ষট্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ
আজ লোকজনেরা ভারি ব্যস্ত। চারিদিকে বাজনা বাজিতেছে। গ্রামে যেন একটি উৎসব পড়িয়াছে। একে বিভার প্রাণে অধীর আনন্দ জাগিতেছে, তাহার 'পরে চারিদিকে বাজনার শব্দ শুনিয়া তাহার হৃদয় যেন উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। পাছে উদয়াদিত্যের কাছে তাহার এই অত্যধিক আনন্দ প্রকাশ হইয়া পড়ে, এইজন্য কত কষ্টে সে হাসি নিবারণ করিয়া রাখিয়াছে। উদয়াদিত্য নদীতীরে উৎসবের ভাব দেখিয়া কী হইতেছে জানিবার জন্য গ্রামে বেড়াইতে গেলেন।
এমন কিছুক্ষণ গেল। একজন তীর হইতে জিজ্ঞাসা করিল, "কাহাদের নৌকা গা?" নৌকা হইতে রাজবাটীর ভৃত্যেরা বলিয়া উঠিল, "কে ও? রামমোহন যে? আরে, এস এস।" রামমোহন তাড়াতাড়ি নৌকায় প্রবেশ করিল। নৌকায় একলা বিভা বসিয়া আছে, রামমোহনকে দেখিয়া হর্ষে উচ্ছ্বসিত হইয়া কহিল, "মোহন।"
রামমোহন। মা।
রামমোহন বিভার সেই সরল আনন্দে পরিপূর্ণ হাসিহাসি মুখখানি অনেকক্ষণ দেখিয়া ম্লানমুখে কহিল, "মা তুমি আসিলে?"
বিভা তাড়াতাড়ি কহিল, "হাঁ, মোহন। মহারাজ কি ইহারই মধ্যে সংবাদ পাইয়াছেন? তুই কি আমাকে লইতে আসিয়াছিস?"
রামমোহন কহিল, "না মা, অত ব্যস্ত হইয়ো না। আজ থাক্, আর-একদিন লইয়া যাইব।"
রামমোহনের ভাব দেখিয়া বিভা একবারে মলিন হইয়া গিয়া কহিল, "কেন মোহন, আজ কেন যাইব না।"
রামমোহন কহিল, "আজ সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে-- আজ থাক্ মা।"
বিভা নিতান্ত ভীত হইয়া কহিল, "সত্য করিয়া বল্ মোহন, কী হইয়াছে?"
রামমোহন আর থাকিতে পারিল না। আত্মগোপন করা তাহার অভ্যাস নাই। সেইখানেই সে বসিয়া পড়িল, কাঁদিয়া কহিল, "মা জননী, আজ তোমার রাজ্যে তোমার স্থান নাই, তোমার রাজবাটীতে তোমার গৃহ নাই। আজ মহারাজ বিবাহ করিতেছেন।"
বিভার মুখ একেবারে পাণ্ডুবর্ণ হইয়া গেল। তাহার হাত-পা হিম হইয়া গেল। রামমোহন কহিতে লাগিল, "মা, যখন তোর এই অধম সন্তান তোকে ডাকিতে গিয়াছিল, তখন তুই কেন আসিলি না মা? তখন তুই নিষ্ঠুর পাষাণী হইয়া আমাকে কেন ফিরাইয়া দিলি মা? মহারাজের কাছে আমার যে আর মুখ রহিল না। বুক ফাটিয়া গেল, তবু যে তোর হইয়া একটি কথাও কহিতে পারিলাম না!"
বিভা আর চোখে কিছু দেখিতে পাইল না, মাথা ঘুরিয়া সেইখানে পড়িয়া গেল। রামমোহন তাড়াতাড়ি জল আনিয়া বিভার মুখে-চোখে ছিটা দিল। কিছুক্ষণ পরে বিভা উঠিয়া বসিল। এক আঘাতে বিভার সমস্ত জগৎ ভাঙিয়া গেছে। স্বামীর রাজ্যের মধ্যে আসিয়া, রাজধানীর কাছে পৌঁছিয়া, রাজপুরীর দুয়ারে আসিয়া তৃষার্তহৃদয় বিভার সমস্ত সুখের আশা মরীচিকার মতো মিলাইয়া গেল।
বিভা আকুলভাবে কহিল, "মোহন, তিনি যে আমাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন-- আমার আসিতে কি বড়ো বিলম্ব হইয়াছে?"
মোহন কহিল, "বিলম্ব হইয়াছে বই কি।"
বিভা অধীর হইয়া কহিল, "আর কি মার্জনা করিবেন না?"
মোহন কহিল, "মার্জনা আর করিলেন কই।"
বিভা কহিল, "মোহন, আমি কেবল একবার তাঁহাকে দেখিতে যাইব।" বলিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে কাঁদিয়া উঠিল।
রামমোহন চোখ মুছিয়া কহিল, "আজ থাক্ না, মা।"
বিভা কহিল, "না মোহন, আমি আজই একবার তাঁহাকে দেখিয়া আসিব।"
রামমোহন কহিল, "যুবরাজ আগে গ্রাম হইতে ফিরিয়া আসুন।"
বিভা কহিল, "না মোহন, এখনই একবার যাই।"
বিভা মনে করিয়াছিল, উদয়াদিত্য এ সংবাদ শুনিলে অপমানের ভয়ে পাছে না যাইতে দেন।
রামমোহন কহিল, "তবে একখানি শিবিকা আনাই।"
বিভা কহিল, "শিবিকা কেন? আমি কি রানী যে শিবিকা চাই। আমি একজন সামান্য প্রজার মতো, একজন ভিখারিনীর মতো যাইব, আমার শিবিকায় কাজ কী?"
রামমোহন কহিল, "আমার প্রাণ থাকিতে আমি তাহা দেখিতে পারিব না।"
বিভা কাতর স্বরে কহিল, "মোহন, তোর পায়ে পড়ি, আমাকে আর বাধা দিস্ নে, বিলম্ব হইয়া যাইতেছে।"
রামমোহন ব্যথিতহৃদয়ে কহিল, "আচ্ছা মা, তাহাই হউক।"
বিভা সামান্য রমণীর বেশে নৌকা হইতে বাহির হইল। নৌকার ভৃত্যেরা আসিয়া কহিল, "এ কী মা, এমন করিয়া এ বেশে কোথায় যাও!"
রামমোহন কহিল, "এ তো মায়ের রাজ্য, যেখানে ইচ্ছা যাইতে পারেন।"
ভৃত্যেরা আপত্তি করিতে লাগিল, রামমোহন তাহাদের ভাগাইয়া দিল।