তিনটি গল্প

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

Genre: Short Story, ছোটগল্প

Language: Bengali

কিন্নর দল

পাড়ায় ছ’সাত ঘর ব্রাহ্মণের বাস মোটে। সকলের অবস্থাই খারাপ। পরস্পরকে ঠকিয়ে পরস্পরের কাছে ধার-ধোর করে এরা দিন গুজরান করে। অবিশ্যি কেউ কাউকে খুব ঠকাতে পারে না, কারণ সবাই বেশ হুঁশিয়ার। গরিব বলেই এরা বেশি কুচুটে ও হিংসুক, কেউ কারো ভালো দেখতে পারে না বা কেউ কাউকে বিশ্বাসও করে না।

আগেই বলেছি, সকলের অবস্থা খারাপ এবং খানিকটা তার দরুন, খানিকটা অন্য কারণে সকলের চেহারা খারাপ। কিশোরী মেয়েদেরও তেমন লালিত্য নেই মুখে, ছোট ছোট ছেলেরা এমন অপরিষ্কার অপরিচ্ছন্ন থাকে এবং এমন পাকা পাকা কথা বলে যে, তাদের আর শিশু বা বালক বলে মনে হয় না। কাব্যে বা উপন্যাসে যে শৈশবকালের কতই প্রশস্তি পাঠ করা যায়, মনে হয় সে সব এদের জন্য নয়, এরা মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়ে একেবারে প্রবীণত্বে পা দিয়েছে।

.....Read more 

গায়ে হলুদ

 

শ্রাবণ মাসের দিন, বর্ষার বিরাম নেই, এই বৃষ্টি আসছে, এই আকাশ পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে। ক্ষেতে আউশ ধানের গোছা কালো হয়ে উঠেছে, ধানের শীষ দেখা দিয়েছে অধিকাংশ ক্ষেতে।

পুঁটি সকালে উঠে একবার চারিদিকে চেয়ে দেখল—চারিদিকে মেঘে মেঘাচ্ছন্ন। হয়তো বা একটু পরে টিপ-টিপ বৃষ্টি পড়তে শুরু করে দেবে। আজ তার মনে একটা অদ্ভুত ধরনের অনুভূতি, সেটাকে আনন্দও বলা যেতে পারে, ছদ্মবেশি বিষাদও বলা যায়। কি যে ঠিক করে না যায় বোঝা, না যায় বোঝানো। আজ তার বিয়ের গায়ে-হলুদের দিন। এমন একটা দিন তার বারো বছরের ক্ষুদ্র জীবনে এইবার প্রথম এলো। সকালে উঠতেই জ্যেঠিমা বলেছে—ও পুঁটি, জলে ভিজে ভিজে কোথাও যেন যাস নি; আর তিনটে দিন কোনো রকমে ভালোয় ভালোয় কেটে গেলি বাঁচি।

আজ কি বার?—মঙ্গলবার! শনিবার বুঝি বিয়ের দিন। পুঁটির মনে সত্যিই কেমন হয়, আনন্দের একটা ঢেউ যেন গলা পর্যন্ত উঠে আটকে গেল। বিয়ে বেশি দূরে কোথাও নয়, এই গ্রামেই, এমন কি এই পাড়াতেই। এক ঘর ব্রাহ্মণ আজ বছরখানেক হলো অন্য জায়গা থেকে উঠে এসেছেন এখানে, দুখানা বড় বড় মেটে ঘর বেঁধেছেন—একখানা রান্নাঘর। এতদিন ধরে সে সঙ্গিনীদের সঙ্গে সেই বাড়িতে কুল পাড়তে গিয়েছে, সত্যনারায়ণের সিন্নি আনতে গিয়েছে, যখন পাড়ার প্রান্তের ঘন জঙ্গল কেটে সে ভদ্রলোক বাড়ি তৈরী করেন ঘাটে যাবার পথে একেবারে ডান ধারে, তখন সে কতবার ভেবেছে এই ঘন বনের মধ্যে বাড়ি করে বাস করবার কার না জানি মাথাব্যাথা পড়ল।

কে জানত, সেই বাড়িটাই—আজ এক বছর এখনও পোরেনি—তবে শ্বশুরবাড়ি হবে! ...... Read more

 

তুচ্ছ

আমি সকালে উঠে কাগজপত্র নিয়ে ঘাঁটছি, এমন সময়ে একটি তেরো-চৌদ্দ বছরের ছোট্ট মেয়ে রাঙা শাড়ি পরে আমাদের বাড়িতে ঢুকল। আমাদেরই গ্রামেরই মেয়ে নিশ্চয়, তবে একে কোথাও দেখিনি বলে চিনতে পারলাম না। মেয়েটির এই অল্প বয়সেই বিয়ে হয়েছে, ওর কপালে সিদুঁর, হাতে সোনা-বাঁধানো শাখা। শ্যামবর্ণ, একহারা চেহারার মেয়ে। মুখখানি বেশ ঢলঢল, বড় বড় চোখ। কানে সোনার দুল। জিজ্ঞেস করলুম—কার মেয়ে তুই রে?

মেয়েটি সামান্য একটু হেসে মাটির দিকে চোখ রেখে বললে—বিশ্বনাথ কামারের।

--বিশুর মেয়ে? বেশ বেশ। তোর দেখছি বিয়ে হয়েছে এই বয়েসে। কোথায় শ্বশুর বাড়ি?

মেয়েটির খুব লজ্জা হচ্ছিল শ্বশুরবাড়ির কথায়। সে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে বললে—নারানপুর। ..... Read more