদের লোকজনরা হঠাৎ পালিয়ে গেল কেন?

সে হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, লামারা বিপদের সঙ্কেত করেছে বলে চলে গেছে। তারা পালায়নি।

তাই কি ভেরি আর ঢাক বাজছিল?

হ্যাঁ।

বিপদটা কীসের?

বোধহয় গুপ্তধনের গুহায় চোর ঢুকেছে!

ছিলা-ছেঁড়া ধনুকের মতো বিমল হঠাৎ সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে উঠল। তারপর কী ভেবে আবার বসে পড়ে জিজ্ঞাসা করলে, তোমরা আমাদের আক্রমণ করেছিলে কেন?

পুরাংয়ে ক’জন বাঙালিকে আমরা গ্রেপ্তার করেছিলুম। জুম্পানওয়ালাকে (শাসনকর্তাকে) অনেক টাকা জরিমানা দিয়ে তারা ছাড়ান পায়। সেই বাঙালিদের মুখে শোনা গেল, গুপ্তধন আনবার জন্যে তোমরা এদিকে এসেছ। জুম্পানওয়ালা তাই আমাদের পাঠিয়েছে।

আর সেই বাঙালিরা?

জানি না, বাবুজি, আর আমি কিছু বলতে পারব না—আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমাকে আর একটু জল দাও।

বিমল তার গলায় আবার জল ঢেলে দিলে। মিনিট দশ পরে সে অন্তিম শ্বাস ত্যাগ করলে। বিমল বললে, চমক্কার!

কুমার বললে, চমৎকার আবার কী?

এই ভৈরবের বুদ্ধি! বেশ বোঝা যাচ্ছে, শাসনকর্তাকে ঘুষ দিয়ে সে মুক্তি পেয়েছে। তারপর এখানকার সেপাই-চৌকিদারদের চোখ আমাদের দিকে আকৃষ্ট করেছে। তারা আমাদের নিয়ে ব্যস্ত, অন্যমনস্ক হয়ে আছে, আর সেই ফাঁকে ভৈরব তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে গুপ্তধনের সন্ধানে যাত্রা করেছে। কিন্তু এমন চমৎকার চালাকি খাটিয়েও ভৈরব বোধহয় শেষরক্ষা করতে পারেনি। লামার দল তাদের আবিষ্কার করে ফেলেছে, জয়ঢাক প্রভৃতি বাজিয়ে তাই তারা করেছে সাহায্যপ্রার্থনা! এতক্ষণে সব পরিষ্কার হয়ে গেল! এখন নাটকের শেষ-অঙ্কের অভিনয় হচ্ছে,--চলো, চলো, আমাদের যথাসময়ে রঙ্গমঞ্চে গিয়ে হাজির হতে হবে।